‘কেউ নির্দেশনা মানছেন না’- প্রশ্ন- সেই জ্ঞান কি তাদের দেয়া হয়েছে?

এএন রাশেদা

কোভিড-১৯ বা ‘করোনাভাইরাস’ আজ বিশ্বব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, কবে কে শুনেছিল- বিশ্বব্যাপী এমন কথা? এলাকা ভিত্তিতে হয়েছিল প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিরা ট্রেঞ্চে অবস্থানকারী ফরাসি সৈন্যদের হত্যার জন্য মিউট্যান্ট (Mutant) ভাইরাস ব্যবহার করেছিল, এর ফলে ৬০ শতাংশ ফরাসি সৈন্য এবং বিশ্বের ২০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, আর সেই বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাহত সৈনিকরা আর একদিকে যখন টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করে একের পর এক মৃত্যুবরণ করছিল, সে সময়ে স্যার অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং গবেষণা করছিলেন ছত্রাক নিয়ে- যার নাম পেনিসিলিয়াম নোটেটাম (Penicillium notatum)। হাসপাতালে দেখতে এসে অনুমতি নিয়ে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে এক যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিকের ওপর তা প্রয়োগ করলেন। দেখা গেল সৈনিকটি সুস্থ হয়ে উঠল। সফল হলো টিটেনাসের বিরুদ্ধে মানুষের বিজয়। আর ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী এমনল ও ই রাস্কার ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর, ভাইরাস সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন বিস্তর। এভাবে একের পর এক আবিষ্কৃত হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী ভাইরাস। বর্তমানে তেমনি বিশ্বব্যাপী গবেষণা চলছে ‘নভেলা করোনা‘ বা কোভিড-১৯ কে পরাজিত করার কৌশল নিয়ে।

কোভিড-১৯ বা করোনার মাধ্যমে সংঘটিত বিপর্যয় নিয়ে বিশ্বের সব মাধ্যমগুলো দিন-রাত নানা খবর প্রচার করছে। তবে একটি ঘাটতি সব মিডিয়ায় আছে, তা হলো ভাইরাসটি কীভাবে শরীরে প্রবেশ করে সেখানে বংশবিস্তার করছে এবং রীতিমতো সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে- তার বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যগুলো যে সহজভাবে কার্টুনের আকারে তুলে ধরা যায়- তা কেউ করছে না। আমাদের দেশে কার্টুনিস্টদের তো অভাব নেই, তাহলে? বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীরা যে কম পড়াশোনা করছে, এটি তারই একটি প্রমাণ। যা হোক সব মিডিয়ায় করোনার সারা শরীরে কাঁটা সংবলিত ছবি দেখানো হয় এবং ছাপানো হয়। কিন্তু কিভাবে তা মানুষের দেহের ভেতরে প্রবেশ করে, তা দেখানো হয় না, কলেজ পর্যায়েই উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ভাইরাস সম্পর্কে পড়ানো হয়। সেখানে ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে যে ভাইরাস- তার সংখ্যাবৃদ্ধি বা বংশবৃদ্ধি আছে; সেই ভাইরাসটিকে বলা হয় ব্যাক্টেরিওফাজ।

করোনাভাইরাস ঘন ঘন পরিবর্তিত হচ্ছে, অর্থাৎ তার আরএনএর (RNA) মধ্যে যে অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, ইউরাসিন ও সাইটেসিন নামে নাইট্রোজেনাস বেস বা নাইট্রোজেনযুক্ত ক্ষার আছে- সংক্ষেপে বলা যায়, তারা স্থান পরিবর্তন করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘করোনাভাইরাসে’ তিন মাসে তিনশ’ বারের বেশি জিনের ধরন বদলেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে- জিন (Gene) কি? সহজভাবে সাধারণের জন্য বলা যায়- DNA-এর একাংশ বা বেশকিছু সংখ্যক নিউক্লিওটাইড, যাকে জিন (Gene) বলা যেতে পারে, যারা বংশাণুক্রমে জীবের বৈশিষ্ট্যকে বহন করে চলে। আর নিউক্লিওটাইড হলো DNA-এর একেকটি অংশ।

