এবারের উৎসববিহীন ১ বৈশাখ

পঞ্চানন মল্লিক

মহামারী করোনার প্রভাবে শঙ্কিত আজ বিশ্ববাসী। শঙ্কিত আমাদের বাংলাদেশের মানুষও। তবু এর মধ্যে আসছে বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য বাংলা নবনর্ষ। তবে করোনার কারণে বাঙালির জীবনে এখন নেই কোন উৎসব। সঙ্গত কারণেই ১ বৈশাখে কোন উৎসব হচ্ছে না এবার। উৎসবের পরিবর্তে মানুষের মনে আজ বিরাজ করছে উৎকণ্ঠার করুণ আবহ। তবুও এর মধ্যে বছর পরিক্রমায় বরণ করতে হবে নতুন বঙ্গাব্দকে। তবে অন্যবারের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়। বরং বাঙালির জীবনে এবার আসছে অনেকটা নিরুত্তাপ ১ বৈশাখ। বাজবে না ঢোল, ঢুলির পায়ের ঘুঙুর, হাতের নাকাড়া, বাজবে না বাঁশি। বটতলায় বসবে না মেলা, বাজবে না তালপাতার সানাই, ঘুরবে না চরকা, উড়বে না রঙিন ঘুড়ি, হবে না মাটির সানকিতে লংকা-ইলিশ-পান্তা ভোজ।

মরণঘাতী ভাইরাসের কারণে আজ ম্র্রিয়মাণ বাঙালির সব উৎসব আমেজ, আনন্দঘন আয়োজন। ম্রিয়মাণ তাই বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য ১ বৈশাখের অনুষ্ঠানও। আসলে মানুষ যখন বিপদগ্রস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত তখন মানুষ মূলত চিন্তা করে প্রথমে কি করে সেই বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। তখন সংকটকালীন সময়। এ সময় কোন উৎসব বা আনন্দ অনুভূতি মানুষের মনের মধ্যে থাকে না। বিশেষ করে প্রতিদিন বিশ্বে যখন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, আমাদের দেশেও এই রোগ বিস্তার লাভ করছে তখন আমাদের ভেতর উৎসবের চিন্তা স্বভাবতই আসবে না। তবে এ কথা ঠিক যে সময় তার আপন গতিতে চলছে। আর সেই নিয়মে প্রকৃতির পালাবদলে চৈত্রের দিন শেষে বৈশাখ তার আপন গতিতে এসে হাজির হবে আমাদের মাঝে। শাখে শাখে ধরবে গুটি আম, কাঁঠালের মুছি, শিশু জাম-খেঁজুর-জামরুলসহ হাজারও ফল সবুজ পাতার অন্তরাল থেকে মুখ তুলবে, পবনদেব খুলে দেবে দখিনা মলয় ঝাঁপি, বইবে আপন গতিতে। কাকের বাসায় কোকিলের ডিম, খৈ-বাবলা-তেঁতুল ডালে শালিকের ছানা পিটপিট করবে। তাই উৎসব না করতে পারলেও মনের ভেতরে তো একটু হু হু করে উঠবে। মনে পড়বে অন্যান্য বারের কথা। মনটা বিষণœ হবে। কিন্তু বিপদ নাকের ডগায় নিয়ে কি আর করার আছে আমাদের। বেঁচে থাকলে সবই আবার হবে। এখন বাঁচার জন্য যেটা আগে করণীয় সেটা তো করতে হবে। হয়তোবা স্রষ্টার কৃপায় বিপদ খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাবে আমাদের।

আগামী বৈশাখে আমরা আবারও মেতে উঠতে পারব আগের মতো উৎসবে। আবার বাঙালি ললনারা সাজবে লালপাড় হলুদ কিম্বা সাদা শাড়িতে, খোঁপায় ফুল, হাতে মেহেদি আঁকা। পুরুষের পরনে থাকবে হলুদ কিম্বা লাল শাদা পাঞ্জাবি, শর্ট পাঞ্জাবি অথবা ফতুয়া। কারও কারও লুঙ্গি, গেঞ্জি ও গামছা। সবাই মিলে আবার চলব বাংলা বর্ষবরণে। কারণ বর্ষবরণের ঐহিত্য বাঙালির অতি প্রাচীন ও চিরায়ত এক ঐতিহ্য। মূলত বাংলায় মুঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন জমির মালিক বা প্রজাদের বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের ওপর ধার্যকৃত সব খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এর পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ জমিদার বা ভূমির মালিকেরা নিজ এলাকার অধিবাসিদের মিষ্টিমুখ করাতেন। তখন এ উপলক্ষে নানা উৎসবের আয়োজন করা হতো। এটি কালক্রমে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যা রূপ পরিবর্তন হয়ে আমাদের দেশে এতদিন এমনকি গত বছর পর্যন্ত প্রতিপালিত হয়েছে। গ্রামের স্কুল-কলেজ কিংবা খোলা মাঠে আয়োজন হয় বৈশাখী অনুষ্ঠানের। এখানে বিক্রি হয় নানা রকম পণ্যসামগ্রী, মিষ্টান্ন, খেলনা ইত্যাদি। নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলার। এরমধ্যে কাবাডি, নৌকাবাইচ, ঢালি খেলা, লাঠি খেলা, কুস্তি, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার মধ্যে বৃহত্তর যশোহর অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের লাঠি খেলা, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি দর্শকের চোখকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশে মাঙ্গলিক শোভাযাত্রা বের করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে আবার সেখানে গিয়ে শেষ হয় এ শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন, সব ধরনের শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষেরা। এমনি করে ১ বৈশাখ বাঙালির জীবনে ঐতিহ্যের ধারক বাহক হয়ে এতদিন প্রতিপালিত হয়ে এসেছে। নববর্ষের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক জড়িত। এদিন অতীতের সব ভুল ভ্রান্তি, গ্লানি, দুঃখ বেদনা ভুলে বাঙালির শুরু হয় নতুন করে পথচলা। চৈত্রের তাপদগ্ধ জীবনে একমুঠো শান্তির বারতা নিয়ে হাজির হয় বৈশাখ। অবশ্য এবার বৈশাখ আসছে বাঙালির জীবনের এক বিষাদময় শঙ্কিত সময়ে।

