করোনা সংক্রমণ

হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা ও উপকরণ ঘাটতি

‘বাড়ছে রোগী, ব্যাপক আকারে ছড়ালে সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা থাকবে না’

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ (কোভিড-১৯) রোগ নিরাময়ে হাসপাতালগুলোতে প্রায় সবধরনের চিকিৎসাসেবা ও উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। সংক্রমণ শনাক্তরণ পরীক্ষার ল্যাবরেটরি, জনবল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) এবং হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনের স্বল্পতাও তীব্র। এর ফলে করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসকরাই বেশি বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। রোগীর সেবা দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে আড়াই শতাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনও ঠিকমতো কাজ করছে না। তাছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতির ঘাটতি, স্বাস্থ্যখাতে চরম অব্যবস্থাপনা এবং মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দিনও ওই জেলায় ভেন্টিলেশন সুবিধা পাননি। তার পরিবার অনেক চেষ্টা করেও ভেন্টিলেশন সমৃদ্ধ সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাননি ঢাকার ফেরার জন্য।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে এটি মোকাবিলা করার সক্ষমতা আমাদের থাকবে না। আজ পর্যন্ত যে সংখ্যক রোগী আছে, তাদের চিকিৎসা দেয়া যাবে; এ সংখ্যা বাড়তে থাকলে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। হাসপাতালগুলো এখনও কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়নি। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), টেস্ট কিটও পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজন আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থাও আমাদের নেই।’

মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ বা বিশাল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে বাংলাদেশের হাসপাতালে জায়গা দেয়ার অবস্থা থাকবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিতে পারব না। এজন্য করোনা প্রতিরোধেই আমাদের সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বেশি বেশি টেস্ট ও রোগীকে আলাদা করা এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।’

আইইডিসিআরের হিসেবে, দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। আর গতকাল পর্যন্ত দেশে মাত্র ২৬ হাজার ৬০৪ জনের করোনাভাইরাসের টেস্ট করানো হয়। গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ২ হাজার ৯৪৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১০১ জনের এবং সুস্থ হয়েছেন মাত্র ৮৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার পিপিই কেনা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৭৬ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি পিপিইর দাম পরেছে প্রায় ১২শ’ টাকা। চড়া দামে এত বিপুল সংখ্যক পিপিই কেনা সত্ত্বেও এর সঙ্কট কেন- সেটা নিয়েই রয়েছে নানা প্রশ্ন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দু’জন চিকিৎসক সংবাদকে জানান, ‘সব হাসপাতালেই চিকিৎসকরা শিফটিং ডিউটি করেন। মনে করেন, একটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যদি ১৫ জন চিকিৎসক থাকেন; তাদের তিন শিফটে ডিউটি করলে প্রতিদিন ৪৫টি পিপিই প্রয়োজন হয়। পিপিই দু’বার ব্যবহারযোগ্য নয়। কিন্তু একটি হাসপাতালের অর্ধেক চিকিৎসকও পিপিই পাচ্ছেন না। আবার যেগুলো দেয়া হচ্ছে সেগুলোও ন্যূনতম মানসম্মত নয়।’

ওই দুই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য সচিব সম্প্রতি ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ‘এন-৯৫ মাস্ক শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়। এজন্য এটি কিনতে পাওয়া যায় না। আসলে এ তথ্য সঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের কমপক্ষে ১৫টি দেশে এন-৯৫ মাস্ক তৈরি হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশেও এটি বিতরণ করা হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশি দামে নিম্ন মানের মাস্ক বিদেশ থেকে আমদানি করছেন।’

সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের সদস্যসহ (স্বাচিপ) তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ সংগঠনের পক্ষ থেকে সারাদেশে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের তথ্য সংগ্রহ করছেন।

তিনি গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আমরা অনেক সময় পেয়েও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করিনি। হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করিনি। এখন করোনার প্রাদুর্ভাব পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রোগীর পাশাপাশি তাদের সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।’

