‘করোনাকালীন’ রাজনীতি : কিছু পর্যবেক্ষণ, কিছু মন্তব্য

শামছুজ্জামান সেলিম

অদ্ভুত এক দানবের সঙ্গে মানব জাতি লড়াই করছে, যাকে চোখে দেখা যায় না। এ দানবের নাম ‘কোভিড-১৯’, অর্থাৎ ‘করোনাভাইরাস’। মানব ইতিহাসে এ জাতীয় মহামারীর কথা কখনও শোনা যায়নি। খুব দ্রুতই ‘কোভিড-১৯’ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেল। পৃথিবীতে অতীতে ভয়ংকর সব মহামারী হয়েছে। এসব মহামারীতে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু ওই সব মহামারী অতি দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েনি এবং এমন ভয়ানক ছোঁয়াছে ছিল না। ১৯১৮ সালে ‘স্প্যানিস ফ্লু’ তে পাঁচ কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছিল ইউরোপে। ‘করোনায়’ অদ্যাবধি পৃথিবীব্যাপী লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিদিন পৃথিবীব্যাপী হাজার হাজার মানুষের দেহে ‘করোনা’ সংক্রমিত হচ্ছে। ‘করোনা’ আক্রমণের যে তীব্রতা তাতে এ বিপদ থেকে বিশ্ববাসী কবে মুক্ত হবে তা বলা একেবারেই অসম্ভব। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞরা যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন তা মেনে চলা জরুরি কর্তব্য হিসেবে গণ্য করতে হবে।

বিশ্ববাসী যখন জীবন-মৃত্যু নিয়ে আতঙ্কিত তখন ট্রাম্প ‘করোনা’ নিয়ে জবরদস্ত রাজনীতি শুরু করেছেন। ট্রাম্পের দেশ আমেরিকা বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর দেশ, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ঠিক সে সময় বিশ্ববাসী দেখছে আমেরিকা ‘করোনার’ কাছে বড়ই অসহায়, ‘করোনাকে’ থামানোর ক্ষমতা তার নেই। অপরদিকে চীন ‘করোনাকে’ ঠিকমতো মোকাবিলা করে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমে ট্রাম্প বললেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে, এ অভিযোগে আমেরিকা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার চাঁদা বন্ধ করে দিল। হোয়াইট হাউজের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলে ফেললেন শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন ‘করোনার’ প্রতি মনোযোগ দেয়নি। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আর যায় কোথায় ঐ কর্মকর্তাকে তড়িঘড়ি বরখাস্ত করা হলো। এখন আবার ট্রাম্প বলছে চীনের ল্যাবটরি থেকে ‘করোনা’ ছড়িয়েছে। তদন্ত করা হোক। তদন্ত দলে আমেরিকার প্রতিনিধি দেয়া হবে। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রকৃত ঘটনাটা কি? বিশ্বের লুটপাটের অর্থনীতি এবং রাজনীতির পালের গোদা ট্রাম্প লুটপাট অটুট ও নিরবচ্ছিন্ন রাখার প্রয়োজনে সামরিক খাতসহ যে সব খাতে বরাদ্দ দেয়া অব্যাহত রাখা দরকার সেখানেই মনোযোগ দিয়েছে। দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন এবং পরিকাঠামোর মান উন্নত করার কোনো দায় ট্রাম্প এবং ট্রাম্প প্রশাসনের নেই। ‘করোনা’ হামলা ওদের স্বাস্থ্য পরিসেবা খাতের অবহেলা অদক্ষতা উলঙ্গ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত¦হীনতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই অপরাধ আড়াল করার জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চীনের বিরুদ্ধে প্রচার যুদ্ধে নেমেছে ট্রাম্প কোম্পানি।

আর একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত করেছে ‘করোনা’। আজকের বিশ্বে লুটেরা পুঁজিবাদ মুনাফার জন্যে সবকিছু করবে, মানুষের জন্যে নয়। ট্রাম্পের প্রশাসনের আর একটা অমানবিক দিক হলো, আফ্রিকান-আমেরিকান, হিসপানিক এবং এশিয়ানসহ কালো মানুষদের ওরা মানুষ মনে করে না। আমেরিকাসহ সমগ্র ইউরোপের ‘করোনা’ পরিস্থিতি বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রকৃত সত্য ঘোষণা করছে অনবরত। অপরদিকে চীন কিউবা ভিয়েতনাম প্রমাণ করছে ‘জনগণের রাষ্ট্র’ কেমন এবং কি ধরনের হতে হয়। এ ভূমিতে ‘মানুষ মানুষের জন্যে’।