এ পর্যন্ত করোনার গঠন বর্ণনায় গবেষকরা যা বলছেন, তাতে প্রতীয়মান হয়- তার আচরণ ওই ব্যাক্টেরিওফাজের মতোই। ব্যাক্টেরিয়াফাজের দেহে একটি বেসপ্লেট আছে। ব্যাক্টেরিওফাজের লেজ আছে। করোনার বেলায় তা বলা হয়নি। সেখানে স্পাইক বা স্পর্শকতন্ত্র আছে- যা দিয়ে সে মনুষ্য দেহের যে কোন অংশে বসতে পারে। তারপর ধরে নিচ্ছি বেসপ্লেটে থাকা স্পাইক বা কাঁটা দিয়ে সে মনুষ্য দেহ ফুটো করে তার দেহের একমাত্র উপাদান RNA-কে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আর RNA অনবরত তার উপস্থিতি বাড়াতে থাকে বিভাজনের মাধ্যমে। মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ‘করোনা’কে পরাস্ত করতে পারলে- সে ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠেন। আর যে ব্যক্তি পারেন না, তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত হন খালি চোখে দেখতে না পাওয়া পরাক্রমশালী এ করোনার কাছে।

করোনাভাইরাসের বংশবৃদ্ধির কাল্পনিক চিত্রটি কার্টুনের মতো করে এঁকে গ্রাম, শহর, বন্দরে যদি দেখাতে পারা যায় সব চ্যানেল ও মিডিয়ার মাধ্যমে- তাহলেই মানুষ সচেতন হবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানে নির্দেশ না মানার যে প্রবণতা, তা অবশ্যই কমবে। যেখানে-সেখানে মাস্ক বা হ্যান্ড গ্লাভস ফেলে দেয়ার যে প্রবণতা তাও কমবে। বাড়িতে রুমাল বা লম্বা এক টুকরা কাপড় টিস্যু পেপার দিয়ে তিন ভাঁজ করেও নাক-মুখ ঢেকে মাথার পেছনে বাঁধা যায়। সেগুলো বাসায় সাবান দিয়ে ধুয়ে আবার ব্যবহার করলে রাস্তাঘাটে মাস্ক ফেলার প্রয়োজন পড়বে না।

এখন আসা যাক, ‘দূরত্ব’র কথায়। কথাটা হওয়া উচিত ছিল ‘শারীরিক দূরত্ব’। অথচ তাকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলে জনগণের কাছে দুর্বোধ্য করে ফেলা হয়েছে। যার ফলে কেউ- এক দেহ থেকে আরেক দেহের দূরত্ব রক্ষা করে চলার বিয়ষটি বুঝতে পারছেন না। তারপরও কথা আছে- আমরা রাস্তায় শারীরিক দূরত্ব পরিমাপ করছি কিন্তু দরিদ্র মানুষদের যে বাসস্থান বিভিন্ন বস্তি- সেখানে তারা কতটুকু দূরে দূরে অবস্থান করতে পারে? সে বিষয়টি উল্লেখ করছি না। এর পরিণাম ভালো হতে পারে না। এর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হচ্ছে যে, কাউকে নিচে ফেলে কারও শান্তি আসতে পারে না।

আর একটা কারণ হলো, সব কিছুকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দেয়া। সে কারণে যখন পথিমধ্যে একজন বালককে (গাড়ির হেল্পার) এক টিভি চ্যানেল থেকে জিজ্ঞেস করা হলো- ‘করোনাভাইরাস’ সম্পর্কে সে জানে কিনা?- সে নিঃশঙ্কচিত্তে তাৎক্ষণিক উত্তর দিল- ‘আমি আল্লায় বিশ্বাস করি, এসব মানি না।’ আর একজন সাদা পাঞ্জাবি, দাড়ি-টুপি পরিহিত বয়স্ক ব্যক্তি- ওই একই ধরনের উত্তর দিলেন- ‘আমরা মুসলমান, আমাদের কিছু হবে না।’ - এসব নানাবিধ কারণে মানুষ কোন বিধিনিষেধ মেনে চলতে চায় না। গত ১৪ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের দোতলায় এক ডাক্তারদের এক সংগঠন আয়োজিত সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেখানেও আমার প্রশ্নের জবাবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় কয়েকজন ডাক্তার এক সঙ্গেই বলে উঠেছিলেন- ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের এখানে কিছু হবে না।’ আমার প্রশ্ন ছিল- আপনারা পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলছেন- যারা মাটি কাটেন, বালু তোলেন, ময়লা পরিষ্কার করেন, ইটভাটায় কাজ করেন- তারা কিভাবে পরিচ্ছন্ন থাকবেন? সেই উত্তর তারা সমস্বরে একইভাবেই দিয়েছিলেন।

