যেসব দেশ যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করলো সংক্রমণ

যথাসময়ে কঠোর ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েই করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছে এশিয়া মহাদেশের মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা। এর কয়েকটি দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও মৃত্যুর হার বিশে্বর শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় কম। আবার আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার সংখ্যাও বেশি। করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশগুলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করে কঠোর ও দৃঢ়ভাবে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের ঘরে রাখতে পেরেছে। এর ফলে ওইসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোর মতো করোনা ভয়ঙ্কর ও প্রাণাঘাতী রূপ নিতে পারেনি।

মালয়েশিয়ায় পরাজিত হচ্ছে করোনা : মালয়েশিয়ায় গত কয়েদিন ধরে করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়মিতভাবে কমছে। দেশটির চিকিৎসকরাও চমক দেখাচ্ছেন। পরাজিত হচ্ছে করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান লকডাউন অমান্য করায় গত দুই দিনে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে, রিমান্ডে নিয়েছে।

এর আগে মানুষের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৫ এপ্রিল নতুন সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। ওইদিন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব বলেন, ?‘আমরা দেখছি, লোকজন এমন আচরণ করছে যেন তারা আইনের তোয়াক্কা কিংবা ভয় করছে না। তাদের ভয় পাওয়ার জন্য এক হাজার রিঙ্গিত (প্রতি রিঙ্গিত ২২/২৩ টাকা) খুব বেশি মনে হচ্ছে না। তারা প্রতিনিয়ত চলাচলের নির্দেশনা লঙ্ঘন করছেন। এরকম পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পুলিশ আগামীকাল থেকে তাদের আর সতর্ক করবে না। যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে তাদের রিমান্ডে নিয়ে আদালতে সোপর্দ করবে পুলিশ। এরপর আদালত তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ আইন অনুযায়ী, আদালত তাদের দুই বছরের কারাদ- এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য পাঁচ বছরের কারাদ- দিতে পারবে।’

গতকাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৩০৫ জন। এর মধ্যে দুই হাজার ৯৬৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। মৃত্যু হয়েছে মাত্র ৮৮ জনের, যাদের অধিকাংশই আগে থেকে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ওইদিন দেশটিতে মারা গেছেন মাত্র দু’জন এবং নতুন করোনা শনাক্ত হয়েছে মাত্র ৫৪ জন।

১৭ এপ্রিল দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, করোনায় আক্রান্ত হয় মাত্র ৬৯ জন। তার বিপরীতে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ২০১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। প্রতিদিন দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা কমছে।

১৫ এপ্রিল দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৫ জন, মারা যান একজন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১৬৯ জন রোগী।

করোনা নিয়ন্ত্রণে মালয়েশিয়ায় গত ১৮ মার্চ থেকে শুরু হয় লকডাউন; শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ বন্ধ না হওয়ায় এর সময়সীমা আরও দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়েছে মালয়েশিয়া সরকার।

তুরস্কেও নিয়ন্ত্রণের পথে : নভেল করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউন দিয়ে নাগরিকদের চলাচল সীমিত করলেও সেই বিধি-নিষেধে ভিন্নতা এনেছে তুরস্ক। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম।

দেশটির সরকার গত সপ্তাহে ৩১টি প্রদেশে ৪৮ ঘণ্টার কাউফিউ দেয়, যার আওতায় আসে দেশটির তিন চতুর্থাংশ মানুষ। কারফিউ ছাড়াও অন্যান্য বিধি-নিষেধের ক্ষেত্রেও নিজেদের মতো করে চলছে তুরস্ক। কর্মদিবসগুলোতে ঘরে থাকার (স্টে হোম) নির্দেশনা শুধু ২০ বছরের কম বয়সী এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য। অন্যরা সবাই বাইরে যেতে পারছেন।

তুরস্কে অনেক ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, রেস্তোরাঁ থেকে শুধু খাবার ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে, পার্কের মতো জনসমাগমস্থলগুলো বন্ধ রয়েছে, ব্যাংক খোলা শুধু কয়েক ঘণ্টার জন্য।

