আমরা কতটা সচেতন?

জয়নুল আবেদীন

করোনাভাইরাসের আক্রমণে-সংক্রমণে, ভীতি-ভয়াবহতায় সারা দুনিয়া যেখানে বিপর্যস্ত, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত এর ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না সেখানে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ইতালি, আমেরিকা, ফ্রান্স, স্পেন থেকে এসে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সপরিবারে বেড়াতে যাচ্ছেন। এয়ারপোর্টে নেমে সঠিক ঠিকানা দিচ্ছেন না, ভুয়া ঠিকানা দিচ্ছেন। থানা পুলিশ তাদের পাসপোর্টে উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়ে তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। হাটে-বাজারে তারা ভাসমান পতিতার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর করোনার জীবাণু ছড়াচ্ছেন। এসব বেহায়া-বেলাজা-বেয়াক্কেল-বেদরদ-বেচশম-বেইনসাফ-বেল্লিকদের কেন আইনের আওতায় আনা হবে না? যারা নিজেরা মরছে, পরিবার পরিজনকে মারছে, পুরো সমাজ রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনছে। করোনা আক্রান্ত দেশ ফেরত কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া জনৈক ভদ্রলোক দাঁত কেলিয়ে বলছেন- আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে এসেছি। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর ওপর ভরসা করলে এদেশে আসতে হবে কেন? আল্লাহর ওপর ভরসা করলে যে কোন স্থান, সে কোন দেশ থেকেই করা যায়। এরা কি দেখেনি রুয়ান্ডাতে পুলিশ গুলি করে হত্যা করছে তাদের যারা রাষ্ট্রের বিধিনিষেধ অমান্য করে সুখে কিংবা শখে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রোগ জীবাণু ছড়াচ্ছে।

এদেশ আমাদের মাতৃভূমি। আমাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন। মা-মাতৃভূমি আমাদের আপতকালীন আশ্রয়। সুখের ঠিকানা। দুঃখের ঠিকানা। আমরা অবশ্যই এবং অবশ্যই আমাদের সুখে দুঃখে মা-মাতৃভূমির কোলে ফিরে আসব। শুধু খেয়াল রাখতে হবে আমার কারণে যেন আমার মা-মাতৃভূমি কোন বিপদ-আপদ-আক্ষেপ বা ঝুঁকিতে না পড়ে।

সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সারা দেশে সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, কোর্ট-কাচারীর জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কারণ করোনাভাইরাস মারাত্মকভাবে ছোঁয়াছে। একজন আক্রান্ত হলে তার থেকে দ্রুত অন্য ১০ জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পত্র-পত্রিকা মোবাইল রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে জনসমাগম পরিহার করার জন্য। কে শোনে কার কথা? যেন ঈদের ছুটি পেয়েছে সবাই। উৎসবে মেতে উঠেছে। দলবেঁধে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন লোকে লোকারণ্য। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ঢল নেমেছে। এই কি আমাদের সচেতনতার নমুনা? এখন পুলিশ আর সেনাবাহিনী নামিয়ে আমাদের সচেতন-সতর্ক করা হচ্ছে। এটা সচেতনতা নয়। সচেতনতা মানুষের অন্তর্গত ব্যাপার। এটা সচেতনতা নয়; এটা হলো ঠেলার নাম বাবাজি। নিজেরা সচেতন হলে পুলিশ আর সেনা মোতায়ন করতে হতো না।

‘সচেতনতা’ নামে জগৎ সংসারে কোন বই নাই যেটা পড়লে সবাই সচেতন হয়ে যাবে। যদি ‘সচেতনতা’ নামে কোন বই থাকতোও আর সরকার এ দেশের আম জনতার প্রত্যেকের হাতে একটা করে বই তুলে দিত তবুও আমরা সবাই সে বই পড়তাম না (কেউ কেউ পড়তো)। কারণ বইটি পড়তে হবে-এই সচেতনতাও আমাদের মধ্যে নেই। শিক্ষিত হলেই সচেতন হবে এমন কথা অন্তত বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রযোজ্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এনামুল হক জনসমক্ষে বলতেন, সভা সেমিনারে বলতেন- এদেশের শিক্ষিতদের শতকরা নব্বই জনই অশিক্ষিত।

