সম্মুখ সমরে যারা তাদের নিরাপত্তা জোরদার করুন

সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ লক্ষাধিক মানুষ। মৃত্যুবরণ করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে রয়েছেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট তাদের সম্পাদকীয়তে বলছে, বর্তমান সময়ে প্রতিটি দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইতালিতে শতাধিক ডাক্তার মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় সব দেশেই মারা যাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। আর সে ঝুঁকির হার বাংলাদেশে অনেক। কেননা এদেশে এখনও বহু চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই। রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য প্রফেসর শহীদুল্লাহ শিকদার। তার থেকে সংক্রমিত হয়েছে তার কন্যা এবং স্ত্রী। গত শনিবার মুন্সীগঞ্জে স্বাস্থ্য বিভাগের দুজন কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ঢাকা মেডিকেলের পাঁচ নম্বর সার্জিক্যাল ইউনিটে এক রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকসহ ৪২ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হয়েছে। এর আগে ডেল্টা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের একজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি মিরপুরের টোলারবাগের এক করোনা (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। ওই হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স এবং তিনজন স্টাফকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। চট্টগ্রাম হাসপাতালের একজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে।

চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এ অসহায়ত্ব আক্ষরিক অর্থেই হতাশাজনক। প্রত্যেহ এমন নেতিবাচক খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। দেশে করোনা সংক্রমণের পরও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কিছু কিছু পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) দেয়া হয়েছে চিকিৎসকদের, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার কোন কোন হাসপাতালে ডাক্তারদের বরাদ্দকৃত পিপিই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরিবারের সদস্যের পরে থাকতে দেখা গেছে। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। প্রশাসনের লোকদেরও কোথাও কোথাও পিপিই পরে থাকতে দেখা গেছে।

এটা মনে রাখতে হবে যে, ডাক্তাররা শুধু করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করেন না। তারা সব রোগের চিকিৎসা করেন। ডাক্তারদের কেউ আক্রান্ত হলে দুই সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি সময়ের জন্য সে রোগী দেখতে পারবে না। এভাবে ডাক্তার আক্রান্ত হলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করবে কে? হৃদরোগ, কিডনির রোগ, সিজারিয়ান সেকশন, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, ক্যানসার এসবের চিকিৎসা কে করবে? ডেঙ্গুর চিকিৎসা কে করবে? কার্যত এর ফলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। অপরপক্ষে একজন ডাক্তার প্রতিদিন যত রোগীর সংস্পর্শে আসেন তাতে একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে তার মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই বেশি। পিপিই না থাকলে এক করোনা রোগীর জীবাণু ডাক্তার সাহেবের মাধ্যমে গোটা হাসপাতালে অন্য রোগীর শরীরে যাবে। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে হলেও চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং ঝুঁকিভাতা দেয়া উচিত। রোগী দেখার কাজে বরাদ্দকৃত পিপিই যারা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনরকম ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সৈনিক হচ্ছেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী। এরা বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।

রবিবার, ১২ এপ্রিল ২০২০ , ২৯ চৈত্র ১৪২৬, ১৭ শাবান ১৪৪১

ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা এখনো পর্যাপ্ত নয়

সম্মুখ সমরে যারা তাদের নিরাপত্তা জোরদার করুন

সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ লক্ষাধিক মানুষ। মৃত্যুবরণ করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে রয়েছেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট তাদের সম্পাদকীয়তে বলছে, বর্তমান সময়ে প্রতিটি দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইতালিতে শতাধিক ডাক্তার মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় সব দেশেই মারা যাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। আর সে ঝুঁকির হার বাংলাদেশে অনেক। কেননা এদেশে এখনও বহু চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই। রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য প্রফেসর শহীদুল্লাহ শিকদার। তার থেকে সংক্রমিত হয়েছে তার কন্যা এবং স্ত্রী। গত শনিবার মুন্সীগঞ্জে স্বাস্থ্য বিভাগের দুজন কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ঢাকা মেডিকেলের পাঁচ নম্বর সার্জিক্যাল ইউনিটে এক রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকসহ ৪২ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হয়েছে। এর আগে ডেল্টা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের একজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি মিরপুরের টোলারবাগের এক করোনা (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। ওই হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স এবং তিনজন স্টাফকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। চট্টগ্রাম হাসপাতালের একজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে।

চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এ অসহায়ত্ব আক্ষরিক অর্থেই হতাশাজনক। প্রত্যেহ এমন নেতিবাচক খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। দেশে করোনা সংক্রমণের পরও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কিছু কিছু পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) দেয়া হয়েছে চিকিৎসকদের, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার কোন কোন হাসপাতালে ডাক্তারদের বরাদ্দকৃত পিপিই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরিবারের সদস্যের পরে থাকতে দেখা গেছে। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। প্রশাসনের লোকদেরও কোথাও কোথাও পিপিই পরে থাকতে দেখা গেছে।

এটা মনে রাখতে হবে যে, ডাক্তাররা শুধু করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করেন না। তারা সব রোগের চিকিৎসা করেন। ডাক্তারদের কেউ আক্রান্ত হলে দুই সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি সময়ের জন্য সে রোগী দেখতে পারবে না। এভাবে ডাক্তার আক্রান্ত হলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করবে কে? হৃদরোগ, কিডনির রোগ, সিজারিয়ান সেকশন, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, ক্যানসার এসবের চিকিৎসা কে করবে? ডেঙ্গুর চিকিৎসা কে করবে? কার্যত এর ফলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। অপরপক্ষে একজন ডাক্তার প্রতিদিন যত রোগীর সংস্পর্শে আসেন তাতে একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে তার মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই বেশি। পিপিই না থাকলে এক করোনা রোগীর জীবাণু ডাক্তার সাহেবের মাধ্যমে গোটা হাসপাতালে অন্য রোগীর শরীরে যাবে। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে হলেও চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং ঝুঁকিভাতা দেয়া উচিত। রোগী দেখার কাজে বরাদ্দকৃত পিপিই যারা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনরকম ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সৈনিক হচ্ছেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী। এরা বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।