করোনা : ভ্রান্তির বেড়াজালে জনগণ

রুকুনউদ্দৌলাহ্

করোনা রোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না ইত্যাদি। বিষয়গুলো সবই করোনা থেকে মুক্ত থাকার ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার প্রতিবেশী যখন আমার কাছে প্রশ্ন করলেন লোক ডেকে ত্রাণ দেয়ায় সামাজিক দূরত্ব নষ্ট হচ্ছে। এটা তো প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। অথচ আমরা জরুরি প্রয়োজনে বাজারে গেলে সামাজিক দূরত্ব নষ্টের কারণে তাড়িয়ে বের করে দেয়া হচ্ছে।

আমি এর কোন জবাব দিতে পারিনি। এর একদিন পর দেখি আমার বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে একটি মিকচার মেশিনের (ছাদ ঢালাইয়ের জন্য খোয়া-সিমেন্ট মেশানোর মেশিন) গাড়ি যাচ্ছে। ওই গাড়িতে ১০-১৫ জন নির্মাণ শ্রমিক গাদাগাদি করে বসে আছেন। তারা যাচ্ছেন নির্ধারিত স্থানে কাজে। দৃশ্যটা দেখে আমার ওই প্রতিবেশীর কথাগুলো কানে বাজছিল। ভাবছিলাম এসব কর্মজীবী মানুষের কি হবে। তারা যে বোঝেন না তা নয়। কিন্তু পেটের তাগিদে তাদের কাছে করোনার ভয় তুচ্ছ।

করোনা নিয়ে ভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে পড়েছে মানুষ। এমন কিছু বিষয় সৃষ্টি হচ্ছে যার কারণে তারা কোন দিক খুঁজে পাচ্ছেন না। একটা কথা আছে, তা হলো যে কাজটা একজন ভালো বলে করছেন, অন্য একজন সেই কাজটার ক্ষতি করেও ভালো করেন। ধরে নেয়া যাক পথের পাশে একটা মসজিদের সামনে একজন সমাজহিতৈষী ব্যক্তি মুসল্লিদের সাইকেল রাখার সুবিধার জন্য একটি খুঁটি পুঁতে দিলেন। অন্য একজন এসে দেখলেন পথের পাশের এ খঁটিটা তো পথচারীদের পথচলা বিঘ্নিত করতে পারে। কেউ এতে ঘা-গুতো খেতে পারেন। এই ভেবে তিনি খুঁটিটি তুলে ফেললেন। নিশ্চয় তিনি মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে কাজটি করেছেন। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে ত্রাণ বিতরণে এমনটা হচ্ছে। মরণব্যাধি করোনা প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হলো সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি। সরকার এ সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেই সঙ্গে সেনাবাহিনী নামিয়েছে। সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ আন্তরিকভাবে সরকারের এ কর্মসূচি কার্যকর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে কর্মহীন মানুষের সহযোগিতার জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই ত্রাণ বিতরণের জন্য ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করায় খুঁটি পোঁতার মতো ভালো কাজটি আর ভালো থাকছে না। এতে সামাজিক দূরত্ব কর্মসূচি ভেঙে পড়ছে। শুধু তাই নয়, জটলার ভেতর থেকে দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ত্রাণ নিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছে।

ত্রাণ বিতরণের এ প্রচলিত পদ্ধতিতে দুর্বলরা না পেলেও এই মহাদুর্যোগের দিনে এক শ্রেণীর নেতাদের আত্মপ্রচারের কাজটি শতভাগ পূর্ণ হচ্ছে। তারা ক্ষুদ্র বৃহৎ ক্ষতির পরোয়া না করে নিজের লাভ খোঁজেন সব সময়। এ অবস্থা সরকার উপলব্ধি করে ইতোমধ্যে লোক জড়ো করে ত্রাণ বিতরণের বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু মতলববাজরা তা যেন কানে তুলছে না। এ অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে একদিন দেখা যাবে মানুষ সামাজিক দূরত্ব আর মানতে চাইবে না। তারা প্রশ্ন তুলবে লোক জড়ো করে ত্রাণ বিতরণ করলে যদি কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো গুরুত্ব নেই। এতে অবস্থার যে ভয়াবহ অবনতি হতে পারে তা আর সাধারণ মানুষ বুঝতে চাইবে না।

একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললেন, সাংবাদিক সাহেব আপনার কী মনে পড়ে ভোটের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটের স্লিপ দিয়ে আসতেন। যাতে ভোটার নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে যেয়ে তার ভোটটা দিতে পারে। ভোটের সময় যদি এটা পারে তা হলে খাদ্য সহায়তা বা ত্রাণ সহায়তা দিতে লোকজড়ো করতে হবে কেন? জনপ্রতিনিধিরা যদি ন্যূনতম আন্তরিক বা সৎ হন তা হলে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হওয়ার কথা নয়। কেননা তারাই জানেন এলাকায় কে হতদরিদ্র, কে মধ্যবিত্ত, কে ত্রাণের জন্য হাত পাততে পারবেন না। সুতরাং তাদেরই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

সব ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম আছে। যশোরের এক প্রচারবিমুখ যুবক নিজে উদ্যোগী হয়ে কয়েকজন যুবককে সংগঠিত করেছেন। যুবকটির নাম রাজিবুল আলম। বাড়ি কারবালা এলাকায়। তিনি যুবকদের দিয়ে তার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভাবীদের নামের তালিকা সংগ্রহ করছেন। তালিকা হাতে পাওয়ার পর রাতের আঁধারে ওই যুবকদের মাধ্যমে অভাবীদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন তার সাধ্যমতো ত্রাণ। তিনি এভাবে ছয়শ’ হতদরিদ্র, সহায়-সম্বলহীন মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সহায়তা সামগ্রী। তার এ উদ্যোগ অ্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।

ভ্রান্তি আরও আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আসন্ন রমজান মাসে জমায়েত না হয়ে নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন সৌদি আরব। সারা বিশ্বের মুসলিমদের প্রতি দেশটির আলেমদের কাউন্সিল এ আহ্বান জানিয়েছে। ১৯ এপ্রিল সৌদি প্রেস এজেন্সির খবরে উল্লেখ করা হয়, সৌদির আলেম কাউন্সিল জানিয়েছে, রমজানে এক সঙ্গে জমায়েত হয়ে নামাজ পড়লে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। সে কারণে জমায়েত না হয়ে নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছে কাউন্সিল।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মক্কা ও মদিনায় অবস্থিত দুই শীর্ষ মসজিদেও জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে সৌদি আরব সরকার। এদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আসন্ন রোজার তারাবি নামাজ এবং ঈদের নামাজও যার যার বাসায় পড়তে হবে বলে জানিয়েছেন সৌদির গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ শেখ। মহামারীর মধ্যে মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ থাকায় আসন্ন রোজায় তারাবির নামাজ কিভাবে হবে, সে বিষয়ে অনেকে ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রশ্ন করেন। মন্ত্রণালয় তখন নির্দেশনা চেয়ে সেই প্রশ্ন গ্র্যান্ড মুফতির কাছে পাঠায়। উত্তরে শেখ আবদুল আজিজ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধের কারণে যদি মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হয় তাহলে বাড়িতেই নামাজ পড়া যাবে। ঈদের নামাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। সৌদি আরবে ইসলামী আইনশাস্ত্রের কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে সে বিষেয়ে ফতোয়া দেয়ার চূড়ান্ত এখতিয়ার দেশটির গ্র্যান্ড মুফতির হাতে ন্যস্ত। এর আগে সৌদি আরবের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী শেখ ড. আবদুল লতিফ বিন আবদুল আজিজ আশ-শেখও আসন্ন রোজার মাসে ঘরে বসেই তারাবি নামাজ পড়ার আহ্বান জানান। কিন্তুআমাদের দেশে হচ্ছে তার উল্টোটা। এক মসজিদের কথা জানি। তারা ওই মসজিদে পাঁচজনের জন্য ইফতারির ব্যবস্থা করেছে। বিষয়টা এমন যে মসজিদে ইফতার করা যেন ফরজ। না করলে ফরজ তরক হয়ে যাবে। তাই পাঁচজনের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করে ফরজ রক্ষা করা হলো (নাউজুবিল্লাহ)।

