বাসন্তীর প্রত্যাবর্তনের পদধ্বনি!

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তার থেকে বেশি বাড়ছে চাল চোরের সংখ্যা- ফেসবুকে এমন একটি বক্তব্য কয়েক দিন ধরে এক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক অ্যাকাউন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান জনপ্রতিনিধির অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় চুরির ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি প্রচার পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে ছবি তোলে তার পোস্ট দিতে বেশি পছন্দ করে, এতে তাদের মান-মর্যাদা বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে স্থানীয় নেতাদের জন্মবার্ষিকী, বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কর্মীরা ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর সেই ছবি পোস্ট করে নেতার গুণের ফর্দ এমনভাবে বর্ণনা করতে থাকেন যে, মনে হয় ঐ নেতা শেখ হাসিনার চেয়েও বড়। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের কর্মীরা ছবি তোলার জন্য নেতা খুঁজে পায় না; অগত্যা তারা সরকার ও আওয়ামী লীগের অপকর্মগুলো জনগণের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরতে যত গবেষণা ও কৌশলের প্রয়োজন হয় তার সবটুকু প্রয়োগ করেন। তুলে ধরা অপকর্মের উত্তর দিয়ে কোন পোস্ট দেয়ার জ্ঞান-গরিমা আওয়ামী লীগ কর্মীদের আছে বলে প্রতিপন্ন হয়নি; বরং উৎফুল্লচিত্তে বিরোধী পক্ষের ফটোশপে তৈরি করা বা আগেকার দিনের চুরির ঘটনাও শেয়ার করছে, লাইক দিচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের মেধার দীনতা কোন সময় কম ছিলো না।

করোনার এই মহাদুর্যোগে নিম্নবিত্তের লোকজন কাজকর্ম হারিয়ে খাবারের সন্ধানে ছোটাছুটি করছে। আওয়ামী লীগের তেরো বছরের শাসনামলে দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও এখনো দশ পার্সেন্ট লোকের থাকা ও খাবারের কোন নিশ্চয়তা নেই। কাজ পেলে দুবেলা খায়, না পেলে উপোস করে। রাজনীতিবিদেরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার অহঙ্কারে আবোলতাবোল বকে তখন তাদের মনে থাকে না যে, ফুটপাতে যাদের রাত্রিযাপন তাদের এখনো ডাস্টবিন থেকে খাবার জোগাড় করে খেতে হয়। রান্নারকোন উপকরণ না থাকায় এরা সাহায্যের চাল, ডাল, তেল, লবণ দিয়েও রান্না করে খেতে পারে না। এদের চেয়ে একটু ভালো অবস্থা বস্তিবাসীর; বস্তিবাসীর চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা দেয়া একটি ছোট্ট ঘর থাকে।

করোনার মহামারীতে দেশ ও জনগণের এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় গরিব, দুস্থ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনপ্রতিনিধিদের যেখানে মানবসেবার অনুসরণযোগ্য নজির সৃষ্টি করার কথা, সেখানে তাদের উল্টো আচরণ সবাইকে হতভম্ব করে তোলে। করোনার এই দুর্যোগে আর্তমানবতার সেবা না করে জনপ্রতিনিধিরা যখন গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল চুরি করে তখন সরকারের ওপর সব আক্রোশ উপড়ে পড়ে।

