হে করোনা তুমি মোদের দানিয়াছ...

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

কে বলিতে পারে করোনা একটি সংক্রমণ ভাইরাস হইয়াও মনে রাখিবার মতো কিছু করিতে পারে নাই? করোনা সকলকে ঘাড় ধরিয়া ঘরমুখী করিয়াছে। ব্যতিব্যস্ততায় যাহারা ঘর সংসারেও মন দেয়ার সময় পাইতেন না তাহারা এখন! ইতোমধ্যে করোনার অপ্রতিরোধ্য প্রাদুর্ভাবে বহু দেশে বড় বড় উৎসব আয়োজন থামিয়া গিয়াছে। সহস্র সভা সম্মেলন স্থগিত, বড় বড়দের বিদেশ ভ্রমন বাতিল, বর্ডার সিল, রেল –সড়ক- নৌ-বিমান চলাচল বন্ধ হইয়াছে। পুরো কয়েক সপ্তাহ বাড়িতে বেড়াইতে যাইবার ছুটি মিলিয়াছে। করোনার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বিশ্ব অর্থনীতির বারোটা বাজিবার বাকি নাই। বাঘে মহিষে এক ঘাটে পানি খাইবার প্রয়োজন পড়িতেছে। এতদিন যাহারা বাণিজ্য যুদ্ধে ছিলেন তাহারা এখন করোনার জন্মবৃত্তান্ত লইয়া পরস্পর দোষারোপে মাতিয়া উঠিতেছেন। সার্ক নামের আঞ্চলিক ফোরামটি এতদিন লাইফ সাপোর্টে ছিল এ সেদিন তাহাদের ভিডিও শীর্ষ সম্মেলন হইয়া গেল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল এমন অনেকে এখন পরস্পর সমর্থনের জিকির তুলিতেছেন। দেশে দেশে বন্দীমুক্তির জন্য বিধির বাঁধন শিথিল হইতেছে। অনেক দেশের দুর্দান্ত আন্দোলন, পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের কৌশলগত আক্রমণ সবই মাঠেই মারা যাইতে চলিয়াছে। অনেক দেশ রাষ্ট্র ও সমাজে অব্যাহত অদক্ষতা, অপারগতা, অযোগ্যতা ও ছোট-বড় দুর্নীতি এমনকি আর্থিক খাত ধ্বংসকারী লুটপাট ও ঋণখেলাপের দায়ভার অজুহাত-উপলক্ষ হিসেবে করোনার ওপর চাপাইবার পথ পাইতেছেন। করোনা আজ এমন একটি ইস্যু যাহার জন্য যাবতীয় মাথাব্যথার অনেক ব্যাপার-স্যাপার হইতে অনেকের দৃষ্টি সরাইবার সমূহ সুযোগ পাইতেছেন। করোনার দোহাই দিয়া করোনা মোকাবিলার নামে, দেশে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, লকআউট, চলিতেছে চলিবে। এতদউপলক্ষে লুণ্ঠনকারী মজুদদার কঞ্জুসের ঘর হইতেও প্রচুর প্রণোদনা ও আয়-ব্যয়ের ঘোষণা আসিতেছে। স্বল্প মেয়াদে যেমন মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে তেমনি অধিকাংশ অর্থনীতির জন্য সংকট-সর্বনাশ হইলেও স্বার্থসন্ধ ও ভেদবুদ্ধি সম্পন্ন কূটকৌশলী কতিপয়ের জন্য করোনা পৌষ মাস।