তিন মাস আগে চীন থেকে করোনাভাইরাসের যে বৈশ্যিক মহামারী শুরু হয়েছে আজ বাংলাদেশের কিছু মানুষও তাতে আক্রান্ত। দেশের অন্যান্য মানুষও আজ শঙ্কিত এ ব্যধি নিয়ে। তাই এটি কোন উৎসবের সময় নয়। এই সংকটময় মুহূর্তে আমরা আগত বৈশাখের কাছে শুধু একটুখানি শান্তিময় পরিবেশ কামনা করব। বৈশাখ তার উত্তাপ দিয়ে আমাদের সব রোগ-ব্যধি, জরা, বিষাদ, গ্লানিমোচন করে দিক এমনটি চাওয়া। চৈত্রের ঘর্মক্লান্ত জীবনে এতটুকু শান্তির পরশ পেতে বৈশাখের কাছে আমরা প্রশান্তির জল প্রত্যাশা করব। পাশাপাশি প্রত্যাশা করব বৈশাখ বাঙালির জীবনে এ সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের নতুন বার্তা ও আশীর্বাদ বয়ে আনবে। নতুন বছরে বাঙালি ফিরে পাবে সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবনযাপনের সুষ্ঠু, অনুকূল পরিবেশ এমনটি যেন হয়।

[লেখক : কলামিস্ট]

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল ২০২০ , ১ বৈশাখ ১৪২৭, ১৯ শাবান ১৪৪১

এবারের উৎসববিহীন ১ বৈশাখ

পঞ্চানন মল্লিক

মহামারী করোনার প্রভাবে শঙ্কিত আজ বিশ্ববাসী। শঙ্কিত আমাদের বাংলাদেশের মানুষও। তবু এর মধ্যে আসছে বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য বাংলা নবনর্ষ। তবে করোনার কারণে বাঙালির জীবনে এখন নেই কোন উৎসব। সঙ্গত কারণেই ১ বৈশাখে কোন উৎসব হচ্ছে না এবার। উৎসবের পরিবর্তে মানুষের মনে আজ বিরাজ করছে উৎকণ্ঠার করুণ আবহ। তবুও এর মধ্যে বছর পরিক্রমায় বরণ করতে হবে নতুন বঙ্গাব্দকে। তবে অন্যবারের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়। বরং বাঙালির জীবনে এবার আসছে অনেকটা নিরুত্তাপ ১ বৈশাখ। বাজবে না ঢোল, ঢুলির পায়ের ঘুঙুর, হাতের নাকাড়া, বাজবে না বাঁশি। বটতলায় বসবে না মেলা, বাজবে না তালপাতার সানাই, ঘুরবে না চরকা, উড়বে না রঙিন ঘুড়ি, হবে না মাটির সানকিতে লংকা-ইলিশ-পান্তা ভোজ।

মরণঘাতী ভাইরাসের কারণে আজ ম্র্রিয়মাণ বাঙালির সব উৎসব আমেজ, আনন্দঘন আয়োজন। ম্রিয়মাণ তাই বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য ১ বৈশাখের অনুষ্ঠানও। আসলে মানুষ যখন বিপদগ্রস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত তখন মানুষ মূলত চিন্তা করে প্রথমে কি করে সেই বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। তখন সংকটকালীন সময়। এ সময় কোন উৎসব বা আনন্দ অনুভূতি মানুষের মনের মধ্যে থাকে না। বিশেষ করে প্রতিদিন বিশ্বে যখন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, আমাদের দেশেও এই রোগ বিস্তার লাভ করছে তখন আমাদের ভেতর উৎসবের চিন্তা স্বভাবতই আসবে না। তবে এ কথা ঠিক যে সময় তার আপন গতিতে চলছে। আর সেই নিয়মে প্রকৃতির পালাবদলে চৈত্রের দিন শেষে বৈশাখ তার আপন গতিতে এসে হাজির হবে আমাদের মাঝে। শাখে শাখে ধরবে গুটি আম, কাঁঠালের মুছি, শিশু জাম-খেঁজুর-জামরুলসহ হাজারও ফল সবুজ পাতার অন্তরাল থেকে মুখ তুলবে, পবনদেব খুলে দেবে দখিনা মলয় ঝাঁপি, বইবে আপন গতিতে। কাকের বাসায় কোকিলের ডিম, খৈ-বাবলা-তেঁতুল ডালে শালিকের ছানা পিটপিট করবে। তাই উৎসব না করতে পারলেও মনের ভেতরে তো একটু হু হু করে উঠবে। মনে পড়বে অন্যান্য বারের কথা। মনটা বিষণœ হবে। কিন্তু বিপদ নাকের ডগায় নিয়ে কি আর করার আছে আমাদের। বেঁচে থাকলে সবই আবার হবে। এখন বাঁচার জন্য যেটা আগে করণীয় সেটা তো করতে হবে। হয়তোবা স্রষ্টার কৃপায় বিপদ খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাবে আমাদের।

আগামী বৈশাখে আমরা আবারও মেতে উঠতে পারব আগের মতো উৎসবে। আবার বাঙালি ললনারা সাজবে লালপাড় হলুদ কিম্বা সাদা শাড়িতে, খোঁপায় ফুল, হাতে মেহেদি আঁকা। পুরুষের পরনে থাকবে হলুদ কিম্বা লাল শাদা পাঞ্জাবি, শর্ট পাঞ্জাবি অথবা ফতুয়া। কারও কারও লুঙ্গি, গেঞ্জি ও গামছা। সবাই মিলে আবার চলব বাংলা বর্ষবরণে। কারণ বর্ষবরণের ঐহিত্য বাঙালির অতি প্রাচীন ও চিরায়ত এক ঐতিহ্য। মূলত বাংলায় মুঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন জমির মালিক বা প্রজাদের বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের ওপর ধার্যকৃত সব খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এর পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ জমিদার বা ভূমির মালিকেরা নিজ এলাকার অধিবাসিদের মিষ্টিমুখ করাতেন। তখন এ উপলক্ষে নানা উৎসবের আয়োজন করা হতো। এটি কালক্রমে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যা রূপ পরিবর্তন হয়ে আমাদের দেশে এতদিন এমনকি গত বছর পর্যন্ত প্রতিপালিত হয়েছে। গ্রামের স্কুল-কলেজ কিংবা খোলা মাঠে আয়োজন হয় বৈশাখী অনুষ্ঠানের। এখানে বিক্রি হয় নানা রকম পণ্যসামগ্রী, মিষ্টান্ন, খেলনা ইত্যাদি। নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলার। এরমধ্যে কাবাডি, নৌকাবাইচ, ঢালি খেলা, লাঠি খেলা, কুস্তি, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার মধ্যে বৃহত্তর যশোহর অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের লাঠি খেলা, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি দর্শকের চোখকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশে মাঙ্গলিক শোভাযাত্রা বের করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে আবার সেখানে গিয়ে শেষ হয় এ শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন, সব ধরনের শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষেরা। এমনি করে ১ বৈশাখ বাঙালির জীবনে ঐতিহ্যের ধারক বাহক হয়ে এতদিন প্রতিপালিত হয়ে এসেছে। নববর্ষের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক জড়িত। এদিন অতীতের সব ভুল ভ্রান্তি, গ্লানি, দুঃখ বেদনা ভুলে বাঙালির শুরু হয় নতুন করে পথচলা। চৈত্রের তাপদগ্ধ জীবনে একমুঠো শান্তির বারতা নিয়ে হাজির হয় বৈশাখ। অবশ্য এবার বৈশাখ আসছে বাঙালির জীবনের এক বিষাদময় শঙ্কিত সময়ে।

তিন মাস আগে চীন থেকে করোনাভাইরাসের যে বৈশ্যিক মহামারী শুরু হয়েছে আজ বাংলাদেশের কিছু মানুষও তাতে আক্রান্ত। দেশের অন্যান্য মানুষও আজ শঙ্কিত এ ব্যধি নিয়ে। তাই এটি কোন উৎসবের সময় নয়। এই সংকটময় মুহূর্তে আমরা আগত বৈশাখের কাছে শুধু একটুখানি শান্তিময় পরিবেশ কামনা করব। বৈশাখ তার উত্তাপ দিয়ে আমাদের সব রোগ-ব্যধি, জরা, বিষাদ, গ্লানিমোচন করে দিক এমনটি চাওয়া। চৈত্রের ঘর্মক্লান্ত জীবনে এতটুকু শান্তির পরশ পেতে বৈশাখের কাছে আমরা প্রশান্তির জল প্রত্যাশা করব। পাশাপাশি প্রত্যাশা করব বৈশাখ বাঙালির জীবনে এ সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের নতুন বার্তা ও আশীর্বাদ বয়ে আনবে। নতুন বছরে বাঙালি ফিরে পাবে সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবনযাপনের সুষ্ঠু, অনুকূল পরিবেশ এমনটি যেন হয়।

[লেখক : কলামিস্ট]