সরকার গরিবদের জন্য হরেক রকমের সহায়তার প্রবর্তন করেছে। দরিদ্র লোকজনের জন্য স্বল্পমূল্যে ভাত-রুটির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ওএমএস বা ওপেন মার্কেট সেল কর্মসূচির আওতায় চাল-গম বিক্রি করা হয়। আওয়ামী লীগ এক সময় ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, এই নিয়ে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। বিলম্ব হলেও আওয়ামী লীগ এখন ১০ টাকা কেজি করে চাল বিক্রি করছে। ওএমএসের এই চালের দাম নির্ধারিত ১০ টাকা হিসেবে সরকারের কোষাগারে জমা করে বাজারে পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রির উদ্দেশে ডিলারেরা এই চাল সরিয়ে রেখে দিচ্ছে। টেস্ট রিলিফ-কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি প্রথম ১৯৭৪ সালে বৃহত্তর রংপুর জেলার মঙ্গাপীড়িত এলাকায় চালু করা হয়, যা এখন দেশের সর্বত্র প্রবর্তন করা হয়েছে। কার্তিক মাসে অতি দরিদ্র, ভূমিহীন ও বেকার মানুষদের রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও মেরামত ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত করে খাদ্য নিশ্চিতকরণ করা হয় কাবিখার মাধ্যমে। কাবিখার আওতায় প্রাপ্ত বরাদ্দের চাল, গম সরাসরি মজুরদের মাঝে বিতরণ করা হয় অথবা চাল, গম বিক্রি করে প্রাপ্ত নগদ অর্থ দ্বারা গৃহীত প্রকল্পসমূহ গঠিত কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। তাই এই খাতে চাল, গম বিক্রিকে দুর্নীতি বলা যাবে না। পাকিস্তান আমলেও ভিন্ন নামে অনুরূপ কর্মসূচি ছিলো। এসব কর্মসূচির আওতায় সম্পাদিত কাজ কখনো সঠিক হয়েছে বলে পাকিস্তান আমলেও শুনিনি। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত নারী, প্রবীণ কর্মক্ষম নয় এমন গরিব ও নিঃস্বদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং বা ভিজিএফ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার প্রতিমাসে নির্ধারিত পরিমাণ খাদ্যশস্য বিতরণ করে যাচ্ছে। পল্লী এলাকায় ভিজিএফ কার্ডধারী দরিদ্র ও দুস্থ মহিলারা এই খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকেন। এ কর্মসূচির অধীনে খাদ্যশস্য বিতরণে খুব নয়ছয় না হলেও ওজনে কম দেয়া বা তালিকাকরণে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠে থাকে। অতি সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী মানবিক সহায়তা হিসেবে ঘরে আবদ্ধ গরিব ও দুস্থ লোক ছাড়াও বর্তমানে কর্মহীন দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষকসহ সকল দুর্গতদের জন্য জরুরিভিত্তিতে ত্রাণ বিতরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন সরকারের একটিই লক্ষ্য- কোন মানুষ যেন খাবারের অভাবে মারা না যায়।

করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথম থেকেই সরকার, ব্যক্তি বা বেসরকারি সংস্থার তরফ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের ত্রাণ বিতরণের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; অনেক চালাক লোক বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন তরফ থেকে দেয়া ত্রাণ লুফে নিচ্ছে। সত্যিকারের অভাবগ্রস্ত লোকের তালিকা তৈরি করা এখনো সম্ভব না হওয়ায় যিনিই ত্রাণ চাচ্ছেন তাকেই দেয়া হচ্ছে; এর ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সরল লোকেরা ত্রাণ পাচ্ছেন না। এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ত্রাণের জন্য আগত কোন লোককে ফেরত দেয়াও ত্রাণ বণ্টনকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জরুরি ত্রাণ বিতরণের এমন বিশৃঙ্খলায় দেশের কয়েকটি জায়গায় ইউপিচেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বাড়ি থেকে সরকারের সিলমারা বস্তার চাল উদ্ধার করা হয়েছে। তাই অনেকে এই বিতরণের সঙ্গে সেনাবাহিনীকে জড়িত করার দাবি তুলছেন। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে টেনে আনা দেশের জন্য সুখকর নয়। সব কাজ সেনাবাহিনীকে দিয়ে করানো হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের স্লোগান উঠে কেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অপরিহার্য হলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার নির্বাচন করার দরকার আছে বলে তো মনে হয় না। নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না বলে সৎ প্রতিনিধি নেই- এমন কথাও বলা যাবে না। কারণ এসব পজিশনে ভোট প্রার্থনা করার লোক খুব বেশি নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও জনগণ এদেরই নির্বাচন করবেন। এছাড়াও কোন আমলেই শতভাগ জনপ্রতিনিধি সৎ ছিলো না। পাকিস্তান আমলে বেসিক ডেমোক্রেসি বা বিডি মেম্বর, চেয়ারম্যানেরাও রিলিফের মালামাল চুরি করতো। আইয়ুব খান তো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিডি মেম্বারদের টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন; টাকা দেয়ার পরও অসৎ মেম্বারদের বিশ্বাস না হওয়ায় তিনি এদের ধরে নিয়ে ভোটের দিন পর্যন্ত গোপন স্থানে আবদ্ধ করে রেখেদেন। অনেকে আবেগতাড়িত হয়ে ‘চাল চোরদের’ প্রকাশ্যে গুলি করে মারার সুপারিশ করেছেন। প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার আইন সৌদি আরব আর পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে বলে আমার জানা নেই, ব্রুনাই শরিয়া আইনে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার ভাবনা-চিন্তা করেছিলো, সম্ভবত পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে যায়। জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হলেও পাকিস্তানে বর্তমানে এমন দ- দেয়া হয় না। বাংলাদেশে পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানের উপদ্রবে অতিষ্ঠ মানুষ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে গুলির মনোবাসনা ব্যক্ত করেছিলো, কিন্তু এখন আর আমরা কেউ আইন বহির্ভূত মৃত্যু চাই না। প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হলে অপরাধ যদি নির্মূল হতো সৌদি আরবকে এখনো প্রায় প্রতি শুক্রবারে নির্দিষ্ট মসজিদের মুসল্লিদের সম্মুখে হাত বা গলাকাটতে হতো না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ত্রাণের সব চাল হরিলুট হচ্ছে মর্মে সংবাদপরিবেশন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৫৭১টি ইউনিয়ন আছে- প্রতিটি ইউনিয়নে একজন চেয়ারম্যান ওবার জন সদস্য আছেন। এই হিসেবে সব ইউনিয়নে মিলে জনপ্রতিনিধি আছেন ৫৯,৪২৩ জন। এমপিসহ সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ সব মিলিয়ে জনপ্রতিনিধি আছেন ৬১,৫৭৯ জন। এই কয়জন লোকই কি শুধু চুরি করে? করোনার প্রাদুর্ভাবের পর যে কয়েকজনের কাছ থেকে সরকারি সিল দেয়াচাল উদ্ধার করা হয়েছে তা খুব বেশি নয়। এমন কয়েকজন অপরাধী প্রতিনিধি চিরকালই ছিলো। তাই বলে তাদের ছেড়ে দেয়ার কথা বলছি না; সরকারই এই সকল অপরাধি সনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা আমাদের সমাজ বহির্ভূত ভিন্ন গ্রহের লোক নন। আমাদের সমাজের কোন সেক্টরটি দুর্নীতিমুক্ত? আমি বলবো না, পাকিস্তান আমলে বিরাজমান দুর্নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মুখে শুনুন, ‘পূর্বে শুনতাম, দারোগা পুলিশের মতো ঘুষ কেউ খায় না। তারপর শুনতাম, সিভিল সাপ্লাইয়ের মতো ঘুষ কেউ খায় না, তারপর শুনতাম কাস্টম অফিসারদের মতো ঘুষ কেউ খায় না। আমি কয়েক বৎসর রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, তাতে দেখেছি জেলখানার ঘুষের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে ঘুষ বোধ হয় কোন ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা নিতে জানে না। ...জেলখানা, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, কাস্টমস, কোর্ট-কাচারি, সাব রেজিস্ট্রার অফিস, ইনকাম ট্যাক্স, কারো চেয়ে কেউ কম না...। এখন সিঁধ চোর কমে গেলেও মসজিদে চপ্পল চুরি হয়, মসজিদের তালা ভেঙ্গে ঘড়ি, মাইক চুরি হয়। মানুষ এই ছ্যাঁচড়ে চোরদের ধরতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলে; কিন্তু ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজদের পাশে রেখে জামাতে নামাজ পড়তে পেরে গর্ব বোধ করে।

রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ হবেই। তাই বলে মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মাস বা দুই মাস চলার সামর্থ্য নেই তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। করোনার দাপট কবে বন্ধ হবে তা এক্ষুণি বলা যাচ্ছে না। হতদরিদ্র লোকেরা কোন কারণে যেন অস্থির হয়ে উঠেছে, এই দুর্যোগে তারা উচ্চকিত স্বরে ত্রাণ পাওয়ার অধিকারের কথা জানাচ্ছে, সুযোগ পেয়ে ট্রাকে ওএমএসের চাল লুট করছে। এই চরম বিপর্যয়কর মুহূর্তে ওএমএস বা ত্রাণের চাল, গম, ডাল, তেল, সাবান চুরির সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরা জড়িত হলে অভাবী মানুষগুলো বিক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে। উত্তপ্ত মানস জগতে ঝড় তোলার জন্য কেউ যদি চুয়াত্তরের বাসন্তীর মতো মাছ ধরার জাল আরেকজন উন্মাদকে পরিয়ে ছবি তোলার দূরভিসন্ধিতে বুনন শুরু করে তাহলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করা বর্তমান সরকারের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২০ , ৬ বৈশাখ ১৪২৭, ২৪ শাবান ১৪৪১

বাসন্তীর প্রত্যাবর্তনের পদধ্বনি!