‘লুটেরা চেতনার এলিমেন্ট’ কখনোই ভাবতে পারে না ‘মানুষ মানুষের জন্যে’। এ সত্যটা এখন আমাদের দেশে আমরা প্রতিদিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ‘করোনা’ প্রতিরোধে লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব কার্যকর করা খুবই জরুরি। এর ফলে সারা দেশে কয়েক কোটি শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। তারা ক্ষুধার্ত, তাদের ঘরে খাবার নেই। রাষ্ট্রের উদ্যোগে এ সব মানুষের জন্যে চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এই চাল চুরি হওয়ার খবর প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এই চাল বিতরণের দায়িত্ব কাদের হাতে এবং কারা এই চাল বিতরণ করছে এবং চুরি করছে? এর উত্তর এ দেশের জনগণ জানে। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু রাগে-দুঃখে বলেছিলেন, ‘... আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমার বাবা কম্বল চোরদের ক্ষমা করেছিলেন, আমি চাল চোরদের ক্ষমা করব না।’ চাল চোরদের ধরার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন খবরে বলা হচ্ছে চাল চোরদের পরিচয়। ‘চেতনায় লুটপাট থাকলে’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই বা কি করবেন!

‘চেতনায় দেশপ্রেম এবং মানুষ’ থাকলে একজন রাজনৈতিক কর্মীর আচরণ কেমন হয় তার প্রমাণ দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পাশাপাশি যুব ইউনিয়ন। দরিদ্র রিকশাচালক ও মেহনতিদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বিতরণ করা শুরু করল ছাত্র ইউনিয়ন। এ কর্তব্য যে ছাত্র ইউনিয়নের ‘চেতনার’ স্বাভাবিক প্রকাশ। এখনও ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের তৎপরতা চোখে জীবন্ত হয়ে ভাসে। তৎকালীন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুজ্জামান নাসিম এবং তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর তৎপরতা এখনও চেতনাকে দৃঢ় করতে সহায়তা করে। নাসিমের ‘ফিডিং সেন্টার’ ছিল ঈশ্বরদী ডাকবাংলো মাঠে। দৈনিক আট মণ আটার রুটি তৈরি করে অভুক্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হতো। পাবনা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এ আটা বরাদ্দ দেয়া হতো। এই কাজ অবশ্যই সহজ ছিল না। জ্বালানি কাঠ জোগাড় করা ছিল খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ। সবই নাসিমের ছাত্র ইউনিয়ন বাহিনী করে ফেলত। জেলা প্রশাসক এ ‘ফিডিং সেন্টার’ পরিদর্শনে এসে খুব বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন।

ছাত্র ইউনিয়ন, যেখানে ‘চেতনায় মানুষ’, জাতির বিপদের দিনে জানপ্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। যখন ঈশ্বরদীর গ্রামাঞ্চলে কলেরা ছড়িয়ে পড়ল তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালে তখনও ছাত্র ইউনিয়ন, নাসিমের বাহিনী। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত স্যালাইন নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসের সম্মুখে রেডক্রসের সাদা জিপটি দাঁড়িয়ে গেল। আবারও নাসিমের খোঁজ। সাহেবরা প্রচুর স্যালাইন দিয়ে গেল নাসিমকে। ছাত্র ইউনিয়ন বাহিনী দিবারাত্র পড়ে থাকল গ্রামে। সেবা করল কলেরা রোগীদের। বেঁচে গেল বহু প্রাণ। আশি সাল পর্যন্ত দেখেছি গ্রামের দরিদ্র মা’য়েরা নাসিমের বাড়িতে আসতেন নাসিমকে একনজর দেখার জন্যে, দোয়া করার জন্যে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সাহেবদের দেখতাম বিমানবন্দরে যাওয়ার সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যেতেন। অফিসে গিয়ে সাহেবরা নাসিমের খোঁজ করতেন। সেটাই তো ছিল ‘চেতনায় মানুষের’ যথার্থ বহির্প্রকাশ এবং আজও এ স্রোতধারা প্রবাহিত ওদের ধমনীতে।

‘করোনা’ আবারও কঠিন পরীক্ষা নিতে এসেছে। ‘চেতনায় চাল চোররা’ গলাবাজি শুরু করেছে। এক মন্ত্রী সাহেবতো বলেই ফেলেছেন, বিএনপি-জামায়াত চাল চুরি করছে! এ অমিত বচন শোনার পর মনে হলো আমি কি বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরুতে জার্মানিতে বাস করছি কিনা!! নাৎসি বাহিনীর অতি দক্ষ মন্ত্রী ‘গোয়েবলস’ এ বচন শুনলে মনে হয় পুলকিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এখন মনে হয় অভিধান থেকে ‘লজ্জা-শরম’ শব্দ দুটি তুলে দেয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু কি এমনিতেই আওয়ামী লীগের বিলোপ ঘটিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন।