তবুও করোনা কেন আতঙ্কের বিষয় বা দুর্নামের শিকার হইতেছে? কারণ- (১) করোনার সৃষ্টির উৎস এখনও অজানা, তাহার কোন প্রতিষেধক নাই এবং তাহার মতো মহামারী হইতে নিষ্কৃতি লাভের সময়সীমা অনিশ্চিত। করোনার স্বগোত্রীয় অনেক ভাইরাসে (যেমন বসন্ত, চিকনগুনিয়া) একবার আক্রান্ত হইলে সবার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হইবার ভয় থাকে না। কিন্তু সে ধরনের ইমিউনিটি দেয়ার সুযোগ বেচারা করোনার নাই। (২) করোনা মানুষের শ্বাসতন্ত্রের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গে সংক্রমিত হইয়া মারাত্মক ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে (৩) বড় বেদনার কারণ হইল নির্ঘাত সংক্রমনের সম্ভাবনায় রোগীর সংস্পর্শে আসা তো দূরের কথা তাহার হইতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান আবশ্যক হইয়া দাঁড়ায়, যে কারণে রোগীকে আইসোলেশনে রাখিতে হয়। এক সময় কুষ্ঠ রোগীদের যেমন দ্বীপান্তর দেয়া হইত। এখন করোনা রোগী সেবা শুশ্রুষা ও সহানুভূতি পাওয়ার সর্বজনীন অধিকার বঞ্চিত হইবে। সম্ভবত এ কারণে, আমাদের দেশে কেহ আক্রান্ত হইয়াছে কিনা তাহা পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ (রোগী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ) হইতে অনীহা ও অপারগতা, প্রস্তুতির অভাবজনিত সীমাদ্ধতা ছিল বা আছে। ফলে লুকাইয়া পালাইয়া কিংবা রোগীর সঠিক সংখ্যা তথ্য প্রকাশ না করিবার প্রয়াস-প্রবণতা পরিলক্ষিত হইতেছে। এমনকি পরিবারের পক্ষ হইতে আপনজনের আক্রান্ত হওয়া বা মৃত্যুর তথ্যটি পর্যন্ত সংগোপন রাখার চেষ্টা চলিতেছে। ইহা স্বয়ংক্রিয় সংক্রমণযোগ্য ভাইরাস বা রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি আত্মঘাতী প্রবণতা। ইহাতে করোনার সংক্রমণেরই বিস্তারের ভয় বাড়িতেছে এবং ইহার নিয়ন্ত্রণ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। (৪) করোনার প্রাদুর্ভাবে পণ্য ও সেবাখাতে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে, কর্মে নিয়োজনে যে অচলায়তন অস্থিরতা তৈরি হয় তাহাতে সব পর্যায়ে (বিশেষ করিয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের) জীবনযাত্রা নির্বাহ সমূহ সমস্যায় আপতিত হইবার আশঙ্কা প্রবল হইতেছে। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি, দেশ ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক ব্যত্যয় ও বিপর্যয় সৃষ্টির আতঙ্ক বাড়িতেছে বই কমিতেছে না। (৫) উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রায় সব অর্থনীতিতে মহামারী আকারে করোনার প্রাদুর্ভাব প্রায় একযোগে এবং অর্থ, বিত্ত, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বাঘা বাঘা দেশ ও সমাজ কুপোকাত হওয়ায় বিপদে পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ সংকুচিত হইতেছে এবং পরস্পরের প্রতি আশা-ভরসা হারাইয়া যাইতেছে।

