করোনামৃত ও আত্মোপলব্ধির ভবিষ্যৎবাদিতা সঞ্জয় দে রিপন ঘরমুখো ব্যস্ত মানুষ এখন ঘরেই, তবুও ঘরগুলো যেন হয়ে উঠেছে ভয়জ

সঞ্জয় দে রিপন

ঘরমুখো ব্যস্ত মানুষ এখন ঘরেই, তবুও ঘরগুলো যেন হয়ে উঠেছে ভয়জাত বাক্সের মতো। সবাই যেন বাক্সবন্দী প্যাকেট হয়ে আরও বেশি আস্থাহীন হয়ে উঠেছে। একবিন্দু স্বপ্নও আর ভাবের দুনিয়াতে উঁকি দিচ্ছে না। চিন্তার রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত সব ভাবনাই আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। সবকিছ্ইু ক্ষণকালীন; ভাবনার বিষয়ীরূপ খুব দ্রুতই যেন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্ক বা ভয় যাপিত সময়কে যেন বন্দী করে ফেলেছে, সবকিছুই যেন থেমে গেছে। মানবজাতি এখন স্থির এবং আরও বেশি গতিহীন, পরিবারের একক ব্যক্তি, ব্যক্তি থেকে সমাজ; সমাজ থেকে রাষ্ট্র তথা বিশ্ব আজ ভয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে কিন্তু পৃথিবীজুড়ে অবসাদভাব কিন্তু কাটছে না। হয়তো স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাচ্ছে মানুষ, সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে অনেককেই অমানবিক করে তুলছে এ ভয়; সৃষ্টির প্রণোদনার চাইতে বেঁচে থাকার সাবধানতা অবলম্বন করাই এখন বড় সত্য। কঠিন এবং নিষ্ঠুর সময় কাঠামোর উত্তরণ ঘটানো হয়তো কঠিন এবং হৃদয় বিদারক হবে কিন্তু তারপরও জীবন প্রতিষ্ঠারকাল নির্মাণের সংগ্রামে থেমে থাকলে চলবে না। আশাবাদী জীবনের পাঠচর্চায় সবাইকে ভবিষ্যৎবাদী হয়ে উঠতে হবে। আমরা মনে করতেই পারি মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে একদিন পৃথিবী তার কক্ষপথে এমন স্থান অতিক্রম করবে যার পরে পরিবর্তিত বায়ুম-লে আর ঘোরাফেরা করতে পারবে না মরণকণা। আবার পৃথিবীতে মানুষ বিচরণ করবে নির্ভয়ে। হঠাৎ করেই মানবসভ্যতায় কড়া নাড়ল কোভিড-১৯। সবকিছুই নিশ্চল হয়ে পড়ল। অসহায় মানুষের পাশে সহায় শুধু একক জীবন বেছে নেয়া। তবুও সংকটকাল পরিবর্তনের প্রচেষ্টা থাকুক নিরন্তর।

সবকিছুই পরিবর্তনশীল, আর তাইতো আলবার্ট আইনস্টাইন দাবি তুলেছিলেন যে পরমস্থান, পরমকাল এবং পরমভর বলতে কিছুই নেই (যদিও চিরায়ত বলবিদ্যায় স্থান, কাল এবং ভরকে পরম বলে ধরা হয়)। সাধারণত আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আইনস্টাইন ১৯০৭-১৯১৫ সালে বিকশিত করে তবে আপেক্ষিকতা এ তত্ত্ব শব্দটি (Theory of relativity) সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লেংঙ্ক (১৯০৬)।

আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে- মহাবিশ্ব সম্প্রসারণ করছে, এবং তার দূরবর্তী অংশ আলোর গতির চেয়ে দ্রুততর গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের সবকিছু আপেক্ষিক অথবা পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীর অন্তর্কাঠামোর পরিবর্তন যেহেতু ঘটমান সেহেতু মানুষের ভাষা, দৃষ্টি, চিন্তার ধরন এবং পদ্ধতি, অনুভূতি, সংকট এবং জয়লাভের পদ্ধতি ইত্যাদি সবকিছুই পরিবর্তিত যা অবশ্যই অনুমেয় নয়। অর্থাৎ জীবন প্রক্রিয়ার বৈশ্বিক পরিবর্তন প্রকৃতিগত সত্য যা বর্তমানে বিজ্ঞানের অনুঘটক এবং ভবিষ্যতে হবে প্রমাণিত অনুষঙ্গ। তাইতো মানবজাতিকে যে কোন সংকটকালে আরও উজ্জীবিত হতে হবে সত্যের পথে, মানবতার পথে। ভয়কে শিক্ষার অনুসর্গ করে নির্ভয়ে গতিশীল জীবনের পথে মানবমুক্তির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। আগামী পৃথিবী নির্মাণে যোগ্যতম হয়ে উঠতে হবে নতুন ভোরের আশায়।

অনিবার্য মৃত্যুলগ্নে মানুষের বেঁচে থাকা; তারপরও দৈব মৃত্যুবরণ করার স্পর্ধা যতটা রয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যুভয় ততটা নির্ভয়ে মানুষ বরণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে চিন্তার মুক্তি এবং স্পর্ধাই মানুষকে লড়াই করার সাহস দেবে, সহায় হবে মানবপ্রেম। যুক্তির একরৈখিক পথ অতিক্রম করে আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মানবজাতি হয়ে উঠবে উপলব্ধির সৈনিক। ভয়জাত প্যাকেটে বসবাস না করে চিন্তার দরজাগুলো খুলে দেবে; আবার যাত্রা করবে স্বপ্নের পথে, পাড়ি দিবে স্বপ্নের সমুদ্র।

পৃথিবীর বুকে সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে সৌন্দর্যের গতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যা বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বুঝেছিলেন ফিলিপো টমাসো মেরিনেট (Filippo Tommaso Marinetti)। তাইতো তিনি ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ফিউচারিজমের মেনিফেস্টো ঘোষণা করেছিলেন এবং বলেছিলেন গতিই সৌন্দর্য। গতিহীন কোন কিছুই সুন্দর নয়। স্থির অথবা থমকে যাওয়া কর্ম কখনই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তিনি আরও বলেছিলেন- আমরা আজ ফিউচারিজমের প্রতিষ্ঠা করছি, কারণ আমরা অনিবার্য ধ্বংস থেকে ইতালিকে উদ্ধার করতে চাই। আমরা বলতে চাই আনন্দ এবং বিদ্রোহে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আজ একশ’ এগারো বছর পর সংকটকাল থেকে উত্তরণের জন্য ভবিষ্যৎবাদিতার সাহস, দুঃসাহসিকতা, স্পর্ধা এবং বিদ্রোহী চিন্তার বড় বেশি প্রয়োজন।

সৌন্দর্য সৃষ্টি অথবা জয়লাভের জন্য সাহসিকতা, স্পর্ধা দেখানোর বিকল্প কিছু নেই; যে কোন সংকটে অথবা মহৎ সৃষ্টি বা মানব কল্যাণের জন্য দুঃসাহসিক হয়ে উঠতে হয়। তাইতো ইতিহাসের পাতায় শ্রেণী বৈষম্য দূর করে প্রাচীন গ্রিকের এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলেন সমাজ সংস্কারক সলোন। মানুষের সেবায় অন্তর আত্মার সততায় দুঃসাহসী হয়েছিলেন মাদার তেরেসা যিনি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসিনি হওয়ার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। এই সময়ই therese de Lisieux এর নাম অনুযায়ী তার নাম টেরিজা রাখা হয় এবং এ নামকরণের পূর্বে তার নাম ছিল অ্যাগনেস গঞ্জা বয়াজু। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মাদার তেরেসা সুবিধাবঞ্চিত মুমূর্ষু রোগীদের জন্য পরিত্যক্ত প্রাচীন মন্দিরে সেবাকেন্দ্র চালু করেন, পরে এ কেন্দ্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘নির্মল হৃদয়’। এখানে হিন্দুদের জন্য গঙ্গার জলে স্নান করার ব্যবস্থা, মুসলিমদের জন্য কোরআন ও নামাজ পড়ার ব্যবস্থা; খ্রিস্টানদের জন্য লাস্ট রাইটের ব্যবস্থা অর্থাৎ যেখানে সব ধর্মের মানুষের জন্য ধর্মপালনের ব্যবস্থা ছিল। মাদার তেরেসা মানবতার জন্য স্পর্ধা দেখিয়েছেন; যখন ক্ষ্ঠুরোগীদের কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করত না, তখন মাদার তেরেসা হয়ে উঠেছিলেন অনেক বেশি দুঃসাহসিক। তিনি কুষ্ঠরোগেীদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মানবতা। তিনি মানবজীবনের সর্বশেষ নিয়তি মৃত্যুর সৌন্দর্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাইতো মাদার তেরেসা বলেছিলেন A beautiful death is for people who lived like animals to die like angels loved and wanted সুতরাং ভয়ের নয়, ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে নির্মাণ করতে হবে স্পর্ধার।