‘করোনা’ সাধারণ ঝড়-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এ এমন এক মহামারী যেখানে কে মরবেন আর কে জীবিত থাকবেন তা বলা অসম্ভব। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা এ বিপদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক জীবন দিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ দুর্যোগের সময় ‘এন-৯৫’ মাস্ক নিয়ে দুর্নীতি করা হয়েছে। এই চোরদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। মুনাফার লোভ অমানুষ করে দেয় মুনাফা লোভীদের। পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে গার্মেন্টস মালিকরা তাতে সেখানে চেতনায় মানুষ দেখা যায় না। ওখানে এই মহান ‘উদ্যোক্তাদের (!)’ চেতনায় শুধুই ‘মুনাফা’ ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘করোনা’ প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। মানববন্ধন করে, মিছিল করে, লোক জড়ো করে, বক্তৃতা দিয়ে ‘করোনা’ প্রতিরোধ এবং নির্মূল করা সম্ভব নয়। তা হলে কি করতে হবে? সরকারকে উত্তম পরামর্শ দিয়ে? সরকার যদি না শোনে তখন কি করতে হবে! প্রচলিত রাজনীতি ‘ক্ষমতার’ জন্যে যা করতে পারে, ‘করোনা’ প্রতিরোধে নিশ্চয়ই তা করতে পারবে না। ইতোমধ্যে সরকার এবং সরকারি দলের ব্যর্থতা গণরোষ তৈরি করছে। বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। এরই মধ্যে এই রোষের প্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। প্রচলিত রাজনীতি এই ‘জনরোষকে’ কিভাবে বিবেচনায় নেবে? এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। ‘উত্তর’ এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। মনে হয় একটা পথ আছে, যার নাম ‘দায়িত্বশীলতা’। ‘দায়িত্বশীল আচরণের’ বিকল্প এ মুহূর্তে বোধ হয় নেই।

২১.০৪.২০২০

বুধবার, ২২ এপ্রিল ২০২০ , ৯ বৈশাখ ১৪২৭, ২৭ শাবান ১৪৪১

‘করোনাকালীন’ রাজনীতি : কিছু পর্যবেক্ষণ, কিছু মন্তব্য

শামছুজ্জামান সেলিম

অদ্ভুত এক দানবের সঙ্গে মানব জাতি লড়াই করছে, যাকে চোখে দেখা যায় না। এ দানবের নাম ‘কোভিড-১৯’, অর্থাৎ ‘করোনাভাইরাস’। মানব ইতিহাসে এ জাতীয় মহামারীর কথা কখনও শোনা যায়নি। খুব দ্রুতই ‘কোভিড-১৯’ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেল। পৃথিবীতে অতীতে ভয়ংকর সব মহামারী হয়েছে। এসব মহামারীতে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু ওই সব মহামারী অতি দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েনি এবং এমন ভয়ানক ছোঁয়াছে ছিল না। ১৯১৮ সালে ‘স্প্যানিস ফ্লু’ তে পাঁচ কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছিল ইউরোপে। ‘করোনায়’ অদ্যাবধি পৃথিবীব্যাপী লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিদিন পৃথিবীব্যাপী হাজার হাজার মানুষের দেহে ‘করোনা’ সংক্রমিত হচ্ছে। ‘করোনা’ আক্রমণের যে তীব্রতা তাতে এ বিপদ থেকে বিশ্ববাসী কবে মুক্ত হবে তা বলা একেবারেই অসম্ভব। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞরা যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন তা মেনে চলা জরুরি কর্তব্য হিসেবে গণ্য করতে হবে।