অস্বীকারের সুযোগ নাই এ যাবৎ প্রাদুর্ভাবিত ভাইরাসের মধ্যে করোনাই কঠোর, সিনিয়র এবং ক্রিটিকাল। এ মুহূর্তে ফেসবুক ও গুগল গংদের গণনায়, স্টাটাসে করোনাই বহুল ব্যবহারিত, উচ্চারিত শব্দ। সার্স, মার্স, এবোলা, বার্ড ফ্লু এরা ছিল আঞ্চলিক। তাদের বিস্তার ও বিপর্যয়- বিধ্বংসী ক্ষমতা এত দ্রুত বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি ও আক্রমণ শানাইতে পারেনি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ সফরের কর্ম পরিকল্পনা আছে করোনার। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক জীবনযাত্রায়, বাজার ব্যবস্থাপনা-অব্যবস্থাপনার কারণে কিছুদিন আগে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এমনকি পিয়াজের কারণে পাবলিক ফান্ড ও সাধারণ ভোক্তার পকেটের মানি লন্ডারড হইয়াছে। শোনা যাইতেছে ১৯৩১ সালের পর বিশ্ব পুঁজিবাজারে লাফালাফি বেশি বাড়িতেছে। চীনে চালু বিদেশি বন্ড ও কোম্পানির কাগজ (স্টক) ম্যানিপুলেট হইয়া চীনা বিনিয়োগকারীদের হাতে চলিয়া যাইতেছে। বোঝা যাইবে না কেন করোনার কারণে সবার স্বাস্থ্য খাতে যতটা না ঝুঁকি তৈরি হইবে তাহার চাইতে বড় বিপর্যয় ঘটিতে যাইতেছে ছোট ও মাঝারি খাতের আয়-ব্যয়, ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ-উৎপাদন, পর্যটন, পরিসম্পদ অবকাঠামো নির্মাণ তথা সামষ্টিক আর্থিক খাতে। দীর্ঘমেয়দি মন্দার দ্বার প্রান্তে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনা ইহাকে তাহার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার সাফল্য মনে করিতেছে।

তবে করোনা নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করিয়া বলিতেছে, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। নিরাময়ের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়। করোনার দ্বারা আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসার শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে তাহাকে প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হইল সংক্রামিত হওয়া হইতে প্রত্যেকের নিজেকে সুরক্ষা। সুতরাং আতঙ্কিত না হইয়া করোনা মোকাবিলায় নিজের দায়িত্ব হিসেবে পরামর্শমত নিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচলে পরিপালনে নিজের যেমন সুরক্ষা মিলিবে অন্যকেও তেমন সংক্রামিত হওয়া হইতে মুক্ত রাখিবার দায়িত্ব পালিত হইবে।’

করোনায় আক্রান্তদের নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নাই সত্য তবে আক্রান্ত হইলেও নিজে নিজে সারিয়া ওঠা সম্ভব। শুধু শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে বাহিত হয়ে ফুসফুসে ভাইরাস মারাত্মক সংক্রমণে নিউমোনিয়া প্রবল হইলে, অন্যান্য জটিল রোগ থাকিলে, বয়স্ক রোগীর চিকিৎসা বা নিরাময় কঠিন হইয়া দাঁড়াইতে পারে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হইয়াছেন কিনা তাহা নিজেই নিজের পরীক্ষা করিতে পারেন- লম্বা একটা শ্বাস লইয়া ১০ সেকেন্ড ধরিয়া রাখিতে হইবে। যদি এ সময়ের মাঝে কাহারও কাশি এবং বুকে ব্যথা অনুভব না হয় তাহা হইলে বুঝিতে হইবে তিনি সুস্থ আছেন। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের প্যাথলজি বিভাগ, বায়ু দূষণজনিত, সাধারণ ঠাণ্ডা, ফ্লু এবং করোনার লক্ষণ শনাক্তে উপসর্গ শ্রেণীবিন্যাস করিয়াছেন- (১) শুকনা কাশি+ হাঁচি= বায়ু দূষণের লক্ষণ (২) কাশি+গলা ব্যথা+হাঁচি+ নাক দিয়ে পানি আসা = সাধারণ ঠাণ্ডা (৩) কাশি+ গলা ব্যথা+ হাঁচি+ নাক দিয়ে পানি আসা+শরীর ব্যথা+ শারীরিক দুর্বলত বোধ+ হালকা জ্বর=ফ্লু (৪)শুকনা কাশি +হাঁচি+শরীর ব্যথা+গলা ব্যথা+ দুর্বলতা বোধ+ বেশি জ্বর+শ্বাসকষ্ট= করোনাভাইরাস। অ্যালকোহল মিশ্রিত জীবাণুনাশক, সাবান হাতে মাখিয়া লইলে করোনা নাই। করোনা গরম আবহাওয়া সহ্য করিতে পারে না। ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাহার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কাজেই ভালো না লাগিলেও এখন বেশি বেশি গরম পানি পান করিতে হইবে, আইসক্রিম হইতে দূরত্ব বজায় রাখিতে হইবে। লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়া গার্গল করিলে গলার মিউকাস পরিষ্কার হইবার সঙ্গে সঙ্গে টনসিলের জীবাণুসহ করোনা দূর হইবে ফুসফুসে সংক্রমিত হইতে পারিবে না। করোনায় আক্রান্ত হইয়াছেন জানিলে অন্তত ১৫ মিনিট পরপর পানি পান করিতে হইবে। মানে খাদ্যনালি ভেজা রাখিতে হইবে। নিয়মিত চা পানেও বিশেষ উপকার পাওয়া সম্ভব। ভাইরাসটি কোনভাবে মুখের ভেতর আসিলে উহা চা বা পানির সঙ্গে পাকস্থলীতে চলিয়া যাইবে। যাহা পাকস্থলীর এসিডে সহজেই মরিয়া যাইবে। আর, নাকে-মুখে আঙুল বা হাত দেয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে হইবে কারন, মানব শরীরে জীবাণু প্রবেশের সদর দরজা হইল নাক-মুখ-চোখ!’

