শিল্পকারখানা চালু কিংবা বন্ধ রাখার ব্যাপারে দ্বিচারিতা কাম্য নয়

কারখানা বন্ধ বা লে-অফ ঘোষণা করলে প্রণোদনা পাবেন না তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। এ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে সাফ জানিয়ে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, প্রণোদনার অর্থ সচল কারখানাগুলো পাবে। কোনো বন্ধ ঘোষিত কারখানাকে প্রণোদনার অর্থ দেয়া যাবে না। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে এসব নির্দেশনা দিয়ে রোববার (১৯ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা সার্বিক অর্থেই দ্বিচারিতার শামিল। করোনা সংক্রমণের কবল থেকে রেহাই পেতে সরকারিভাবে একদিকে বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে, লকডাউন মেনে চলতে হবে, সবাইকে ঘরে থাকতে হবে অন্যদিকে কারখানা মালিকদের বলা হচ্ছে, কারখানা বন্ধ করলে সরকারি সুবিধা পাওয়া যাবে না। কারখানা বন্ধ রাখার কারণে প্রণোদনা না দেয়ার কথাটি যখনই নির্দেশিত হয় তখনই মালিকদের তাগিদ থাকে কারখানা চালু রাখার, শ্রমিকদের জোর করে কাজে আনার। তাহলে জনগণকে ঘরের বাইরে না যাওয়ার সরকারি নির্দেশনার অর্থ কি? অনর্থক এ কথা বলারই বা দরকার কি? যদি শ্রমিকদের ঘরের বাইরে বের করার ইচ্ছা অর্থ মন্ত্রণালয়ের থাকে তবে তো লকডাউনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। শ্রমিকদের ঘরের বাইরে বের করে এনে যেমন তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হবে তেমনি তাদের মাধ্যমে গোটা দেশেও সংক্রমণ ছড়াবে। সেক্ষেত্রে শুধু শ্রমিক কেন, সবাইকে ঘর থেকে বের হওয়ায় লাইসেন্স দেয়া হোক। জনস্বাস্থ্য এবং মৃত্যুঝুঁকির চেয়ে যখন অর্থনীতির স্বাস্থ্য ঠিক রাখাটাই বড় বলে মনে করা হয় তখন মহামারীর ভয় করার দরকার কি? ভয় আর আশঙ্কাকেই ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিতে হবে।

একটি সহযোগী গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেও সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও খুলনার ৯৮ পোশাক ও বস্ত্রকল উৎপাদন চালিয়েছে।

সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও খুলনায় ৭ হাজার ৬০২টি শিল্পকারখানার মধ্যে ৫২২টি সোমবার উৎপাদন চালিয়েছে। বন্ধ ছিল ৭ হাজার ৮০টি শিল্প কারখানা।

সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের আটটি জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন। সে সময় গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামছুন্নাহার বলেন, অনেক পোশাক কারখানা মালিক পিপিই বানানোর জন্য শ্রমিকদের ডেকে এনে অন্য পণ্য তৈরি করাচ্ছে। কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি না মানছে না। অন্যদিকে শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানা চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালানোর কোন উপায় নেই। কেননা কারখানার মেশিনগুলো পাশাপাশি বা লাগোয়া অবস্থায় থাকে। কাজেই কোনভাবেই শ্রমিকদের পক্ষে তিন বা ছয় ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। অর্থাৎ শিল্প মালিকদের এসব কথার মূল উদ্দেশ্যই হলো, ব্যক্তিস্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতেও কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখা। আর এখন অবস্থাদৃশ্যে মনে হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয়েরও উদ্দেশ্য, ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিটা আরও বাড়–ক; অল্প কিছু নয়, বরং সব কারখানাই চালু রাখা হোক।

আমরা মনে করি, সরকারকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, শিল্পকারখানার ব্যাপারে প্রকৃত অর্থে কি করা উচিত। তারা যদি বলে কারখানা চালু রাখতে হবে তাহলে লকডাউন থাকবে না, সামাজিক দূরত্ব থাকবে না। আর যদি লকডাউনটাকে কার্যকর রাখতে চায়, তাহলে সবকিছুই বন্ধ রাখতে হবে। প্রণোদনার ক্ষেত্রে কোনরকম শর্ত আরোপ করা যাবে না। যেটাই করা হোক, সিদ্ধান্তে যেন গরমিল না হয়। কি করা হবে সেটা নীতিনির্ধারকদের স্পষ্ট করতে হবে। এবং সে অনুযায়ী সংকট মোকাবিলা করতে হবে। একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিলে সংকট বাড়বে, কোনকিছুই আর সামাল দেয়া যাবে না।