ভবিষ্যৎবাদী হয়ে উঠতে হবে সবাইকে। প্রশংসনীয় স্থবিরতা কাটিয়ে, জ্বরে জাগিয়ে তুলতে চাই নিদ্রাহীনতা এবং চিন্তাশক্তির মুষ্টি দিয়ে প্রতিহত করতে চাই সভ্যতা বিনষ্টের সব উপকরণ। আমরা মনে করতে চাই পৃথিবী তার আদর্শ অক্ষটি বরাবর অবস্থান করবে। অসম্ভবের মুহূর্তগুলোকে পেছনে ফেলে চিরন্তন ও সর্বব্যাপী গতির সঞ্চারণ ঘটবে।

নরসিংদীর আলোকবালী ইউনিয়নের পূর্বপাড়ায় করোনা উপসর্গ নিয়ে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সুলতানা বেগমের (৩৫) মৃত্যু হলে স্বামীর বাড়ি কাজিরকান্দিতে লাশ দাফন করতে দেননি গ্রামবাসী। মেঘনা নদীতে নৌকায় ভাসছে তার লাশ। মেয়ের লাশ পাহারা দিচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা ফরিদ মিয়া। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার ইউনিয়নের কলারগাঁও গ্রামের সুশান্ত কর্মকারের (৩৪) মৃত্যুর পর স্বজন ও গ্রামবাসী কেউ লাশ দেখতে আসেননি এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার জন্যও এগিয়ে আসেননি কেউ।

ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ প্রগ্রাম পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে- সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে নির্দেশনা মানতে গিয়ে নিম্নআয়ের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এবং দারিদ্র্যের হার বেড়ে গিয়েছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ (দুই কোটি ৩৮ লাখ) মানুষের ঘরে কোন খাবারই নেই। অনাহারে থাকতে না পেরে সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এমন সংকটকালে আমাদের ভবিষ্যৎবাদী হয়ে উঠতে হবে। রাষ্ট্র যেন প্রয়োজন অনুযায়ী অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে যায় আর রাষ্ট্র পৌঁছাতে না পারলেও আমরা যেন পৌঁছে যেতে পারি অসহায় মানুষের কল্যাণে, এ হোক আমাদের প্রত্যয়।

সবশেষে আহমদ ছফার একটি কথা স্মরণ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন- ‘আমার কাছে ঈশ্বর-চিন্তা আর মানুষের অমরতার চিন্তা সমার্থক। কেউ যদি আমাকে আস্তিক বলেন বিনা বাক্যে মেনে নেব। আমি আস্তিক। যদি কেউ বলেন নাস্তিক আপত্তি করব না। আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি কোন বিবাদেও হেতু দেখতে পাইনে। আমার অভীষ্ট বিষয় মানুষ, শুধু মানুষ। মানুষই সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মূল্যচিন্তা, সমস্ত বিজ্ঞানবুদ্ধির উৎস।’ তাইতো মরণকতা’র ভয়কে নির্ভয়ে স্পর্ধার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, সভ্যতার জয় করতে হবে সুুনিশ্চিত।

[ লেখক : খ-কালীন প্রভাষক, শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ]

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২০ , ৩ বৈশাখ ১৪২৭, ২১ শাবান ১৪৪১

করোনামৃত ও আত্মোপলব্ধির ভবিষ্যৎবাদিতা সঞ্জয় দে রিপন ঘরমুখো ব্যস্ত মানুষ এখন ঘরেই, তবুও ঘরগুলো যেন হয়ে উঠেছে ভয়জ

সঞ্জয় দে রিপন

ঘরমুখো ব্যস্ত মানুষ এখন ঘরেই, তবুও ঘরগুলো যেন হয়ে উঠেছে ভয়জাত বাক্সের মতো। সবাই যেন বাক্সবন্দী প্যাকেট হয়ে আরও বেশি আস্থাহীন হয়ে উঠেছে। একবিন্দু স্বপ্নও আর ভাবের দুনিয়াতে উঁকি দিচ্ছে না। চিন্তার রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত সব ভাবনাই আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। সবকিছ্ইু ক্ষণকালীন; ভাবনার বিষয়ীরূপ খুব দ্রুতই যেন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্ক বা ভয় যাপিত সময়কে যেন বন্দী করে ফেলেছে, সবকিছুই যেন থেমে গেছে। মানবজাতি এখন স্থির এবং আরও বেশি গতিহীন, পরিবারের একক ব্যক্তি, ব্যক্তি থেকে সমাজ; সমাজ থেকে রাষ্ট্র তথা বিশ্ব আজ ভয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে কিন্তু পৃথিবীজুড়ে অবসাদভাব কিন্তু কাটছে না। হয়তো স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাচ্ছে মানুষ, সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে অনেককেই অমানবিক করে তুলছে এ ভয়; সৃষ্টির প্রণোদনার চাইতে বেঁচে থাকার সাবধানতা অবলম্বন করাই এখন বড় সত্য। কঠিন এবং নিষ্ঠুর সময় কাঠামোর উত্তরণ ঘটানো হয়তো কঠিন এবং হৃদয় বিদারক হবে কিন্তু তারপরও জীবন প্রতিষ্ঠারকাল নির্মাণের সংগ্রামে থেমে থাকলে চলবে না। আশাবাদী জীবনের পাঠচর্চায় সবাইকে ভবিষ্যৎবাদী হয়ে উঠতে হবে। আমরা মনে করতেই পারি মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে একদিন পৃথিবী তার কক্ষপথে এমন স্থান অতিক্রম করবে যার পরে পরিবর্তিত বায়ুম-লে আর ঘোরাফেরা করতে পারবে না মরণকণা। আবার পৃথিবীতে মানুষ বিচরণ করবে নির্ভয়ে। হঠাৎ করেই মানবসভ্যতায় কড়া নাড়ল কোভিড-১৯। সবকিছুই নিশ্চল হয়ে পড়ল। অসহায় মানুষের পাশে সহায় শুধু একক জীবন বেছে নেয়া। তবুও সংকটকাল পরিবর্তনের প্রচেষ্টা থাকুক নিরন্তর।

সবকিছুই পরিবর্তনশীল, আর তাইতো আলবার্ট আইনস্টাইন দাবি তুলেছিলেন যে পরমস্থান, পরমকাল এবং পরমভর বলতে কিছুই নেই (যদিও চিরায়ত বলবিদ্যায় স্থান, কাল এবং ভরকে পরম বলে ধরা হয়)। সাধারণত আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আইনস্টাইন ১৯০৭-১৯১৫ সালে বিকশিত করে তবে আপেক্ষিকতা এ তত্ত্ব শব্দটি (Theory of relativity) সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লেংঙ্ক (১৯০৬)।

আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে- মহাবিশ্ব সম্প্রসারণ করছে, এবং তার দূরবর্তী অংশ আলোর গতির চেয়ে দ্রুততর গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের সবকিছু আপেক্ষিক অথবা পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীর অন্তর্কাঠামোর পরিবর্তন যেহেতু ঘটমান সেহেতু মানুষের ভাষা, দৃষ্টি, চিন্তার ধরন এবং পদ্ধতি, অনুভূতি, সংকট এবং জয়লাভের পদ্ধতি ইত্যাদি সবকিছুই পরিবর্তিত যা অবশ্যই অনুমেয় নয়। অর্থাৎ জীবন প্রক্রিয়ার বৈশ্বিক পরিবর্তন প্রকৃতিগত সত্য যা বর্তমানে বিজ্ঞানের অনুঘটক এবং ভবিষ্যতে হবে প্রমাণিত অনুষঙ্গ। তাইতো মানবজাতিকে যে কোন সংকটকালে আরও উজ্জীবিত হতে হবে সত্যের পথে, মানবতার পথে। ভয়কে শিক্ষার অনুসর্গ করে নির্ভয়ে গতিশীল জীবনের পথে মানবমুক্তির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। আগামী পৃথিবী নির্মাণে যোগ্যতম হয়ে উঠতে হবে নতুন ভোরের আশায়।

অনিবার্য মৃত্যুলগ্নে মানুষের বেঁচে থাকা; তারপরও দৈব মৃত্যুবরণ করার স্পর্ধা যতটা রয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যুভয় ততটা নির্ভয়ে মানুষ বরণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে চিন্তার মুক্তি এবং স্পর্ধাই মানুষকে লড়াই করার সাহস দেবে, সহায় হবে মানবপ্রেম। যুক্তির একরৈখিক পথ অতিক্রম করে আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মানবজাতি হয়ে উঠবে উপলব্ধির সৈনিক। ভয়জাত প্যাকেটে বসবাস না করে চিন্তার দরজাগুলো খুলে দেবে; আবার যাত্রা করবে স্বপ্নের পথে, পাড়ি দিবে স্বপ্নের সমুদ্র।

পৃথিবীর বুকে সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে সৌন্দর্যের গতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যা বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বুঝেছিলেন ফিলিপো টমাসো মেরিনেট (Filippo Tommaso Marinetti)। তাইতো তিনি ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ফিউচারিজমের মেনিফেস্টো ঘোষণা করেছিলেন এবং বলেছিলেন গতিই সৌন্দর্য। গতিহীন কোন কিছুই সুন্দর নয়। স্থির অথবা থমকে যাওয়া কর্ম কখনই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তিনি আরও বলেছিলেন- আমরা আজ ফিউচারিজমের প্রতিষ্ঠা করছি, কারণ আমরা অনিবার্য ধ্বংস থেকে ইতালিকে উদ্ধার করতে চাই। আমরা বলতে চাই আনন্দ এবং বিদ্রোহে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আজ একশ’ এগারো বছর পর সংকটকাল থেকে উত্তরণের জন্য ভবিষ্যৎবাদিতার সাহস, দুঃসাহসিকতা, স্পর্ধা এবং বিদ্রোহী চিন্তার বড় বেশি প্রয়োজন।

সৌন্দর্য সৃষ্টি অথবা জয়লাভের জন্য সাহসিকতা, স্পর্ধা দেখানোর বিকল্প কিছু নেই; যে কোন সংকটে অথবা মহৎ সৃষ্টি বা মানব কল্যাণের জন্য দুঃসাহসিক হয়ে উঠতে হয়। তাইতো ইতিহাসের পাতায় শ্রেণী বৈষম্য দূর করে প্রাচীন গ্রিকের এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলেন সমাজ সংস্কারক সলোন। মানুষের সেবায় অন্তর আত্মার সততায় দুঃসাহসী হয়েছিলেন মাদার তেরেসা যিনি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসিনি হওয়ার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। এই সময়ই therese de Lisieux এর নাম অনুযায়ী তার নাম টেরিজা রাখা হয় এবং এ নামকরণের পূর্বে তার নাম ছিল অ্যাগনেস গঞ্জা বয়াজু। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মাদার তেরেসা সুবিধাবঞ্চিত মুমূর্ষু রোগীদের জন্য পরিত্যক্ত প্রাচীন মন্দিরে সেবাকেন্দ্র চালু করেন, পরে এ কেন্দ্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘নির্মল হৃদয়’। এখানে হিন্দুদের জন্য গঙ্গার জলে স্নান করার ব্যবস্থা, মুসলিমদের জন্য কোরআন ও নামাজ পড়ার ব্যবস্থা; খ্রিস্টানদের জন্য লাস্ট রাইটের ব্যবস্থা অর্থাৎ যেখানে সব ধর্মের মানুষের জন্য ধর্মপালনের ব্যবস্থা ছিল। মাদার তেরেসা মানবতার জন্য স্পর্ধা দেখিয়েছেন; যখন ক্ষ্ঠুরোগীদের কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করত না, তখন মাদার তেরেসা হয়ে উঠেছিলেন অনেক বেশি দুঃসাহসিক। তিনি কুষ্ঠরোগেীদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মানবতা। তিনি মানবজীবনের সর্বশেষ নিয়তি মৃত্যুর সৌন্দর্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাইতো মাদার তেরেসা বলেছিলেন A beautiful death is for people who lived like animals to die like angels loved and wanted সুতরাং ভয়ের নয়, ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে নির্মাণ করতে হবে স্পর্ধার।

