আইসিটি সেক্টরকে বাঁচাতে দরকার সম্মিলিত কাজ

রেজওয়ানা খান

বিশ্ব এখন করোনাভাইরাসের কবলে। আমাদের বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশে দিনকে দিন আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে; যোগ হচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা। বার বার সচেতনতার কথা বলার পরও অনেকেই সেটা নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আবার অনেকে গুরুত্ব বুঝতেও পারছে না। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা অন্য উন্নত দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে এর পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। আমরা এখনো ভয়াবহ কোনো ঘটনার সম্মুখীন হইনি কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দেশেও ইউরোপ বা আমেরিকার মতো পরিস্থিত হবে।

এবার আসি আইসিটি সেক্টরের কথায়। প্রাণের আইসিটি সেক্টর। ফুসফুসে যেন ধাক্কা লেগেছে। করোনায় আমাদের প্রিয় আইসিটি সেক্টরও কোণঠাসা। আমাদের অনেকেই হোম ফ্রম অফিস করছি আবার অনেকে বন্ধ রেখে প্রতিষ্ঠান। কারণ অফিস বন্ধ, নেই স্টাফ। এ ছাড়াও করোনার কারণে বড় ছোট সব ধরনের আইটি প্রতিষ্ঠান আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে। মাস গেলেই আছে অফিস ভাড়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনসহ আরও কত কিছু। আবার যারা আমাদের মতো আইটি উদ্যোক্তা তৈরি কাজে জড়িত, যারা আমরা ইনভেস্টর তারা তো মহবিপদে। নতুন স্টার্টাপগুলোর কি হবে, যেখানে ইনভেস্ট করা আছে সেই প্রতিষ্ঠানের কি হবে? তারা এই করোনা পরিস্থিতি বা পরবর্তী সময়ে কতটুকু এগুতে পারবে? তা নিয়েও চিন্তা একেবারে কম নয়। অফিসের স্টাফদের হয়তো কোনো রকমে এপ্রিল/মে মাসের বেতন দেয়া হবে কিন্তু তারপর আগামী দিনগুলোতে কি হবে? যদি এভাবে লকডাউন বা জীবন বাঁচানোর যুদ্ধই করতে হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো কি হবে।

এদিকে, দেশের ভেতরের কাজের অবস্থা তো আমরা সবাই জানি। আর বিদেশে কাজের জায়গাগুলোতেও একই অবস্থা। যারা বিদেশি ক্লায়েন্ট নিয়ে কাজ করেন তাদের অনেকের হয়তো কাজ বন্ধ আছে। কবে চালু হবে কিংবা কবে থেকে কাজ শুরু হবে অনেকে জানে না। কারণ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কাজের ফেরেনি। সারাবিশ্বে লকডাউনে প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ রেখেছে অনেকে। আবার অনেকের সার্পোট নেয়াও কমে গেছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই পেমেন্টও নেই। আবার মার্চ পর্যন্ত যে প্রতিষ্ঠান যে কাজে ব্যস্ত ছিল হঠাৎ করেই বন্ধ হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান যেখানে ইনভেস্ট করেছে সেগুলো বন্ধ। আইসিটি সেক্টর অবস্থা এমনই। সফটওয়্যার থেকে হার্ডওয়্যার সবারই একই অবস্থা।

যাই হোক, কাজের প্রয়োজনে বা প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সদস্য হিসেবে অনেকে পরামর্শ করছে এখন কিভাবে সামনে এগোনো যায় কিংবা কিভাবে কাজ করা যায়। আমার পরিষ্কার কথা। বেসিসের ইসিসহ সংগঠনের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এটি কারও ব্যক্তিগত কাজ নয়। এটি সংগঠনের কাজ। বেসিসই পারে বেসিস পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে। আর এর জন্য কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে ইসি কমিটির সঙ্গে পুরো ইসি এবং বেসিস লিডার পর্যায়ের অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সম্মিলিত কাজ করলেই আসবে সুফল, সফলতা। তবে আমরা যে কাজই করি না কেন তার স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আর সম্মিলিত কাজ করলে আমরা যে সফল হব সে আশা আলো দেখিয়েছেন, জাগিয়েছেন আমাদের দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাননীয় আইসিটি অ্যাডভাইজার সজীব ওয়াজেদ জয়। এর সঙ্গে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ভাই আমাদের সব সময় সার্বিক সহযোগিতা করেছেন এবং করছেন।