বুধবার, ২২ এপ্রিল ২০২০ , ৯ বৈশাখ ১৪২৭, ২৭ শাবান ১৪৪১

শিল্পকারখানা চালু কিংবা বন্ধ রাখার ব্যাপারে দ্বিচারিতা কাম্য নয়

কারখানা বন্ধ বা লে-অফ ঘোষণা করলে প্রণোদনা পাবেন না তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। এ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে সাফ জানিয়ে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, প্রণোদনার অর্থ সচল কারখানাগুলো পাবে। কোনো বন্ধ ঘোষিত কারখানাকে প্রণোদনার অর্থ দেয়া যাবে না। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে এসব নির্দেশনা দিয়ে রোববার (১৯ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা সার্বিক অর্থেই দ্বিচারিতার শামিল। করোনা সংক্রমণের কবল থেকে রেহাই পেতে সরকারিভাবে একদিকে বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে, লকডাউন মেনে চলতে হবে, সবাইকে ঘরে থাকতে হবে অন্যদিকে কারখানা মালিকদের বলা হচ্ছে, কারখানা বন্ধ করলে সরকারি সুবিধা পাওয়া যাবে না। কারখানা বন্ধ রাখার কারণে প্রণোদনা না দেয়ার কথাটি যখনই নির্দেশিত হয় তখনই মালিকদের তাগিদ থাকে কারখানা চালু রাখার, শ্রমিকদের জোর করে কাজে আনার। তাহলে জনগণকে ঘরের বাইরে না যাওয়ার সরকারি নির্দেশনার অর্থ কি? অনর্থক এ কথা বলারই বা দরকার কি? যদি শ্রমিকদের ঘরের বাইরে বের করার ইচ্ছা অর্থ মন্ত্রণালয়ের থাকে তবে তো লকডাউনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। শ্রমিকদের ঘরের বাইরে বের করে এনে যেমন তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হবে তেমনি তাদের মাধ্যমে গোটা দেশেও সংক্রমণ ছড়াবে। সেক্ষেত্রে শুধু শ্রমিক কেন, সবাইকে ঘর থেকে বের হওয়ায় লাইসেন্স দেয়া হোক। জনস্বাস্থ্য এবং মৃত্যুঝুঁকির চেয়ে যখন অর্থনীতির স্বাস্থ্য ঠিক রাখাটাই বড় বলে মনে করা হয় তখন মহামারীর ভয় করার দরকার কি? ভয় আর আশঙ্কাকেই ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিতে হবে।

একটি সহযোগী গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেও সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও খুলনার ৯৮ পোশাক ও বস্ত্রকল উৎপাদন চালিয়েছে।

সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও খুলনায় ৭ হাজার ৬০২টি শিল্পকারখানার মধ্যে ৫২২টি সোমবার উৎপাদন চালিয়েছে। বন্ধ ছিল ৭ হাজার ৮০টি শিল্প কারখানা।

সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের আটটি জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন। সে সময় গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামছুন্নাহার বলেন, অনেক পোশাক কারখানা মালিক পিপিই বানানোর জন্য শ্রমিকদের ডেকে এনে অন্য পণ্য তৈরি করাচ্ছে। কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি না মানছে না। অন্যদিকে শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানা চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালানোর কোন উপায় নেই। কেননা কারখানার মেশিনগুলো পাশাপাশি বা লাগোয়া অবস্থায় থাকে। কাজেই কোনভাবেই শ্রমিকদের পক্ষে তিন বা ছয় ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। অর্থাৎ শিল্প মালিকদের এসব কথার মূল উদ্দেশ্যই হলো, ব্যক্তিস্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতেও কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখা। আর এখন অবস্থাদৃশ্যে মনে হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয়েরও উদ্দেশ্য, ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিটা আরও বাড়–ক; অল্প কিছু নয়, বরং সব কারখানাই চালু রাখা হোক।

আমরা মনে করি, সরকারকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, শিল্পকারখানার ব্যাপারে প্রকৃত অর্থে কি করা উচিত। তারা যদি বলে কারখানা চালু রাখতে হবে তাহলে লকডাউন থাকবে না, সামাজিক দূরত্ব থাকবে না। আর যদি লকডাউনটাকে কার্যকর রাখতে চায়, তাহলে সবকিছুই বন্ধ রাখতে হবে। প্রণোদনার ক্ষেত্রে কোনরকম শর্ত আরোপ করা যাবে না। যেটাই করা হোক, সিদ্ধান্তে যেন গরমিল না হয়। কি করা হবে সেটা নীতিনির্ধারকদের স্পষ্ট করতে হবে। এবং সে অনুযায়ী সংকট মোকাবিলা করতে হবে। একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিলে সংকট বাড়বে, কোনকিছুই আর সামাল দেয়া যাবে না।