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তার থেকে বেশি বাড়ছে চাল চোরের সংখ্যা- ফেসবুকে এমন একটি বক্তব্য কয়েক দিন ধরে এক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক অ্যাকাউন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান জনপ্রতিনিধির অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় চুরির ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি প্রচার পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে ছবি তোলে তার পোস্ট দিতে বেশি পছন্দ করে, এতে তাদের মান-মর্যাদা বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে স্থানীয় নেতাদের জন্মবার্ষিকী, বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কর্মীরা ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর সেই ছবি পোস্ট করে নেতার গুণের ফর্দ এমনভাবে বর্ণনা করতে থাকেন যে, মনে হয় ঐ নেতা শেখ হাসিনার চেয়েও বড়। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের কর্মীরা ছবি তোলার জন্য নেতা খুঁজে পায় না; অগত্যা তারা সরকার ও আওয়ামী লীগের অপকর্মগুলো জনগণের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরতে যত গবেষণা ও কৌশলের প্রয়োজন হয় তার সবটুকু প্রয়োগ করেন। তুলে ধরা অপকর্মের উত্তর দিয়ে কোন পোস্ট দেয়ার জ্ঞান-গরিমা আওয়ামী লীগ কর্মীদের আছে বলে প্রতিপন্ন হয়নি; বরং উৎফুল্লচিত্তে বিরোধী পক্ষের ফটোশপে তৈরি করা বা আগেকার দিনের চুরির ঘটনাও শেয়ার করছে, লাইক দিচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের মেধার দীনতা কোন সময় কম ছিলো না।

করোনার এই মহাদুর্যোগে নিম্নবিত্তের লোকজন কাজকর্ম হারিয়ে খাবারের সন্ধানে ছোটাছুটি করছে। আওয়ামী লীগের তেরো বছরের শাসনামলে দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও এখনো দশ পার্সেন্ট লোকের থাকা ও খাবারের কোন নিশ্চয়তা নেই। কাজ পেলে দুবেলা খায়, না পেলে উপোস করে। রাজনীতিবিদেরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার অহঙ্কারে আবোলতাবোল বকে তখন তাদের মনে থাকে না যে, ফুটপাতে যাদের রাত্রিযাপন তাদের এখনো ডাস্টবিন থেকে খাবার জোগাড় করে খেতে হয়। রান্নারকোন উপকরণ না থাকায় এরা সাহায্যের চাল, ডাল, তেল, লবণ দিয়েও রান্না করে খেতে পারে না। এদের চেয়ে একটু ভালো অবস্থা বস্তিবাসীর; বস্তিবাসীর চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা দেয়া একটি ছোট্ট ঘর থাকে।

করোনার মহামারীতে দেশ ও জনগণের এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় গরিব, দুস্থ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনপ্রতিনিধিদের যেখানে মানবসেবার অনুসরণযোগ্য নজির সৃষ্টি করার কথা, সেখানে তাদের উল্টো আচরণ সবাইকে হতভম্ব করে তোলে। করোনার এই দুর্যোগে আর্তমানবতার সেবা না করে জনপ্রতিনিধিরা যখন গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল চুরি করে তখন সরকারের ওপর সব আক্রোশ উপড়ে পড়ে।