তিনি জানান, ‘আজ (গতকাল) দুপুর পর্যন্ত সারাদেশে ১৭৩ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্সসহ এ সংখ্যা আরও বেশি। এরপরও অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের গাফিলতির অভিযোগ আনা হচ্ছে। এটা চিকিৎসকদের সঙ্গে নির্মম পরিহাস ছাড়া কিছুই না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ৬৫৪টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা রয়েছে ৪৩২টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩২২টি এবং বাকি ১১০টি সারাদেশে। এ ছাড়াও রেজিস্টার্ড প্রাইভেট হাসপাতাল আছে পাঁচ হাজার ৫৫টি। এগুলোতে আইসিইউ শয্যা (বেড) রয়েছে ৭৩৭টি। বেসরকারি আইসিইউ বেডের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪৯৪টি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বাকি ২৪৩টি।

কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় দেশের আট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে চার হাজার ৫১৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এগুলোয় আইসিইউ সুবিধা নেই। এমনকি এখন পর্যন্ত আইসিইউ সুবিধা স্থাপনের তৎপরতাও দেখা যায়নি।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাসপাতাল প্রস্তুত, সংক্রমণ শনাক্তরণ পরীক্ষার ল্যাবরেটরি প্রস্তুত, চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু গত ডিসেম্বর চীনের উহান প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর পর্যাপ্ত সময় পেয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। অথচ বার বার তারা করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার দাবি করেছেন।

স্বাচিপ নেতা ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত না করেই চিকিৎসকদের করোনাযুদ্ধে নামানো হয়েছে। ন্যূনতম যেসব সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হচ্ছে সেগুলোও মানসম্মত নয়।’

জানা গেছে, রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে। রাজধানীর ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালেও করোনাভাইরাসের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুর মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে রিজেন্ট হাসপাতাল উত্তরা ও মিরপুর, যাত্রাবাড়ীর সাজেদা ফাউন্ডেশন প্রস্তুত রাখার দাবি করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১০টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ৮টি, উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি, মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি এবং যাত্রাবাড়ীর সাজিদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৫টি ভেন্টিলেশন শয্যা। পাশাপাশি কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে অতিরিক্ত ১৬টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ৮টি ভেন্টিলেটর বসানোর কাজ চলছে।

নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর বাইরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতালেও শয্যা রাখতে বলা হয়েছে।

৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। গতকালও একজন রোগী মুগদায় ভর্তি হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এই হাসপাতালে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকলেও এগুলো পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনবল নেই হাসপাতালটিতে।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের দু’জন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। আসলে এটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নয়; এটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতেই। এখানে শুধুমাত্র সকালে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ সাধারণ কিছু রোগের মেডিকেল টেস্ট করা হয়। বিকেলে বা রাতে এখানে কোন রোগীর টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নেই। কোন রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে অক্সিজেন বা ভেন্টিলেশন দেয়ারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কিছুদিন আগে আইইডিসিআরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ আছে। যে প্রতিষ্ঠানে ১০টি আইসিইউ আছে, সেখানে আমরা তিনটি করোনা রোগের জন্য বরাদ্দ রাখতে বলেছি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৫০০ ভেন্টিলেটর মেশিন আছে। আরও সাড়ে ৩০০ আসছে। প্রাইভেট সেক্টরে ৭০০ ভেন্টিলেটর মেশিন আছে।

image

লকডাউন মানা হচ্ছে না, বাড়ছে ঝুঁকি। গতকাল রাজধানীর একটি বাজারের চিত্র -সংবাদ

আরও খবর
রমজান মাসেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন -ডব্লিউএইচও
২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করবে সরকার প্রধানমন্ত্রী
অ্যাপের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করা হবে
চব্বিশ ঘণ্টায় আরও ১০ জনসহ মৃত্যু শত পার
করোনা সংক্রমণ রোধে জরুরি নির্দেশনা
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি মোসলে উদ্দিন ভারতে গ্রেফতারের খবর
তিন শতাধিক ডাক্তার নার্স আক্রান্ত
পিপিই সংগ্রহে ১৭৬ কোটি টাকা খরচ
ভারতে আটক ১৬৪ বাংলাদেশিকে আনা হয়েছে
ডাক্তার ও নার্সদের আলাদা আবাসনের জন্য ডিসিদের নির্দেশ
লকডাউনে সীতাকুণ্ডে বেসরকারি কল-কারখানা চালু নিরুপম দাশ গুপ্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সারাদেশে চলছে লকডাউন
এসকে হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল

মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল ২০২০ , ৮ বৈশাখ ১৪২৭, ২৬ শাবান ১৪৪১

করোনা সংক্রমণ

হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা ও উপকরণ ঘাটতি

‘বাড়ছে রোগী, ব্যাপক আকারে ছড়ালে সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা থাকবে না’

রাকিব উদ্দিন

image

লকডাউন মানা হচ্ছে না, বাড়ছে ঝুঁকি। গতকাল রাজধানীর একটি বাজারের চিত্র -সংবাদ

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ (কোভিড-১৯) রোগ নিরাময়ে হাসপাতালগুলোতে প্রায় সবধরনের চিকিৎসাসেবা ও উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। সংক্রমণ শনাক্তরণ পরীক্ষার ল্যাবরেটরি, জনবল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) এবং হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনের স্বল্পতাও তীব্র। এর ফলে করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসকরাই বেশি বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। রোগীর সেবা দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে আড়াই শতাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনও ঠিকমতো কাজ করছে না। তাছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতির ঘাটতি, স্বাস্থ্যখাতে চরম অব্যবস্থাপনা এবং মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দিনও ওই জেলায় ভেন্টিলেশন সুবিধা পাননি। তার পরিবার অনেক চেষ্টা করেও ভেন্টিলেশন সমৃদ্ধ সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাননি ঢাকার ফেরার জন্য।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে এটি মোকাবিলা করার সক্ষমতা আমাদের থাকবে না। আজ পর্যন্ত যে সংখ্যক রোগী আছে, তাদের চিকিৎসা দেয়া যাবে; এ সংখ্যা বাড়তে থাকলে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। হাসপাতালগুলো এখনও কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়নি। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), টেস্ট কিটও পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজন আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থাও আমাদের নেই।’

মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ বা বিশাল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে বাংলাদেশের হাসপাতালে জায়গা দেয়ার অবস্থা থাকবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিতে পারব না। এজন্য করোনা প্রতিরোধেই আমাদের সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বেশি বেশি টেস্ট ও রোগীকে আলাদা করা এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।’

আইইডিসিআরের হিসেবে, দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। আর গতকাল পর্যন্ত দেশে মাত্র ২৬ হাজার ৬০৪ জনের করোনাভাইরাসের টেস্ট করানো হয়। গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ২ হাজার ৯৪৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১০১ জনের এবং সুস্থ হয়েছেন মাত্র ৮৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার পিপিই কেনা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৭৬ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি পিপিইর দাম পরেছে প্রায় ১২শ’ টাকা। চড়া দামে এত বিপুল সংখ্যক পিপিই কেনা সত্ত্বেও এর সঙ্কট কেন- সেটা নিয়েই রয়েছে নানা প্রশ্ন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দু’জন চিকিৎসক সংবাদকে জানান, ‘সব হাসপাতালেই চিকিৎসকরা শিফটিং ডিউটি করেন। মনে করেন, একটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যদি ১৫ জন চিকিৎসক থাকেন; তাদের তিন শিফটে ডিউটি করলে প্রতিদিন ৪৫টি পিপিই প্রয়োজন হয়। পিপিই দু’বার ব্যবহারযোগ্য নয়। কিন্তু একটি হাসপাতালের অর্ধেক চিকিৎসকও পিপিই পাচ্ছেন না। আবার যেগুলো দেয়া হচ্ছে সেগুলোও ন্যূনতম মানসম্মত নয়।’

ওই দুই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য সচিব সম্প্রতি ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ‘এন-৯৫ মাস্ক শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়। এজন্য এটি কিনতে পাওয়া যায় না। আসলে এ তথ্য সঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের কমপক্ষে ১৫টি দেশে এন-৯৫ মাস্ক তৈরি হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশেও এটি বিতরণ করা হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশি দামে নিম্ন মানের মাস্ক বিদেশ থেকে আমদানি করছেন।’

সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের সদস্যসহ (স্বাচিপ) তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ সংগঠনের পক্ষ থেকে সারাদেশে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের তথ্য সংগ্রহ করছেন।

তিনি গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আমরা অনেক সময় পেয়েও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করিনি। হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করিনি। এখন করোনার প্রাদুর্ভাব পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রোগীর পাশাপাশি তাদের সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।’

তিনি জানান, ‘আজ (গতকাল) দুপুর পর্যন্ত সারাদেশে ১৭৩ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্সসহ এ সংখ্যা আরও বেশি। এরপরও অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের গাফিলতির অভিযোগ আনা হচ্ছে। এটা চিকিৎসকদের সঙ্গে নির্মম পরিহাস ছাড়া কিছুই না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ৬৫৪টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা রয়েছে ৪৩২টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩২২টি এবং বাকি ১১০টি সারাদেশে। এ ছাড়াও রেজিস্টার্ড প্রাইভেট হাসপাতাল আছে পাঁচ হাজার ৫৫টি। এগুলোতে আইসিইউ শয্যা (বেড) রয়েছে ৭৩৭টি। বেসরকারি আইসিইউ বেডের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪৯৪টি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বাকি ২৪৩টি।

কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় দেশের আট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে চার হাজার ৫১৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এগুলোয় আইসিইউ সুবিধা নেই। এমনকি এখন পর্যন্ত আইসিইউ সুবিধা স্থাপনের তৎপরতাও দেখা যায়নি।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাসপাতাল প্রস্তুত, সংক্রমণ শনাক্তরণ পরীক্ষার ল্যাবরেটরি প্রস্তুত, চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু গত ডিসেম্বর চীনের উহান প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর পর্যাপ্ত সময় পেয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। অথচ বার বার তারা করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার দাবি করেছেন।

স্বাচিপ নেতা ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত না করেই চিকিৎসকদের করোনাযুদ্ধে নামানো হয়েছে। ন্যূনতম যেসব সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হচ্ছে সেগুলোও মানসম্মত নয়।’

জানা গেছে, রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে। রাজধানীর ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালেও করোনাভাইরাসের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুর মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে রিজেন্ট হাসপাতাল উত্তরা ও মিরপুর, যাত্রাবাড়ীর সাজেদা ফাউন্ডেশন প্রস্তুত রাখার দাবি করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১০টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ৮টি, উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি, মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি এবং যাত্রাবাড়ীর সাজিদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৫টি ভেন্টিলেশন শয্যা। পাশাপাশি কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে অতিরিক্ত ১৬টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ৮টি ভেন্টিলেটর বসানোর কাজ চলছে।

নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর বাইরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতালেও শয্যা রাখতে বলা হয়েছে।

৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। গতকালও একজন রোগী মুগদায় ভর্তি হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এই হাসপাতালে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকলেও এগুলো পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনবল নেই হাসপাতালটিতে।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের দু’জন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। আসলে এটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নয়; এটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতেই। এখানে শুধুমাত্র সকালে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ সাধারণ কিছু রোগের মেডিকেল টেস্ট করা হয়। বিকেলে বা রাতে এখানে কোন রোগীর টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নেই। কোন রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে অক্সিজেন বা ভেন্টিলেশন দেয়ারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কিছুদিন আগে আইইডিসিআরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ আছে। যে প্রতিষ্ঠানে ১০টি আইসিইউ আছে, সেখানে আমরা তিনটি করোনা রোগের জন্য বরাদ্দ রাখতে বলেছি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৫০০ ভেন্টিলেটর মেশিন আছে। আরও সাড়ে ৩০০ আসছে। প্রাইভেট সেক্টরে ৭০০ ভেন্টিলেটর মেশিন আছে।