গত দেড় দুই দশকে আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে। শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেড়েছে। জগতের দেশে দেশে পড়াশোনা, চাকরি-বাকরির সুবাদে গমনাগমন বেড়েছে। টিভি দর্শক বেড়েছে। কম্পিউটার ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে। এইসব মানুষের সচেতনতার সহায়ক। এগুলো মানুষকে সচেতন করে। কিন্তু আমরা কি গুণে-মানে-মাপে-মাত্রায় সেই কাক্সিক্ষত মানের সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছি? আমরা কি ভেতরে বাহিরে শিল্প-সুন্দর, চাঁছাছোলা মানবপ্রেমী মাটিপ্রেমী খাঁটি মানুষ তৈরি করতে পেরেছি? সেই নিঃস্বার্থ সচেতন মানুষ কই? আজও পর্যন্ত একটু সুযোগ পেলেই আমরা পাবলিকের শুধু পকেট কাটা না, গলা কাটতে পারলেই খুশি হই। আমরা যেন সদাসর্বদা সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকি। বন্য হিংস্র পশুরা যেমন শিকারের অপেক্ষায় গাছের আড়ালে ওঁৎ পেতে থাকে। আমরা ওঁৎ পেতে থাকি আমাদের কাগুজে সার্টিফিকেট আর ভদ্র চেহারার আড়ালে। করোনা সংক্রমণের প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে। লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র আমাদের ব্যবসায়ীরা ৩৫ টাকার পিয়াজ ৮০, ১০০ আবার কেউ কেউ ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা শুরু করেছেন। যে দোকানদারের কাছে ১০ বস্তা পিয়াজ ছিল তিনি ৯ বস্তা গুদামে পাঠিয়ে দিলেন। ১ বস্তা পিয়াজ সামনে রেখে বললেন পিয়াজ আর নেই। বিক্রি করলেন ৩/৪ গুণ দামে। রসুন, আটা, চাল, চিনি, লবণ, ডাল, তেল সবকিছুর দামই খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল সমান তালে। কারণ এসব ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা সম্পর্কে ‘সচেতন’। ক্রেতার সামনে কোন বুলি আওড়াতে হবে তাও তারা ভালোবাবেই জানেন। সকালে কোন পণ্যটি কত দামে বিক্রি করেছেন এবং বিকালে দাম কত বাড়াতে হবে তাও সচেতনভাবেই করেন। এ দলে রয়েছে আমদানিকারক, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা সবাই। এ ব্যাপারে সবাই এক। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, আইলা, সিডর, করোনা- এসব তাদের জন্য আশীর্বাদ। এদেশে যা কিছু সংকট তা কিছুই সুযোগ। এখন তো এদেশে বেশিরভাগ মানুষই মুসলমান। আর আমাদের মতো এসব সেকেন্ড হ্যান্ড মুসলমানরাই যে কোন দুর্বিপাকের সুযোগ নিয়ে, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ নয় তালগাছ বানিয়ে ফেলেন। এদেশে এসব কাজে আমরা যতটা সচেতন দুনিয়ার ইহুদি, খ্রিস্টান রাষ্ট্রের অধিবাসীরাও ততটা নন বরং তারা এর বিপরীত। যে কোন দুর্যোগ এবং উৎসবে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেন। আমাদের সরকার সাধুবাদ জানাই এ জন্য যে, পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ থেকে পুলিশের অভিযানে- পিটুনি, জেল-জরিমানা যখন শুরু হয়েছে তখন এসব জন্মান্ধ ‘স্বার্থ সচেতন’ ধান্দাবাজরা লেজ গুটাতে শুরু করেছে। গত কয়েক মাস ধরে পিয়াজের মূল্য বৃদ্ধি করে গণমানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তারা নিজেদের লালে লাল করে নিয়েছেন। তারপর লবণ নিয়ে খেল খেলতে চেয়েছিলেন। এবারে করোনাকে পুঁজি করে হয়তো তাদের সর্বপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মহাপরিকল্পনা ছিল। সরকার জনগণের পক্ষে থাকায় ব্যাটে বলে হয়নি।

