প্রমাণ দিলেন ডা. মঈন উদ্দীন

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশে প্রাণ বিসর্জন দিলেন সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের সহকারী ড. অধ্যাপক মঈন উদ্দীন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেই এ মরণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হন। প্রথম অবস্থায় সিলেটেই স্ব-অন্তরীণ থাকলেও অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে জরুরিভিত্তিতে ঢাকায় প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দিলে সিলেট ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক তাকে ভেন্টিলেটর দিতে অস্বীকার করেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে পরিবারের উদ্যোগে ভেন্টিলেটরবিহীন সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় আনা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গত বুধবার তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম চিকিৎসক শহীদ না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তিনি আর ফিরবেন না। কিন্তু তার আত্মত্যাগ এ দেশ ও জাতির কাছে একজন চিকিৎসকের জীবন যে কত মূল্যহীন সেটা প্রমাণ করে গেল। এ দেশে একজন পাতি আমলার সামান্য দুর্ঘটনা ঘটলে ত্বরিতগতিতে হেলিকপ্টার দুয়ারে পৌঁছে যায় রাজধানীতে এনে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জন্য। এ স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী, নারীবিদ্বেষী, নারী শিক্ষার কট্টরবিরোধী, নারীকে লালসার দৃষ্টিভঙ্গিতে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনাকারী সাম্প্রদায়িক শক্তির মহাগুরুর চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টার (কারও কারও মতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স) পাওয়া গেলেও করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা একজন চিকিৎসকের জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বা হেলিকপ্টার দূরে থাকুক ভেন্টিলেটরসহ একটি অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া গেল না। অকালে প্রাণ দিতে হলো। এর চেয়ে দুঃখের, ক্ষোভের এবং আত্মগ্লানির আর কিছুই হতে পারে না।

এজন্য আমরা কাকে দায়ী করব? কাকে ধিক্কার দেব! আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে, না এর অব্যবস্থাকে? ওসমানী হাসপাতালের মহামান্য পরিচালককে? না সেই আমলাতন্ত্রকে যে আমলাতন্ত্র এ দেশের সব অঘটনের জন্য দায়ী, যে আমলাতান্ত্রিকতার জন্য ভেন্টিলেটর পাননি ডা. মঈন উদ্দীন? না নিজেদেরকে, না স্বয়ং ডা. মঈন উদ্দীনকে এ দেশে জন্মেছিলেন বলে?

আমরা এখনও জানি না আমরা কাকে দায়ী করব? কারণ এ বিষয়ে সরকার এখনও কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেনি অথবা গঠন করার প্রয়োজন মনে করেনি। তবে আমরা নিশ্চিত, এরকম একটি পরিস্থিতিতে উল্লিখিত পাতি আমলা বা তেঁতুল হুজুর বলে খ্যাত যে ব্যক্তি তাদের মৃত্যু ঘটলে এতক্ষণে তদন্ত কমিশন গঠন হয়ে যেত এবং ত্বরিতগতিতে নির্দোষ-দোষী নির্বিশেষে কয়েকজনের শাস্তিও হয়ে যেত। যেমনভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে কাজ করতে থাকা নির্দোষ ৬ জন চিকিৎসককে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে। এখানেও খ—গর নিচে ৬ জন চিকিৎসক, যারা সার্ভিস দিচ্ছেন করোনা রোগীদের এবং যাদের সার্ভিস ছাড়া করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না। তাদের এখন ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। যার প্রথম শিকার হলেন ডা. মঈন উদ্দীন।

তবে একথা নিশ্চিত ভাবেই উল্লেখ করা যায়, ডা. মঈন উদ্দীনের আত্মত্যাগ এটাই প্রমাণ করেছে এ দেশে আর যারই জীবনের মূল্য থাকুক না কেন একজন চিকিৎসকের জীবনের মূল্য এখনও নির্ধারিত হয়নি।

আমরা চাই না ডা. মঈন উদ্দীনদের এ মৃত্যু। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে চিকিৎসককে পূর্ণ রণসাজ দিয়েই যুদ্ধে পাঠাতে হবে, যেন আর কোন চিকিৎসকের মৃত্যু না হতে পারে। রাজধানীর বাইরে কোন রোগীকে সেব দিতে গিয়ে গিয়ে আক্রান্ত হলে অবশ্যই তাকে হেলিকপ্টার দিয়ে ভেন্টিলেটরে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে।

শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল ২০২০ , ৪ বৈশাখ ১৪২৭, ২২ শাবান ১৪৪১

একজন চিকিৎসকের জীবনের মূল্য কত!