সুতরাং এখনও সময় আছে, সম্ভাব্য সবাইকে শনাক্তকরণের পরীক্ষা পদ্ধতি প্রক্রিয়া সহজসাধ্য বা নাগালের মধ্যে আনা। আর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীকে উপযুক্ত পোশাকসহ ভাইরাস হইতে তাহাদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা, সরকারি ও ব্যক্তিখাত মিলিয়া সর্বদলীয় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং সামাজিক সেবা শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটিলে করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় সাফল্য মিলিবে।

[লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান]

সোমবার, ২০ এপ্রিল ২০২০ , ৭ বৈশাখ ১৪২৭, ২৫ শাবান ১৪৪১

আমজনতার অর্থনীতি

হে করোনা তুমি মোদের দানিয়াছ...

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

কে বলিতে পারে করোনা একটি সংক্রমণ ভাইরাস হইয়াও মনে রাখিবার মতো কিছু করিতে পারে নাই? করোনা সকলকে ঘাড় ধরিয়া ঘরমুখী করিয়াছে। ব্যতিব্যস্ততায় যাহারা ঘর সংসারেও মন দেয়ার সময় পাইতেন না তাহারা এখন! ইতোমধ্যে করোনার অপ্রতিরোধ্য প্রাদুর্ভাবে বহু দেশে বড় বড় উৎসব আয়োজন থামিয়া গিয়াছে। সহস্র সভা সম্মেলন স্থগিত, বড় বড়দের বিদেশ ভ্রমন বাতিল, বর্ডার সিল, রেল –সড়ক- নৌ-বিমান চলাচল বন্ধ হইয়াছে। পুরো কয়েক সপ্তাহ বাড়িতে বেড়াইতে যাইবার ছুটি মিলিয়াছে। করোনার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বিশ্ব অর্থনীতির বারোটা বাজিবার বাকি নাই। বাঘে মহিষে এক ঘাটে পানি খাইবার প্রয়োজন পড়িতেছে। এতদিন যাহারা বাণিজ্য যুদ্ধে ছিলেন তাহারা এখন করোনার জন্মবৃত্তান্ত লইয়া পরস্পর দোষারোপে মাতিয়া উঠিতেছেন। সার্ক নামের আঞ্চলিক ফোরামটি এতদিন লাইফ সাপোর্টে ছিল এ সেদিন তাহাদের ভিডিও শীর্ষ সম্মেলন হইয়া গেল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল এমন অনেকে এখন পরস্পর সমর্থনের জিকির তুলিতেছেন। দেশে দেশে বন্দীমুক্তির জন্য বিধির বাঁধন শিথিল হইতেছে। অনেক দেশের দুর্দান্ত আন্দোলন, পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের কৌশলগত আক্রমণ সবই মাঠেই মারা যাইতে চলিয়াছে। অনেক দেশ রাষ্ট্র ও সমাজে অব্যাহত অদক্ষতা, অপারগতা, অযোগ্যতা ও ছোট-বড় দুর্নীতি এমনকি আর্থিক খাত ধ্বংসকারী লুটপাট ও ঋণখেলাপের দায়ভার অজুহাত-উপলক্ষ হিসেবে করোনার ওপর চাপাইবার পথ পাইতেছেন। করোনা আজ এমন একটি ইস্যু যাহার জন্য যাবতীয় মাথাব্যথার অনেক ব্যাপার-স্যাপার হইতে অনেকের দৃষ্টি সরাইবার সমূহ সুযোগ পাইতেছেন। করোনার দোহাই দিয়া করোনা মোকাবিলার নামে, দেশে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, লকআউট, চলিতেছে চলিবে। এতদউপলক্ষে লুণ্ঠনকারী মজুদদার কঞ্জুসের ঘর হইতেও প্রচুর প্রণোদনা ও আয়-ব্যয়ের ঘোষণা আসিতেছে। স্বল্প মেয়াদে যেমন মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে তেমনি অধিকাংশ অর্থনীতির জন্য সংকট-সর্বনাশ হইলেও স্বার্থসন্ধ ও ভেদবুদ্ধি সম্পন্ন কূটকৌশলী কতিপয়ের জন্য করোনা পৌষ মাস।