এ ব্যাপারে আমি আরও একটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭২ হাজার কোটি টাকার সহায়তায় প্যাকেজ ঘোষণা নিয়ে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়; প্যাকেজ-১ যা লেখা আছে-

প্যাকেজ-১ : ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেয়া, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেয়া। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

প্যাকেজ-১ এর অন্তর্ভুক্ত আমাদের আইসিটি সেক্টর। এই প্যাকেজটি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এটি নিয়ে আমাদের সবার সহযোগিতা এবং সমন্বয়মূলক কাজ আমাদের একটি সমাধান হতে পারে।

প্যাকেজ-২ এ যা আছে তাও আইসিটি সেক্টরে অন্তর্ভূক্ত। আমরা চেষ্টা করলে প্যাকেজ-২ নিয়েও চেষ্টা করতে পারি। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়; প্যাকেজ-১ যা লেখা আছে-

প্যাকেজ-২ : ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান : ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণ গ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

এ ছাড়াও এবার প্যাকেজ-৫ একটু দেখা যাক সেখানে কি লেখা আছে-

প্যাকেজ-৫: এর আগে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন/ভাতা পরিশোধ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন ৪টিসহ মোট ৫টি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা যা জিডিপি’র প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এই প্যাকেজটির দিকে একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দেখা যায় আমাদের সেক্টর কিন্তু এখন রফতানিমুখী এবং আমাদের হয়তো শ্রমিক নেই কিন্তু আমাদের কর্মচারী তো আছে। আমার এই প্যাকেজ নিয়েও কাজ করতে পারি। সহযোগিতা বা সহায়তার জন্য কাজ তো করা যেতে পারে তাই নয় কি।

এবার আরও একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। করোনা পরিবর্তী আইসিটি সেক্টর বাঁচানোর যুদ্ধ কিন্তু শুধু আমার-আপনার একার নয়। এই যুদ্ধ সবার কারণ করোনা পরিবর্তী সময় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যে কত সাহসী ব্যাপার হবে তা যারা প্রতিষ্ঠানের প্রধান তারাই বুঝতে পারছে। আর শুধু বেসিস নয়, সহায়তার ব্যাপারটি নিয়ে আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরের সব সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কাজ করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে। এর মধ্যে পাঁচটি সংগঠন বেসিস, বিসিএস, আইএসপিএবি, বাক্য ও ই-ক্যাব অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও আবেদনটি পাঠিয়েছে। অবশ্যই সেটি বাহবা পাওয়ার যোগ্য। তারা বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাবে আসন্ন বিপর্যয়ের শঙ্কায় সরকারের কাছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার অনুদান চেয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ এবং এন্টারপ্রেনিওরশিপ সার্পোর্ট ফান্ড (ইএসএফ) থেকে অর্থপ্রাপ্তি সহজীকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে আবেদনে। একইসঙ্গে ঋণ গ্রহণের এক বছর পর থেকে ২ শতাংশ সুদে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান এবং নিয়োজিত ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে ইএসএফ তহবিল থেকে অর্থপ্রাপ্তিতে সম্পত্তি বন্ধকীসহ বিদ্যমান জটিলতা বাদ দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে অনুরোধ করা হয়েছে। সাধুবাদ জানাই।