তাই পরিষ্কার করেই বলা যায়, অজ্ঞতা ও অদৃষ্টবাদিতা উভয়ই ‘করোনা’ সম্পর্কিত বিধিনিষেধ না মানার পক্ষে মানুষকে সাহস জোগায়। একজন শিক্ষিতজনের ভাষায়- ‘করোনা মানে কিছু নির্দেশনা, যা আমরা মেনে চলব।’ কাজ এবং খাদ্য উভয় অবশ্যই বড় সমস্যা।

সে কারণেই আমার মতো অনেকেরই উদ্বেগ- ‘করোনা’ কী এবং কিভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করে তা জনগণের কাছে সহজবোধ্য ভাবে ছবি সহকারে প্রচার করা দরকার। যা খুবই জরুরি। শুধু মৃত্যু গুণে গুণে তা সম্ভব হবে না। গত ১৫ এপ্রিলে দেখা গেল বহু ব্যক্তিগত গাড়ি একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশের ভাষ্য হলো- এক গাড়িতে ৪-৫ জন করে বসেছে। তাহলে দুই ফিট শারীরিক দূরত্ব মানা হলো কি? খুলনার মেয়রকেও দেখা গেছে আশপাশে শতাধিক ব্যক্তি নিয়ে ত্রাণ দিতে। এমন উদাহরণ অনেক, তাই সহজ পদ্ধতিতে বোধগম্য উপায়গুলোই পারে সাধারণ মানুষকে করোনার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে, শুধু নির্দেশনা দিয়েই তা সম্ভব হবে না। এবং হচ্ছেও না। দেশ আজ মহাসংকটে।

[পরিচিতি : সাবেক অধ্যাপক, জীববিজ্ঞান বিভাগ, নটর ডেম কলেজ। সম্পাদক শিক্ষাবার্তা]

সোমবার, ২০ এপ্রিল ২০২০ , ৭ বৈশাখ ১৪২৭, ২৫ শাবান ১৪৪১

‘কেউ নির্দেশনা মানছেন না’- প্রশ্ন- সেই জ্ঞান কি তাদের দেয়া হয়েছে?

এএন রাশেদা

image

কোভিড-১৯ বা ‘করোনাভাইরাস’ আজ বিশ্বব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, কবে কে শুনেছিল- বিশ্বব্যাপী এমন কথা? এলাকা ভিত্তিতে হয়েছিল প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিরা ট্রেঞ্চে অবস্থানকারী ফরাসি সৈন্যদের হত্যার জন্য মিউট্যান্ট (Mutant) ভাইরাস ব্যবহার করেছিল, এর ফলে ৬০ শতাংশ ফরাসি সৈন্য এবং বিশ্বের ২০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, আর সেই বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাহত সৈনিকরা আর একদিকে যখন টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করে একের পর এক মৃত্যুবরণ করছিল, সে সময়ে স্যার অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং গবেষণা করছিলেন ছত্রাক নিয়ে- যার নাম পেনিসিলিয়াম নোটেটাম (Penicillium notatum)। হাসপাতালে দেখতে এসে অনুমতি নিয়ে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে এক যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিকের ওপর তা প্রয়োগ করলেন। দেখা গেল সৈনিকটি সুস্থ হয়ে উঠল। সফল হলো টিটেনাসের বিরুদ্ধে মানুষের বিজয়। আর ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী এমনল ও ই রাস্কার ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর, ভাইরাস সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন বিস্তর। এভাবে একের পর এক আবিষ্কৃত হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী ভাইরাস। বর্তমানে তেমনি বিশ্বব্যাপী গবেষণা চলছে ‘নভেলা করোনা‘ বা কোভিড-১৯ কে পরাজিত করার কৌশল নিয়ে।

কোভিড-১৯ বা করোনার মাধ্যমে সংঘটিত বিপর্যয় নিয়ে বিশ্বের সব মাধ্যমগুলো দিন-রাত নানা খবর প্রচার করছে। তবে একটি ঘাটতি সব মিডিয়ায় আছে, তা হলো ভাইরাসটি কীভাবে শরীরে প্রবেশ করে সেখানে বংশবিস্তার করছে এবং রীতিমতো সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে- তার বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যগুলো যে সহজভাবে কার্টুনের আকারে তুলে ধরা যায়- তা কেউ করছে না। আমাদের দেশে কার্টুনিস্টদের তো অভাব নেই, তাহলে? বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীরা যে কম পড়াশোনা করছে, এটি তারই একটি প্রমাণ। যা হোক সব মিডিয়ায় করোনার সারা শরীরে কাঁটা সংবলিত ছবি দেখানো হয় এবং ছাপানো হয়। কিন্তু কিভাবে তা মানুষের দেহের ভেতরে প্রবেশ করে, তা দেখানো হয় না, কলেজ পর্যায়েই উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ভাইরাস সম্পর্কে পড়ানো হয়। সেখানে ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে যে ভাইরাস- তার সংখ্যাবৃদ্ধি বা বংশবৃদ্ধি আছে; সেই ভাইরাসটিকে বলা হয় ব্যাক্টেরিওফাজ।

করোনাভাইরাস ঘন ঘন পরিবর্তিত হচ্ছে, অর্থাৎ তার আরএনএর (RNA) মধ্যে যে অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, ইউরাসিন ও সাইটেসিন নামে নাইট্রোজেনাস বেস বা নাইট্রোজেনযুক্ত ক্ষার আছে- সংক্ষেপে বলা যায়, তারা স্থান পরিবর্তন করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘করোনাভাইরাসে’ তিন মাসে তিনশ’ বারের বেশি জিনের ধরন বদলেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে- জিন (Gene) কি? সহজভাবে সাধারণের জন্য বলা যায়- DNA-এর একাংশ বা বেশকিছু সংখ্যক নিউক্লিওটাইড, যাকে জিন (Gene) বলা যেতে পারে, যারা বংশাণুক্রমে জীবের বৈশিষ্ট্যকে বহন করে চলে। আর নিউক্লিওটাইড হলো DNA-এর একেকটি অংশ।

এ পর্যন্ত করোনার গঠন বর্ণনায় গবেষকরা যা বলছেন, তাতে প্রতীয়মান হয়- তার আচরণ ওই ব্যাক্টেরিওফাজের মতোই। ব্যাক্টেরিয়াফাজের দেহে একটি বেসপ্লেট আছে। ব্যাক্টেরিওফাজের লেজ আছে। করোনার বেলায় তা বলা হয়নি। সেখানে স্পাইক বা স্পর্শকতন্ত্র আছে- যা দিয়ে সে মনুষ্য দেহের যে কোন অংশে বসতে পারে। তারপর ধরে নিচ্ছি বেসপ্লেটে থাকা স্পাইক বা কাঁটা দিয়ে সে মনুষ্য দেহ ফুটো করে তার দেহের একমাত্র উপাদান RNA-কে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আর RNA অনবরত তার উপস্থিতি বাড়াতে থাকে বিভাজনের মাধ্যমে। মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ‘করোনা’কে পরাস্ত করতে পারলে- সে ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠেন। আর যে ব্যক্তি পারেন না, তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত হন খালি চোখে দেখতে না পাওয়া পরাক্রমশালী এ করোনার কাছে।

করোনাভাইরাসের বংশবৃদ্ধির কাল্পনিক চিত্রটি কার্টুনের মতো করে এঁকে গ্রাম, শহর, বন্দরে যদি দেখাতে পারা যায় সব চ্যানেল ও মিডিয়ার মাধ্যমে- তাহলেই মানুষ সচেতন হবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানে নির্দেশ না মানার যে প্রবণতা, তা অবশ্যই কমবে। যেখানে-সেখানে মাস্ক বা হ্যান্ড গ্লাভস ফেলে দেয়ার যে প্রবণতা তাও কমবে। বাড়িতে রুমাল বা লম্বা এক টুকরা কাপড় টিস্যু পেপার দিয়ে তিন ভাঁজ করেও নাক-মুখ ঢেকে মাথার পেছনে বাঁধা যায়। সেগুলো বাসায় সাবান দিয়ে ধুয়ে আবার ব্যবহার করলে রাস্তাঘাটে মাস্ক ফেলার প্রয়োজন পড়বে না।