তবুও করোনা কেন আতঙ্কের বিষয় বা দুর্নামের শিকার হইতেছে? কারণ- (১) করোনার সৃষ্টির উৎস এখনও অজানা, তাহার কোন প্রতিষেধক নাই এবং তাহার মতো মহামারী হইতে নিষ্কৃতি লাভের সময়সীমা অনিশ্চিত। করোনার স্বগোত্রীয় অনেক ভাইরাসে (যেমন বসন্ত, চিকনগুনিয়া) একবার আক্রান্ত হইলে সবার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হইবার ভয় থাকে না। কিন্তু সে ধরনের ইমিউনিটি দেয়ার সুযোগ বেচারা করোনার নাই। (২) করোনা মানুষের শ্বাসতন্ত্রের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গে সংক্রমিত হইয়া মারাত্মক ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে (৩) বড় বেদনার কারণ হইল নির্ঘাত সংক্রমনের সম্ভাবনায় রোগীর সংস্পর্শে আসা তো দূরের কথা তাহার হইতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান আবশ্যক হইয়া দাঁড়ায়, যে কারণে রোগীকে আইসোলেশনে রাখিতে হয়। এক সময় কুষ্ঠ রোগীদের যেমন দ্বীপান্তর দেয়া হইত। এখন করোনা রোগী সেবা শুশ্রুষা ও সহানুভূতি পাওয়ার সর্বজনীন অধিকার বঞ্চিত হইবে। সম্ভবত এ কারণে, আমাদের দেশে কেহ আক্রান্ত হইয়াছে কিনা তাহা পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ (রোগী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ) হইতে অনীহা ও অপারগতা, প্রস্তুতির অভাবজনিত সীমাদ্ধতা ছিল বা আছে। ফলে লুকাইয়া পালাইয়া কিংবা রোগীর সঠিক সংখ্যা তথ্য প্রকাশ না করিবার প্রয়াস-প্রবণতা পরিলক্ষিত হইতেছে। এমনকি পরিবারের পক্ষ হইতে আপনজনের আক্রান্ত হওয়া বা মৃত্যুর তথ্যটি পর্যন্ত সংগোপন রাখার চেষ্টা চলিতেছে। ইহা স্বয়ংক্রিয় সংক্রমণযোগ্য ভাইরাস বা রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি আত্মঘাতী প্রবণতা। ইহাতে করোনার সংক্রমণেরই বিস্তারের ভয় বাড়িতেছে এবং ইহার নিয়ন্ত্রণ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। (৪) করোনার প্রাদুর্ভাবে পণ্য ও সেবাখাতে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে, কর্মে নিয়োজনে যে অচলায়তন অস্থিরতা তৈরি হয় তাহাতে সব পর্যায়ে (বিশেষ করিয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের) জীবনযাত্রা নির্বাহ সমূহ সমস্যায় আপতিত হইবার আশঙ্কা প্রবল হইতেছে। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি, দেশ ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক ব্যত্যয় ও বিপর্যয় সৃষ্টির আতঙ্ক বাড়িতেছে বই কমিতেছে না। (৫) উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রায় সব অর্থনীতিতে মহামারী আকারে করোনার প্রাদুর্ভাব প্রায় একযোগে এবং অর্থ, বিত্ত, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বাঘা বাঘা দেশ ও সমাজ কুপোকাত হওয়ায় বিপদে পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ সংকুচিত হইতেছে এবং পরস্পরের প্রতি আশা-ভরসা হারাইয়া যাইতেছে।