রুই কাতলা গেল তল/বাইলায় বলে কত জল- বড় ব্যবসায়ী তো বটেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যে মাস্ক বিক্রি করছে করোনার খবরে সেও উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ৫ টাকার মাস্ক বিক্রি শুরু করে ১০ টাকায়, ১০ টাকারটা ২০ টাকায়। বর্তমানে যে মাস্কগুলো ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এদের উৎপাদন খরচ ৫ থেকে ৭ টাকা। তাহলে যেগুলো পূর্বে ৫ টাকা এবং ১০ টাকায় বিক্রি হতো সেগুলোর উৎপাদন খরচ কত? করোনার খবরে পাড়া মহল্লার ওষুধের দোকানেও ডেটল, স্যাভলন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বর্ধিত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এদেশে পণ্যমূল্য বেশি না। উৎপাদন খরচ বা আমদানি খরচ কোনটাই বেশি না শুধু আমাদের ব্যবসায়ীদের লোভ বেশি। KENT-37, KENT-38 গিটে বাত- এর ব্যথায় এ ওষুধগুলো ব্যবহার হয়। আমাদানিকারকের আমদানি খরচ ১০০ থেকে ১২০ টাকা। পাইকারি বিক্রেতা বিক্রি করে ১৫০ টাকায় আর খুচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। চাল, ডালের দাম সাধারণ মানুষ কমবেশি জানে। কিন্তু ওষুধপত্র, প্রসাধন সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, চামড়াজাত দ্রব্য এসবের দাম-দর সম্পর্কে আমজনতা তেমন সচেতন নয়। আর আমাদের এ অসচেতনতার কারণেই বিক্রেতাদের পোয়া বারো।

মোবাইলের ১ সেট হেডফোনের ক্রয়মুল্য ২৭ থেকে ৩০ টাকা। আর সেটাই বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। অভিজাত মার্কেটগুলোতে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। কাওরান বাজারে ১০০ লেবু বিক্রি হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। আর সেই লেবু কারওয়ান বাজার থেকে অতি অল্প দূরত্বে ফার্মগেট আসলেই হালি ৪০ টাকা। আর রমজান মাস এলে তো কথাই নেই। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে রমজান মাস রহমতের মাস। এটা যে কত বড় রহমতের মাস তা সবচেয়ে ভালো বোঝে ব্যবসায়ীরা। কারণ এ একমাসে সারা বছরের কামাই, সারা বছরের উপার্জন। তাদের শুধুই আফসোস রমজান মাস কেন বছরে ৩ বার এলো না। তারা এতই ধার্মিক এবং এতই সচেতন যে, রমজান আসার অনেক দিন আগে থেকেই ট্রাকে ট্রাকে ভোগ্যপণ্য গুদামজাত করা শুরু করে যাতে রমজানে কোন রোজাদার কোন পণ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হয়। মানুষের প্রতি তাদের কত মহব্বত!

প্রতি বছরই রমজানকে সামনে রেখে সরকার বিভিন্ন সংস্থাকে মাঠে নামাচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এবছরও সে রকম ১০টি সংস্থাকে মাঠে নামানো হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এসব সরকারি সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ হারায় না হয় চোখ বন্ধ করে থাকে না হয় অসাধু ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে উঠে।

আমরা যারা ক্রেতা আমাদেরও বাতিক আছে-ত্রুটি আছে। রমজান মাস মানে সংযমের মাস। এ সময়ে আহার বিহার কম হবে। সবাই ইবাদতে মশগুল থাকবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র এর ঠিক উল্টো। রমজানেই খাবার দাবারের মহাধুমধাম। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় সেহেরি, ইফতারের রকমারি আয়োজন। তেলে ঝোলে সয়লাব। উচ্চবিত্তের পরিবারে ইফতারির সময় ডাইনিং টেবিলের অবস্থা দেখলে মনে হয় ইফতারির বাজার সাজানো হয়েছে। এসব ‘ইফতারি সচেতন’ ভোজন রসিকদের পেটপূজার নানা পণ্য সরবরাহ করতে গিয়েইতো ব্যবসায়ীরা মুনাফার হাতটা বাড়িয়ে দেন।

৬০ হাজার টাকার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয় (আমরা বিক্রি করতে বাধ্য হই) ৭শ’ থেকে ১ হাজার টাকায়। সেই গরুর চামড়ার অংশ বিশেষ দিয়ে তৈরি এক জোড়া জুতা আমাদের কিনতে হয় ৪, ৬ কিংবা ৭ হাজার টাকায়। কোরবানির পশুর চামড়ার এ মূল্যটা গরিবের হক, গরিবের প্রাপ্য। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত চামড়ার মূল্য চড়া। শুধু ঈদের দিনে চামড়া জলের দাম। এরাও সচেতন। কীভাবে গরিবের হক মেরে খেতে হবে সে সচেতনতা তাদের আছে। সচেতনতা নেই আমাদের। ৬০ হাজার টাকা খরচা করে যারা কোরবানি দিতে পারে তারা গরিব মানুষদের চামড়ার মূল্যবাবদ সেই ৭শ’ থেকে ১ হাজার টাকাও দিতে পারবে। ক্ষমতাহীন ক্ষমতাসীন কোন সিন্ডিকেটকেই ৮ হাজার ১০ হাজার টাকার চামড়া জলের দামে দিব না। সারা দেশের জনগণের মধ্যে এটুকু চেতনার সঞ্চার হোক, সচেতনতা গড়ে উঠুক। ট্যানারি মালিকসহ চামড়া শিল্পের রথী মহারথীদের টনক নড়বে, প্রমাদ গুণবে, ব্যবসায় ভাটির টান পড়বে।

[লেখক : জয়নুল আবেদীন, সিনিয়র প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ।

মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা, ঢাকা]

বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২০ , ১০ বৈশাখ ১৪২৭, ২৮ শাবান ১৪৪১

আমরা কতটা সচেতন?

জয়নুল আবেদীন

করোনাভাইরাসের আক্রমণে-সংক্রমণে, ভীতি-ভয়াবহতায় সারা দুনিয়া যেখানে বিপর্যস্ত, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত এর ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না সেখানে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ইতালি, আমেরিকা, ফ্রান্স, স্পেন থেকে এসে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সপরিবারে বেড়াতে যাচ্ছেন। এয়ারপোর্টে নেমে সঠিক ঠিকানা দিচ্ছেন না, ভুয়া ঠিকানা দিচ্ছেন। থানা পুলিশ তাদের পাসপোর্টে উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়ে তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। হাটে-বাজারে তারা ভাসমান পতিতার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর করোনার জীবাণু ছড়াচ্ছেন। এসব বেহায়া-বেলাজা-বেয়াক্কেল-বেদরদ-বেচশম-বেইনসাফ-বেল্লিকদের কেন আইনের আওতায় আনা হবে না? যারা নিজেরা মরছে, পরিবার পরিজনকে মারছে, পুরো সমাজ রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনছে। করোনা আক্রান্ত দেশ ফেরত কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া জনৈক ভদ্রলোক দাঁত কেলিয়ে বলছেন- আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে এসেছি। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর ওপর ভরসা করলে এদেশে আসতে হবে কেন? আল্লাহর ওপর ভরসা করলে যে কোন স্থান, সে কোন দেশ থেকেই করা যায়। এরা কি দেখেনি রুয়ান্ডাতে পুলিশ গুলি করে হত্যা করছে তাদের যারা রাষ্ট্রের বিধিনিষেধ অমান্য করে সুখে কিংবা শখে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রোগ জীবাণু ছড়াচ্ছে।

এদেশ আমাদের মাতৃভূমি। আমাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন। মা-মাতৃভূমি আমাদের আপতকালীন আশ্রয়। সুখের ঠিকানা। দুঃখের ঠিকানা। আমরা অবশ্যই এবং অবশ্যই আমাদের সুখে দুঃখে মা-মাতৃভূমির কোলে ফিরে আসব। শুধু খেয়াল রাখতে হবে আমার কারণে যেন আমার মা-মাতৃভূমি কোন বিপদ-আপদ-আক্ষেপ বা ঝুঁকিতে না পড়ে।

সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সারা দেশে সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, কোর্ট-কাচারীর জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কারণ করোনাভাইরাস মারাত্মকভাবে ছোঁয়াছে। একজন আক্রান্ত হলে তার থেকে দ্রুত অন্য ১০ জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পত্র-পত্রিকা মোবাইল রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে জনসমাগম পরিহার করার জন্য। কে শোনে কার কথা? যেন ঈদের ছুটি পেয়েছে সবাই। উৎসবে মেতে উঠেছে। দলবেঁধে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন লোকে লোকারণ্য। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ঢল নেমেছে। এই কি আমাদের সচেতনতার নমুনা? এখন পুলিশ আর সেনাবাহিনী নামিয়ে আমাদের সচেতন-সতর্ক করা হচ্ছে। এটা সচেতনতা নয়। সচেতনতা মানুষের অন্তর্গত ব্যাপার। এটা সচেতনতা নয়; এটা হলো ঠেলার নাম বাবাজি। নিজেরা সচেতন হলে পুলিশ আর সেনা মোতায়ন করতে হতো না।

‘সচেতনতা’ নামে জগৎ সংসারে কোন বই নাই যেটা পড়লে সবাই সচেতন হয়ে যাবে। যদি ‘সচেতনতা’ নামে কোন বই থাকতোও আর সরকার এ দেশের আম জনতার প্রত্যেকের হাতে একটা করে বই তুলে দিত তবুও আমরা সবাই সে বই পড়তাম না (কেউ কেউ পড়তো)। কারণ বইটি পড়তে হবে-এই সচেতনতাও আমাদের মধ্যে নেই। শিক্ষিত হলেই সচেতন হবে এমন কথা অন্তত বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রযোজ্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এনামুল হক জনসমক্ষে বলতেন, সভা সেমিনারে বলতেন- এদেশের শিক্ষিতদের শতকরা নব্বই জনই অশিক্ষিত।