এখন আসা যাক, ‘দূরত্ব’র কথায়। কথাটা হওয়া উচিত ছিল ‘শারীরিক দূরত্ব’। অথচ তাকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলে জনগণের কাছে দুর্বোধ্য করে ফেলা হয়েছে। যার ফলে কেউ- এক দেহ থেকে আরেক দেহের দূরত্ব রক্ষা করে চলার বিয়ষটি বুঝতে পারছেন না। তারপরও কথা আছে- আমরা রাস্তায় শারীরিক দূরত্ব পরিমাপ করছি কিন্তু দরিদ্র মানুষদের যে বাসস্থান বিভিন্ন বস্তি- সেখানে তারা কতটুকু দূরে দূরে অবস্থান করতে পারে? সে বিষয়টি উল্লেখ করছি না। এর পরিণাম ভালো হতে পারে না। এর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হচ্ছে যে, কাউকে নিচে ফেলে কারও শান্তি আসতে পারে না।

আর একটা কারণ হলো, সব কিছুকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দেয়া। সে কারণে যখন পথিমধ্যে একজন বালককে (গাড়ির হেল্পার) এক টিভি চ্যানেল থেকে জিজ্ঞেস করা হলো- ‘করোনাভাইরাস’ সম্পর্কে সে জানে কিনা?- সে নিঃশঙ্কচিত্তে তাৎক্ষণিক উত্তর দিল- ‘আমি আল্লায় বিশ্বাস করি, এসব মানি না।’ আর একজন সাদা পাঞ্জাবি, দাড়ি-টুপি পরিহিত বয়স্ক ব্যক্তি- ওই একই ধরনের উত্তর দিলেন- ‘আমরা মুসলমান, আমাদের কিছু হবে না।’ - এসব নানাবিধ কারণে মানুষ কোন বিধিনিষেধ মেনে চলতে চায় না। গত ১৪ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের দোতলায় এক ডাক্তারদের এক সংগঠন আয়োজিত সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেখানেও আমার প্রশ্নের জবাবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় কয়েকজন ডাক্তার এক সঙ্গেই বলে উঠেছিলেন- ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের এখানে কিছু হবে না।’ আমার প্রশ্ন ছিল- আপনারা পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলছেন- যারা মাটি কাটেন, বালু তোলেন, ময়লা পরিষ্কার করেন, ইটভাটায় কাজ করেন- তারা কিভাবে পরিচ্ছন্ন থাকবেন? সেই উত্তর তারা সমস্বরে একইভাবেই দিয়েছিলেন।

তাই পরিষ্কার করেই বলা যায়, অজ্ঞতা ও অদৃষ্টবাদিতা উভয়ই ‘করোনা’ সম্পর্কিত বিধিনিষেধ না মানার পক্ষে মানুষকে সাহস জোগায়। একজন শিক্ষিতজনের ভাষায়- ‘করোনা মানে কিছু নির্দেশনা, যা আমরা মেনে চলব।’ কাজ এবং খাদ্য উভয় অবশ্যই বড় সমস্যা।

সে কারণেই আমার মতো অনেকেরই উদ্বেগ- ‘করোনা’ কী এবং কিভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করে তা জনগণের কাছে সহজবোধ্য ভাবে ছবি সহকারে প্রচার করা দরকার। যা খুবই জরুরি। শুধু মৃত্যু গুণে গুণে তা সম্ভব হবে না। গত ১৫ এপ্রিলে দেখা গেল বহু ব্যক্তিগত গাড়ি একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশের ভাষ্য হলো- এক গাড়িতে ৪-৫ জন করে বসেছে। তাহলে দুই ফিট শারীরিক দূরত্ব মানা হলো কি? খুলনার মেয়রকেও দেখা গেছে আশপাশে শতাধিক ব্যক্তি নিয়ে ত্রাণ দিতে। এমন উদাহরণ অনেক, তাই সহজ পদ্ধতিতে বোধগম্য উপায়গুলোই পারে সাধারণ মানুষকে করোনার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে, শুধু নির্দেশনা দিয়েই তা সম্ভব হবে না। এবং হচ্ছেও না। দেশ আজ মহাসংকটে।

[পরিচিতি : সাবেক অধ্যাপক, জীববিজ্ঞান বিভাগ, নটর ডেম কলেজ। সম্পাদক শিক্ষাবার্তা]