অস্বীকারের সুযোগ নাই এ যাবৎ প্রাদুর্ভাবিত ভাইরাসের মধ্যে করোনাই কঠোর, সিনিয়র এবং ক্রিটিকাল। এ মুহূর্তে ফেসবুক ও গুগল গংদের গণনায়, স্টাটাসে করোনাই বহুল ব্যবহারিত, উচ্চারিত শব্দ। সার্স, মার্স, এবোলা, বার্ড ফ্লু এরা ছিল আঞ্চলিক। তাদের বিস্তার ও বিপর্যয়- বিধ্বংসী ক্ষমতা এত দ্রুত বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি ও আক্রমণ শানাইতে পারেনি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ সফরের কর্ম পরিকল্পনা আছে করোনার। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক জীবনযাত্রায়, বাজার ব্যবস্থাপনা-অব্যবস্থাপনার কারণে কিছুদিন আগে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এমনকি পিয়াজের কারণে পাবলিক ফান্ড ও সাধারণ ভোক্তার পকেটের মানি লন্ডারড হইয়াছে। শোনা যাইতেছে ১৯৩১ সালের পর বিশ্ব পুঁজিবাজারে লাফালাফি বেশি বাড়িতেছে। চীনে চালু বিদেশি বন্ড ও কোম্পানির কাগজ (স্টক) ম্যানিপুলেট হইয়া চীনা বিনিয়োগকারীদের হাতে চলিয়া যাইতেছে। বোঝা যাইবে না কেন করোনার কারণে সবার স্বাস্থ্য খাতে যতটা না ঝুঁকি তৈরি হইবে তাহার চাইতে বড় বিপর্যয় ঘটিতে যাইতেছে ছোট ও মাঝারি খাতের আয়-ব্যয়, ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ-উৎপাদন, পর্যটন, পরিসম্পদ অবকাঠামো নির্মাণ তথা সামষ্টিক আর্থিক খাতে। দীর্ঘমেয়দি মন্দার দ্বার প্রান্তে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনা ইহাকে তাহার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার সাফল্য মনে করিতেছে।

তবে করোনা নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করিয়া বলিতেছে, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। নিরাময়ের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়। করোনার দ্বারা আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসার শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে তাহাকে প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হইল সংক্রামিত হওয়া হইতে প্রত্যেকের নিজেকে সুরক্ষা। সুতরাং আতঙ্কিত না হইয়া করোনা মোকাবিলায় নিজের দায়িত্ব হিসেবে পরামর্শমত নিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচলে পরিপালনে নিজের যেমন সুরক্ষা মিলিবে অন্যকেও তেমন সংক্রামিত হওয়া হইতে মুক্ত রাখিবার দায়িত্ব পালিত হইবে।’