ভবিষ্যৎবাদী হয়ে উঠতে হবে সবাইকে। প্রশংসনীয় স্থবিরতা কাটিয়ে, জ্বরে জাগিয়ে তুলতে চাই নিদ্রাহীনতা এবং চিন্তাশক্তির মুষ্টি দিয়ে প্রতিহত করতে চাই সভ্যতা বিনষ্টের সব উপকরণ। আমরা মনে করতে চাই পৃথিবী তার আদর্শ অক্ষটি বরাবর অবস্থান করবে। অসম্ভবের মুহূর্তগুলোকে পেছনে ফেলে চিরন্তন ও সর্বব্যাপী গতির সঞ্চারণ ঘটবে।

নরসিংদীর আলোকবালী ইউনিয়নের পূর্বপাড়ায় করোনা উপসর্গ নিয়ে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সুলতানা বেগমের (৩৫) মৃত্যু হলে স্বামীর বাড়ি কাজিরকান্দিতে লাশ দাফন করতে দেননি গ্রামবাসী। মেঘনা নদীতে নৌকায় ভাসছে তার লাশ। মেয়ের লাশ পাহারা দিচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা ফরিদ মিয়া। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার ইউনিয়নের কলারগাঁও গ্রামের সুশান্ত কর্মকারের (৩৪) মৃত্যুর পর স্বজন ও গ্রামবাসী কেউ লাশ দেখতে আসেননি এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার জন্যও এগিয়ে আসেননি কেউ।

ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ প্রগ্রাম পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে- সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে নির্দেশনা মানতে গিয়ে নিম্নআয়ের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এবং দারিদ্র্যের হার বেড়ে গিয়েছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ (দুই কোটি ৩৮ লাখ) মানুষের ঘরে কোন খাবারই নেই। অনাহারে থাকতে না পেরে সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এমন সংকটকালে আমাদের ভবিষ্যৎবাদী হয়ে উঠতে হবে। রাষ্ট্র যেন প্রয়োজন অনুযায়ী অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে যায় আর রাষ্ট্র পৌঁছাতে না পারলেও আমরা যেন পৌঁছে যেতে পারি অসহায় মানুষের কল্যাণে, এ হোক আমাদের প্রত্যয়।

সবশেষে আহমদ ছফার একটি কথা স্মরণ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন- ‘আমার কাছে ঈশ্বর-চিন্তা আর মানুষের অমরতার চিন্তা সমার্থক। কেউ যদি আমাকে আস্তিক বলেন বিনা বাক্যে মেনে নেব। আমি আস্তিক। যদি কেউ বলেন নাস্তিক আপত্তি করব না। আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি কোন বিবাদেও হেতু দেখতে পাইনে। আমার অভীষ্ট বিষয় মানুষ, শুধু মানুষ। মানুষই সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মূল্যচিন্তা, সমস্ত বিজ্ঞানবুদ্ধির উৎস।’ তাইতো মরণকতা’র ভয়কে নির্ভয়ে স্পর্ধার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, সভ্যতার জয় করতে হবে সুুনিশ্চিত।

[ লেখক : খ-কালীন প্রভাষক, শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ]