ত্রাণ কার্যক্রম বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় করণীয়

করোনার প্রভাবে জনজীবনের করুণ অবস্থা। এই কঠিন মহামারী থেকে বাঁচতে ‘ঘরে’ থাকাই এখন পর্যন্ত বড় প্রতিষেধক। ঘরে থাকতে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে যাচ্ছে দ্রুত। বাংলাদেশের অর্থনীতিও ভীষণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে হুমকির মুখে। বিশ্বব্যাংকের ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অনুসারে বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৪১ লাখ। যাদের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, তারা হতদরিদ্র। এটা আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে একই প্রতিবেদন অনুযায়ী নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বিবেচনায় এই সংখ্যা ৮ কোটি ৬২ লাখ। আর অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এতে দারিদ্র্যের হার ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ।

নিম্নআয়ের এই জনগোষ্ঠী মূলত দিনমজুর, কারখানার শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিক্সাচালক, চা বিক্রেতা, হকার। এরা দিন আনে দিন খায়। একদিন কাজ না থাকলে পরদিন ওদের চুলোয় আগুন জ্বলে না। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে তাই ঘরে রাখা কঠিন, কখনো কখনো অসম্ভবও। কঠিন বাস্তবতা জেনে সরকার তাদের ঘরে রাখার জন্য বিভিন্ন অনুদান, খাদ্য সামগ্রী ও ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা খুব প্রশংসনীয়। তবে এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। শতকরা ২০ ভাগ মানুষ সহযোগিতা পেলেও বাকি ৮০ ভাগই বঞ্চিত। ক্ষুধার তাড়নায় ক্রমেই মানুষের ভেতর হাহাকার বেড়েছে। তারা সামাজিক দূরত্ব মানছে না। নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। ত্রাণ দেখলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। চাহিদার তুলানয় অপর্যাপ্ত হওয়ায় ত্রাণের গাড়ি থেকে মানুষ ত্রাণ কেড়েও নিচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র পরিসরে চলা ত্রাণ বিতরণে প্রচুর বিশৃঙ্খলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় ব্যাহত হচ্ছে।

দিন যতই গড়াচ্ছে ক্ষুধাপীড়িত মানুষ করোনাকে ততই অগ্রাহ্য করছে। ভয় করছে না। তাদের কাছে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার চেয়ে করোনাভীতি বড় না। সন্তানদের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে না পারা কত কষ্টের সেটা সবার কাছেই বোধগম্য। তাই পেটের ক্ষুধা নিরাবরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে থাকবে না; ছুটতে থাকবে। রাস্তায় বেরিয়ে আসবে। এভাবে তারা সংক্রমিত হবে। অন্যদিকে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ সচেতন না। ফলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ বাড়ছে। সামাজিক সংক্রমণ বাড়ায় করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। তাই এদের ঘরে না রাখতে পারলে করোনা প্রতিরোধে সরকারের উদ্যোগ সফল হবে না। এক্ষেত্রে ওদের ঘরে রাখতে শুধু পুলিশ প্রশাসনের কঠোরতা আর মারমুখি অবস্থান নয় ; খাবারও দরকার। ঘরে খাবার থাকলে মানুষ বাইরে বের হবো না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই মানুষকে ঘরে রাখতে সরকারকে ত্রাণ কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সক্ষমতা না থাকলে দেশি-বিদেশি সংস্থা থেকে ঋণ নিতে হবে। বিরাট অঙ্কের তহবিল গঠন করতে হবে।

কেন্দ্রীয় তহবিল গঠনের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালাতে সরকারকে আরো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। অসহায় সবাই যেন ত্রাণ পায় এটা নিশ্চিত করা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকলে এই চ্যালেঞ্জ নিশ্চিত করা যাবে না। ইতোমধ্যে দেশবাসী লক্ষ্য করেছে ত্রাণ বিতরণে বেশ বিশৃঙ্খলা ঘটছে। এর ফলে অনেকে ত্রাণ না দিয়েও ফিরে গিয়েছে। ত্রাণ দাতাদের নির্দেশনা শুনছে না গৃহীতরা। ত্রাণ দেখলেই তারা একত্রে জড়ো হচ্ছে। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। আবার সবাই পাচ্ছেও না ত্রাণ। কেউ কেউ একাধিকবার পাচ্ছে। কেউ মোটেও পাচ্ছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণে অসদুপায় ও স্বজনপ্রীতির কথাও উঠেছে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা হলে অনেকটাই শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যাবে। কারণ আপামর জনতা তুলনামূলকভাবে সেনাবাহিনীকে ভয় পায় এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রতি সবারই আস্থা আছে।

ত্রাণ বাজারে, পথে, রাস্তায় বিতরন নয়, বাসায় বাসায় গিয়ে বিতরণ করতে হবে। এতে করে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসের সঙ্গে সবাই ত্রাণ পাবে। বাসায় দেয়ার আরেকটা বিশেষ ভালো দিক রয়েছে। সমাজে কিছু ব্যক্তিত্বসচেতন নিম্নআয়ের মানুষ আছে যারা না খেয়ে থাকলেও কারো দ্বারে দ্বারে যায় না, কারো হাত পা ধরে না। তারা ত্রাণের জন্য রাস্তায় দাঁড়ায় না। বাসায় ত্রাণ দিলে এই মানুষগুলোও পাবে। ইসলামেও এ ধরনের লোকদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। বাসায় গেলে এটাও বোঝা যাবে কে কে ত্রাণ প্রাপ্য। শহরের গলিতে গলিতে, প্রতিটি বস্তিতে গিয়ে কাজটি করা যায়। আর গ্রামে এক একটা পাড়ায় গিয়ে এটা করা যায়।

বিদ্যমান ত্রাণ বিতরনে আরেকটি কাজ করা যায়। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় ‘ত্রাণ বুথ’ বা ‘ত্রাণ ভাণ্ডার’ খুলে বিত্তবানদের কাছ থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করা যায়। যারাই ত্রাণ দিতে চায় তারা এখানে জমা দিবে। একভাণ্ডার থেকেই পরে বাসায় বাসায় গিয়ে বিতরণ করা হবে। বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে এটা একটা কার্যকরী পদক্ষেপ। ত্রাণ সংগ্রহের এই কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে খাটানো যায়।

অনিল মো. মোমিন

আরও খবর

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২০ , ৩ বৈশাখ ১৪২৭, ২১ শাবান ১৪৪১

ত্রাণ কার্যক্রম বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় করণীয়

করোনার প্রভাবে জনজীবনের করুণ অবস্থা। এই কঠিন মহামারী থেকে বাঁচতে ‘ঘরে’ থাকাই এখন পর্যন্ত বড় প্রতিষেধক। ঘরে থাকতে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে যাচ্ছে দ্রুত। বাংলাদেশের অর্থনীতিও ভীষণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে হুমকির মুখে। বিশ্বব্যাংকের ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অনুসারে বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৪১ লাখ। যাদের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, তারা হতদরিদ্র। এটা আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে একই প্রতিবেদন অনুযায়ী নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বিবেচনায় এই সংখ্যা ৮ কোটি ৬২ লাখ। আর অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এতে দারিদ্র্যের হার ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ।

নিম্নআয়ের এই জনগোষ্ঠী মূলত দিনমজুর, কারখানার শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিক্সাচালক, চা বিক্রেতা, হকার। এরা দিন আনে দিন খায়। একদিন কাজ না থাকলে পরদিন ওদের চুলোয় আগুন জ্বলে না। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে তাই ঘরে রাখা কঠিন, কখনো কখনো অসম্ভবও। কঠিন বাস্তবতা জেনে সরকার তাদের ঘরে রাখার জন্য বিভিন্ন অনুদান, খাদ্য সামগ্রী ও ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা খুব প্রশংসনীয়। তবে এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। শতকরা ২০ ভাগ মানুষ সহযোগিতা পেলেও বাকি ৮০ ভাগই বঞ্চিত। ক্ষুধার তাড়নায় ক্রমেই মানুষের ভেতর হাহাকার বেড়েছে। তারা সামাজিক দূরত্ব মানছে না। নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। ত্রাণ দেখলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। চাহিদার তুলানয় অপর্যাপ্ত হওয়ায় ত্রাণের গাড়ি থেকে মানুষ ত্রাণ কেড়েও নিচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র পরিসরে চলা ত্রাণ বিতরণে প্রচুর বিশৃঙ্খলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় ব্যাহত হচ্ছে।

দিন যতই গড়াচ্ছে ক্ষুধাপীড়িত মানুষ করোনাকে ততই অগ্রাহ্য করছে। ভয় করছে না। তাদের কাছে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার চেয়ে করোনাভীতি বড় না। সন্তানদের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে না পারা কত কষ্টের সেটা সবার কাছেই বোধগম্য। তাই পেটের ক্ষুধা নিরাবরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে থাকবে না; ছুটতে থাকবে। রাস্তায় বেরিয়ে আসবে। এভাবে তারা সংক্রমিত হবে। অন্যদিকে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ সচেতন না। ফলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ বাড়ছে। সামাজিক সংক্রমণ বাড়ায় করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। তাই এদের ঘরে না রাখতে পারলে করোনা প্রতিরোধে সরকারের উদ্যোগ সফল হবে না। এক্ষেত্রে ওদের ঘরে রাখতে শুধু পুলিশ প্রশাসনের কঠোরতা আর মারমুখি অবস্থান নয় ; খাবারও দরকার। ঘরে খাবার থাকলে মানুষ বাইরে বের হবো না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই মানুষকে ঘরে রাখতে সরকারকে ত্রাণ কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সক্ষমতা না থাকলে দেশি-বিদেশি সংস্থা থেকে ঋণ নিতে হবে। বিরাট অঙ্কের তহবিল গঠন করতে হবে।

কেন্দ্রীয় তহবিল গঠনের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালাতে সরকারকে আরো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। অসহায় সবাই যেন ত্রাণ পায় এটা নিশ্চিত করা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকলে এই চ্যালেঞ্জ নিশ্চিত করা যাবে না। ইতোমধ্যে দেশবাসী লক্ষ্য করেছে ত্রাণ বিতরণে বেশ বিশৃঙ্খলা ঘটছে। এর ফলে অনেকে ত্রাণ না দিয়েও ফিরে গিয়েছে। ত্রাণ দাতাদের নির্দেশনা শুনছে না গৃহীতরা। ত্রাণ দেখলেই তারা একত্রে জড়ো হচ্ছে। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। আবার সবাই পাচ্ছেও না ত্রাণ। কেউ কেউ একাধিকবার পাচ্ছে। কেউ মোটেও পাচ্ছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণে অসদুপায় ও স্বজনপ্রীতির কথাও উঠেছে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা হলে অনেকটাই শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যাবে। কারণ আপামর জনতা তুলনামূলকভাবে সেনাবাহিনীকে ভয় পায় এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রতি সবারই আস্থা আছে।

ত্রাণ বাজারে, পথে, রাস্তায় বিতরন নয়, বাসায় বাসায় গিয়ে বিতরণ করতে হবে। এতে করে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসের সঙ্গে সবাই ত্রাণ পাবে। বাসায় দেয়ার আরেকটা বিশেষ ভালো দিক রয়েছে। সমাজে কিছু ব্যক্তিত্বসচেতন নিম্নআয়ের মানুষ আছে যারা না খেয়ে থাকলেও কারো দ্বারে দ্বারে যায় না, কারো হাত পা ধরে না। তারা ত্রাণের জন্য রাস্তায় দাঁড়ায় না। বাসায় ত্রাণ দিলে এই মানুষগুলোও পাবে। ইসলামেও এ ধরনের লোকদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। বাসায় গেলে এটাও বোঝা যাবে কে কে ত্রাণ প্রাপ্য। শহরের গলিতে গলিতে, প্রতিটি বস্তিতে গিয়ে কাজটি করা যায়। আর গ্রামে এক একটা পাড়ায় গিয়ে এটা করা যায়।

বিদ্যমান ত্রাণ বিতরনে আরেকটি কাজ করা যায়। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় ‘ত্রাণ বুথ’ বা ‘ত্রাণ ভাণ্ডার’ খুলে বিত্তবানদের কাছ থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করা যায়। যারাই ত্রাণ দিতে চায় তারা এখানে জমা দিবে। একভাণ্ডার থেকেই পরে বাসায় বাসায় গিয়ে বিতরণ করা হবে। বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে এটা একটা কার্যকরী পদক্ষেপ। ত্রাণ সংগ্রহের এই কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে খাটানো যায়।

অনিল মো. মোমিন