গত দেড় দুই দশকে আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে। শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেড়েছে। জগতের দেশে দেশে পড়াশোনা, চাকরি-বাকরির সুবাদে গমনাগমন বেড়েছে। টিভি দর্শক বেড়েছে। কম্পিউটার ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে। এইসব মানুষের সচেতনতার সহায়ক। এগুলো মানুষকে সচেতন করে। কিন্তু আমরা কি গুণে-মানে-মাপে-মাত্রায় সেই কাক্সিক্ষত মানের সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছি? আমরা কি ভেতরে বাহিরে শিল্প-সুন্দর, চাঁছাছোলা মানবপ্রেমী মাটিপ্রেমী খাঁটি মানুষ তৈরি করতে পেরেছি? সেই নিঃস্বার্থ সচেতন মানুষ কই? আজও পর্যন্ত একটু সুযোগ পেলেই আমরা পাবলিকের শুধু পকেট কাটা না, গলা কাটতে পারলেই খুশি হই। আমরা যেন সদাসর্বদা সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকি। বন্য হিংস্র পশুরা যেমন শিকারের অপেক্ষায় গাছের আড়ালে ওঁৎ পেতে থাকে। আমরা ওঁৎ পেতে থাকি আমাদের কাগুজে সার্টিফিকেট আর ভদ্র চেহারার আড়ালে। করোনা সংক্রমণের প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে। লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র আমাদের ব্যবসায়ীরা ৩৫ টাকার পিয়াজ ৮০, ১০০ আবার কেউ কেউ ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা শুরু করেছেন। যে দোকানদারের কাছে ১০ বস্তা পিয়াজ ছিল তিনি ৯ বস্তা গুদামে পাঠিয়ে দিলেন। ১ বস্তা পিয়াজ সামনে রেখে বললেন পিয়াজ আর নেই। বিক্রি করলেন ৩/৪ গুণ দামে। রসুন, আটা, চাল, চিনি, লবণ, ডাল, তেল সবকিছুর দামই খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল সমান তালে। কারণ এসব ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা সম্পর্কে ‘সচেতন’। ক্রেতার সামনে কোন বুলি আওড়াতে হবে তাও তারা ভালোবাবেই জানেন। সকালে কোন পণ্যটি কত দামে বিক্রি করেছেন এবং বিকালে দাম কত বাড়াতে হবে তাও সচেতনভাবেই করেন। এ দলে রয়েছে আমদানিকারক, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা সবাই। এ ব্যাপারে সবাই এক। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, আইলা, সিডর, করোনা- এসব তাদের জন্য আশীর্বাদ। এদেশে যা কিছু সংকট তা কিছুই সুযোগ। এখন তো এদেশে বেশিরভাগ মানুষই মুসলমান। আর আমাদের মতো এসব সেকেন্ড হ্যান্ড মুসলমানরাই যে কোন দুর্বিপাকের সুযোগ নিয়ে, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ নয় তালগাছ বানিয়ে ফেলেন। এদেশে এসব কাজে আমরা যতটা সচেতন দুনিয়ার ইহুদি, খ্রিস্টান রাষ্ট্রের অধিবাসীরাও ততটা নন বরং তারা এর বিপরীত। যে কোন দুর্যোগ এবং উৎসবে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেন। আমাদের সরকার সাধুবাদ জানাই এ জন্য যে, পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ থেকে পুলিশের অভিযানে- পিটুনি, জেল-জরিমানা যখন শুরু হয়েছে তখন এসব জন্মান্ধ ‘স্বার্থ সচেতন’ ধান্দাবাজরা লেজ গুটাতে শুরু করেছে। গত কয়েক মাস ধরে পিয়াজের মূল্য বৃদ্ধি করে গণমানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তারা নিজেদের লালে লাল করে নিয়েছেন। তারপর লবণ নিয়ে খেল খেলতে চেয়েছিলেন। এবারে করোনাকে পুঁজি করে হয়তো তাদের সর্বপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মহাপরিকল্পনা ছিল। সরকার জনগণের পক্ষে থাকায় ব্যাটে বলে হয়নি।

রুই কাতলা গেল তল/বাইলায় বলে কত জল- বড় ব্যবসায়ী তো বটেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যে মাস্ক বিক্রি করছে করোনার খবরে সেও উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ৫ টাকার মাস্ক বিক্রি শুরু করে ১০ টাকায়, ১০ টাকারটা ২০ টাকায়। বর্তমানে যে মাস্কগুলো ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এদের উৎপাদন খরচ ৫ থেকে ৭ টাকা। তাহলে যেগুলো পূর্বে ৫ টাকা এবং ১০ টাকায় বিক্রি হতো সেগুলোর উৎপাদন খরচ কত? করোনার খবরে পাড়া মহল্লার ওষুধের দোকানেও ডেটল, স্যাভলন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বর্ধিত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এদেশে পণ্যমূল্য বেশি না। উৎপাদন খরচ বা আমদানি খরচ কোনটাই বেশি না শুধু আমাদের ব্যবসায়ীদের লোভ বেশি। KENT-37, KENT-38 গিটে বাত- এর ব্যথায় এ ওষুধগুলো ব্যবহার হয়। আমাদানিকারকের আমদানি খরচ ১০০ থেকে ১২০ টাকা। পাইকারি বিক্রেতা বিক্রি করে ১৫০ টাকায় আর খুচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। চাল, ডালের দাম সাধারণ মানুষ কমবেশি জানে। কিন্তু ওষুধপত্র, প্রসাধন সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, চামড়াজাত দ্রব্য এসবের দাম-দর সম্পর্কে আমজনতা তেমন সচেতন নয়। আর আমাদের এ অসচেতনতার কারণেই বিক্রেতাদের পোয়া বারো।