অন্যদিকে, অবকাঠামো নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছে, খোলা রয়েছে কারখানা ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যেগুলো অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে চায় না।

তুর্কি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, তুরস্কের মতো আংশিক বিধি-নিষেধও ভাইরাসের বিস্তার রোধে কাজে দিতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নাজুক ব্যক্তিরা সুরক্ষিত থাকবে এবং যারা কাজ চালিয়ে যাবে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে তা করবে।

ওয়ার্ল্ডওমিটারের গতকালের হিসাবে, তুরস্ক মোট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৭৮ হাজার ৫৪৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন এক হাজার ৭৬৯ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন আট হাজার ৬৩১ জন। ওইদিন তুরস্কে নতুন কোন করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি।

মৃত্যুহীন ভিয়েতনাম : ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, ভিয়েতনামে গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয় ২৬৮ জন এবং ২০১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এই ভাইরাসে দেশটিতে কেউ মারা যাননি।

গত ২৩ জানুয়ারি ভিয়েতনামে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। তখন দেশটির হো চি মিন শহরে দু’জন চীনা নাগরিককে করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়।

এরপরই দেশটিতে করোনাকে মহামারী ঘোষণা করা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি আরও কয়েক করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় হ্যানয়ের অদূরের সোন লুই গ্রামের ১০ হাজার ৬০০ জন্য নাগরিককে ২০ দিনের জন্য অবরুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারেনি।

শ্রীলঙ্কা সরকারের কঠোর পদক্ষেপে নিয়ন্ত্রণে করোনাভাইরাস : গতকাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে মাত্র ২৪৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছে মাত্র ৭ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭৭ জন।

গত ২৬ শ্রীলঙ্কায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপরই ভাইরাস রোধে প্রস্তুতি শুরু করে দেশটি। সাধারণ ছুটির নামে ১৪ মার্চ থেকে প্রথম ধাপে লকডাউনের আগে কূটনীতিকদের নিয়ে ব্রিফিং করেন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীনেশ গুনাবর্ধানে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর প্রধানকে প্রধান সমন্বয়কারী করা হয়; যদিও সেনাবাহিনী মাঠে না নেমে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে। তবে লোকজনের ঘর থেকে বের হওয়া প্রতিহত করাসহ সব ধরনের নজরদারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপালন করেছে পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী। ১৫ মার্চ সাধারণ ছুটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেন।

শ্রীংকার বিদেশ ফেরত লোকজনকে যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিনে নিতে পুলিশকে কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়েছে দেশটির সরকার। ১ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত চীন, ইতালি, দক্ষিন কোরিয়া ফেরত লোকজনকে শ্রীলঙ্কার পুলিশ বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করে। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় পুলিশের কাছে নাম নিবন্ধন করে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে বলা হয়। কিন্তু বিদেশ ফেরত লোকজনের সবাই পুলিশের কাছে নাম নিবন্ধন করেনি। এরপর পুলিশের আরেক নির্দেশনায় বলা হয়, যারা পুলিশের কাছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন করছে না, তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রোক করা হবে। এরপর বাকি লোকজন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাম, ঠিকানা দিয়ে কোয়ারেন্টিনে গেছে।

থাইল্যান্ডেও নিয়ন্ত্রণের পথে করোনা : ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত থাইল্যান্ডে করোনায় আক্রান্ত রোগী মোট দুই হাজার ৭৩৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৪৭ জন। গতকাল নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে মাত্র ৩৩ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন এক হাজার ৭৮৭ জন।

জানুয়ারির প্রথম দিকেই থাইল্যান্ডে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে দেশটির সরকার নাগরিকদের ঘরে রাখতে লকডাউন ও অন্যান্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক পর্যায়ে বিদেশে অবস্থারত নিজ দেশের নাগরিকদেরই দেশে ফেরা বন্ধ করে দেয়। মূলত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, লকডাউন ও অন্যান্য পদক্ষেপ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের কারণেই দেশটিতে করোনার প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নিতে পারেনি। এখন সুস্থতার সংখ্যা বাড়ছে, নতুন শনাক্ত রোগী কমছে। দেশটি মোট এক লাখ ৪৯৮ জন নাগরিকের করোনা টেস্ট করিয়েছে।

নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ : মূলত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও পরামর্শ অনুযায়ী, লকডাউন ও নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন করেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করেছে।

গতকাল পর্যন্ত নেপালে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৩০ জন। কারও মৃত্যু হয়নি; সুস্থ হয়েছেন ২ জন। এরপরও দেশটি ১৫ হাজার ৮০০ জন নাগরিকের করোনা টেস্ট করিয়েছে। গত কয়েকদিনে দেশটিতে করোনায় কেউ আক্রান্ত হয়নি।

মালদ্বীপে গতকাল পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৪ জন। গতকাল শনাক্ত হয়েছে মাত্র পাঁচজন। এখন পর্যন্ত মালদ্বীপে করোনায় কারও মৃত্যু হয়নি। দেশটি মোট তিন হাজার ৭১১ জনের করোনা টেস্ট করিয়েছে।

ভুটানে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে মাত্র পাঁচজন। তাদের মধ্যে দু’জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। ভুটানে করোনাভাইরাসে কেউ মারা যায়নি। দেশটিতে করোনা সন্দেহে মোট আট ১০৭ জন নাগরিকের ‘করোনা টেস্ট’ করিয়েছে।

আরও খবর
সারাদেশে দু’শতাধিক ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত
পাঁচ কোটি লোক খাদ্য সহায়তার আওতায় আসবে প্রধানমন্ত্রী
করোনার নতুন কেন্দ্র হতে পারে আফ্রিকা
মৃত্যু দেড় লাখ ও আক্রান্ত সাড়ে ২২ লাখ ছাড়িয়েছে
২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ৯ মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ৩০৬
লকডাউন না মেনে লাখো মানুষের ঢল
ঈদের নামাজও বাসায় সৌদির গ্র্যান্ড মুফতি
লকডাউন না মানলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা
ছুটি আরও বাড়তে পারে
কৃষক বাঁচাতে কৃষিপণ্যের বাজারজাত নিশ্চিত করতে হবে : দেবপ্রিয়
পুলিশের ৬৫ সদস্য করোনায় আক্রান্ত
দশ মিনিটে করোনা শনাক্ত
নারায়ণগঞ্জে নেই করোনা পরীক্ষাগার
লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না কেন?
ঈদের আগে খুলছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

রবিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২০ , ৬ বৈশাখ ১৪২৭, ২৪ শাবান ১৪৪১

করোনাভাইরাস

যেসব দেশ যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করলো সংক্রমণ

রাকিব উদ্দিন

যথাসময়ে কঠোর ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েই করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছে এশিয়া মহাদেশের মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা। এর কয়েকটি দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও মৃত্যুর হার বিশে্বর শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় কম। আবার আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার সংখ্যাও বেশি। করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশগুলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করে কঠোর ও দৃঢ়ভাবে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের ঘরে রাখতে পেরেছে। এর ফলে ওইসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোর মতো করোনা ভয়ঙ্কর ও প্রাণাঘাতী রূপ নিতে পারেনি।

মালয়েশিয়ায় পরাজিত হচ্ছে করোনা : মালয়েশিয়ায় গত কয়েদিন ধরে করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়মিতভাবে কমছে। দেশটির চিকিৎসকরাও চমক দেখাচ্ছেন। পরাজিত হচ্ছে করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান লকডাউন অমান্য করায় গত দুই দিনে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে, রিমান্ডে নিয়েছে।

এর আগে মানুষের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৫ এপ্রিল নতুন সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। ওইদিন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব বলেন, ?‘আমরা দেখছি, লোকজন এমন আচরণ করছে যেন তারা আইনের তোয়াক্কা কিংবা ভয় করছে না। তাদের ভয় পাওয়ার জন্য এক হাজার রিঙ্গিত (প্রতি রিঙ্গিত ২২/২৩ টাকা) খুব বেশি মনে হচ্ছে না। তারা প্রতিনিয়ত চলাচলের নির্দেশনা লঙ্ঘন করছেন। এরকম পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পুলিশ আগামীকাল থেকে তাদের আর সতর্ক করবে না। যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে তাদের রিমান্ডে নিয়ে আদালতে সোপর্দ করবে পুলিশ। এরপর আদালত তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ আইন অনুযায়ী, আদালত তাদের দুই বছরের কারাদ- এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য পাঁচ বছরের কারাদ- দিতে পারবে।’

গতকাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৩০৫ জন। এর মধ্যে দুই হাজার ৯৬৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। মৃত্যু হয়েছে মাত্র ৮৮ জনের, যাদের অধিকাংশই আগে থেকে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ওইদিন দেশটিতে মারা গেছেন মাত্র দু’জন এবং নতুন করোনা শনাক্ত হয়েছে মাত্র ৫৪ জন।

১৭ এপ্রিল দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, করোনায় আক্রান্ত হয় মাত্র ৬৯ জন। তার বিপরীতে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ২০১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। প্রতিদিন দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা কমছে।

১৫ এপ্রিল দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৫ জন, মারা যান একজন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১৬৯ জন রোগী।

করোনা নিয়ন্ত্রণে মালয়েশিয়ায় গত ১৮ মার্চ থেকে শুরু হয় লকডাউন; শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ বন্ধ না হওয়ায় এর সময়সীমা আরও দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়েছে মালয়েশিয়া সরকার।

তুরস্কেও নিয়ন্ত্রণের পথে : নভেল করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউন দিয়ে নাগরিকদের চলাচল সীমিত করলেও সেই বিধি-নিষেধে ভিন্নতা এনেছে তুরস্ক। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম।

দেশটির সরকার গত সপ্তাহে ৩১টি প্রদেশে ৪৮ ঘণ্টার কাউফিউ দেয়, যার আওতায় আসে দেশটির তিন চতুর্থাংশ মানুষ। কারফিউ ছাড়াও অন্যান্য বিধি-নিষেধের ক্ষেত্রেও নিজেদের মতো করে চলছে তুরস্ক। কর্মদিবসগুলোতে ঘরে থাকার (স্টে হোম) নির্দেশনা শুধু ২০ বছরের কম বয়সী এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য। অন্যরা সবাই বাইরে যেতে পারছেন।

তুরস্কে অনেক ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, রেস্তোরাঁ থেকে শুধু খাবার ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে, পার্কের মতো জনসমাগমস্থলগুলো বন্ধ রয়েছে, ব্যাংক খোলা শুধু কয়েক ঘণ্টার জন্য।

অন্যদিকে, অবকাঠামো নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছে, খোলা রয়েছে কারখানা ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যেগুলো অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে চায় না।

তুর্কি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, তুরস্কের মতো আংশিক বিধি-নিষেধও ভাইরাসের বিস্তার রোধে কাজে দিতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নাজুক ব্যক্তিরা সুরক্ষিত থাকবে এবং যারা কাজ চালিয়ে যাবে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে তা করবে।

ওয়ার্ল্ডওমিটারের গতকালের হিসাবে, তুরস্ক মোট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৭৮ হাজার ৫৪৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন এক হাজার ৭৬৯ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন আট হাজার ৬৩১ জন। ওইদিন তুরস্কে নতুন কোন করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি।

মৃত্যুহীন ভিয়েতনাম : ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, ভিয়েতনামে গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয় ২৬৮ জন এবং ২০১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এই ভাইরাসে দেশটিতে কেউ মারা যাননি।

গত ২৩ জানুয়ারি ভিয়েতনামে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। তখন দেশটির হো চি মিন শহরে দু’জন চীনা নাগরিককে করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়।

এরপরই দেশটিতে করোনাকে মহামারী ঘোষণা করা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি আরও কয়েক করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় হ্যানয়ের অদূরের সোন লুই গ্রামের ১০ হাজার ৬০০ জন্য নাগরিককে ২০ দিনের জন্য অবরুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারেনি।

