জিয়াউদ্দীন আহমেদ
মরণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে জনসমাগম নিষিদ্ধ সম্পর্কিত সরকারের নির্দেশ অমান্য করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা যোবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। মাওলানা সাহেব সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। এখন করোনায় আক্রান্ত জীবিত রোগীর কলও অনেক ডাক্তার রিসিভ করেন না। হাসপাতালে ডাক্তার নার্স দারোয়ানও করোনা রোগী ও তার আত্মীয়স্বজন থেকে যোজন মাইল দূরে থাকেন। করোনায় মৃত মাকে সন্তান জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসে। শ্বাসকষ্টে হাসপাতালে অক্সিজেন দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসা ছাড়া একাকী চিৎকার করতে করতে মরতে হয়। মরার পর বউও স্বামীর মরদেহ দেখার আগ্রহ দেখায় না- এমন নির্দয় পৃথিবীতে তিনি হাজার হাজার ভক্তের জানাজা পেয়েছেন। এগুলো বিপত্তি জানা সত্বেওআহম্মক ও নির্বোধ না হলে জনাসমাগমে যোগ দিয়ে নিজের মৃত্যু কেউ নিজে ডেকে আনে না। অতি ধার্মিকেরা অতি বিশ্বাসী- ওরা নিজেও মরে অন্যকেও মারে। করোনা ঠেকাতে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ’র তাওয়াফ বন্ধ, অধিক লোকের জামায়াতে জুমা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বন্ধ, করোনার সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হলে হজও বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- এ অবস্থায়ও জামায়তে ফরজ নামাজ আদায়ের চেয়ে ফরজে কেফায়ার জানাজা এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন কারণ রয়েছে। ভাইরাল হওয়া একটি মেসেজে দুইজনের টেলিফোনে কথোপকথন থেকে মনে হলো, বর্তমান সরকারকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে জানাজায় লোক জড়ো করা হয়েছে। মেসেজটির সত্যাসত্য যাচাই করার কোন ইনস্ট্রুমেন্ট আমার কাছে নেই। যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনসারী হুজুরের জানাজায় হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করেন সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিশু অথৈ-এর করোনা সন্দেহে তার মরদেহ বহনের জন্য মসজিদ কমিটি খাটিয়া দেয়নি, জানাজা পড়াতে কোন ইমাম পাওয়া যায়নি, প্রশাসনিকভাবে গঠিত দাফন কমিটির মাধ্যমে লাশ দাফন করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম। অন্যদিকে ভারতের তামিলনাড়–র এক গ্রামে একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে লকডাউনের ভেতর জমায়েত হয়েছিলো কয়েক হাজার মানুষ।
ধার্মিকদের চিন্তার স্বাধীনতা নেই; বাঁধাধরা তত্ত্ব ও তথ্যের বাইরে ডান বা বাম কোনদিকে তাদের হেলতে দেয়া হয়না। তাই এদের গোয়ার্তুমি থাকা স্বাভাবিক। ধর্ম পালনে এরা এত বেশী বিমোহিত থাকেন যে, শয়তানকে পাথর মারতে গিয়ে শত শত সঙ্গী ধার্মিককে পদদলিত করার সময় পায়ের নিচে কোন শক্ত পদার্থের স্পর্শ অনুভবকরার বোধ থাকে না। সরকার তাই এদের ক্ষেপাবে বলে মনে হয় না। কারণ আবেগে আঘাত লাগলে এরা ক্রুদ্ধও বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে উঠেন, তাদের উত্তেজনা স্ফুলিঙ্গ হয়ে সব কিছু জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের এই ভয়কে তারা উপভোগ করেন, তারা কামনা করেন তাদের অন্ধবিশ্বাসকে সবাই যেন সমীহ করে। ধর্মান্ধদের এই অস্থিরতা সহজাত, তাদের জ্ঞানের অনুশীলন একটি বিষয়ে আবদ্ধ থাকে বিধায় যুক্তির আলো তাদের মনের গহীন অন্ধকারে ঢুকতে পারে না। পৃথক অভ্যাস, পৃথক আকাক্সক্ষা, পৃথক সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, পৃথক মানসিক গঠন- এতগুলো পৃথক নিয়ে একক সমাজ তৈরি করা কঠিন। কারো মজ্জাগত বিশ্বাস টলানো তত সহজ নয়। বিজ্ঞানও তার ভুল স্বীকার করে, জ্ঞানের গভীরতা ও পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানও তার পূর্ব সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করে থাকে। কিন্তু যে কোন অবস্থায়, যে কোন পরিস্থিতিতে ধার্মিকদের মজ্জাগত বিশ্বাসে অটল থাকতে হয়। এদের অনেকে করোনা ভাইরাসের ভয়ে ভীত হলেও মজ্জাগত বিশ্বাসের দৃশ্যমান প্রতীতি সৃষ্টির জন্য উদাসীনতার ভান করেন। এদের গোঁড়ামি এদেরকে আক্রমণাত্মক করে তোলে, এদের মতের বিপক্ষে যুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা যুক্তি প্রদানকারীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়।
রাহ্মণবাড়িয়া তার অনেক কৃর্তীমান ব্যক্তির জন্য ভারত উপমহাদেশ ও বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হতো। শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান রূপে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। বাংলায় ঈশা খাঁ প্রথম অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী, মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ, সেতার ও সানাই বাদক, সুরসম্রাট, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মস্থান রাহ্মণবাড়িয়ায়। ইংল্যান্ডের রানী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে ‘সুরসম্রাট’ খেতাবে ভূষিত করেন; তিনি ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ লাভ করেন, তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি দেয়া হয়। পন্ডিত রবি শঙ্কর ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে অন্নপূর্ণার স্বামী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীরবর্বরতার কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে রবি শঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আবদুল কুদ্দুস মাখন ও ড. আকবর আলী খানের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না, জনগণও স্বাধ্যবিধি মানতে অভ্যস্ত নয়। করোনার সংক্রমণ রোধে প্রথম থেকেই সরকারের গাফলতির কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোরেশোরে প্রচার হচ্ছে। যারা বিমানবন্দরে করোনা বিষয়ক কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন তারা তাদের দায়িত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি, অথবা কিছু বোধহীন অথর্ব লোককে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করাহয়েছিলো। আমার এক আত্মীয় ও এক বন্ধু মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন, কিন্তু তাদের নাকি একটি প্রশ্নও করা হয়নি। তারপর অফিস-আদালত সব ছুটি দিয়ে সারা দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত লোকদের অবাধ যাতায়াতে সায় দেয়া হলো। গার্মেন্টস খোলার ঘোষণা দিয়ে আরেকটি বালসুলভ কাজ করা হলো।
বেঁচে থাকার জন্য যেমন লকডাউন দরকার, আবার বেঁচে থাকার জন্যই কিছু লোকের চলাফেরায় শিথিলতা আবশ্যক। আমাদের দেশে সবার জন্য লকডাউন প্রযোজ্য নয়; ১০ টাকা কেজি দরে চাল ও কম দামে অন্যান্য সামগ্রী কেনার জন্য লোককে রাস্তায় দাঁড়াতে দিতে হবে; ত্রাণ নেয়ার জন্য গরিব লোকদের ছোটাছুটি চলবেই। করোনা থেকে মুক্ত থাকতে আমরা যতই হোম কোয়ারেন্টিনে থাকি না কেন, ফসল মাঠে রেখে কৃষক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে না। তারা ফসল না তুললে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা সম্ভবহবে না। তাই তাদের ঘরে বসে থাকার উপায় নেই। দেশের সবকিছু থেমে থাকলেও কৃষককে দ্বিগুণ উৎসাহউদ্দীপনা নিয়ে ফসল তোলা ও নতুন ফসল লাগানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড?তে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমাদের পতিত জমি নেই, শিল্পায়ন ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফসলি জমি কমছে। কয়েক মাস যাবত সারা পৃথিবীতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ। তাই করোনা পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বব্যাপী একটা ক্রাইসিস দেখা দিতে পারে। এছাড়াও যারা ওষুধ উৎপাদন করছেন, যারা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক তৈরি করছেন, যারা পাউরুটি বানাচ্ছেন, বিস্কিট প্রস্তুত করছেন তাদের বাসায় আবদ্ধ করে রাখা সমীচীন হবে না। ঢাকারকারনবাজার বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকার লোক না খেয়ে মরবে, কৃষক সবজী বিক্রি করতে না পেরে শুধু না খেয়েমরবে না-পরবর্তী উৎপাদনে আগ্রহী হবে না। মাছের বাজার না থাকলে জনগণ মাছ পাবে না- এতে শুধু ভোক্তা নয় মাছচাষিও মরবে। ট্রাক না চললে কৃষিপণ্যসহ অনেক পচনশীল দ্রব্য মাটির নিচে পুঁতে ফেলা ছাড়া গত্যন্তরথাকবে না। মানুষের জীবন মরণের সঙ্গে জড?িত এমন জীবিকা বন্ধ করলে দেশ বন্ধ হয়ে যাবে, মানুষ করোনা ছাড়াই মরবে। বহু কলকারখানা বন্ধ। রিকশাচালক, ভ্যান চালক, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, হাঁস-মুরগির খামার, দুগ্ধ খামার, ফুটপাতের বিক্রেতা, কুলি, মজুর, শ্রমিকদের কোন কাজ নেই, আয় নেই। করোনার সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হলে জনগণের আর্থিক দুর্গতি চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। এখন যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছেতা আরও ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। তাই বলে উক্ত পেশাজীবীদের ঘরের বাইরে আসার সঙ্গে ধর্মীয় বা কোন সামাজিক সম্মিলনকে তুলনা করা যথার্থ হবে না।
আমেরিকা প্রবাসী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুফতি আজম আবু হানিফা হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মে মাসের ১২ তারিখে সুরাইয়া তারার উদয়নের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতালা সারা বিশ্ব থেকে করোনাভাইরাস উঠিয়ে নেবেন। চরম অসহায়ত্বে মানুষ সব বিশ্বাস করে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও অসুস্থ ছেলে বুলবুলকে বাঁচানোর প্রত্যাশায় কালীপূজা করেছিলেন। জর্জ ডাব্লিও বুশের একটি বক্তব্য সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে; তিনি ১৫ বছর পূর্বে পৃথিবীব্যাপী যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করে আমেরিকাকে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন তার সেই বর্ণনার সঙ্গে বর্তমান করোনা ভাইরাসের হুবহু মিল পরিলক্ষিত হয়। বুশ না বলে বাংলাদেশের কেউ বললে আজ তিনি বুজর্গ হয়ে যেতে পারতেন, তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ঐশী বাণী শুনিয়েছেন বলে অনেকে আহ্লাদে আটখানা হতেন। ইতোমধ্যে কিছু দেশ লকডাউন তুলে দিতে যাচ্ছে; পাশ্চাত্যের লোকজন কাজ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে, লকডাউন তুলে নিতে মিছিল পর্যন্ত হচ্ছে। জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সরকার জনগণের চলাফেরা ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে মিডিয়ায় কোন পরামর্শ বা নির্দেশনা দেয়নি, জনগণ নিজে থেকেই সব পরিপালন করছে। লক্ষ লক্ষ অভিবাসী থাকা সত্ত্বেও ঐসব দেশের রাস্তাঘাটে লোকজন গিজগিজ করে না। ভূখণ্ড বিচারে বাংলাদেশ খুবই ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা বিচারে বৃহৎ। জন্ম হার হ্রাসে আওয়ামী লীগ সরকারকে একেবারেই নির্লিপ্ত উদাসীন মনে হয়। একটি অতি ছোট্ট ভূখণ্ডে এত লোকের অবস্থানে শৃঙ্খলা আনতে আলাদীনের প্রদীপ লাগবে, আইনকানুন-পুলিশ-সেনাবাহিনী দিয়ে হবে না।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী, পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com
রবিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২০ , ১২ বৈশাখ ১৪২৭, ২ রমাজান ১৪৪১
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
মরণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে জনসমাগম নিষিদ্ধ সম্পর্কিত সরকারের নির্দেশ অমান্য করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা যোবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। মাওলানা সাহেব সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। এখন করোনায় আক্রান্ত জীবিত রোগীর কলও অনেক ডাক্তার রিসিভ করেন না। হাসপাতালে ডাক্তার নার্স দারোয়ানও করোনা রোগী ও তার আত্মীয়স্বজন থেকে যোজন মাইল দূরে থাকেন। করোনায় মৃত মাকে সন্তান জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসে। শ্বাসকষ্টে হাসপাতালে অক্সিজেন দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসা ছাড়া একাকী চিৎকার করতে করতে মরতে হয়। মরার পর বউও স্বামীর মরদেহ দেখার আগ্রহ দেখায় না- এমন নির্দয় পৃথিবীতে তিনি হাজার হাজার ভক্তের জানাজা পেয়েছেন। এগুলো বিপত্তি জানা সত্বেওআহম্মক ও নির্বোধ না হলে জনাসমাগমে যোগ দিয়ে নিজের মৃত্যু কেউ নিজে ডেকে আনে না। অতি ধার্মিকেরা অতি বিশ্বাসী- ওরা নিজেও মরে অন্যকেও মারে। করোনা ঠেকাতে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ’র তাওয়াফ বন্ধ, অধিক লোকের জামায়াতে জুমা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বন্ধ, করোনার সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হলে হজও বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- এ অবস্থায়ও জামায়তে ফরজ নামাজ আদায়ের চেয়ে ফরজে কেফায়ার জানাজা এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন কারণ রয়েছে। ভাইরাল হওয়া একটি মেসেজে দুইজনের টেলিফোনে কথোপকথন থেকে মনে হলো, বর্তমান সরকারকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে জানাজায় লোক জড়ো করা হয়েছে। মেসেজটির সত্যাসত্য যাচাই করার কোন ইনস্ট্রুমেন্ট আমার কাছে নেই। যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনসারী হুজুরের জানাজায় হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করেন সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিশু অথৈ-এর করোনা সন্দেহে তার মরদেহ বহনের জন্য মসজিদ কমিটি খাটিয়া দেয়নি, জানাজা পড়াতে কোন ইমাম পাওয়া যায়নি, প্রশাসনিকভাবে গঠিত দাফন কমিটির মাধ্যমে লাশ দাফন করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম। অন্যদিকে ভারতের তামিলনাড়–র এক গ্রামে একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে লকডাউনের ভেতর জমায়েত হয়েছিলো কয়েক হাজার মানুষ।
ধার্মিকদের চিন্তার স্বাধীনতা নেই; বাঁধাধরা তত্ত্ব ও তথ্যের বাইরে ডান বা বাম কোনদিকে তাদের হেলতে দেয়া হয়না। তাই এদের গোয়ার্তুমি থাকা স্বাভাবিক। ধর্ম পালনে এরা এত বেশী বিমোহিত থাকেন যে, শয়তানকে পাথর মারতে গিয়ে শত শত সঙ্গী ধার্মিককে পদদলিত করার সময় পায়ের নিচে কোন শক্ত পদার্থের স্পর্শ অনুভবকরার বোধ থাকে না। সরকার তাই এদের ক্ষেপাবে বলে মনে হয় না। কারণ আবেগে আঘাত লাগলে এরা ক্রুদ্ধও বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে উঠেন, তাদের উত্তেজনা স্ফুলিঙ্গ হয়ে সব কিছু জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের এই ভয়কে তারা উপভোগ করেন, তারা কামনা করেন তাদের অন্ধবিশ্বাসকে সবাই যেন সমীহ করে। ধর্মান্ধদের এই অস্থিরতা সহজাত, তাদের জ্ঞানের অনুশীলন একটি বিষয়ে আবদ্ধ থাকে বিধায় যুক্তির আলো তাদের মনের গহীন অন্ধকারে ঢুকতে পারে না। পৃথক অভ্যাস, পৃথক আকাক্সক্ষা, পৃথক সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, পৃথক মানসিক গঠন- এতগুলো পৃথক নিয়ে একক সমাজ তৈরি করা কঠিন। কারো মজ্জাগত বিশ্বাস টলানো তত সহজ নয়। বিজ্ঞানও তার ভুল স্বীকার করে, জ্ঞানের গভীরতা ও পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানও তার পূর্ব সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করে থাকে। কিন্তু যে কোন অবস্থায়, যে কোন পরিস্থিতিতে ধার্মিকদের মজ্জাগত বিশ্বাসে অটল থাকতে হয়। এদের অনেকে করোনা ভাইরাসের ভয়ে ভীত হলেও মজ্জাগত বিশ্বাসের দৃশ্যমান প্রতীতি সৃষ্টির জন্য উদাসীনতার ভান করেন। এদের গোঁড়ামি এদেরকে আক্রমণাত্মক করে তোলে, এদের মতের বিপক্ষে যুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা যুক্তি প্রদানকারীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়।
রাহ্মণবাড়িয়া তার অনেক কৃর্তীমান ব্যক্তির জন্য ভারত উপমহাদেশ ও বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হতো। শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান রূপে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। বাংলায় ঈশা খাঁ প্রথম অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী, মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ, সেতার ও সানাই বাদক, সুরসম্রাট, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মস্থান রাহ্মণবাড়িয়ায়। ইংল্যান্ডের রানী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে ‘সুরসম্রাট’ খেতাবে ভূষিত করেন; তিনি ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ লাভ করেন, তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি দেয়া হয়। পন্ডিত রবি শঙ্কর ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে অন্নপূর্ণার স্বামী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীরবর্বরতার কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে রবি শঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আবদুল কুদ্দুস মাখন ও ড. আকবর আলী খানের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না, জনগণও স্বাধ্যবিধি মানতে অভ্যস্ত নয়। করোনার সংক্রমণ রোধে প্রথম থেকেই সরকারের গাফলতির কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোরেশোরে প্রচার হচ্ছে। যারা বিমানবন্দরে করোনা বিষয়ক কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন তারা তাদের দায়িত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি, অথবা কিছু বোধহীন অথর্ব লোককে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করাহয়েছিলো। আমার এক আত্মীয় ও এক বন্ধু মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন, কিন্তু তাদের নাকি একটি প্রশ্নও করা হয়নি। তারপর অফিস-আদালত সব ছুটি দিয়ে সারা দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত লোকদের অবাধ যাতায়াতে সায় দেয়া হলো। গার্মেন্টস খোলার ঘোষণা দিয়ে আরেকটি বালসুলভ কাজ করা হলো।
বেঁচে থাকার জন্য যেমন লকডাউন দরকার, আবার বেঁচে থাকার জন্যই কিছু লোকের চলাফেরায় শিথিলতা আবশ্যক। আমাদের দেশে সবার জন্য লকডাউন প্রযোজ্য নয়; ১০ টাকা কেজি দরে চাল ও কম দামে অন্যান্য সামগ্রী কেনার জন্য লোককে রাস্তায় দাঁড়াতে দিতে হবে; ত্রাণ নেয়ার জন্য গরিব লোকদের ছোটাছুটি চলবেই। করোনা থেকে মুক্ত থাকতে আমরা যতই হোম কোয়ারেন্টিনে থাকি না কেন, ফসল মাঠে রেখে কৃষক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে না। তারা ফসল না তুললে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা সম্ভবহবে না। তাই তাদের ঘরে বসে থাকার উপায় নেই। দেশের সবকিছু থেমে থাকলেও কৃষককে দ্বিগুণ উৎসাহউদ্দীপনা নিয়ে ফসল তোলা ও নতুন ফসল লাগানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড?তে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমাদের পতিত জমি নেই, শিল্পায়ন ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফসলি জমি কমছে। কয়েক মাস যাবত সারা পৃথিবীতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ। তাই করোনা পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বব্যাপী একটা ক্রাইসিস দেখা দিতে পারে। এছাড়াও যারা ওষুধ উৎপাদন করছেন, যারা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক তৈরি করছেন, যারা পাউরুটি বানাচ্ছেন, বিস্কিট প্রস্তুত করছেন তাদের বাসায় আবদ্ধ করে রাখা সমীচীন হবে না। ঢাকারকারনবাজার বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকার লোক না খেয়ে মরবে, কৃষক সবজী বিক্রি করতে না পেরে শুধু না খেয়েমরবে না-পরবর্তী উৎপাদনে আগ্রহী হবে না। মাছের বাজার না থাকলে জনগণ মাছ পাবে না- এতে শুধু ভোক্তা নয় মাছচাষিও মরবে। ট্রাক না চললে কৃষিপণ্যসহ অনেক পচনশীল দ্রব্য মাটির নিচে পুঁতে ফেলা ছাড়া গত্যন্তরথাকবে না। মানুষের জীবন মরণের সঙ্গে জড?িত এমন জীবিকা বন্ধ করলে দেশ বন্ধ হয়ে যাবে, মানুষ করোনা ছাড়াই মরবে। বহু কলকারখানা বন্ধ। রিকশাচালক, ভ্যান চালক, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, হাঁস-মুরগির খামার, দুগ্ধ খামার, ফুটপাতের বিক্রেতা, কুলি, মজুর, শ্রমিকদের কোন কাজ নেই, আয় নেই। করোনার সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হলে জনগণের আর্থিক দুর্গতি চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। এখন যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছেতা আরও ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। তাই বলে উক্ত পেশাজীবীদের ঘরের বাইরে আসার সঙ্গে ধর্মীয় বা কোন সামাজিক সম্মিলনকে তুলনা করা যথার্থ হবে না।
আমেরিকা প্রবাসী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুফতি আজম আবু হানিফা হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মে মাসের ১২ তারিখে সুরাইয়া তারার উদয়নের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতালা সারা বিশ্ব থেকে করোনাভাইরাস উঠিয়ে নেবেন। চরম অসহায়ত্বে মানুষ সব বিশ্বাস করে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও অসুস্থ ছেলে বুলবুলকে বাঁচানোর প্রত্যাশায় কালীপূজা করেছিলেন। জর্জ ডাব্লিও বুশের একটি বক্তব্য সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে; তিনি ১৫ বছর পূর্বে পৃথিবীব্যাপী যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করে আমেরিকাকে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন তার সেই বর্ণনার সঙ্গে বর্তমান করোনা ভাইরাসের হুবহু মিল পরিলক্ষিত হয়। বুশ না বলে বাংলাদেশের কেউ বললে আজ তিনি বুজর্গ হয়ে যেতে পারতেন, তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ঐশী বাণী শুনিয়েছেন বলে অনেকে আহ্লাদে আটখানা হতেন। ইতোমধ্যে কিছু দেশ লকডাউন তুলে দিতে যাচ্ছে; পাশ্চাত্যের লোকজন কাজ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে, লকডাউন তুলে নিতে মিছিল পর্যন্ত হচ্ছে। জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সরকার জনগণের চলাফেরা ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে মিডিয়ায় কোন পরামর্শ বা নির্দেশনা দেয়নি, জনগণ নিজে থেকেই সব পরিপালন করছে। লক্ষ লক্ষ অভিবাসী থাকা সত্ত্বেও ঐসব দেশের রাস্তাঘাটে লোকজন গিজগিজ করে না। ভূখণ্ড বিচারে বাংলাদেশ খুবই ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা বিচারে বৃহৎ। জন্ম হার হ্রাসে আওয়ামী লীগ সরকারকে একেবারেই নির্লিপ্ত উদাসীন মনে হয়। একটি অতি ছোট্ট ভূখণ্ডে এত লোকের অবস্থানে শৃঙ্খলা আনতে আলাদীনের প্রদীপ লাগবে, আইনকানুন-পুলিশ-সেনাবাহিনী দিয়ে হবে না।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী, পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com