আমি বেসিসের সদস্য হিসেবে এবার বেসিসের সদস্যদের কথা বলি। বেসিস ইসি সদস্য অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার কারণ করোনা পরিস্থিতির প্রথম থেকে তারা সদস্যদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ইসি চাইলে করোনার এই সময় বেসিসের অভিজ্ঞ সদস্যদেরও যুক্ত করতে পারে বিভিন্ন কাজে। হয়তো সেক্ষেত্রে কিছু চাপ হলেও কমে যাবে তাদের। এ ছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় আইসিটি উপদেষ্টাকে অনেক ধন্যবাদ শিল্প ও আইসিটিসহ অন্যান্য সার্ভিস ব্যবসার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা প্যাকেজ দেয়ার জন্য। এখন আমাদের অ্যাসোসিয়েশনগুলোর কাজ হচ্ছে আমাদের মেম্বার সার্টিফিকেটগুলো একটা গ্যারান্টি ফর্ম হিসেবে ব্যাংকগুলোকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা, ব্যাংকিং গাইডলাইনে এই জিনিস রাখতেই হবে। না হলে কোলেটরাল দিয়ে আমাদের আইটি কোম্পানিগুলো ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ব্যাংক লোন পাবে না।

আইসিটি সেক্টরকে ভালোবেসে কাজ করে যাচ্ছি প্রায় ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে। মানপ্রাণ দিয়ে চাই এই সেক্টরের যেন বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয় কিন্তু করোনায় এ সেক্টরের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে সত্যিই আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিভাবে এই সেক্টরকে বাঁচানো যায় তা নিয়ে ভাবছি, কাজ করছি প্রতিনিয়ত। করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্মিলিতভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে আমাদের। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাঁচাতে মাঝারি এবং বড় বড় আইসিটি প্রতিষ্ঠান। কারণ আইসিটি সেক্টরে সবারই গুরুত্ব সমান। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরা যদি করোনার এই দুর্যোগ কেটে উঠতে পারি, করোনা মোকাবিলা করে আমরা যদি টিকে থাকতে পারি তাহলে ২০২০ সাল অর্থাৎ মুজিববর্ষে এটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।

[লেখক : সিইও, স্টার কম্পিউটার সিস্টেমস লিমিটেড (এসসিএসএল)]

সোমবার, ২৭ এপ্রিল ২০২০ , ১৩ বৈশাখ ১৪২৭, ৩ রমাজান ১৪৪১

আইসিটি সেক্টরকে বাঁচাতে দরকার সম্মিলিত কাজ

রেজওয়ানা খান

বিশ্ব এখন করোনাভাইরাসের কবলে। আমাদের বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশে দিনকে দিন আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে; যোগ হচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা। বার বার সচেতনতার কথা বলার পরও অনেকেই সেটা নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আবার অনেকে গুরুত্ব বুঝতেও পারছে না। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা অন্য উন্নত দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে এর পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। আমরা এখনো ভয়াবহ কোনো ঘটনার সম্মুখীন হইনি কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দেশেও ইউরোপ বা আমেরিকার মতো পরিস্থিত হবে।

এবার আসি আইসিটি সেক্টরের কথায়। প্রাণের আইসিটি সেক্টর। ফুসফুসে যেন ধাক্কা লেগেছে। করোনায় আমাদের প্রিয় আইসিটি সেক্টরও কোণঠাসা। আমাদের অনেকেই হোম ফ্রম অফিস করছি আবার অনেকে বন্ধ রেখে প্রতিষ্ঠান। কারণ অফিস বন্ধ, নেই স্টাফ। এ ছাড়াও করোনার কারণে বড় ছোট সব ধরনের আইটি প্রতিষ্ঠান আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে। মাস গেলেই আছে অফিস ভাড়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনসহ আরও কত কিছু। আবার যারা আমাদের মতো আইটি উদ্যোক্তা তৈরি কাজে জড়িত, যারা আমরা ইনভেস্টর তারা তো মহবিপদে। নতুন স্টার্টাপগুলোর কি হবে, যেখানে ইনভেস্ট করা আছে সেই প্রতিষ্ঠানের কি হবে? তারা এই করোনা পরিস্থিতি বা পরবর্তী সময়ে কতটুকু এগুতে পারবে? তা নিয়েও চিন্তা একেবারে কম নয়। অফিসের স্টাফদের হয়তো কোনো রকমে এপ্রিল/মে মাসের বেতন দেয়া হবে কিন্তু তারপর আগামী দিনগুলোতে কি হবে? যদি এভাবে লকডাউন বা জীবন বাঁচানোর যুদ্ধই করতে হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো কি হবে।

এদিকে, দেশের ভেতরের কাজের অবস্থা তো আমরা সবাই জানি। আর বিদেশে কাজের জায়গাগুলোতেও একই অবস্থা। যারা বিদেশি ক্লায়েন্ট নিয়ে কাজ করেন তাদের অনেকের হয়তো কাজ বন্ধ আছে। কবে চালু হবে কিংবা কবে থেকে কাজ শুরু হবে অনেকে জানে না। কারণ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কাজের ফেরেনি। সারাবিশ্বে লকডাউনে প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ রেখেছে অনেকে। আবার অনেকের সার্পোট নেয়াও কমে গেছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই পেমেন্টও নেই। আবার মার্চ পর্যন্ত যে প্রতিষ্ঠান যে কাজে ব্যস্ত ছিল হঠাৎ করেই বন্ধ হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান যেখানে ইনভেস্ট করেছে সেগুলো বন্ধ। আইসিটি সেক্টর অবস্থা এমনই। সফটওয়্যার থেকে হার্ডওয়্যার সবারই একই অবস্থা।

যাই হোক, কাজের প্রয়োজনে বা প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সদস্য হিসেবে অনেকে পরামর্শ করছে এখন কিভাবে সামনে এগোনো যায় কিংবা কিভাবে কাজ করা যায়। আমার পরিষ্কার কথা। বেসিসের ইসিসহ সংগঠনের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এটি কারও ব্যক্তিগত কাজ নয়। এটি সংগঠনের কাজ। বেসিসই পারে বেসিস পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে। আর এর জন্য কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে ইসি কমিটির সঙ্গে পুরো ইসি এবং বেসিস লিডার পর্যায়ের অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সম্মিলিত কাজ করলেই আসবে সুফল, সফলতা। তবে আমরা যে কাজই করি না কেন তার স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আর সম্মিলিত কাজ করলে আমরা যে সফল হব সে আশা আলো দেখিয়েছেন, জাগিয়েছেন আমাদের দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাননীয় আইসিটি অ্যাডভাইজার সজীব ওয়াজেদ জয়। এর সঙ্গে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ভাই আমাদের সব সময় সার্বিক সহযোগিতা করেছেন এবং করছেন।

এ ব্যাপারে আমি আরও একটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭২ হাজার কোটি টাকার সহায়তায় প্যাকেজ ঘোষণা নিয়ে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়; প্যাকেজ-১ যা লেখা আছে-

প্যাকেজ-১ : ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেয়া, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেয়া। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

প্যাকেজ-১ এর অন্তর্ভুক্ত আমাদের আইসিটি সেক্টর। এই প্যাকেজটি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এটি নিয়ে আমাদের সবার সহযোগিতা এবং সমন্বয়মূলক কাজ আমাদের একটি সমাধান হতে পারে।

প্যাকেজ-২ এ যা আছে তাও আইসিটি সেক্টরে অন্তর্ভূক্ত। আমরা চেষ্টা করলে প্যাকেজ-২ নিয়েও চেষ্টা করতে পারি। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়; প্যাকেজ-১ যা লেখা আছে-

প্যাকেজ-২ : ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান : ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণ গ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

এ ছাড়াও এবার প্যাকেজ-৫ একটু দেখা যাক সেখানে কি লেখা আছে-

প্যাকেজ-৫: এর আগে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন/ভাতা পরিশোধ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন ৪টিসহ মোট ৫টি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা যা জিডিপি’র প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এই প্যাকেজটির দিকে একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দেখা যায় আমাদের সেক্টর কিন্তু এখন রফতানিমুখী এবং আমাদের হয়তো শ্রমিক নেই কিন্তু আমাদের কর্মচারী তো আছে। আমার এই প্যাকেজ নিয়েও কাজ করতে পারি। সহযোগিতা বা সহায়তার জন্য কাজ তো করা যেতে পারে তাই নয় কি।

এবার আরও একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। করোনা পরিবর্তী আইসিটি সেক্টর বাঁচানোর যুদ্ধ কিন্তু শুধু আমার-আপনার একার নয়। এই যুদ্ধ সবার কারণ করোনা পরিবর্তী সময় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যে কত সাহসী ব্যাপার হবে তা যারা প্রতিষ্ঠানের প্রধান তারাই বুঝতে পারছে। আর শুধু বেসিস নয়, সহায়তার ব্যাপারটি নিয়ে আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরের সব সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কাজ করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে। এর মধ্যে পাঁচটি সংগঠন বেসিস, বিসিএস, আইএসপিএবি, বাক্য ও ই-ক্যাব অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও আবেদনটি পাঠিয়েছে। অবশ্যই সেটি বাহবা পাওয়ার যোগ্য। তারা বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাবে আসন্ন বিপর্যয়ের শঙ্কায় সরকারের কাছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার অনুদান চেয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ এবং এন্টারপ্রেনিওরশিপ সার্পোর্ট ফান্ড (ইএসএফ) থেকে অর্থপ্রাপ্তি সহজীকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে আবেদনে। একইসঙ্গে ঋণ গ্রহণের এক বছর পর থেকে ২ শতাংশ সুদে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান এবং নিয়োজিত ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে ইএসএফ তহবিল থেকে অর্থপ্রাপ্তিতে সম্পত্তি বন্ধকীসহ বিদ্যমান জটিলতা বাদ দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে অনুরোধ করা হয়েছে। সাধুবাদ জানাই।

আমি বেসিসের সদস্য হিসেবে এবার বেসিসের সদস্যদের কথা বলি। বেসিস ইসি সদস্য অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার কারণ করোনা পরিস্থিতির প্রথম থেকে তারা সদস্যদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ইসি চাইলে করোনার এই সময় বেসিসের অভিজ্ঞ সদস্যদেরও যুক্ত করতে পারে বিভিন্ন কাজে। হয়তো সেক্ষেত্রে কিছু চাপ হলেও কমে যাবে তাদের। এ ছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় আইসিটি উপদেষ্টাকে অনেক ধন্যবাদ শিল্প ও আইসিটিসহ অন্যান্য সার্ভিস ব্যবসার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা প্যাকেজ দেয়ার জন্য। এখন আমাদের অ্যাসোসিয়েশনগুলোর কাজ হচ্ছে আমাদের মেম্বার সার্টিফিকেটগুলো একটা গ্যারান্টি ফর্ম হিসেবে ব্যাংকগুলোকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা, ব্যাংকিং গাইডলাইনে এই জিনিস রাখতেই হবে। না হলে কোলেটরাল দিয়ে আমাদের আইটি কোম্পানিগুলো ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ব্যাংক লোন পাবে না।

আইসিটি সেক্টরকে ভালোবেসে কাজ করে যাচ্ছি প্রায় ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে। মানপ্রাণ দিয়ে চাই এই সেক্টরের যেন বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয় কিন্তু করোনায় এ সেক্টরের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে সত্যিই আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিভাবে এই সেক্টরকে বাঁচানো যায় তা নিয়ে ভাবছি, কাজ করছি প্রতিনিয়ত। করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্মিলিতভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে আমাদের। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাঁচাতে মাঝারি এবং বড় বড় আইসিটি প্রতিষ্ঠান। কারণ আইসিটি সেক্টরে সবারই গুরুত্ব সমান। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরা যদি করোনার এই দুর্যোগ কেটে উঠতে পারি, করোনা মোকাবিলা করে আমরা যদি টিকে থাকতে পারি তাহলে ২০২০ সাল অর্থাৎ মুজিববর্ষে এটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।

[লেখক : সিইও, স্টার কম্পিউটার সিস্টেমস লিমিটেড (এসসিএসএল)]