শ্রীলঙ্কা সরকারের কঠোর পদক্ষেপে নিয়ন্ত্রণে করোনাভাইরাস : গতকাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে মাত্র ২৪৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছে মাত্র ৭ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭৭ জন।

গত ২৬ শ্রীলঙ্কায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপরই ভাইরাস রোধে প্রস্তুতি শুরু করে দেশটি। সাধারণ ছুটির নামে ১৪ মার্চ থেকে প্রথম ধাপে লকডাউনের আগে কূটনীতিকদের নিয়ে ব্রিফিং করেন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীনেশ গুনাবর্ধানে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর প্রধানকে প্রধান সমন্বয়কারী করা হয়; যদিও সেনাবাহিনী মাঠে না নেমে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে। তবে লোকজনের ঘর থেকে বের হওয়া প্রতিহত করাসহ সব ধরনের নজরদারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপালন করেছে পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী। ১৫ মার্চ সাধারণ ছুটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেন।

শ্রীংকার বিদেশ ফেরত লোকজনকে যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিনে নিতে পুলিশকে কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়েছে দেশটির সরকার। ১ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত চীন, ইতালি, দক্ষিন কোরিয়া ফেরত লোকজনকে শ্রীলঙ্কার পুলিশ বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করে। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় পুলিশের কাছে নাম নিবন্ধন করে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে বলা হয়। কিন্তু বিদেশ ফেরত লোকজনের সবাই পুলিশের কাছে নাম নিবন্ধন করেনি। এরপর পুলিশের আরেক নির্দেশনায় বলা হয়, যারা পুলিশের কাছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন করছে না, তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রোক করা হবে। এরপর বাকি লোকজন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাম, ঠিকানা দিয়ে কোয়ারেন্টিনে গেছে।

থাইল্যান্ডেও নিয়ন্ত্রণের পথে করোনা : ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত থাইল্যান্ডে করোনায় আক্রান্ত রোগী মোট দুই হাজার ৭৩৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৪৭ জন। গতকাল নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে মাত্র ৩৩ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন এক হাজার ৭৮৭ জন।

জানুয়ারির প্রথম দিকেই থাইল্যান্ডে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে দেশটির সরকার নাগরিকদের ঘরে রাখতে লকডাউন ও অন্যান্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক পর্যায়ে বিদেশে অবস্থারত নিজ দেশের নাগরিকদেরই দেশে ফেরা বন্ধ করে দেয়। মূলত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, লকডাউন ও অন্যান্য পদক্ষেপ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের কারণেই দেশটিতে করোনার প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নিতে পারেনি। এখন সুস্থতার সংখ্যা বাড়ছে, নতুন শনাক্ত রোগী কমছে। দেশটি মোট এক লাখ ৪৯৮ জন নাগরিকের করোনা টেস্ট করিয়েছে।

নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ : মূলত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও পরামর্শ অনুযায়ী, লকডাউন ও নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন করেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করেছে।

গতকাল পর্যন্ত নেপালে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৩০ জন। কারও মৃত্যু হয়নি; সুস্থ হয়েছেন ২ জন। এরপরও দেশটি ১৫ হাজার ৮০০ জন নাগরিকের করোনা টেস্ট করিয়েছে। গত কয়েকদিনে দেশটিতে করোনায় কেউ আক্রান্ত হয়নি।

মালদ্বীপে গতকাল পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৪ জন। গতকাল শনাক্ত হয়েছে মাত্র পাঁচজন। এখন পর্যন্ত মালদ্বীপে করোনায় কারও মৃত্যু হয়নি। দেশটি মোট তিন হাজার ৭১১ জনের করোনা টেস্ট করিয়েছে।

ভুটানে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে মাত্র পাঁচজন। তাদের মধ্যে দু’জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। ভুটানে করোনাভাইরাসে কেউ মারা যায়নি। দেশটিতে করোনা সন্দেহে মোট আট ১০৭ জন নাগরিকের ‘করোনা টেস্ট’ করিয়েছে।