বাঙালির ভাষা রাষ্ট্রের পিতা ॥ ভাষা রাষ্ট্র গড়ার সূচনা লগ্ন

মোস্তাফা জব্বার

ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পর বাঙালিরা প্রথম ধাক্কাটি পায় তার ভাষা নিয়ে। কিছুদিনের মাঝেই সেটি কেবল ভাষায় সীমিত থাকেনি, আক্রমণের ভিত্তি বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন ধারার ওপরও সম্প্রসারিত হয়। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয় যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যার বাসিন্দারা বাঙালি তারা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র। ফলে ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে। পুরো ইতিহাসটি পর্যালোচনা করলে প্রশ্নাতীতভাবে উপলব্ধি করা যাবে যে, এই ভাষা রাষ্ট্রের জনক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই সঙ্গে বাঙালির ভাষা রাষ্ট্রের জনককে চিনতে হলে তাই প্রারম্ভিকভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততা জানা দরকার। বাংলাদেশেরই একদল সুশীল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, ভাষা আন্দোলনেই নাকি জাতির পিতার কোন সম্পৃক্ত ছিলো না। আসুন ইতিহাসের পাতার দিকে চোখ খুলে তাকাই।

ভাষা রাষ্ট্র গড়ার সূচনা লগ্ন : ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করলেন। ফলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। দেশ বিভাগের পূর্বে ছাত্রদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৭ সালের আগষ্টে এই ছাত্র সংগঠনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র একুশ দিনের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর কমরুদ্দিন আহাম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নুরুদ্দিন আহম্মদ, আবদুল অদুদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হয়। এর প্রধান কারণ ছিল বাঙালির ভাষা, কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। ভাবতে অবাক লাগে যে বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের পিতা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একুশ দিনের মাঝেই ভাষারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেন। দূরদর্শীতার কথা ভাবতেই হবে।

মুসলমানদের জন্য ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে এমনটা বঙ্গবন্ধু তখনই টের পেয়েছিলেন। ফলে উক্ত সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক বলেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক।’ এভাবেই ভাষার দাবি প্রথম বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। (সূত্র : ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গাজীউল হক, ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)।

অনুভূত হয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই এই রাষ্ট্র যে বাঙালিদের নয় সেটি বঙ্গবন্ধু ও তার সঙ্গীরা উপলব্ধি করেন ও অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গড়ে তোলে তার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গড়ে তোলার দাবি উত্থাপন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু আরও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। তিনি ছাত্রদের সংগঠিত করার জন্য গড়ে তোলেন ছাত্রলীগ।

কলকাতায় ছাত্রদের দুটি গ্রুপ ছিল। একটির নেতৃত্বে শেখ মুজিব, অপরটির নেতৃত্বে শাহ আজিজ। ঢাকায় এসে শাহ আজিজ গ্রুপ সরকার সমর্থক হয়ে যায়, কিন্তু শেখ মুজিবের অংশ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক সভায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে পুনর্গঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’-এ লিখেছেন, ‘ওই সভায় শেখ মুজিব উপস্থিত না থাকলেও তাকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করা হয়। শেখ মুজিব তা শুধু মেনেই নেননি, বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।’ এটি এখন অনুভব করা যায় যে বঙ্গবন্ধুর হাতে ছাত্রলীগের গড়ে ওঠাটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের জাতিসত্তার লড়াইতে এই সংগঠনটির কোন তূলনা হতে পারেনা।

ইতিহাসের অংশ হিসেবে এর আগের ইতিহাস একটু জানা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর জিয়াউদ্দিন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যেহেতু স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে সেহেতু উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। পাকিস্তান নিশ্চিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউদ্দিনের উপরোক্ত মতামত প্রচারিত হলে ড. মো. শহীদুল্লাহ এর প্রেক্ষিতে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি জোরালোভাবে বলেন- ‘উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়। যদি বিদেশি ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাস্তিানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই।’ তার এই বক্তব্যের পক্ষে বা বিপক্ষে তখন কেউ কোন মন্তব্য করেছে বলে মনে হয় না। কেননা তখন সকলের দৃষ্টি ভারত বিভক্তি এবং নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তির দিকে।

তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙালির জন্য প্রাথমিক শিক্ষণীয় ভাষা অবশ্যই বাংলা হইবে। উম্মাদ ব্যতীত কেহই ইহার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করিতে পারিবে না।’ পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য না করার ফলে এ নিয়ে বড় কোনো ধরনের বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই রাষ্ট্রভাষার সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। কেননা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটি বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়েছিল। বিশেষত পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান (১৮৮৯-১৯৭৩) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে মতামত রেখেছিলেন ১৯৪৭ সালের ১৮ মে তারিখে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দেয়া না হলেও বাংলাকে অবমূল্যায়ন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। উর্দুর পক্ষে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট ছিলো। তখন সচেতন মহল আশঙ্কা করেন, যে কোন মুহূর্তে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সরকারি ঘোষণা আসতে পারে। গণতান্ত্রিক যুবলীগ ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত তাদের সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা’ করার দাবি জানায়। ঐ সময়ে প্রয়াত ড. মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-৮১) তার এক নিবন্ধে লেখেন যে, উর্দু প্রচলিত হলে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক রাষ্ট্রিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংস ঘনিয়ে আসবে এবং সর্ব বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের যন্ত্র। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র তিন মাসের মধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে এতসব প্রতিক্রিয়ার পরও করাচিতে ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত শিক্ষা- সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান, মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও আবদুল হামিদ ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সম্ভবত এটিই সরকারের প্রথম উদ্যোগ ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়। এই সংবাদ ৬ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে প্রকাশিত মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে তীব্র্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের প্রাঙ্গনে ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা করা হয়। এটিই রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে ছাত্রদের প্রথম সাধারণ সমাবেশ। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাশেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, একেএম আহসান, কল্যাণ দাশগুপ্ত ও এস আহমদ প্রমুখ। সভার প্রস্তাব পাঠ করেন ফরিদ আহমদ। সমাবেশ শেষে ছাত্ররা মিছিল সহকারে সচিবালয় এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ছাত্রদের অংশগ্রহণ দেখে বিভিন্ন স্তরের মানুষও এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। এরই ফলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের পক্ষ থেকে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং মনি অর্ডার, ডাকটিকিট ও টাকায় ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা লেখার আবেদন জানানো হয়।

বাঙালি প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নির্দেশে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে একটি পত্র লেখেন। তাতে বলা হয়, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা বাংলা ভাষায় উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করতে চান এবং এর জন্য তার সাহায্য পেলে তারা উপকৃত হবেন।’ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চিঠির জবাব দেননি এবং তার মর্ম সংবাদপত্রে প্রেরণ করেন যা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তৎকালীন প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার প্রাদেশিক পরিষদে ৮ এপ্রিল ১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলায় সরকারি অফিস ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষা চালুর বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং বাংলা আরবী হরফে লেখার পক্ষে জোর প্রস্তাব রাখেন। (বশির আল হেলাল প্রণীত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ. ৬১৯)।

ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার প্রসঙ্গটি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনের গণপরিষদ ইংরেজির সঙ্গে উর্দু ভাষা ব্যবহারের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার সম্পর্কিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) আনীত সংশোধনী প্রস্তাবের উপর ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার উপরে আলোচনা শুরু হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঐতিহাসিক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং জোরালো ভাষায় এর পক্ষে বক্তব্য রাখেন। তিনি যা বলেন তার ভাবানুবাদ এমন- এটি রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা এবং মর্যাদাটাও অনন্য। এই রাষ্ট্রের ছয় কোটি নব্বই লাখ মানুষের মাঝে চার কোটি চল্লিশ লাখ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। সুতরাং রাষ্ট্রের ভাষা কি হওয়া উচিত? রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত এবং সেই কারণেই আমি মনে করি বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।’

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সম্মানিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের বিরোধিতা করে দীর্ঘ বক্তৃতায় যা ব?লেন তার ভাবানুবাদ হলো- ‘পাকিস্তান একটি মুসলমান রাষ্ট্র এবং সেজন্য এই রাষ্ট্রের ভাষা একটি মুসলিম ভাষাই হতে হবে। আমি বছরের পর বছর কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলিতে কখনও কাউকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলতে শুনিনি। আমি জানতে চাই এখন কেন এই দাবি ওঠলো। এই দাবি পাকিস্তানের মানুষদেরকে বিভক্ত করার একটি প্রয়াস। এই সংশোধনী মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য।’

দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলিম লীগ দলের কোন বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে সমর্থন করে কথা বলেননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার গণমানুষের ভাষার স্বপক্ষে কথা বলেননি বরং খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে যা বলেন তার ভাবানুবাদ এমন: সংসদ নেতা এটি স্পষ্ট করেছেন যে বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা রাখা হবে এবং আমি বিশ্বাস করি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা করার কোন যৌক্তিক কারণ নাই তবে বাংলা প্রদেশের জন্য এটি হতে পারে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত বাংলা ভাষা প্রস্তাব ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তান সরকারের একগুঁয়েমি এবং মুসলিম লীগ নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের আচরণকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে, ‘... করাচিতে গণপরিষদে এই মর্মে প্রস্তাব পাস করা হলো যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন থেকেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। তখন কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একমাত্র এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। আমি অবাক হয়ে যাই, ওই সময় আমাদের বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ কি করেছিল? ...’

ঢাকা। ২৬ এপ্রিল, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল ২০২০ , ১৪ বৈশাখ ১৪২৭, ৪ রমাজান ১৪৪১

বাঙালির ভাষা রাষ্ট্রের পিতা ॥ ভাষা রাষ্ট্র গড়ার সূচনা লগ্ন

মোস্তাফা জব্বার

ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পর বাঙালিরা প্রথম ধাক্কাটি পায় তার ভাষা নিয়ে। কিছুদিনের মাঝেই সেটি কেবল ভাষায় সীমিত থাকেনি, আক্রমণের ভিত্তি বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন ধারার ওপরও সম্প্রসারিত হয়। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয় যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যার বাসিন্দারা বাঙালি তারা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র। ফলে ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে। পুরো ইতিহাসটি পর্যালোচনা করলে প্রশ্নাতীতভাবে উপলব্ধি করা যাবে যে, এই ভাষা রাষ্ট্রের জনক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই সঙ্গে বাঙালির ভাষা রাষ্ট্রের জনককে চিনতে হলে তাই প্রারম্ভিকভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততা জানা দরকার। বাংলাদেশেরই একদল সুশীল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, ভাষা আন্দোলনেই নাকি জাতির পিতার কোন সম্পৃক্ত ছিলো না। আসুন ইতিহাসের পাতার দিকে চোখ খুলে তাকাই।

ভাষা রাষ্ট্র গড়ার সূচনা লগ্ন : ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করলেন। ফলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। দেশ বিভাগের পূর্বে ছাত্রদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৭ সালের আগষ্টে এই ছাত্র সংগঠনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র একুশ দিনের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর কমরুদ্দিন আহাম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নুরুদ্দিন আহম্মদ, আবদুল অদুদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হয়। এর প্রধান কারণ ছিল বাঙালির ভাষা, কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। ভাবতে অবাক লাগে যে বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের পিতা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একুশ দিনের মাঝেই ভাষারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেন। দূরদর্শীতার কথা ভাবতেই হবে।

মুসলমানদের জন্য ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে এমনটা বঙ্গবন্ধু তখনই টের পেয়েছিলেন। ফলে উক্ত সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক বলেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক।’ এভাবেই ভাষার দাবি প্রথম বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। (সূত্র : ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গাজীউল হক, ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)।

অনুভূত হয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই এই রাষ্ট্র যে বাঙালিদের নয় সেটি বঙ্গবন্ধু ও তার সঙ্গীরা উপলব্ধি করেন ও অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গড়ে তোলে তার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গড়ে তোলার দাবি উত্থাপন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু আরও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। তিনি ছাত্রদের সংগঠিত করার জন্য গড়ে তোলেন ছাত্রলীগ।

কলকাতায় ছাত্রদের দুটি গ্রুপ ছিল। একটির নেতৃত্বে শেখ মুজিব, অপরটির নেতৃত্বে শাহ আজিজ। ঢাকায় এসে শাহ আজিজ গ্রুপ সরকার সমর্থক হয়ে যায়, কিন্তু শেখ মুজিবের অংশ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক সভায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে পুনর্গঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’-এ লিখেছেন, ‘ওই সভায় শেখ মুজিব উপস্থিত না থাকলেও তাকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করা হয়। শেখ মুজিব তা শুধু মেনেই নেননি, বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।’ এটি এখন অনুভব করা যায় যে বঙ্গবন্ধুর হাতে ছাত্রলীগের গড়ে ওঠাটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের জাতিসত্তার লড়াইতে এই সংগঠনটির কোন তূলনা হতে পারেনা।

ইতিহাসের অংশ হিসেবে এর আগের ইতিহাস একটু জানা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর জিয়াউদ্দিন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যেহেতু স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে সেহেতু উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। পাকিস্তান নিশ্চিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউদ্দিনের উপরোক্ত মতামত প্রচারিত হলে ড. মো. শহীদুল্লাহ এর প্রেক্ষিতে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি জোরালোভাবে বলেন- ‘উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়। যদি বিদেশি ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাস্তিানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই।’ তার এই বক্তব্যের পক্ষে বা বিপক্ষে তখন কেউ কোন মন্তব্য করেছে বলে মনে হয় না। কেননা তখন সকলের দৃষ্টি ভারত বিভক্তি এবং নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তির দিকে।

তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙালির জন্য প্রাথমিক শিক্ষণীয় ভাষা অবশ্যই বাংলা হইবে। উম্মাদ ব্যতীত কেহই ইহার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করিতে পারিবে না।’ পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য না করার ফলে এ নিয়ে বড় কোনো ধরনের বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই রাষ্ট্রভাষার সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। কেননা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটি বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়েছিল। বিশেষত পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান (১৮৮৯-১৯৭৩) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে মতামত রেখেছিলেন ১৯৪৭ সালের ১৮ মে তারিখে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দেয়া না হলেও বাংলাকে অবমূল্যায়ন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। উর্দুর পক্ষে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট ছিলো। তখন সচেতন মহল আশঙ্কা করেন, যে কোন মুহূর্তে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সরকারি ঘোষণা আসতে পারে। গণতান্ত্রিক যুবলীগ ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত তাদের সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা’ করার দাবি জানায়। ঐ সময়ে প্রয়াত ড. মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-৮১) তার এক নিবন্ধে লেখেন যে, উর্দু প্রচলিত হলে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক রাষ্ট্রিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংস ঘনিয়ে আসবে এবং সর্ব বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের যন্ত্র। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র তিন মাসের মধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে এতসব প্রতিক্রিয়ার পরও করাচিতে ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত শিক্ষা- সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান, মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও আবদুল হামিদ ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সম্ভবত এটিই সরকারের প্রথম উদ্যোগ ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়। এই সংবাদ ৬ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে প্রকাশিত মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে তীব্র্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের প্রাঙ্গনে ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা করা হয়। এটিই রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে ছাত্রদের প্রথম সাধারণ সমাবেশ। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাশেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, একেএম আহসান, কল্যাণ দাশগুপ্ত ও এস আহমদ প্রমুখ। সভার প্রস্তাব পাঠ করেন ফরিদ আহমদ। সমাবেশ শেষে ছাত্ররা মিছিল সহকারে সচিবালয় এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ছাত্রদের অংশগ্রহণ দেখে বিভিন্ন স্তরের মানুষও এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। এরই ফলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের পক্ষ থেকে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং মনি অর্ডার, ডাকটিকিট ও টাকায় ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা লেখার আবেদন জানানো হয়।

বাঙালি প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নির্দেশে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে একটি পত্র লেখেন। তাতে বলা হয়, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা বাংলা ভাষায় উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করতে চান এবং এর জন্য তার সাহায্য পেলে তারা উপকৃত হবেন।’ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চিঠির জবাব দেননি এবং তার মর্ম সংবাদপত্রে প্রেরণ করেন যা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তৎকালীন প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার প্রাদেশিক পরিষদে ৮ এপ্রিল ১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলায় সরকারি অফিস ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষা চালুর বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং বাংলা আরবী হরফে লেখার পক্ষে জোর প্রস্তাব রাখেন। (বশির আল হেলাল প্রণীত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ. ৬১৯)।

ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার প্রসঙ্গটি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনের গণপরিষদ ইংরেজির সঙ্গে উর্দু ভাষা ব্যবহারের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার সম্পর্কিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) আনীত সংশোধনী প্রস্তাবের উপর ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার উপরে আলোচনা শুরু হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঐতিহাসিক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং জোরালো ভাষায় এর পক্ষে বক্তব্য রাখেন। তিনি যা বলেন তার ভাবানুবাদ এমন- এটি রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা এবং মর্যাদাটাও অনন্য। এই রাষ্ট্রের ছয় কোটি নব্বই লাখ মানুষের মাঝে চার কোটি চল্লিশ লাখ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। সুতরাং রাষ্ট্রের ভাষা কি হওয়া উচিত? রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত এবং সেই কারণেই আমি মনে করি বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।’

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সম্মানিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের বিরোধিতা করে দীর্ঘ বক্তৃতায় যা ব?লেন তার ভাবানুবাদ হলো- ‘পাকিস্তান একটি মুসলমান রাষ্ট্র এবং সেজন্য এই রাষ্ট্রের ভাষা একটি মুসলিম ভাষাই হতে হবে। আমি বছরের পর বছর কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলিতে কখনও কাউকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলতে শুনিনি। আমি জানতে চাই এখন কেন এই দাবি ওঠলো। এই দাবি পাকিস্তানের মানুষদেরকে বিভক্ত করার একটি প্রয়াস। এই সংশোধনী মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য।’

দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলিম লীগ দলের কোন বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে সমর্থন করে কথা বলেননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার গণমানুষের ভাষার স্বপক্ষে কথা বলেননি বরং খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে যা বলেন তার ভাবানুবাদ এমন: সংসদ নেতা এটি স্পষ্ট করেছেন যে বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা রাখা হবে এবং আমি বিশ্বাস করি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা করার কোন যৌক্তিক কারণ নাই তবে বাংলা প্রদেশের জন্য এটি হতে পারে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত বাংলা ভাষা প্রস্তাব ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তান সরকারের একগুঁয়েমি এবং মুসলিম লীগ নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের আচরণকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে, ‘... করাচিতে গণপরিষদে এই মর্মে প্রস্তাব পাস করা হলো যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন থেকেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। তখন কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একমাত্র এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। আমি অবাক হয়ে যাই, ওই সময় আমাদের বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ কি করেছিল? ...’

ঢাকা। ২৬ এপ্রিল, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com