করোনায় আক্রান্তদের নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নাই সত্য তবে আক্রান্ত হইলেও নিজে নিজে সারিয়া ওঠা সম্ভব। শুধু শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে বাহিত হয়ে ফুসফুসে ভাইরাস মারাত্মক সংক্রমণে নিউমোনিয়া প্রবল হইলে, অন্যান্য জটিল রোগ থাকিলে, বয়স্ক রোগীর চিকিৎসা বা নিরাময় কঠিন হইয়া দাঁড়াইতে পারে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হইয়াছেন কিনা তাহা নিজেই নিজের পরীক্ষা করিতে পারেন- লম্বা একটা শ্বাস লইয়া ১০ সেকেন্ড ধরিয়া রাখিতে হইবে। যদি এ সময়ের মাঝে কাহারও কাশি এবং বুকে ব্যথা অনুভব না হয় তাহা হইলে বুঝিতে হইবে তিনি সুস্থ আছেন। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের প্যাথলজি বিভাগ, বায়ু দূষণজনিত, সাধারণ ঠাণ্ডা, ফ্লু এবং করোনার লক্ষণ শনাক্তে উপসর্গ শ্রেণীবিন্যাস করিয়াছেন- (১) শুকনা কাশি+ হাঁচি= বায়ু দূষণের লক্ষণ (২) কাশি+গলা ব্যথা+হাঁচি+ নাক দিয়ে পানি আসা = সাধারণ ঠাণ্ডা (৩) কাশি+ গলা ব্যথা+ হাঁচি+ নাক দিয়ে পানি আসা+শরীর ব্যথা+ শারীরিক দুর্বলত বোধ+ হালকা জ্বর=ফ্লু (৪)শুকনা কাশি +হাঁচি+শরীর ব্যথা+গলা ব্যথা+ দুর্বলতা বোধ+ বেশি জ্বর+শ্বাসকষ্ট= করোনাভাইরাস। অ্যালকোহল মিশ্রিত জীবাণুনাশক, সাবান হাতে মাখিয়া লইলে করোনা নাই। করোনা গরম আবহাওয়া সহ্য করিতে পারে না। ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাহার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কাজেই ভালো না লাগিলেও এখন বেশি বেশি গরম পানি পান করিতে হইবে, আইসক্রিম হইতে দূরত্ব বজায় রাখিতে হইবে। লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়া গার্গল করিলে গলার মিউকাস পরিষ্কার হইবার সঙ্গে সঙ্গে টনসিলের জীবাণুসহ করোনা দূর হইবে ফুসফুসে সংক্রমিত হইতে পারিবে না। করোনায় আক্রান্ত হইয়াছেন জানিলে অন্তত ১৫ মিনিট পরপর পানি পান করিতে হইবে। মানে খাদ্যনালি ভেজা রাখিতে হইবে। নিয়মিত চা পানেও বিশেষ উপকার পাওয়া সম্ভব। ভাইরাসটি কোনভাবে মুখের ভেতর আসিলে উহা চা বা পানির সঙ্গে পাকস্থলীতে চলিয়া যাইবে। যাহা পাকস্থলীর এসিডে সহজেই মরিয়া যাইবে। আর, নাকে-মুখে আঙুল বা হাত দেয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে হইবে কারন, মানব শরীরে জীবাণু প্রবেশের সদর দরজা হইল নাক-মুখ-চোখ!’

সুতরাং এখনও সময় আছে, সম্ভাব্য সবাইকে শনাক্তকরণের পরীক্ষা পদ্ধতি প্রক্রিয়া সহজসাধ্য বা নাগালের মধ্যে আনা। আর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীকে উপযুক্ত পোশাকসহ ভাইরাস হইতে তাহাদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা, সরকারি ও ব্যক্তিখাত মিলিয়া সর্বদলীয় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং সামাজিক সেবা শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটিলে করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় সাফল্য মিলিবে।

[লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান]