হাওরের ফসল রক্ষায় কৃষকের পাশে দাঁড়ানো জরুরি

আকাশ চৌধুরী

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্যের মতো এই কৃষি ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষের ঘুম এখন হারাম হয়ে গেছে। সবারই জানা, ভাটিবাংলা মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ক্ষেতের ধান। আর সেই ধান কাটার মৌসুম এখন চলমান। একটা সময় ছিল বেপারীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ধান কাটতো। তবে যুগের পরিবর্তনে দিন দিন তা হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ শহরমুখী হওয়ায় এখন আগের মতো আর বেপারী পাওয়া যায় না। বেশিরভাগে নিজ এলাকার মানুষই ধান কেটে ঘরে তুলছে। তবে হাওরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রতি বছরই ধান কাটা নিয়ে শঙ্কা কাজ করে। কারণ তাদের বছরের একটি ফসলই অকাল বন্যায় পানিতে ভেসে যায়।

নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর সরকার এই জেলাগুলোর হাওর রক্ষায় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। অকাল বন্যায় যাতে পানিতে ফসল ভেসে না যায় সেজন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। তারপরও এই জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যা সংঘটিত হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০০, ২০০২, ২০০৪, ২০১০, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে আকস্মিক বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সাল ছাড়া অন্যসব বছরে আকস্মিক বন্যা হয়েছে এপ্রিল মাসে। ২০১৭ সালে আগাম বন্যা হয়েছে মার্চ মাসে। ১১ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তরের উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত এক লেখা থেকে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় হাওরাঞ্চলে এসব আকস্মিক বন্যার যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. হাওরের পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা; খ. ধানচাষি ও মাছ উৎপাদনকারীদের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বন্দ্ব; গ. সঠিক সময়ে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত না হওয়া; ঘ. সুশাসন সম্পর্কিত সমস্যা ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় উল্লেখিত যে কারণগুলো চিহ্নিত করেছে তা শতভাগ সত্যি বলে ধরে নেয়া যায়। বিগত দিনগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে এসব কারণেই আকস্মিক বন্যা হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি সঠিক সময় বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় হাওরে পানি ঢুকেছে বলেও কৃষকদের অভিযোগ রয়েছে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের গাফিলতির বিষয়টিও সবসময় আলোচনায় এসেছে। এদের নামে মামলাও হয়েছে। তবে সেগুলোর সঠিক তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় এরা বরাবরই এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তবে এবারের বিষয়টি ভিন্ন।

করোনা ভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে রোগটির কারণে গোটা বিশ্ব এখন স্থবির। উন্নত দেশগুলোতেও ভেঙে পড়ছে অর্থনীতির কাঠামো। আমাদের মতো দরিদ্র একটি দেশে তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য মজুদ রয়েছে। সরকার থেকে শহর-গ্রাম প্রত্যেক স্থানে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এটাই তো সমাধান নয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ২০১৯-২০ অর্থবছরের বোরো ধানসহ অন্যান্য রবি ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এতে চলতি অর্থবছরে দেশে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন। তবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা দেখছে। সংস্থাটি এজন্য একাধিকবার সতর্কবার্তা জারি করেছে। সম্প্রতি জারিকৃত সতর্কবার্তায় সংস্থাটি বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের এক প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। ফলে এ দেশের ধান সঠিকভাবে উৎপাদন করা জরুরি।

গত ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, সরকার কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বোরো ফসল উঠবে। কৃষক যেন সঠিক মূল্য পায়, বিষয়টি লক্ষ্য রেখে খাদ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি ধান-চাল ক্রয় করবে। অর্থাৎ দুই লাখ টন চাল বেশি ক্রয় করবে- সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি নিজেরা উৎপাদন ঠিক রাখি, তাহলে এই সংকট মোকাবেলা করতে পারব। এজন্য আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে, যাতে আমার দেশের মানুষ কষ্ট না পায়।’ হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রীর এ কথার বাস্তবায়ন তখনই হবে যখন কৃষক হাওর থেকে ঠিকমতো ফসল ঘরে তুলতে পারবে। আগাম বন্যার আগেই ধান কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে কৃষকের ফসল। আর এজন্য সবার সহযোগিতা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

[লেখক : সাংবাদিক]

মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল ২০২০ , ৮ বৈশাখ ১৪২৭, ২৬ শাবান ১৪৪১

হাওরের ফসল রক্ষায় কৃষকের পাশে দাঁড়ানো জরুরি

আকাশ চৌধুরী

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্যের মতো এই কৃষি ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষের ঘুম এখন হারাম হয়ে গেছে। সবারই জানা, ভাটিবাংলা মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ক্ষেতের ধান। আর সেই ধান কাটার মৌসুম এখন চলমান। একটা সময় ছিল বেপারীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ধান কাটতো। তবে যুগের পরিবর্তনে দিন দিন তা হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ শহরমুখী হওয়ায় এখন আগের মতো আর বেপারী পাওয়া যায় না। বেশিরভাগে নিজ এলাকার মানুষই ধান কেটে ঘরে তুলছে। তবে হাওরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রতি বছরই ধান কাটা নিয়ে শঙ্কা কাজ করে। কারণ তাদের বছরের একটি ফসলই অকাল বন্যায় পানিতে ভেসে যায়।

নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর সরকার এই জেলাগুলোর হাওর রক্ষায় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। অকাল বন্যায় যাতে পানিতে ফসল ভেসে না যায় সেজন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। তারপরও এই জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যা সংঘটিত হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০০, ২০০২, ২০০৪, ২০১০, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে আকস্মিক বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সাল ছাড়া অন্যসব বছরে আকস্মিক বন্যা হয়েছে এপ্রিল মাসে। ২০১৭ সালে আগাম বন্যা হয়েছে মার্চ মাসে। ১১ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তরের উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত এক লেখা থেকে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় হাওরাঞ্চলে এসব আকস্মিক বন্যার যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. হাওরের পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা; খ. ধানচাষি ও মাছ উৎপাদনকারীদের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বন্দ্ব; গ. সঠিক সময়ে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত না হওয়া; ঘ. সুশাসন সম্পর্কিত সমস্যা ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় উল্লেখিত যে কারণগুলো চিহ্নিত করেছে তা শতভাগ সত্যি বলে ধরে নেয়া যায়। বিগত দিনগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে এসব কারণেই আকস্মিক বন্যা হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি সঠিক সময় বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় হাওরে পানি ঢুকেছে বলেও কৃষকদের অভিযোগ রয়েছে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের গাফিলতির বিষয়টিও সবসময় আলোচনায় এসেছে। এদের নামে মামলাও হয়েছে। তবে সেগুলোর সঠিক তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় এরা বরাবরই এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তবে এবারের বিষয়টি ভিন্ন।

করোনা ভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে রোগটির কারণে গোটা বিশ্ব এখন স্থবির। উন্নত দেশগুলোতেও ভেঙে পড়ছে অর্থনীতির কাঠামো। আমাদের মতো দরিদ্র একটি দেশে তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য মজুদ রয়েছে। সরকার থেকে শহর-গ্রাম প্রত্যেক স্থানে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এটাই তো সমাধান নয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ২০১৯-২০ অর্থবছরের বোরো ধানসহ অন্যান্য রবি ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এতে চলতি অর্থবছরে দেশে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন। তবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা দেখছে। সংস্থাটি এজন্য একাধিকবার সতর্কবার্তা জারি করেছে। সম্প্রতি জারিকৃত সতর্কবার্তায় সংস্থাটি বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের এক প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। ফলে এ দেশের ধান সঠিকভাবে উৎপাদন করা জরুরি।

গত ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, সরকার কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বোরো ফসল উঠবে। কৃষক যেন সঠিক মূল্য পায়, বিষয়টি লক্ষ্য রেখে খাদ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি ধান-চাল ক্রয় করবে। অর্থাৎ দুই লাখ টন চাল বেশি ক্রয় করবে- সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি নিজেরা উৎপাদন ঠিক রাখি, তাহলে এই সংকট মোকাবেলা করতে পারব। এজন্য আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে, যাতে আমার দেশের মানুষ কষ্ট না পায়।’ হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রীর এ কথার বাস্তবায়ন তখনই হবে যখন কৃষক হাওর থেকে ঠিকমতো ফসল ঘরে তুলতে পারবে। আগাম বন্যার আগেই ধান কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে কৃষকের ফসল। আর এজন্য সবার সহযোগিতা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

[লেখক : সাংবাদিক]