ড. আনু মাহ্মুদ
কার্যকর অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন; স্লোগান সামনে রেখে ঢাকায় বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) দুই দিনব্যাপী বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের প্রথম দিনে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ ও বিনিয়োগ চাওয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কার্যকর অংশীদারিত্ব দাবি করে বলা হয়, এতে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। এছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণ ও দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, কার্যকর অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে পুরোপুরিভাবে এসডিজি অর্জনে সাফল্য পাবে বাংলাদেশ। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিএফ বৈঠকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বিডিএফের এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশ্বব্যাব্যাংক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ইউএনডিপি, এআইআইবি, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশের মোট ৭০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন।
এবারের আলোচনার বিষয়গুলো হচ্ছে- বেসরকারি খাতকে উন্নয়নে অংশগ্রহণ ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অর্থায়ন, স্বনির্ভর বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থায়ন ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুযোগ তৈরি করা, স্বাস্থ্যসেবা, অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা প্রদান, টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা, টেকসই নগর, ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর সুরক্ষায় সেবা দেয়া এবং সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা, চতুর্থ শিক্ষা বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি।
এদিকে, এবারের বৈঠকটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। এবারের বৈঠক নিয়ে আশাবাদী ইআরডি সচিব বলেন, উন্নয়নে অর্থায়ন একটি বড় ব্যাপার। দাতাদেশগুলো সহজ শর্তে ও কমসুদে ঋণ দিলে দ্রুত বাংলাদেশর উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু দাতারা বেশিরভাগ সময় ঋণ প্রদানে কঠিন শর্তের আরোপ করে থাকে। এতে সমস্যা তৈরি হয়। রূপকল্প-২১, রূপকল্প-৪১, মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হলে সহজ শর্তের ঋণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার দাতা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্মেলনের প্রথম দিনে জাইকার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মি, জুনিচি ইয়ামাদা, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. হার্টউইগ শেফার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট শিক্সিন চেনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতারাসহ ৩০-৪০ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। বিডিএফের মূল প্রবন্ধ হিসেবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম এবার এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে এগিয়ে চলেছে। এখন সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একইসঙ্গে সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখীসমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ গঠনে কাজ করছে সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এবার ফোরামে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রূপরেখা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সরকারের পদক্ষেপগুলো বা বিভিন্ন আর্থসামাজিক অগ্রাধিকার খাতে সরকারের মধ্যম মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক কূটনীতি
তিন বছর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতিমালা উপস্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, কূটনীতিকদের এখন নতুন নীতিতে কাজ করা উচিত। আমাদের কূটনৈতিক নীতি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে রাজনৈতিক এই দর্শনের বাইরেও যেতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। কীভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিবিড় ও জোরদার করা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে মিশনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের। গত জুলাইয়ে লন্ডনে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনেও বিষয়টির পুনরুল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন সংসদ সদস্যের প্রশ্নের উত্তর দানকালে অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয়টি বিশদ তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সময়ের চাহিদা পূরণে পররাষ্ট্রনীতিতেও সংযোজন ও পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কূটনীতিই হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের উন্নত দেশ বিনির্মাণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কূটনীতি আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ, দক্ষ জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধি এবং নতুন বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আর্থিক বুনিয়াদের ভিত্তি আরও মজবুত করার জন্য বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ বাড়ানোই এ কূটনীতির মূল লক্ষ্য। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রথমে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর সক্রিয়তা জরুরি। সরকার বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং ইতোমধ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করার জন্য বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। আগামী তিন বছরে বাংলাদেশে কোন দেশ কি পরিমাণ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারে তার একটি রূপরেখা দিতে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নির্দেশনাটি গুরুত্বের সঙ্গেই দেখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হবে বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো। কিন্তু পরিতাপের সঙ্গেই বলতে হয়, আমাদের দূতাবাসগুলোর পারফরম্যান্স আশানুরূপ নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, দূতাবাস ও মিশনগুলোর প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্রান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোন সফলতা কি দৃশ্যমান? ব্রান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে বাংলাদেশকে তুলে ধরে দেশের মর্যাদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো সাফল্য দেখাতে পারেনি বেশিরভাগ মিশনই। বিদেশে গণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে তুলে ধরার কাজটি হয়নি সেভাবে। ফলে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সেভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারেনি কখনই। আরও অগ্রহণযোগ্য বিষয় হলো কূটনীতিকদের একটি বড় অংশের মধ্যেই শ্রমবাজার সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে অতীতে। শ্রমবাজারের সংকট দূর করা, নতুন শ্রমবাজার তৈরি, বন্ধ বাজার খোলাকে কূটনৈতিক সম্পর্কের দায়িত্বের মধ্যে নিতে হবে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী লক্ষ্য অর্জনে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি আহরণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য দূতাবাসগুলোর সক্রিয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে স্বপ্রণোদিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক কূটনীতির চর্চার জন্য সবার আগে চাই নিজ দেশ এবং কূটনৈতিক দায়িত্বের প্রতি আন্তরিক অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা। কেন্দ্রীয়ভাবেও বিষয়টি মনিটর করাও আবশ্যক।
[লেখক : প্রাবন্ধিক, অর্থনীতির বিশ্লেষক, কলামিস্ট ]
anumahmud@yahoo.com