শুধু তাই নয়, আমাদের মসজিদগুলোতে ভিড় এড়াতে সাময়িকভাবে জামাত বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ মানছে, কেউ মানছে না। যারা মানছে না তারা বলছে মানুষকে মসজিদ বিমুখ করার এ একটি চক্রান্ত। এ দিকে আবার বিভিন্ন সময় শত শত আলেমরা বিবৃতি দিচ্ছেন মসজিদগুলো খুলে দিতে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের কথা নেই। কথা হলো সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি তো আমাদের দেশের আলেমদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নন। তিনি সারা মুসলিম জাহানের স্বীকৃত মুরুব্বি। তিনি কি তাহলে ফতোয়া দিয়ে ভুল করেছেন। সাধারণ মানুষ কার কথা ধরবেন বা শুনবেন। এ নিয়ে আমাদের আলেমদের কাছে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, কোন ব্যক্তিকে দেখে ইসলামের বিষয়ে কিছু করা যাবে না। কোরআন ও হাদিস দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব গ্র্যান্ড মুফতি আমাদের দেশের আলেমদের চেয়ে অযোগ্য।

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলা। বিষয়টি নিয়ে কোন বিতর্ক আজো দেখা যায়নি। রোগ-ব্যাধির মধ্যে কিছু আছে পানিবাহিত, কিছু আছে বায়ুবাহিত। করোনা মানুষের মাধ্যমে বেশি ছড়ায়। এজন্য সামাজিক দূরত্ব রক্ষার প্রতি এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাস এমনই একটা জিনিস যা জীবন্ত নয়। এটি প্রোটিনের অণুমাত্র এবং চর্বির আস্তরে মোড়ানো থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় করোনা সংক্রমণ এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে- এই ভাইরাস নাক, চোখ ও মুখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ভাইরাসটি ভঙ্গুর। তাই সাবান ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে এ ভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাস থেকে কিছুটা মুক্ত থাকার একটা পথ হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা। বিষয় দুটো মানার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

করোনাভাইরাস রোধে যখন বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই এর একমাত্র ওষুধ তখন যশোর প্রশাসন এর বিপরীতে চলছেন। আমলা বলে কথা। কারণ তারা যেটা বোঝেন আর কেউ সেটা বোঝেন না। তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নামে প্রশাসন শহরের বড় বাজার সরিয়ে নিয়ে গেছেন আবাসিক এলাকায়। যেমন খালধার সড়কের আবাসিক এলাকায় বসিয়েছেন মাছের বাজার। এতে গোটা এলাকায় নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পথ সুগম হয়েছে আবাসিক এলাকায়।

আমজনতার এক কথা, ত্রাণ নিয়ে যে অবস্থা চলছে তা হতে দেয়া যাবে না। সামাজিক দূরত্ব যা সৃষ্টি হয়েছে তা ভেঙে পড়তে দেয়া যাবে না। এজন্য অসহায় অভাবীদের সুষ্ঠু তালিকা তৈরি করে ত্রাণসামগ্রী তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে তালিকা ধরে সীমিত সংখ্যায় ডেকে তাদের হাতে ত্রাণ তুলে দেয়া যেতে পারে। এর বাইরে সরকার আরও যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতি বের করতে পারে। তবে সার কথা হলো সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে যে উপকার পাওয়া গেছে তা ধরে রাখতে হলে কোনো অবস্থাতেই তা ভেঙে পড়তে দেয়া যাবে না।

ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের এমন কি অনেক শিক্ষিতজনেরও গভীর জ্ঞান নেই। এ দেশের মানুষ ধর্মীয় প্রতিটি বিষয়ে ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর দেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাদের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে চলি। পৃথিবীতে কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। এ দেশের বিজ্ঞ আলেমরা সৌদির গ্র্যান্ড মুফতির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করতে পারেন। তা না করে বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে ধর্মীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এমন জগাখিচুড়ি অবস্থা সমর্থনযোগ্য নয়।

বুধবার, ২২ এপ্রিল ২০২০ , ৯ বৈশাখ ১৪২৭, ২৭ শাবান ১৪৪১

গ্রাম-গ্রামান্তরে

করোনা : ভ্রান্তির বেড়াজালে জনগণ

রুকুনউদ্দৌলাহ্

করোনা রোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না ইত্যাদি। বিষয়গুলো সবই করোনা থেকে মুক্ত থাকার ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার প্রতিবেশী যখন আমার কাছে প্রশ্ন করলেন লোক ডেকে ত্রাণ দেয়ায় সামাজিক দূরত্ব নষ্ট হচ্ছে। এটা তো প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। অথচ আমরা জরুরি প্রয়োজনে বাজারে গেলে সামাজিক দূরত্ব নষ্টের কারণে তাড়িয়ে বের করে দেয়া হচ্ছে।

আমি এর কোন জবাব দিতে পারিনি। এর একদিন পর দেখি আমার বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে একটি মিকচার মেশিনের (ছাদ ঢালাইয়ের জন্য খোয়া-সিমেন্ট মেশানোর মেশিন) গাড়ি যাচ্ছে। ওই গাড়িতে ১০-১৫ জন নির্মাণ শ্রমিক গাদাগাদি করে বসে আছেন। তারা যাচ্ছেন নির্ধারিত স্থানে কাজে। দৃশ্যটা দেখে আমার ওই প্রতিবেশীর কথাগুলো কানে বাজছিল। ভাবছিলাম এসব কর্মজীবী মানুষের কি হবে। তারা যে বোঝেন না তা নয়। কিন্তু পেটের তাগিদে তাদের কাছে করোনার ভয় তুচ্ছ।

করোনা নিয়ে ভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে পড়েছে মানুষ। এমন কিছু বিষয় সৃষ্টি হচ্ছে যার কারণে তারা কোন দিক খুঁজে পাচ্ছেন না। একটা কথা আছে, তা হলো যে কাজটা একজন ভালো বলে করছেন, অন্য একজন সেই কাজটার ক্ষতি করেও ভালো করেন। ধরে নেয়া যাক পথের পাশে একটা মসজিদের সামনে একজন সমাজহিতৈষী ব্যক্তি মুসল্লিদের সাইকেল রাখার সুবিধার জন্য একটি খুঁটি পুঁতে দিলেন। অন্য একজন এসে দেখলেন পথের পাশের এ খঁটিটা তো পথচারীদের পথচলা বিঘ্নিত করতে পারে। কেউ এতে ঘা-গুতো খেতে পারেন। এই ভেবে তিনি খুঁটিটি তুলে ফেললেন। নিশ্চয় তিনি মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে কাজটি করেছেন। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে ত্রাণ বিতরণে এমনটা হচ্ছে। মরণব্যাধি করোনা প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হলো সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি। সরকার এ সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেই সঙ্গে সেনাবাহিনী নামিয়েছে। সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ আন্তরিকভাবে সরকারের এ কর্মসূচি কার্যকর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে কর্মহীন মানুষের সহযোগিতার জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই ত্রাণ বিতরণের জন্য ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করায় খুঁটি পোঁতার মতো ভালো কাজটি আর ভালো থাকছে না। এতে সামাজিক দূরত্ব কর্মসূচি ভেঙে পড়ছে। শুধু তাই নয়, জটলার ভেতর থেকে দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ত্রাণ নিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছে।

ত্রাণ বিতরণের এ প্রচলিত পদ্ধতিতে দুর্বলরা না পেলেও এই মহাদুর্যোগের দিনে এক শ্রেণীর নেতাদের আত্মপ্রচারের কাজটি শতভাগ পূর্ণ হচ্ছে। তারা ক্ষুদ্র বৃহৎ ক্ষতির পরোয়া না করে নিজের লাভ খোঁজেন সব সময়। এ অবস্থা সরকার উপলব্ধি করে ইতোমধ্যে লোক জড়ো করে ত্রাণ বিতরণের বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু মতলববাজরা তা যেন কানে তুলছে না। এ অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে একদিন দেখা যাবে মানুষ সামাজিক দূরত্ব আর মানতে চাইবে না। তারা প্রশ্ন তুলবে লোক জড়ো করে ত্রাণ বিতরণ করলে যদি কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো গুরুত্ব নেই। এতে অবস্থার যে ভয়াবহ অবনতি হতে পারে তা আর সাধারণ মানুষ বুঝতে চাইবে না।

একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললেন, সাংবাদিক সাহেব আপনার কী মনে পড়ে ভোটের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটের স্লিপ দিয়ে আসতেন। যাতে ভোটার নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে যেয়ে তার ভোটটা দিতে পারে। ভোটের সময় যদি এটা পারে তা হলে খাদ্য সহায়তা বা ত্রাণ সহায়তা দিতে লোকজড়ো করতে হবে কেন? জনপ্রতিনিধিরা যদি ন্যূনতম আন্তরিক বা সৎ হন তা হলে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হওয়ার কথা নয়। কেননা তারাই জানেন এলাকায় কে হতদরিদ্র, কে মধ্যবিত্ত, কে ত্রাণের জন্য হাত পাততে পারবেন না। সুতরাং তাদেরই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

সব ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম আছে। যশোরের এক প্রচারবিমুখ যুবক নিজে উদ্যোগী হয়ে কয়েকজন যুবককে সংগঠিত করেছেন। যুবকটির নাম রাজিবুল আলম। বাড়ি কারবালা এলাকায়। তিনি যুবকদের দিয়ে তার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভাবীদের নামের তালিকা সংগ্রহ করছেন। তালিকা হাতে পাওয়ার পর রাতের আঁধারে ওই যুবকদের মাধ্যমে অভাবীদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন তার সাধ্যমতো ত্রাণ। তিনি এভাবে ছয়শ’ হতদরিদ্র, সহায়-সম্বলহীন মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সহায়তা সামগ্রী। তার এ উদ্যোগ অ্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।

ভ্রান্তি আরও আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আসন্ন রমজান মাসে জমায়েত না হয়ে নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন সৌদি আরব। সারা বিশ্বের মুসলিমদের প্রতি দেশটির আলেমদের কাউন্সিল এ আহ্বান জানিয়েছে। ১৯ এপ্রিল সৌদি প্রেস এজেন্সির খবরে উল্লেখ করা হয়, সৌদির আলেম কাউন্সিল জানিয়েছে, রমজানে এক সঙ্গে জমায়েত হয়ে নামাজ পড়লে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। সে কারণে জমায়েত না হয়ে নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছে কাউন্সিল।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মক্কা ও মদিনায় অবস্থিত দুই শীর্ষ মসজিদেও জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে সৌদি আরব সরকার। এদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আসন্ন রোজার তারাবি নামাজ এবং ঈদের নামাজও যার যার বাসায় পড়তে হবে বলে জানিয়েছেন সৌদির গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ শেখ। মহামারীর মধ্যে মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ থাকায় আসন্ন রোজায় তারাবির নামাজ কিভাবে হবে, সে বিষয়ে অনেকে ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রশ্ন করেন। মন্ত্রণালয় তখন নির্দেশনা চেয়ে সেই প্রশ্ন গ্র্যান্ড মুফতির কাছে পাঠায়। উত্তরে শেখ আবদুল আজিজ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধের কারণে যদি মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হয় তাহলে বাড়িতেই নামাজ পড়া যাবে। ঈদের নামাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। সৌদি আরবে ইসলামী আইনশাস্ত্রের কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে সে বিষেয়ে ফতোয়া দেয়ার চূড়ান্ত এখতিয়ার দেশটির গ্র্যান্ড মুফতির হাতে ন্যস্ত। এর আগে সৌদি আরবের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী শেখ ড. আবদুল লতিফ বিন আবদুল আজিজ আশ-শেখও আসন্ন রোজার মাসে ঘরে বসেই তারাবি নামাজ পড়ার আহ্বান জানান। কিন্তুআমাদের দেশে হচ্ছে তার উল্টোটা। এক মসজিদের কথা জানি। তারা ওই মসজিদে পাঁচজনের জন্য ইফতারির ব্যবস্থা করেছে। বিষয়টা এমন যে মসজিদে ইফতার করা যেন ফরজ। না করলে ফরজ তরক হয়ে যাবে। তাই পাঁচজনের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করে ফরজ রক্ষা করা হলো (নাউজুবিল্লাহ)।