প্রমাণ দিলেন ডা. মঈন উদ্দীন

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশে প্রাণ বিসর্জন দিলেন সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের সহকারী ড. অধ্যাপক মঈন উদ্দীন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেই এ মরণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হন। প্রথম অবস্থায় সিলেটেই স্ব-অন্তরীণ থাকলেও অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে জরুরিভিত্তিতে ঢাকায় প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দিলে সিলেট ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক তাকে ভেন্টিলেটর দিতে অস্বীকার করেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে পরিবারের উদ্যোগে ভেন্টিলেটরবিহীন সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় আনা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গত বুধবার তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম চিকিৎসক শহীদ না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তিনি আর ফিরবেন না। কিন্তু তার আত্মত্যাগ এ দেশ ও জাতির কাছে একজন চিকিৎসকের জীবন যে কত মূল্যহীন সেটা প্রমাণ করে গেল। এ দেশে একজন পাতি আমলার সামান্য দুর্ঘটনা ঘটলে ত্বরিতগতিতে হেলিকপ্টার দুয়ারে পৌঁছে যায় রাজধানীতে এনে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জন্য। এ স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী, নারীবিদ্বেষী, নারী শিক্ষার কট্টরবিরোধী, নারীকে লালসার দৃষ্টিভঙ্গিতে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনাকারী সাম্প্রদায়িক শক্তির মহাগুরুর চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টার (কারও কারও মতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স) পাওয়া গেলেও করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা একজন চিকিৎসকের জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বা হেলিকপ্টার দূরে থাকুক ভেন্টিলেটরসহ একটি অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া গেল না। অকালে প্রাণ দিতে হলো। এর চেয়ে দুঃখের, ক্ষোভের এবং আত্মগ্লানির আর কিছুই হতে পারে না।

এজন্য আমরা কাকে দায়ী করব? কাকে ধিক্কার দেব! আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে, না এর অব্যবস্থাকে? ওসমানী হাসপাতালের মহামান্য পরিচালককে? না সেই আমলাতন্ত্রকে যে আমলাতন্ত্র এ দেশের সব অঘটনের জন্য দায়ী, যে আমলাতান্ত্রিকতার জন্য ভেন্টিলেটর পাননি ডা. মঈন উদ্দীন? না নিজেদেরকে, না স্বয়ং ডা. মঈন উদ্দীনকে এ দেশে জন্মেছিলেন বলে?

আমরা এখনও জানি না আমরা কাকে দায়ী করব? কারণ এ বিষয়ে সরকার এখনও কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেনি অথবা গঠন করার প্রয়োজন মনে করেনি। তবে আমরা নিশ্চিত, এরকম একটি পরিস্থিতিতে উল্লিখিত পাতি আমলা বা তেঁতুল হুজুর বলে খ্যাত যে ব্যক্তি তাদের মৃত্যু ঘটলে এতক্ষণে তদন্ত কমিশন গঠন হয়ে যেত এবং ত্বরিতগতিতে নির্দোষ-দোষী নির্বিশেষে কয়েকজনের শাস্তিও হয়ে যেত। যেমনভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে কাজ করতে থাকা নির্দোষ ৬ জন চিকিৎসককে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে। এখানেও খ—গর নিচে ৬ জন চিকিৎসক, যারা সার্ভিস দিচ্ছেন করোনা রোগীদের এবং যাদের সার্ভিস ছাড়া করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না। তাদের এখন ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। যার প্রথম শিকার হলেন ডা. মঈন উদ্দীন।

তবে একথা নিশ্চিত ভাবেই উল্লেখ করা যায়, ডা. মঈন উদ্দীনের আত্মত্যাগ এটাই প্রমাণ করেছে এ দেশে আর যারই জীবনের মূল্য থাকুক না কেন একজন চিকিৎসকের জীবনের মূল্য এখনও নির্ধারিত হয়নি।

আমরা চাই না ডা. মঈন উদ্দীনদের এ মৃত্যু। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে চিকিৎসককে পূর্ণ রণসাজ দিয়েই যুদ্ধে পাঠাতে হবে, যেন আর কোন চিকিৎসকের মৃত্যু না হতে পারে। রাজধানীর বাইরে কোন রোগীকে সেব দিতে গিয়ে গিয়ে আক্রান্ত হলে অবশ্যই তাকে হেলিকপ্টার দিয়ে ভেন্টিলেটরে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে।