স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন

মোহাম্মদ শাহজাহান

করোনাভাইরাসের মহামারী ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশ্বে ২৫ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ। করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ১১ জানুয়ারি। ৯০ দিনের মাথায় ১০ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই সংখ্যা ১ লাখ থেকে ২ লাখে পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ১৫ দিন। দেশে সংক্রমণের সংখ্যা ২৫ এপ্রিল (৪৯তম দিনে) উন্নীত হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৮ জনে। আর মৃতের সংখ্যা ১৪০ জন। এদিকে ২৮ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ২৪০ জন। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সাধারণ ছুটি ও কার্যত লকডাউনের এক মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৯৯ শতাংশ। ঢাকায় যেমন রোগী শনাক্ত বাড়ছে, তেমনি ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন নতুন করে জেলা-উপজেলা-গ্রামে নতুন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের একজন সাবেক পরিচালক বিবিসিকে বলেছেন, ‘গত কয়েক দিনের চিত্রে দেখা যায়, রোগের বিস্তার তো কমছেই না, বরং বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকার কোনো লক্ষণও নেই।’ আসলে করোনার মতো শক্তিশালী ও ভয়ংকর শত্রুকে মোকাবিলার জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়োজন, সে তুলনায় বাংলাদেশ এর ধারে কাছেও নেই। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সর্বত্রই যেন একটা অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতা চলছে। কোথাও কোনো সমন্বয় নেই। গত এক মাস ধরে দেশে ঘোষিত ও অঘোষিত লকডাউন চলছে। মানুষকে ঘরে রাখার জন্য পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত রাস্তায় নামানো হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। হয় মাছ বাজার, নয় কাঁচাবাজার বা ত্রাণের আশায় অথবা বিনা কাজে নানা অজুহাতে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে একত্র হতে দেখা যাচ্ছে। সারা দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত শত শত হাসপাতালে রোগীদের কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতাল খোলা থাকলেও সেগুলোতে চরম অরাজকতা চলছে। ডাক্তারদের চেম্বারগুলো বন্ধ। করোনার অজুহাতে চিকিৎসকগণ অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীদেরও চিকিৎসা দিচ্ছেন না। সবচেয়ে দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ও কষ্টের কথা হলো করোনা যুদ্ধের সম্মুখ সারির যোদ্ধা, ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ডবয় অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য চার মাসেও পিপিই ও অন্য সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। ইতিমধ্যে কয়েকশ ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর এই সংখ্যা প্রতিদিন উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন যে হারে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, এতেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, এখনো স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার তেমন কোনো ব্যবস্থাই হয়নি। স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী যদি নিশ্চিতভাবেই থাকতো তাহলে সরকার প্রধানকে এ ব্যাপারে কথা বলতে হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে দুটি বিভাগের ৮ জেলার কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরবরাহ করা পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্কের মান নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। মেডিকেল সামগ্রী গ্রহণ করার সময় কেবল মোড়ক না দেখে ভেতরের বস্তুটিও দেখে এবং বুঝে নিতে হবে। এন-৯৫ মাস্ক লেখা, কিন্তু ভেতরে যে জিনিসটা, সেটা সঠিক থাকে কিনা, এটা দেখা দরকার। একই সঙ্গে হাসপাতালে মানসম্পন্ন পিপিই যাচ্ছে কিনা, তা তদারক করারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এই ছোট্ট দেশে অনেক খবরই প্রধানমন্ত্রী পেয়ে যান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি আমাদের মন্ত্রীর কাছে কিছু ছবি পাঠিয়েছি। যারা সাপ্লাই (সরবরাহ) দেয়, তারা কি সঠিকভাবে সব জিনিস দিচ্ছে কিনা? মহানগর হাসপাতালে কিছু জিনিস গেছে, পিপিই নাম দিচ্ছে বেশ ভালো, কিন্তু জিনিসগুলো বোধ হয় ঠিকমতো যায়নি। এটা একটু আপনাদের খোঁজ করে দেখা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে কি আমাদের বুঝা উচিত নয় যে, ডাক্তারদের পিপিই’র নামে ভেজাল সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হয়েছে?

বিবিসিসহ গণমাধ্যমে ভুক্তভোগী স্বাস্থ্যকর্মীদের বক্তব্যসহ বিভিন্নভাবে উঠে আসছে অদ্যাবধি তাদের সুরক্ষা সামগ্রী পরিপূর্ণভাবে দেয়া হয়নি। আবার যেখানে দেখা হয়েছে সেখানে ভেজাল সামগ্রী দেয়া হয়েছে। আবার কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম দেয়া হয়েছে। একজন ডাক্তার কয়েকদিন আগে বিবিসিকে বলেছেন, একদিকে পিপিই তো মানসম্পন্ন নয়, অন্যদিকে ডাক্তারদের ওগুলো দেয়া হলেও নার্সদের চাহিদামতো দেয়া হয়নি। টেকনিশিয়ানদের বেলায়ও একই কথা। আবার আয়া বা ওয়ার্ডবয়দের তো পিপিই-ই দেয়া হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, আয়া বা ওয়ার্ডবয়দের সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া না হলে তারা নিজেরা যেমন সংক্রমিত হবেন, আবার তাদের মাধ্যমে অন্যরা হবেন। এমতাবস্থায় চিকিৎসকদের সঙ্গে কর্মরত সংশ্লিষ্ট সকলকে সুরক্ষা সামগ্রীসহ তাদের আবাসন ও যাতায়াত ব্যবস্থার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট প-িত ব্যক্তিদের বলতে চাই- ‘কিছু লোককে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়, সব লোককে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না।’ স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা শুরু থেকে বলে আসছেন, সব ঠিক আছে, সব ব্যবস্থা আছে, কোনো সমস্যা নেই, কোনো সমস্যা হবে না- এসব বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এটা তো ঠিক, করোনা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যখন যা চায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ব্যবস্থা করে দেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রীরা যার যার দফতর পরিচালনা করলেও বাংলাদেশে একটু ব্যতিক্রম। এ দেশে প্রায় সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন থেকেই করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশ সামাল দেয়ার কর্মসূচি প্রণয়ন করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলার কাজে নিয়োজিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ কোনো কিছুই ভালোভাবে সামাল দিতে পারছেন না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২২ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ ৪৩৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। বিএমএ-এর দেয়া তালিকায় বলা হয়, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসার কারণে আরো সহস্রাধিক স্বাস্থ্যকর্মীকে হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এতো বিপুল সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হওয়ার কারণগুলো বলা হচ্ছে- এক. মানহীন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ও মাস্ক; দুই. অনেক হাসপাতালে পিপিই সরবরাহ করা হয়নি, যেখানে করা হয়েছে সবাই তা পায়নি; তিন. সরবরাহ করা পিপিই কীভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহারের পর কীভাবে জীবাণুমুক্ত করে খুলতে হবে- এসব বিষয়ে অধিকাংশ স্বাস্থ্যকর্মীর ধারণা নেই এবং চার. সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের অব্যবস্থাপনা। চারদিকে সংকট আর সমস্যা। কোথাও যেন কোনো সুখবর নেই। রোগীর তুলনায় পরীক্ষা বাড়ছে না, পরীক্ষার কিটের মজুদ নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা, হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি, আইসিইউ সিটের স্বল্পতা তো আছেই। নতুন অভিযোগ উঠেছে- সন্দেহভাজন করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহে মেয়াদোত্তীর্ণ টিউব ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করা হচ্ছে। আইইডিসিআর থেকে দেয়া এসব টিউবের ২০১৮ সালের জানুয়ারি এবং সিরিঞ্জের ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মেয়াদ পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে যাওয়া টিউব ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে অনেকের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এই টিউব ও সিরিঞ্জ আর জীবাণুমুক্ত থাকে না এবং ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়।

অনেকেই মনে করেন বর্তমানের চরম অব্যবস্থাপূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ভাইরাসটি সারা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে এটি মোকাবিলা করার সক্ষমতা আমাদের থাকবে না। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও পরম সুহৃদ, আওয়ামী লীগের দুর্দিনের বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর দৈনিক সংবাদ বলতে বাধ্য হয়েছে : ‘স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান নেতৃত্ব দিয়ে করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না।’ ২০ এপ্রিল দৈনিক সংবাদ ‘চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা দিন- বর্তমান সেটআপ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্ষম নয়’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছে- টানা ৭ বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন জাহিদ মালেক। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কাজের কাজ কিছু করতে না পারলেও নানা ইস্যুতে একাধিকবার সমালোচিত হয়েছেন। এবার চিকিৎসকদের পিপিই সরবরাহ নিয়েও তীব্র সমালোচনার মুখে এই মন্ত্রী। বিশেষ করে এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, মাস্ক সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে মন্ত্রীর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে। একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর এমন ব্যর্থতা, অযোগ্যতা এবং অবিমৃশ্যকারিতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জাহিদ মালিক স্বাস্থ্যখাতের কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি নন। তিনি একজন ব্যবসায়ী। কাজেই গোটা স্বাস্থ্য খাতকে নিজের ব্যবসার উপকরণ বানিয়ে নেয়া তার জন্য অস্বাভাবিক কাজ নয়। আমরা চাই, এ অযোগ্য ব্যক্তিকে অতিদ্রুত অপসারণ করা হোক এবং স্বাস্থ্যখাতে অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল এবং কর্মনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হোক। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সচিব, ডিজিসহ শীর্ষদের অনেকেই তাদের বর্তমান দায়িত্ব থেকে সরে গেলে ভালো হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার ভয় না থাকলে অন্যসব পত্রিকাও করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষমাহীন ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা নিয়ে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাকীয় লিখতো। ইতিমধ্যে ত্রাণ চোরদের খবর ছাপানোর দায়ে দুই সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে প্রতিদিনের গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার কেচ্ছাকাহিনী প্রকাশিত হয়ে আসছে।

গত চার মাসে করোনাভাইরাসের গতি-প্রকৃতি-বিস্তৃতি প্রমাণ করেছে, যেসব দেশ শুরু থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করেছে, সেসব দেশে করোনার ভয়াল রূপ দেখা যায়নি। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কারণে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। আর যেসব দেশ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দিক-নির্দেশনা মেনে এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ না করে উদাসীনতা দেখিয়েছে, গাফেলতি করেছে- সেসব দেশকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত মালদ্বীপে করোনায় ১০০ জন আক্রান্ত হয়েছে- একজনও মারা যায়নি। একইভাবে নেপালে করোনায় ৩১ জন ও ভুটানে ৬ জন আক্রান্ত হলেও এ পর্যন্ত একজনও মারা যায়নি। এই তিনটি দেশই করোনা প্রতিরোধে শুরু থেকেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন দেশে লকডাউন ও কারফিউ জারির মাধ্যমে জনগণকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়।

বাংলাদেশে করোনা বিস্তারে স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা ক’জন জানি, করোনা আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ঘরেই চিকিৎসা সম্ভব। ২০ শতাংশকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। সর্দি, কাশি ও জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিহিস্টাসিন জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। তবে শ্বাসকষ্ট ও গলায় ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়। দেশের সকল মানুষকে জানাতে হবে- করোনা প্রতিরোধের কোনো ওষুধ নেই, টিকা নেই। খুবই ছোঁয়াচে রোগ এটা। ঘরে থাকা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। করোনায় আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ ঘরে বসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যায়। শ্বাসকষ্ট ও গলা ব্যথা না হলে হাসপাতালে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার একমাত্র উপায়- সকলকে ঘরে থাকতে হবে। আরেকটি দরকারি বিষয় হচ্ছে, তথ্য গোপন করা যাবে না। এই প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। তা না হলে প্রথমে আক্রান্ত রোগীর ঘরের লোকজনের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হয়ে যাবে। গ্রামে-গঞ্জে-পাড়ায় এক বাড়িতে বহু লোক বাস করে। কাজেই ‘বাড়িতে থাকা’ না বলে ‘ঘরে’ থাকার কথা বলতে হবে।

তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন, সঙ্গনিরোধ, কোয়ারেন্টিন- এই শব্দগুলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে বোধগম্য নয়। গণমাধ্যমে বিশেষ করে টেলিভিশন সহজ ভাষায় এ কথাগুলো প্রচার করতে পারে। সোজা কথায় বলতে হবে- একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক, মুছাফা করতে পারবে না। যে কোনো অবস্থানে দু’ব্যক্তির মধ্যে কয়েক হাত দূরত্ব থাকতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একাকী রাখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ- এই কঠিন-বিদঘুটে শব্দগুলো পরিপূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে। সর্বোপরি দেশের ১৬/১৭ কোটি মানুষকে করোনা থেকে বেঁচে থাকার উপায়গুলো সহজ ভাষায় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের পরিপূর্ণভাবে সচেতন করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আমরা করোনা যুদ্ধের প্রথম সারির সম্মুখ যোদ্ধা বলে থাকি। কিন্তু আসল যোদ্ধা হচ্ছেন আম-জনতা। দেশের সকল জনগণকে নিয়ে করোনা-যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু মনের অজান্তেই করোনা পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। যে কোনো মূল্যে টেস্ট বা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। উল্লেখ্য, করোনা পরীক্ষায় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি ১০ লাখে মাত্র ৮০ জনের শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২১ জন, সেখানে গড়ে প্রতি ১০ লাখে ৫ হাজার ৩৬৩ জনের পরীক্ষা হচ্ছে। ভুটানে প্রতি ১০ লাখ গড়ে ১ হাজার ৫১ জন, পাকিস্তানে গড়ে ৩৩২ জন, শ্রীলংকায় ২২৩ জন, নেপালে ২১৬, ভারতে ১৭৭ জনের। অন্যদিকে ইতালিতে প্রতি ১০ লাখে গড়ে ১৭ হাজার ৭৫৮ জন, জার্মানিতে গড়ে ১৫ হাজার ৭৩০, স্পেনে ১২ হাজার ৮৩৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৯ হাজার ৩৬৭ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ হাজার ৪২৬ জনের করোনা শনাক্তের পরীক্ষা হচ্ছে।

সবশেষে, সংক্রমণের হার কমাতে হবে। লকডাউনের কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে- আস্থায় নিতে হবে এবং জীবন বাঁচাতে হবে। একটি জাতীয় দৈনিক (সংবাদ) ২৬ এপ্রিল তাদের লিড নিউজে বলেছে, ‘লকডাউনের এক মাসে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, অর্থনৈতিক স্থবিরতা বেড়েছে।’ এই অবস্থায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কার্যকর করতে না পারলে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে।

কবি বলেছেন, ‘মরিতে চাহে না কেহ সুন্দর ভুবনে’- এই দুনিয়ায় কেউ মরতে চায় না। জনগণকে সচেতন করা গেলে তারা নিজেদের স্বার্থেই মেলামেশা ছেড়ে বিচ্ছিন্ন থাকবে, করোনা পরীক্ষায় উৎসাহী হবে, অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি গোপন রাখবে না। জনগণ সচেতন হলে নিজেদের স্বার্থেই তা মেনে চলবে।

২৬ এপ্রিল ২০২০

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল ২০২০ , ১৪ বৈশাখ ১৪২৭, ৪ রমাজান ১৪৪১

স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন

মোহাম্মদ শাহজাহান

করোনাভাইরাসের মহামারী ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশ্বে ২৫ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ। করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ১১ জানুয়ারি। ৯০ দিনের মাথায় ১০ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই সংখ্যা ১ লাখ থেকে ২ লাখে পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ১৫ দিন। দেশে সংক্রমণের সংখ্যা ২৫ এপ্রিল (৪৯তম দিনে) উন্নীত হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৮ জনে। আর মৃতের সংখ্যা ১৪০ জন। এদিকে ২৮ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ২৪০ জন। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সাধারণ ছুটি ও কার্যত লকডাউনের এক মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৯৯ শতাংশ। ঢাকায় যেমন রোগী শনাক্ত বাড়ছে, তেমনি ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন নতুন করে জেলা-উপজেলা-গ্রামে নতুন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের একজন সাবেক পরিচালক বিবিসিকে বলেছেন, ‘গত কয়েক দিনের চিত্রে দেখা যায়, রোগের বিস্তার তো কমছেই না, বরং বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকার কোনো লক্ষণও নেই।’ আসলে করোনার মতো শক্তিশালী ও ভয়ংকর শত্রুকে মোকাবিলার জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়োজন, সে তুলনায় বাংলাদেশ এর ধারে কাছেও নেই। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সর্বত্রই যেন একটা অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতা চলছে। কোথাও কোনো সমন্বয় নেই। গত এক মাস ধরে দেশে ঘোষিত ও অঘোষিত লকডাউন চলছে। মানুষকে ঘরে রাখার জন্য পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত রাস্তায় নামানো হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। হয় মাছ বাজার, নয় কাঁচাবাজার বা ত্রাণের আশায় অথবা বিনা কাজে নানা অজুহাতে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে একত্র হতে দেখা যাচ্ছে। সারা দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত শত শত হাসপাতালে রোগীদের কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতাল খোলা থাকলেও সেগুলোতে চরম অরাজকতা চলছে। ডাক্তারদের চেম্বারগুলো বন্ধ। করোনার অজুহাতে চিকিৎসকগণ অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীদেরও চিকিৎসা দিচ্ছেন না। সবচেয়ে দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ও কষ্টের কথা হলো করোনা যুদ্ধের সম্মুখ সারির যোদ্ধা, ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ডবয় অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য চার মাসেও পিপিই ও অন্য সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। ইতিমধ্যে কয়েকশ ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর এই সংখ্যা প্রতিদিন উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন যে হারে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, এতেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, এখনো স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার তেমন কোনো ব্যবস্থাই হয়নি। স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী যদি নিশ্চিতভাবেই থাকতো তাহলে সরকার প্রধানকে এ ব্যাপারে কথা বলতে হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে দুটি বিভাগের ৮ জেলার কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরবরাহ করা পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্কের মান নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। মেডিকেল সামগ্রী গ্রহণ করার সময় কেবল মোড়ক না দেখে ভেতরের বস্তুটিও দেখে এবং বুঝে নিতে হবে। এন-৯৫ মাস্ক লেখা, কিন্তু ভেতরে যে জিনিসটা, সেটা সঠিক থাকে কিনা, এটা দেখা দরকার। একই সঙ্গে হাসপাতালে মানসম্পন্ন পিপিই যাচ্ছে কিনা, তা তদারক করারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এই ছোট্ট দেশে অনেক খবরই প্রধানমন্ত্রী পেয়ে যান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি আমাদের মন্ত্রীর কাছে কিছু ছবি পাঠিয়েছি। যারা সাপ্লাই (সরবরাহ) দেয়, তারা কি সঠিকভাবে সব জিনিস দিচ্ছে কিনা? মহানগর হাসপাতালে কিছু জিনিস গেছে, পিপিই নাম দিচ্ছে বেশ ভালো, কিন্তু জিনিসগুলো বোধ হয় ঠিকমতো যায়নি। এটা একটু আপনাদের খোঁজ করে দেখা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে কি আমাদের বুঝা উচিত নয় যে, ডাক্তারদের পিপিই’র নামে ভেজাল সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হয়েছে?

বিবিসিসহ গণমাধ্যমে ভুক্তভোগী স্বাস্থ্যকর্মীদের বক্তব্যসহ বিভিন্নভাবে উঠে আসছে অদ্যাবধি তাদের সুরক্ষা সামগ্রী পরিপূর্ণভাবে দেয়া হয়নি। আবার যেখানে দেখা হয়েছে সেখানে ভেজাল সামগ্রী দেয়া হয়েছে। আবার কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম দেয়া হয়েছে। একজন ডাক্তার কয়েকদিন আগে বিবিসিকে বলেছেন, একদিকে পিপিই তো মানসম্পন্ন নয়, অন্যদিকে ডাক্তারদের ওগুলো দেয়া হলেও নার্সদের চাহিদামতো দেয়া হয়নি। টেকনিশিয়ানদের বেলায়ও একই কথা। আবার আয়া বা ওয়ার্ডবয়দের তো পিপিই-ই দেয়া হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, আয়া বা ওয়ার্ডবয়দের সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া না হলে তারা নিজেরা যেমন সংক্রমিত হবেন, আবার তাদের মাধ্যমে অন্যরা হবেন। এমতাবস্থায় চিকিৎসকদের সঙ্গে কর্মরত সংশ্লিষ্ট সকলকে সুরক্ষা সামগ্রীসহ তাদের আবাসন ও যাতায়াত ব্যবস্থার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট প-িত ব্যক্তিদের বলতে চাই- ‘কিছু লোককে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়, সব লোককে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না।’ স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা শুরু থেকে বলে আসছেন, সব ঠিক আছে, সব ব্যবস্থা আছে, কোনো সমস্যা নেই, কোনো সমস্যা হবে না- এসব বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এটা তো ঠিক, করোনা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যখন যা চায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ব্যবস্থা করে দেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রীরা যার যার দফতর পরিচালনা করলেও বাংলাদেশে একটু ব্যতিক্রম। এ দেশে প্রায় সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন থেকেই করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশ সামাল দেয়ার কর্মসূচি প্রণয়ন করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলার কাজে নিয়োজিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ কোনো কিছুই ভালোভাবে সামাল দিতে পারছেন না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২২ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ ৪৩৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। বিএমএ-এর দেয়া তালিকায় বলা হয়, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসার কারণে আরো সহস্রাধিক স্বাস্থ্যকর্মীকে হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এতো বিপুল সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হওয়ার কারণগুলো বলা হচ্ছে- এক. মানহীন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ও মাস্ক; দুই. অনেক হাসপাতালে পিপিই সরবরাহ করা হয়নি, যেখানে করা হয়েছে সবাই তা পায়নি; তিন. সরবরাহ করা পিপিই কীভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহারের পর কীভাবে জীবাণুমুক্ত করে খুলতে হবে- এসব বিষয়ে অধিকাংশ স্বাস্থ্যকর্মীর ধারণা নেই এবং চার. সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের অব্যবস্থাপনা। চারদিকে সংকট আর সমস্যা। কোথাও যেন কোনো সুখবর নেই। রোগীর তুলনায় পরীক্ষা বাড়ছে না, পরীক্ষার কিটের মজুদ নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা, হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি, আইসিইউ সিটের স্বল্পতা তো আছেই। নতুন অভিযোগ উঠেছে- সন্দেহভাজন করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহে মেয়াদোত্তীর্ণ টিউব ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করা হচ্ছে। আইইডিসিআর থেকে দেয়া এসব টিউবের ২০১৮ সালের জানুয়ারি এবং সিরিঞ্জের ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মেয়াদ পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে যাওয়া টিউব ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে অনেকের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এই টিউব ও সিরিঞ্জ আর জীবাণুমুক্ত থাকে না এবং ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়।

অনেকেই মনে করেন বর্তমানের চরম অব্যবস্থাপূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ভাইরাসটি সারা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে এটি মোকাবিলা করার সক্ষমতা আমাদের থাকবে না। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও পরম সুহৃদ, আওয়ামী লীগের দুর্দিনের বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর দৈনিক সংবাদ বলতে বাধ্য হয়েছে : ‘স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান নেতৃত্ব দিয়ে করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না।’ ২০ এপ্রিল দৈনিক সংবাদ ‘চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা দিন- বর্তমান সেটআপ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্ষম নয়’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছে- টানা ৭ বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন জাহিদ মালেক। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কাজের কাজ কিছু করতে না পারলেও নানা ইস্যুতে একাধিকবার সমালোচিত হয়েছেন। এবার চিকিৎসকদের পিপিই সরবরাহ নিয়েও তীব্র সমালোচনার মুখে এই মন্ত্রী। বিশেষ করে এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, মাস্ক সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে মন্ত্রীর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে। একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর এমন ব্যর্থতা, অযোগ্যতা এবং অবিমৃশ্যকারিতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জাহিদ মালিক স্বাস্থ্যখাতের কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি নন। তিনি একজন ব্যবসায়ী। কাজেই গোটা স্বাস্থ্য খাতকে নিজের ব্যবসার উপকরণ বানিয়ে নেয়া তার জন্য অস্বাভাবিক কাজ নয়। আমরা চাই, এ অযোগ্য ব্যক্তিকে অতিদ্রুত অপসারণ করা হোক এবং স্বাস্থ্যখাতে অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল এবং কর্মনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হোক। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সচিব, ডিজিসহ শীর্ষদের অনেকেই তাদের বর্তমান দায়িত্ব থেকে সরে গেলে ভালো হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার ভয় না থাকলে অন্যসব পত্রিকাও করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষমাহীন ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা নিয়ে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাকীয় লিখতো। ইতিমধ্যে ত্রাণ চোরদের খবর ছাপানোর দায়ে দুই সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে প্রতিদিনের গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার কেচ্ছাকাহিনী প্রকাশিত হয়ে আসছে।

গত চার মাসে করোনাভাইরাসের গতি-প্রকৃতি-বিস্তৃতি প্রমাণ করেছে, যেসব দেশ শুরু থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করেছে, সেসব দেশে করোনার ভয়াল রূপ দেখা যায়নি। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কারণে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। আর যেসব দেশ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দিক-নির্দেশনা মেনে এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ না করে উদাসীনতা দেখিয়েছে, গাফেলতি করেছে- সেসব দেশকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত মালদ্বীপে করোনায় ১০০ জন আক্রান্ত হয়েছে- একজনও মারা যায়নি। একইভাবে নেপালে করোনায় ৩১ জন ও ভুটানে ৬ জন আক্রান্ত হলেও এ পর্যন্ত একজনও মারা যায়নি। এই তিনটি দেশই করোনা প্রতিরোধে শুরু থেকেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন দেশে লকডাউন ও কারফিউ জারির মাধ্যমে জনগণকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়।

বাংলাদেশে করোনা বিস্তারে স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা ক’জন জানি, করোনা আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ঘরেই চিকিৎসা সম্ভব। ২০ শতাংশকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। সর্দি, কাশি ও জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিহিস্টাসিন জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। তবে শ্বাসকষ্ট ও গলায় ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়। দেশের সকল মানুষকে জানাতে হবে- করোনা প্রতিরোধের কোনো ওষুধ নেই, টিকা নেই। খুবই ছোঁয়াচে রোগ এটা। ঘরে থাকা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। করোনায় আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ ঘরে বসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যায়। শ্বাসকষ্ট ও গলা ব্যথা না হলে হাসপাতালে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার একমাত্র উপায়- সকলকে ঘরে থাকতে হবে। আরেকটি দরকারি বিষয় হচ্ছে, তথ্য গোপন করা যাবে না। এই প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। তা না হলে প্রথমে আক্রান্ত রোগীর ঘরের লোকজনের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হয়ে যাবে। গ্রামে-গঞ্জে-পাড়ায় এক বাড়িতে বহু লোক বাস করে। কাজেই ‘বাড়িতে থাকা’ না বলে ‘ঘরে’ থাকার কথা বলতে হবে।

তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন, সঙ্গনিরোধ, কোয়ারেন্টিন- এই শব্দগুলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে বোধগম্য নয়। গণমাধ্যমে বিশেষ করে টেলিভিশন সহজ ভাষায় এ কথাগুলো প্রচার করতে পারে। সোজা কথায় বলতে হবে- একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক, মুছাফা করতে পারবে না। যে কোনো অবস্থানে দু’ব্যক্তির মধ্যে কয়েক হাত দূরত্ব থাকতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একাকী রাখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ- এই কঠিন-বিদঘুটে শব্দগুলো পরিপূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে। সর্বোপরি দেশের ১৬/১৭ কোটি মানুষকে করোনা থেকে বেঁচে থাকার উপায়গুলো সহজ ভাষায় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের পরিপূর্ণভাবে সচেতন করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আমরা করোনা যুদ্ধের প্রথম সারির সম্মুখ যোদ্ধা বলে থাকি। কিন্তু আসল যোদ্ধা হচ্ছেন আম-জনতা। দেশের সকল জনগণকে নিয়ে করোনা-যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু মনের অজান্তেই করোনা পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। যে কোনো মূল্যে টেস্ট বা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। উল্লেখ্য, করোনা পরীক্ষায় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি ১০ লাখে মাত্র ৮০ জনের শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২১ জন, সেখানে গড়ে প্রতি ১০ লাখে ৫ হাজার ৩৬৩ জনের পরীক্ষা হচ্ছে। ভুটানে প্রতি ১০ লাখ গড়ে ১ হাজার ৫১ জন, পাকিস্তানে গড়ে ৩৩২ জন, শ্রীলংকায় ২২৩ জন, নেপালে ২১৬, ভারতে ১৭৭ জনের। অন্যদিকে ইতালিতে প্রতি ১০ লাখে গড়ে ১৭ হাজার ৭৫৮ জন, জার্মানিতে গড়ে ১৫ হাজার ৭৩০, স্পেনে ১২ হাজার ৮৩৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৯ হাজার ৩৬৭ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ হাজার ৪২৬ জনের করোনা শনাক্তের পরীক্ষা হচ্ছে।

সবশেষে, সংক্রমণের হার কমাতে হবে। লকডাউনের কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে- আস্থায় নিতে হবে এবং জীবন বাঁচাতে হবে। একটি জাতীয় দৈনিক (সংবাদ) ২৬ এপ্রিল তাদের লিড নিউজে বলেছে, ‘লকডাউনের এক মাসে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, অর্থনৈতিক স্থবিরতা বেড়েছে।’ এই অবস্থায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কার্যকর করতে না পারলে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে।

কবি বলেছেন, ‘মরিতে চাহে না কেহ সুন্দর ভুবনে’- এই দুনিয়ায় কেউ মরতে চায় না। জনগণকে সচেতন করা গেলে তারা নিজেদের স্বার্থেই মেলামেশা ছেড়ে বিচ্ছিন্ন থাকবে, করোনা পরীক্ষায় উৎসাহী হবে, অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি গোপন রাখবে না। জনগণ সচেতন হলে নিজেদের স্বার্থেই তা মেনে চলবে।

২৬ এপ্রিল ২০২০

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com