বিশ্ববাসী যখন জীবন-মৃত্যু নিয়ে আতঙ্কিত তখন ট্রাম্প ‘করোনা’ নিয়ে জবরদস্ত রাজনীতি শুরু করেছেন। ট্রাম্পের দেশ আমেরিকা বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর দেশ, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ঠিক সে সময় বিশ্ববাসী দেখছে আমেরিকা ‘করোনার’ কাছে বড়ই অসহায়, ‘করোনাকে’ থামানোর ক্ষমতা তার নেই। অপরদিকে চীন ‘করোনাকে’ ঠিকমতো মোকাবিলা করে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমে ট্রাম্প বললেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে, এ অভিযোগে আমেরিকা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার চাঁদা বন্ধ করে দিল। হোয়াইট হাউজের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলে ফেললেন শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন ‘করোনার’ প্রতি মনোযোগ দেয়নি। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আর যায় কোথায় ঐ কর্মকর্তাকে তড়িঘড়ি বরখাস্ত করা হলো। এখন আবার ট্রাম্প বলছে চীনের ল্যাবটরি থেকে ‘করোনা’ ছড়িয়েছে। তদন্ত করা হোক। তদন্ত দলে আমেরিকার প্রতিনিধি দেয়া হবে। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রকৃত ঘটনাটা কি? বিশ্বের লুটপাটের অর্থনীতি এবং রাজনীতির পালের গোদা ট্রাম্প লুটপাট অটুট ও নিরবচ্ছিন্ন রাখার প্রয়োজনে সামরিক খাতসহ যে সব খাতে বরাদ্দ দেয়া অব্যাহত রাখা দরকার সেখানেই মনোযোগ দিয়েছে। দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন এবং পরিকাঠামোর মান উন্নত করার কোনো দায় ট্রাম্প এবং ট্রাম্প প্রশাসনের নেই। ‘করোনা’ হামলা ওদের স্বাস্থ্য পরিসেবা খাতের অবহেলা অদক্ষতা উলঙ্গ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত¦হীনতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই অপরাধ আড়াল করার জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চীনের বিরুদ্ধে প্রচার যুদ্ধে নেমেছে ট্রাম্প কোম্পানি।

আর একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত করেছে ‘করোনা’। আজকের বিশ্বে লুটেরা পুঁজিবাদ মুনাফার জন্যে সবকিছু করবে, মানুষের জন্যে নয়। ট্রাম্পের প্রশাসনের আর একটা অমানবিক দিক হলো, আফ্রিকান-আমেরিকান, হিসপানিক এবং এশিয়ানসহ কালো মানুষদের ওরা মানুষ মনে করে না। আমেরিকাসহ সমগ্র ইউরোপের ‘করোনা’ পরিস্থিতি বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রকৃত সত্য ঘোষণা করছে অনবরত। অপরদিকে চীন কিউবা ভিয়েতনাম প্রমাণ করছে ‘জনগণের রাষ্ট্র’ কেমন এবং কি ধরনের হতে হয়। এ ভূমিতে ‘মানুষ মানুষের জন্যে’।

‘লুটেরা চেতনার এলিমেন্ট’ কখনোই ভাবতে পারে না ‘মানুষ মানুষের জন্যে’। এ সত্যটা এখন আমাদের দেশে আমরা প্রতিদিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ‘করোনা’ প্রতিরোধে লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব কার্যকর করা খুবই জরুরি। এর ফলে সারা দেশে কয়েক কোটি শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। তারা ক্ষুধার্ত, তাদের ঘরে খাবার নেই। রাষ্ট্রের উদ্যোগে এ সব মানুষের জন্যে চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এই চাল চুরি হওয়ার খবর প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এই চাল বিতরণের দায়িত্ব কাদের হাতে এবং কারা এই চাল বিতরণ করছে এবং চুরি করছে? এর উত্তর এ দেশের জনগণ জানে। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু রাগে-দুঃখে বলেছিলেন, ‘... আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমার বাবা কম্বল চোরদের ক্ষমা করেছিলেন, আমি চাল চোরদের ক্ষমা করব না।’ চাল চোরদের ধরার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন খবরে বলা হচ্ছে চাল চোরদের পরিচয়। ‘চেতনায় লুটপাট থাকলে’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই বা কি করবেন!

‘চেতনায় দেশপ্রেম এবং মানুষ’ থাকলে একজন রাজনৈতিক কর্মীর আচরণ কেমন হয় তার প্রমাণ দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পাশাপাশি যুব ইউনিয়ন। দরিদ্র রিকশাচালক ও মেহনতিদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বিতরণ করা শুরু করল ছাত্র ইউনিয়ন। এ কর্তব্য যে ছাত্র ইউনিয়নের ‘চেতনার’ স্বাভাবিক প্রকাশ। এখনও ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের তৎপরতা চোখে জীবন্ত হয়ে ভাসে। তৎকালীন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুজ্জামান নাসিম এবং তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর তৎপরতা এখনও চেতনাকে দৃঢ় করতে সহায়তা করে। নাসিমের ‘ফিডিং সেন্টার’ ছিল ঈশ্বরদী ডাকবাংলো মাঠে। দৈনিক আট মণ আটার রুটি তৈরি করে অভুক্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হতো। পাবনা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এ আটা বরাদ্দ দেয়া হতো। এই কাজ অবশ্যই সহজ ছিল না। জ্বালানি কাঠ জোগাড় করা ছিল খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ। সবই নাসিমের ছাত্র ইউনিয়ন বাহিনী করে ফেলত। জেলা প্রশাসক এ ‘ফিডিং সেন্টার’ পরিদর্শনে এসে খুব বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন।

ছাত্র ইউনিয়ন, যেখানে ‘চেতনায় মানুষ’, জাতির বিপদের দিনে জানপ্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। যখন ঈশ্বরদীর গ্রামাঞ্চলে কলেরা ছড়িয়ে পড়ল তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালে তখনও ছাত্র ইউনিয়ন, নাসিমের বাহিনী। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত স্যালাইন নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসের সম্মুখে রেডক্রসের সাদা জিপটি দাঁড়িয়ে গেল। আবারও নাসিমের খোঁজ। সাহেবরা প্রচুর স্যালাইন দিয়ে গেল নাসিমকে। ছাত্র ইউনিয়ন বাহিনী দিবারাত্র পড়ে থাকল গ্রামে। সেবা করল কলেরা রোগীদের। বেঁচে গেল বহু প্রাণ। আশি সাল পর্যন্ত দেখেছি গ্রামের দরিদ্র মা’য়েরা নাসিমের বাড়িতে আসতেন নাসিমকে একনজর দেখার জন্যে, দোয়া করার জন্যে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সাহেবদের দেখতাম বিমানবন্দরে যাওয়ার সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যেতেন। অফিসে গিয়ে সাহেবরা নাসিমের খোঁজ করতেন। সেটাই তো ছিল ‘চেতনায় মানুষের’ যথার্থ বহির্প্রকাশ এবং আজও এ স্রোতধারা প্রবাহিত ওদের ধমনীতে।

‘করোনা’ আবারও কঠিন পরীক্ষা নিতে এসেছে। ‘চেতনায় চাল চোররা’ গলাবাজি শুরু করেছে। এক মন্ত্রী সাহেবতো বলেই ফেলেছেন, বিএনপি-জামায়াত চাল চুরি করছে! এ অমিত বচন শোনার পর মনে হলো আমি কি বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরুতে জার্মানিতে বাস করছি কিনা!! নাৎসি বাহিনীর অতি দক্ষ মন্ত্রী ‘গোয়েবলস’ এ বচন শুনলে মনে হয় পুলকিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এখন মনে হয় অভিধান থেকে ‘লজ্জা-শরম’ শব্দ দুটি তুলে দেয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু কি এমনিতেই আওয়ামী লীগের বিলোপ ঘটিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন।

‘করোনা’ সাধারণ ঝড়-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এ এমন এক মহামারী যেখানে কে মরবেন আর কে জীবিত থাকবেন তা বলা অসম্ভব। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা এ বিপদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক জীবন দিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ দুর্যোগের সময় ‘এন-৯৫’ মাস্ক নিয়ে দুর্নীতি করা হয়েছে। এই চোরদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। মুনাফার লোভ অমানুষ করে দেয় মুনাফা লোভীদের। পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে গার্মেন্টস মালিকরা তাতে সেখানে চেতনায় মানুষ দেখা যায় না। ওখানে এই মহান ‘উদ্যোক্তাদের (!)’ চেতনায় শুধুই ‘মুনাফা’ ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘করোনা’ প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। মানববন্ধন করে, মিছিল করে, লোক জড়ো করে, বক্তৃতা দিয়ে ‘করোনা’ প্রতিরোধ এবং নির্মূল করা সম্ভব নয়। তা হলে কি করতে হবে? সরকারকে উত্তম পরামর্শ দিয়ে? সরকার যদি না শোনে তখন কি করতে হবে! প্রচলিত রাজনীতি ‘ক্ষমতার’ জন্যে যা করতে পারে, ‘করোনা’ প্রতিরোধে নিশ্চয়ই তা করতে পারবে না। ইতোমধ্যে সরকার এবং সরকারি দলের ব্যর্থতা গণরোষ তৈরি করছে। বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। এরই মধ্যে এই রোষের প্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। প্রচলিত রাজনীতি এই ‘জনরোষকে’ কিভাবে বিবেচনায় নেবে? এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। ‘উত্তর’ এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। মনে হয় একটা পথ আছে, যার নাম ‘দায়িত্বশীলতা’। ‘দায়িত্বশীল আচরণের’ বিকল্প এ মুহূর্তে বোধ হয় নেই।

২১.০৪.২০২০