মোবাইলের ১ সেট হেডফোনের ক্রয়মুল্য ২৭ থেকে ৩০ টাকা। আর সেটাই বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। অভিজাত মার্কেটগুলোতে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। কাওরান বাজারে ১০০ লেবু বিক্রি হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। আর সেই লেবু কারওয়ান বাজার থেকে অতি অল্প দূরত্বে ফার্মগেট আসলেই হালি ৪০ টাকা। আর রমজান মাস এলে তো কথাই নেই। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে রমজান মাস রহমতের মাস। এটা যে কত বড় রহমতের মাস তা সবচেয়ে ভালো বোঝে ব্যবসায়ীরা। কারণ এ একমাসে সারা বছরের কামাই, সারা বছরের উপার্জন। তাদের শুধুই আফসোস রমজান মাস কেন বছরে ৩ বার এলো না। তারা এতই ধার্মিক এবং এতই সচেতন যে, রমজান আসার অনেক দিন আগে থেকেই ট্রাকে ট্রাকে ভোগ্যপণ্য গুদামজাত করা শুরু করে যাতে রমজানে কোন রোজাদার কোন পণ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হয়। মানুষের প্রতি তাদের কত মহব্বত!

প্রতি বছরই রমজানকে সামনে রেখে সরকার বিভিন্ন সংস্থাকে মাঠে নামাচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এবছরও সে রকম ১০টি সংস্থাকে মাঠে নামানো হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এসব সরকারি সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ হারায় না হয় চোখ বন্ধ করে থাকে না হয় অসাধু ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে উঠে।

আমরা যারা ক্রেতা আমাদেরও বাতিক আছে-ত্রুটি আছে। রমজান মাস মানে সংযমের মাস। এ সময়ে আহার বিহার কম হবে। সবাই ইবাদতে মশগুল থাকবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র এর ঠিক উল্টো। রমজানেই খাবার দাবারের মহাধুমধাম। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় সেহেরি, ইফতারের রকমারি আয়োজন। তেলে ঝোলে সয়লাব। উচ্চবিত্তের পরিবারে ইফতারির সময় ডাইনিং টেবিলের অবস্থা দেখলে মনে হয় ইফতারির বাজার সাজানো হয়েছে। এসব ‘ইফতারি সচেতন’ ভোজন রসিকদের পেটপূজার নানা পণ্য সরবরাহ করতে গিয়েইতো ব্যবসায়ীরা মুনাফার হাতটা বাড়িয়ে দেন।

৬০ হাজার টাকার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয় (আমরা বিক্রি করতে বাধ্য হই) ৭শ’ থেকে ১ হাজার টাকায়। সেই গরুর চামড়ার অংশ বিশেষ দিয়ে তৈরি এক জোড়া জুতা আমাদের কিনতে হয় ৪, ৬ কিংবা ৭ হাজার টাকায়। কোরবানির পশুর চামড়ার এ মূল্যটা গরিবের হক, গরিবের প্রাপ্য। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত চামড়ার মূল্য চড়া। শুধু ঈদের দিনে চামড়া জলের দাম। এরাও সচেতন। কীভাবে গরিবের হক মেরে খেতে হবে সে সচেতনতা তাদের আছে। সচেতনতা নেই আমাদের। ৬০ হাজার টাকা খরচা করে যারা কোরবানি দিতে পারে তারা গরিব মানুষদের চামড়ার মূল্যবাবদ সেই ৭শ’ থেকে ১ হাজার টাকাও দিতে পারবে। ক্ষমতাহীন ক্ষমতাসীন কোন সিন্ডিকেটকেই ৮ হাজার ১০ হাজার টাকার চামড়া জলের দামে দিব না। সারা দেশের জনগণের মধ্যে এটুকু চেতনার সঞ্চার হোক, সচেতনতা গড়ে উঠুক। ট্যানারি মালিকসহ চামড়া শিল্পের রথী মহারথীদের টনক নড়বে, প্রমাদ গুণবে, ব্যবসায় ভাটির টান পড়বে।

[লেখক : জয়নুল আবেদীন, সিনিয়র প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ।

মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা, ঢাকা]