শুধু তাই নয়, আমাদের মসজিদগুলোতে ভিড় এড়াতে সাময়িকভাবে জামাত বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ মানছে, কেউ মানছে না। যারা মানছে না তারা বলছে মানুষকে মসজিদ বিমুখ করার এ একটি চক্রান্ত। এ দিকে আবার বিভিন্ন সময় শত শত আলেমরা বিবৃতি দিচ্ছেন মসজিদগুলো খুলে দিতে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের কথা নেই। কথা হলো সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি তো আমাদের দেশের আলেমদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নন। তিনি সারা মুসলিম জাহানের স্বীকৃত মুরুব্বি। তিনি কি তাহলে ফতোয়া দিয়ে ভুল করেছেন। সাধারণ মানুষ কার কথা ধরবেন বা শুনবেন। এ নিয়ে আমাদের আলেমদের কাছে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, কোন ব্যক্তিকে দেখে ইসলামের বিষয়ে কিছু করা যাবে না। কোরআন ও হাদিস দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব গ্র্যান্ড মুফতি আমাদের দেশের আলেমদের চেয়ে অযোগ্য।

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলা। বিষয়টি নিয়ে কোন বিতর্ক আজো দেখা যায়নি। রোগ-ব্যাধির মধ্যে কিছু আছে পানিবাহিত, কিছু আছে বায়ুবাহিত। করোনা মানুষের মাধ্যমে বেশি ছড়ায়। এজন্য সামাজিক দূরত্ব রক্ষার প্রতি এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাস এমনই একটা জিনিস যা জীবন্ত নয়। এটি প্রোটিনের অণুমাত্র এবং চর্বির আস্তরে মোড়ানো থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় করোনা সংক্রমণ এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে- এই ভাইরাস নাক, চোখ ও মুখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ভাইরাসটি ভঙ্গুর। তাই সাবান ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে এ ভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাস থেকে কিছুটা মুক্ত থাকার একটা পথ হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা। বিষয় দুটো মানার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

করোনাভাইরাস রোধে যখন বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই এর একমাত্র ওষুধ তখন যশোর প্রশাসন এর বিপরীতে চলছেন। আমলা বলে কথা। কারণ তারা যেটা বোঝেন আর কেউ সেটা বোঝেন না। তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নামে প্রশাসন শহরের বড় বাজার সরিয়ে নিয়ে গেছেন আবাসিক এলাকায়। যেমন খালধার সড়কের আবাসিক এলাকায় বসিয়েছেন মাছের বাজার। এতে গোটা এলাকায় নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পথ সুগম হয়েছে আবাসিক এলাকায়।

আমজনতার এক কথা, ত্রাণ নিয়ে যে অবস্থা চলছে তা হতে দেয়া যাবে না। সামাজিক দূরত্ব যা সৃষ্টি হয়েছে তা ভেঙে পড়তে দেয়া যাবে না। এজন্য অসহায় অভাবীদের সুষ্ঠু তালিকা তৈরি করে ত্রাণসামগ্রী তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে তালিকা ধরে সীমিত সংখ্যায় ডেকে তাদের হাতে ত্রাণ তুলে দেয়া যেতে পারে। এর বাইরে সরকার আরও যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতি বের করতে পারে। তবে সার কথা হলো সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে যে উপকার পাওয়া গেছে তা ধরে রাখতে হলে কোনো অবস্থাতেই তা ভেঙে পড়তে দেয়া যাবে না।

ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের এমন কি অনেক শিক্ষিতজনেরও গভীর জ্ঞান নেই। এ দেশের মানুষ ধর্মীয় প্রতিটি বিষয়ে ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর দেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাদের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে চলি। পৃথিবীতে কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। এ দেশের বিজ্ঞ আলেমরা সৌদির গ্র্যান্ড মুফতির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করতে পারেন। তা না করে বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে ধর্মীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এমন জগাখিচুড়ি অবস্থা সমর্থনযোগ্য নয়।