সরকার গরিবদের জন্য হরেক রকমের সহায়তার প্রবর্তন করেছে। দরিদ্র লোকজনের জন্য স্বল্পমূল্যে ভাত-রুটির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ওএমএস বা ওপেন মার্কেট সেল কর্মসূচির আওতায় চাল-গম বিক্রি করা হয়। আওয়ামী লীগ এক সময় ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, এই নিয়ে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। বিলম্ব হলেও আওয়ামী লীগ এখন ১০ টাকা কেজি করে চাল বিক্রি করছে। ওএমএসের এই চালের দাম নির্ধারিত ১০ টাকা হিসেবে সরকারের কোষাগারে জমা করে বাজারে পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রির উদ্দেশে ডিলারেরা এই চাল সরিয়ে রেখে দিচ্ছে। টেস্ট রিলিফ-কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি প্রথম ১৯৭৪ সালে বৃহত্তর রংপুর জেলার মঙ্গাপীড়িত এলাকায় চালু করা হয়, যা এখন দেশের সর্বত্র প্রবর্তন করা হয়েছে। কার্তিক মাসে অতি দরিদ্র, ভূমিহীন ও বেকার মানুষদের রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও মেরামত ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত করে খাদ্য নিশ্চিতকরণ করা হয় কাবিখার মাধ্যমে। কাবিখার আওতায় প্রাপ্ত বরাদ্দের চাল, গম সরাসরি মজুরদের মাঝে বিতরণ করা হয় অথবা চাল, গম বিক্রি করে প্রাপ্ত নগদ অর্থ দ্বারা গৃহীত প্রকল্পসমূহ গঠিত কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। তাই এই খাতে চাল, গম বিক্রিকে দুর্নীতি বলা যাবে না। পাকিস্তান আমলেও ভিন্ন নামে অনুরূপ কর্মসূচি ছিলো। এসব কর্মসূচির আওতায় সম্পাদিত কাজ কখনো সঠিক হয়েছে বলে পাকিস্তান আমলেও শুনিনি। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত নারী, প্রবীণ কর্মক্ষম নয় এমন গরিব ও নিঃস্বদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং বা ভিজিএফ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার প্রতিমাসে নির্ধারিত পরিমাণ খাদ্যশস্য বিতরণ করে যাচ্ছে। পল্লী এলাকায় ভিজিএফ কার্ডধারী দরিদ্র ও দুস্থ মহিলারা এই খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকেন। এ কর্মসূচির অধীনে খাদ্যশস্য বিতরণে খুব নয়ছয় না হলেও ওজনে কম দেয়া বা তালিকাকরণে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠে থাকে। অতি সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী মানবিক সহায়তা হিসেবে ঘরে আবদ্ধ গরিব ও দুস্থ লোক ছাড়াও বর্তমানে কর্মহীন দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষকসহ সকল দুর্গতদের জন্য জরুরিভিত্তিতে ত্রাণ বিতরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন সরকারের একটিই লক্ষ্য- কোন মানুষ যেন খাবারের অভাবে মারা না যায়।

করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথম থেকেই সরকার, ব্যক্তি বা বেসরকারি সংস্থার তরফ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের ত্রাণ বিতরণের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; অনেক চালাক লোক বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন তরফ থেকে দেয়া ত্রাণ লুফে নিচ্ছে। সত্যিকারের অভাবগ্রস্ত লোকের তালিকা তৈরি করা এখনো সম্ভব না হওয়ায় যিনিই ত্রাণ চাচ্ছেন তাকেই দেয়া হচ্ছে; এর ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সরল লোকেরা ত্রাণ পাচ্ছেন না। এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ত্রাণের জন্য আগত কোন লোককে ফেরত দেয়াও ত্রাণ বণ্টনকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জরুরি ত্রাণ বিতরণের এমন বিশৃঙ্খলায় দেশের কয়েকটি জায়গায় ইউপিচেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বাড়ি থেকে সরকারের সিলমারা বস্তার চাল উদ্ধার করা হয়েছে। তাই অনেকে এই বিতরণের সঙ্গে সেনাবাহিনীকে জড়িত করার দাবি তুলছেন। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে টেনে আনা দেশের জন্য সুখকর নয়। সব কাজ সেনাবাহিনীকে দিয়ে করানো হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের স্লোগান উঠে কেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অপরিহার্য হলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার নির্বাচন করার দরকার আছে বলে তো মনে হয় না। নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না বলে সৎ প্রতিনিধি নেই- এমন কথাও বলা যাবে না। কারণ এসব পজিশনে ভোট প্রার্থনা করার লোক খুব বেশি নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও জনগণ এদেরই নির্বাচন করবেন। এছাড়াও কোন আমলেই শতভাগ জনপ্রতিনিধি সৎ ছিলো না। পাকিস্তান আমলে বেসিক ডেমোক্রেসি বা বিডি মেম্বর, চেয়ারম্যানেরাও রিলিফের মালামাল চুরি করতো। আইয়ুব খান তো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিডি মেম্বারদের টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন; টাকা দেয়ার পরও অসৎ মেম্বারদের বিশ্বাস না হওয়ায় তিনি এদের ধরে নিয়ে ভোটের দিন পর্যন্ত গোপন স্থানে আবদ্ধ করে রেখেদেন। অনেকে আবেগতাড়িত হয়ে ‘চাল চোরদের’ প্রকাশ্যে গুলি করে মারার সুপারিশ করেছেন। প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার আইন সৌদি আরব আর পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে বলে আমার জানা নেই, ব্রুনাই শরিয়া আইনে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার ভাবনা-চিন্তা করেছিলো, সম্ভবত পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে যায়। জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হলেও পাকিস্তানে বর্তমানে এমন দ- দেয়া হয় না। বাংলাদেশে পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানের উপদ্রবে অতিষ্ঠ মানুষ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে গুলির মনোবাসনা ব্যক্ত করেছিলো, কিন্তু এখন আর আমরা কেউ আইন বহির্ভূত মৃত্যু চাই না। প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হলে অপরাধ যদি নির্মূল হতো সৌদি আরবকে এখনো প্রায় প্রতি শুক্রবারে নির্দিষ্ট মসজিদের মুসল্লিদের সম্মুখে হাত বা গলাকাটতে হতো না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ত্রাণের সব চাল হরিলুট হচ্ছে মর্মে সংবাদপরিবেশন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৫৭১টি ইউনিয়ন আছে- প্রতিটি ইউনিয়নে একজন চেয়ারম্যান ওবার জন সদস্য আছেন। এই হিসেবে সব ইউনিয়নে মিলে জনপ্রতিনিধি আছেন ৫৯,৪২৩ জন। এমপিসহ সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ সব মিলিয়ে জনপ্রতিনিধি আছেন ৬১,৫৭৯ জন। এই কয়জন লোকই কি শুধু চুরি করে? করোনার প্রাদুর্ভাবের পর যে কয়েকজনের কাছ থেকে সরকারি সিল দেয়াচাল উদ্ধার করা হয়েছে তা খুব বেশি নয়। এমন কয়েকজন অপরাধী প্রতিনিধি চিরকালই ছিলো। তাই বলে তাদের ছেড়ে দেয়ার কথা বলছি না; সরকারই এই সকল অপরাধি সনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা আমাদের সমাজ বহির্ভূত ভিন্ন গ্রহের লোক নন। আমাদের সমাজের কোন সেক্টরটি দুর্নীতিমুক্ত? আমি বলবো না, পাকিস্তান আমলে বিরাজমান দুর্নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মুখে শুনুন, ‘পূর্বে শুনতাম, দারোগা পুলিশের মতো ঘুষ কেউ খায় না। তারপর শুনতাম, সিভিল সাপ্লাইয়ের মতো ঘুষ কেউ খায় না, তারপর শুনতাম কাস্টম অফিসারদের মতো ঘুষ কেউ খায় না। আমি কয়েক বৎসর রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, তাতে দেখেছি জেলখানার ঘুষের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে ঘুষ বোধ হয় কোন ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা নিতে জানে না। ...জেলখানা, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, কাস্টমস, কোর্ট-কাচারি, সাব রেজিস্ট্রার অফিস, ইনকাম ট্যাক্স, কারো চেয়ে কেউ কম না...। এখন সিঁধ চোর কমে গেলেও মসজিদে চপ্পল চুরি হয়, মসজিদের তালা ভেঙ্গে ঘড়ি, মাইক চুরি হয়। মানুষ এই ছ্যাঁচড়ে চোরদের ধরতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলে; কিন্তু ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজদের পাশে রেখে জামাতে নামাজ পড়তে পেরে গর্ব বোধ করে।

রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ হবেই। তাই বলে মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মাস বা দুই মাস চলার সামর্থ্য নেই তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। করোনার দাপট কবে বন্ধ হবে তা এক্ষুণি বলা যাচ্ছে না। হতদরিদ্র লোকেরা কোন কারণে যেন অস্থির হয়ে উঠেছে, এই দুর্যোগে তারা উচ্চকিত স্বরে ত্রাণ পাওয়ার অধিকারের কথা জানাচ্ছে, সুযোগ পেয়ে ট্রাকে ওএমএসের চাল লুট করছে। এই চরম বিপর্যয়কর মুহূর্তে ওএমএস বা ত্রাণের চাল, গম, ডাল, তেল, সাবান চুরির সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরা জড়িত হলে অভাবী মানুষগুলো বিক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে। উত্তপ্ত মানস জগতে ঝড় তোলার জন্য কেউ যদি চুয়াত্তরের বাসন্তীর মতো মাছ ধরার জাল আরেকজন উন্মাদকে পরিয়ে ছবি তোলার দূরভিসন্ধিতে বুনন শুরু করে তাহলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করা বর্তমান সরকারের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com