শুক্রবার, ২৪ এপ্রিল ২০২০ , ১১ বৈশাখ ১৪২৭, ২৯ শাবান ১৪৪
ড. আনু মাহ্মুদ
কার্যকর অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন; স্লোগান সামনে রেখে ঢাকায় বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) দুই দিনব্যাপী বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের প্রথম দিনে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ ও বিনিয়োগ চাওয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কার্যকর অংশীদারিত্ব দাবি করে বলা হয়, এতে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। এছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণ ও দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, কার্যকর অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে পুরোপুরিভাবে এসডিজি অর্জনে সাফল্য পাবে বাংলাদেশ। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিএফ বৈঠকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বিডিএফের এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশ্বব্যাব্যাংক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ইউএনডিপি, এআইআইবি, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশের মোট ৭০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন।
এবারের আলোচনার বিষয়গুলো হচ্ছে- বেসরকারি খাতকে উন্নয়নে অংশগ্রহণ ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অর্থায়ন, স্বনির্ভর বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থায়ন ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুযোগ তৈরি করা, স্বাস্থ্যসেবা, অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা প্রদান, টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা, টেকসই নগর, ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর সুরক্ষায় সেবা দেয়া এবং সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা, চতুর্থ শিক্ষা বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি।
এদিকে, এবারের বৈঠকটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। এবারের বৈঠক নিয়ে আশাবাদী ইআরডি সচিব বলেন, উন্নয়নে অর্থায়ন একটি বড় ব্যাপার। দাতাদেশগুলো সহজ শর্তে ও কমসুদে ঋণ দিলে দ্রুত বাংলাদেশর উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু দাতারা বেশিরভাগ সময় ঋণ প্রদানে কঠিন শর্তের আরোপ করে থাকে। এতে সমস্যা তৈরি হয়। রূপকল্প-২১, রূপকল্প-৪১, মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হলে সহজ শর্তের ঋণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার দাতা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্মেলনের প্রথম দিনে জাইকার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মি, জুনিচি ইয়ামাদা, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. হার্টউইগ শেফার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট শিক্সিন চেনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতারাসহ ৩০-৪০ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। বিডিএফের মূল প্রবন্ধ হিসেবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম এবার এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে এগিয়ে চলেছে। এখন সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একইসঙ্গে সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখীসমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ গঠনে কাজ করছে সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এবার ফোরামে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রূপরেখা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সরকারের পদক্ষেপগুলো বা বিভিন্ন আর্থসামাজিক অগ্রাধিকার খাতে সরকারের মধ্যম মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক কূটনীতি
তিন বছর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতিমালা উপস্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, কূটনীতিকদের এখন নতুন নীতিতে কাজ করা উচিত। আমাদের কূটনৈতিক নীতি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে রাজনৈতিক এই দর্শনের বাইরেও যেতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। কীভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিবিড় ও জোরদার করা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে মিশনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের। গত জুলাইয়ে লন্ডনে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনেও বিষয়টির পুনরুল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন সংসদ সদস্যের প্রশ্নের উত্তর দানকালে অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয়টি বিশদ তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সময়ের চাহিদা পূরণে পররাষ্ট্রনীতিতেও সংযোজন ও পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কূটনীতিই হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের উন্নত দেশ বিনির্মাণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কূটনীতি আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ, দক্ষ জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধি এবং নতুন বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আর্থিক বুনিয়াদের ভিত্তি আরও মজবুত করার জন্য বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ বাড়ানোই এ কূটনীতির মূল লক্ষ্য। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রথমে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর সক্রিয়তা জরুরি। সরকার বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং ইতোমধ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করার জন্য বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। আগামী তিন বছরে বাংলাদেশে কোন দেশ কি পরিমাণ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারে তার একটি রূপরেখা দিতে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নির্দেশনাটি গুরুত্বের সঙ্গেই দেখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হবে বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো। কিন্তু পরিতাপের সঙ্গেই বলতে হয়, আমাদের দূতাবাসগুলোর পারফরম্যান্স আশানুরূপ নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, দূতাবাস ও মিশনগুলোর প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্রান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোন সফলতা কি দৃশ্যমান? ব্রান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে বাংলাদেশকে তুলে ধরে দেশের মর্যাদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো সাফল্য দেখাতে পারেনি বেশিরভাগ মিশনই। বিদেশে গণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে তুলে ধরার কাজটি হয়নি সেভাবে। ফলে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সেভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারেনি কখনই। আরও অগ্রহণযোগ্য বিষয় হলো কূটনীতিকদের একটি বড় অংশের মধ্যেই শ্রমবাজার সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে অতীতে। শ্রমবাজারের সংকট দূর করা, নতুন শ্রমবাজার তৈরি, বন্ধ বাজার খোলাকে কূটনৈতিক সম্পর্কের দায়িত্বের মধ্যে নিতে হবে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী লক্ষ্য অর্জনে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি আহরণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য দূতাবাসগুলোর সক্রিয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে স্বপ্রণোদিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক কূটনীতির চর্চার জন্য সবার আগে চাই নিজ দেশ এবং কূটনৈতিক দায়িত্বের প্রতি আন্তরিক অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা। কেন্দ্রীয়ভাবেও বিষয়টি মনিটর করাও আবশ্যক।
[লেখক : প্রাবন্ধিক, অর্থনীতির বিশ্লেষক, কলামিস্ট ]
anumahmud@yahoo.com