সারাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ

করোনা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে

দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। করোনাভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে ৩টি বিশেষ নির্দেশনা জারী করেছে। নির্দেশনাগুলো হলো- ১/ সবাইকে অবশ্যই ঘরে অবস্থান করতে হবে। ২/ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ৩/ সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ার করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এদিকে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যু। করোনা সংক্রমণের বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুরুর দিকে সব দেশেই আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই কম ছিল। শনাক্তের দেড় মাস পর থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে। বাংলাদেশে গতকাল ছিল করোনা শনাক্তের ৪০তম দিন। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় দেশে আরও ১০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩৪১ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭২ জনে, মোট মৃত্যু ৬০, হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন প্রায় এক লাখ মানুষ। পরীক্ষার পরিধি বাড়ছে বলে, শনাক্তের হার বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রেট’ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। কারণ একই পরিস্থিতি ইউরোপ, আমেরিকায়ও হয়েছে। ফলে এপ্রিলজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। পরীক্ষার পরিধি অনেক বাড়াতে হবে। এ সময় রোগটি নিয়ন্ত্রণে জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং উপজেলা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। যাতে দ্রুত শনাক্ত করে রোগীকে আইসোলেশনে রাখা যায়। এভাবেই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) এই একই কথা বলে আসছে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজন করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকে প্রথম ত্রিশ দিনে করোনায় আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৩ জনে, মৃত্যুবরণ করেন ১২ জন। প্রথম রোগী শনাক্তের পর টানা ছয়দিন কোন রোগী শনাক্ত হয়নি। এরপর মার্চ জুড়ে দৈনিক দুই থেকে সর্বোচ্চ ছয়জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, শনাক্তের সংখ্যা শূন্যের কোটায় ছিল ৯ দিন। ৫ এপ্রিল ২৯তম দিনে ১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়, এই প্রথম শনাক্তের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছায়। ত্রিশতম দিনে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩৫-এ দাঁড়ায়। এরপর ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রেট’ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই হু হু করে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। গত ১৫ এপ্রিল ঊনচল্লিশতম দিনে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২১৯ জন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়। গতকাল শনাক্ত হলো ৩৪১ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ স্তরে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভাইরাসটি এই মুহূর্তে অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে। কবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হবে, তা কেউ জানেন না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে সরকার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি, লকডাউনসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ধরনের উদ্যোগকে সর্বশক্তি দিয়ে আরও জোরালো করতে হবে। যেহেতু এখনও এই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তাই লকডাউনই ব্যাপকহারে ভাইরাসটি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে উত্তম পন্থা।

গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, করোনা শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ১৩৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে ২ হাজার ১৯টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৬ হাজার ৮৮৭টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। নতুন নমুনা পরীক্ষায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৩৪১ জন। ফলে দেশে মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭২ জনে। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মারা গেছেন আরও ১০ জন। এতে মৃতের সংখ্যা হয়েছে ৬০। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে সাতজন পুরুষ ও তিনজন নারী। এদের মধ্যে ঢাকায় সাতজন ও ঢাকার বাইরে তিনজনের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী একজন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী তিনজন, ষাটোর্ধ্ব পাঁচজন এবং সত্তরোর্ধ্ব একজন রয়েছেন।

ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ জনকে আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে। এনিয়ে এখন ৪৬১ জন আইসোলেশনে আছেন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টা হোম কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৯ জনকে। এখন হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ৯৯ হাজার ২০৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে ৭১৫ জনকে। এখন মোট ৩ হাজার ৮৭৫ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় মোট কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে ৫ হাজার ২১৪ জনকে। আর এখন পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৩ হাজার ৭৯ জনকে নেয়া হয়েছে কোয়ারেন্টিনে। গত ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯ হাজার ২৫ জন। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৬৬ হাজার ৭০৫ জন। তিনি জানান, সারাদেশে মোট আইসোলেশন বেড রয়েছে ৬ হাজার ৯৭৭টি। তন্মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ১ হাজার ৫৫০টি ও ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৪২৭টি রয়েছে। আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১৯২টি এবং ডায়ালাইসিস ইউনিটের সংখ্যা ৪০টি। সারাদেশে ৬৪ জেলায় কোয়ারেন্টিনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ৪৮৮টি প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে কোয়ারেন্টিন করা যাবে ২৬ হাজার ৩৫২ জনকে। বুলেটিন উপস্থাপনকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আমরা লক্ষ্য করছি, জনগণ প্রয়োজন ছাড়াই বাইরে ঘোরাফেরা করে। আমরা সবাইকে অনুরোধ করব, আপনারা বাড়িতে থাকবেন। যত বেশি বাইরে ঘোরাফেরা করবেন, এই সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে। আমাদের চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ইউরোপ, আমেরিকাতে চিকিৎসা দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেই পরিস্থিতিতে আমরা যেতে চাই না।

স্থানীয় সূত্র বলছে, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে চেম্বারে বসছেন না অনেক চিকিৎসক, অনেক জায়গায় টেকনিশিয়ানরা কর্মস্থলে না থাকায় রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাও বন্ধ আছে বলে রোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ আসছে। সর্দি, কাশি, জ্বর, গলা ব্যথা উপসর্গ নিয়ে অনেকেই ডাক্তার দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেকে ডাক্তার দেখাতে পারলেও দ্রুত করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা যাচ্ছে না, সরকারের সীমাবদ্ধতার কারণে। আবার অনেকের এসব উপসর্গ থাকলেও ভয়ে গোপন রাখছেন, ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন না। কয়েক হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর মৃত্যু এবং রোগী রেখে চিকিৎসকদের পালিয়ে যাওয়ার খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।

করোনার বিস্তার রোধে সবাইকে বাড়িতে থাকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে করোনাভাইরাস। চীন পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিয়ে উঠলেও এখন ভুগছে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল। এ ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজারেরও বেশি। তবে ৫ লাখ ১৬ হাজারের মতো রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।

আরও খবর
জাতিসংঘ তহবিল গঠন না করলে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে ডাব্লিউএফপি সংবাদ ডেস্ক করোনাভাইরাসের কারণে থমকে যাওয়া বিশ
আরও ৫০ লাখ দরিদ্র লোককে রেশনকার্ড দেয়া হবে : প্রধানমন্ত্রী
বাদুরের দুই প্রজাতির মধ্যে করোনার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে
আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস
করোনা সৃষ্টি করছে দীর্ঘমেয়াদি প্রাণঘাতী সংকট
ইরানের ম্যাজিকাল ডিভাইসে ৫ সেকেন্ডে শনাক্ত হবে করোনা রোগী
মাঠে নামছে ‘দুর্যোগে আলোর গেরিলা’
আইইডিসিআরের ৬ কর্মী আক্রান্ত
এসএসসি ফল নির্ধারিত সময়ে প্রকাশ হচ্ছে না
করোনায় মৃত্যুর চেয়ে সুস্থতার হার বেশি
টিভি চ্যানেলের আরও ৪ জন করোনা আক্রান্ত
২৫০ ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার ডিলার আটক
করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশি ১৩০০ ছাড়াল

শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল ২০২০ , ৪ বৈশাখ ১৪২৭, ২২ শাবান ১৪৪১

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘোষণা

সারাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ

করোনা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। করোনাভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে ৩টি বিশেষ নির্দেশনা জারী করেছে। নির্দেশনাগুলো হলো- ১/ সবাইকে অবশ্যই ঘরে অবস্থান করতে হবে। ২/ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ৩/ সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ার করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এদিকে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যু। করোনা সংক্রমণের বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুরুর দিকে সব দেশেই আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই কম ছিল। শনাক্তের দেড় মাস পর থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে। বাংলাদেশে গতকাল ছিল করোনা শনাক্তের ৪০তম দিন। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় দেশে আরও ১০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩৪১ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭২ জনে, মোট মৃত্যু ৬০, হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন প্রায় এক লাখ মানুষ। পরীক্ষার পরিধি বাড়ছে বলে, শনাক্তের হার বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রেট’ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। কারণ একই পরিস্থিতি ইউরোপ, আমেরিকায়ও হয়েছে। ফলে এপ্রিলজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। পরীক্ষার পরিধি অনেক বাড়াতে হবে। এ সময় রোগটি নিয়ন্ত্রণে জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং উপজেলা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। যাতে দ্রুত শনাক্ত করে রোগীকে আইসোলেশনে রাখা যায়। এভাবেই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) এই একই কথা বলে আসছে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজন করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকে প্রথম ত্রিশ দিনে করোনায় আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৩ জনে, মৃত্যুবরণ করেন ১২ জন। প্রথম রোগী শনাক্তের পর টানা ছয়দিন কোন রোগী শনাক্ত হয়নি। এরপর মার্চ জুড়ে দৈনিক দুই থেকে সর্বোচ্চ ছয়জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, শনাক্তের সংখ্যা শূন্যের কোটায় ছিল ৯ দিন। ৫ এপ্রিল ২৯তম দিনে ১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়, এই প্রথম শনাক্তের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছায়। ত্রিশতম দিনে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩৫-এ দাঁড়ায়। এরপর ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রেট’ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই হু হু করে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। গত ১৫ এপ্রিল ঊনচল্লিশতম দিনে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২১৯ জন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়। গতকাল শনাক্ত হলো ৩৪১ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ স্তরে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভাইরাসটি এই মুহূর্তে অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে। কবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হবে, তা কেউ জানেন না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে সরকার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি, লকডাউনসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ধরনের উদ্যোগকে সর্বশক্তি দিয়ে আরও জোরালো করতে হবে। যেহেতু এখনও এই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তাই লকডাউনই ব্যাপকহারে ভাইরাসটি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে উত্তম পন্থা।

গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, করোনা শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ১৩৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে ২ হাজার ১৯টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৬ হাজার ৮৮৭টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। নতুন নমুনা পরীক্ষায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৩৪১ জন। ফলে দেশে মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭২ জনে। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মারা গেছেন আরও ১০ জন। এতে মৃতের সংখ্যা হয়েছে ৬০। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে সাতজন পুরুষ ও তিনজন নারী। এদের মধ্যে ঢাকায় সাতজন ও ঢাকার বাইরে তিনজনের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী একজন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী তিনজন, ষাটোর্ধ্ব পাঁচজন এবং সত্তরোর্ধ্ব একজন রয়েছেন।

ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ জনকে আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে। এনিয়ে এখন ৪৬১ জন আইসোলেশনে আছেন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টা হোম কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৯ জনকে। এখন হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ৯৯ হাজার ২০৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে ৭১৫ জনকে। এখন মোট ৩ হাজার ৮৭৫ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় মোট কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে ৫ হাজার ২১৪ জনকে। আর এখন পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৩ হাজার ৭৯ জনকে নেয়া হয়েছে কোয়ারেন্টিনে। গত ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯ হাজার ২৫ জন। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৬৬ হাজার ৭০৫ জন। তিনি জানান, সারাদেশে মোট আইসোলেশন বেড রয়েছে ৬ হাজার ৯৭৭টি। তন্মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ১ হাজার ৫৫০টি ও ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৪২৭টি রয়েছে। আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১৯২টি এবং ডায়ালাইসিস ইউনিটের সংখ্যা ৪০টি। সারাদেশে ৬৪ জেলায় কোয়ারেন্টিনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ৪৮৮টি প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে কোয়ারেন্টিন করা যাবে ২৬ হাজার ৩৫২ জনকে। বুলেটিন উপস্থাপনকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আমরা লক্ষ্য করছি, জনগণ প্রয়োজন ছাড়াই বাইরে ঘোরাফেরা করে। আমরা সবাইকে অনুরোধ করব, আপনারা বাড়িতে থাকবেন। যত বেশি বাইরে ঘোরাফেরা করবেন, এই সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে। আমাদের চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ইউরোপ, আমেরিকাতে চিকিৎসা দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেই পরিস্থিতিতে আমরা যেতে চাই না।

স্থানীয় সূত্র বলছে, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে চেম্বারে বসছেন না অনেক চিকিৎসক, অনেক জায়গায় টেকনিশিয়ানরা কর্মস্থলে না থাকায় রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাও বন্ধ আছে বলে রোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ আসছে। সর্দি, কাশি, জ্বর, গলা ব্যথা উপসর্গ নিয়ে অনেকেই ডাক্তার দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেকে ডাক্তার দেখাতে পারলেও দ্রুত করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা যাচ্ছে না, সরকারের সীমাবদ্ধতার কারণে। আবার অনেকের এসব উপসর্গ থাকলেও ভয়ে গোপন রাখছেন, ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন না। কয়েক হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর মৃত্যু এবং রোগী রেখে চিকিৎসকদের পালিয়ে যাওয়ার খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।

করোনার বিস্তার রোধে সবাইকে বাড়িতে থাকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে করোনাভাইরাস। চীন পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিয়ে উঠলেও এখন ভুগছে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল। এ ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজারেরও বেশি। তবে ৫ লাখ ১৬ হাজারের মতো রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।