জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার আয়বৈষম্যও বাড়ছে। এর ফলে শুধু ধনীদের সম্পদ বাড়ছে। আর এতে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবেচনায় শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় আবারও উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে গত দশকে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) বেড়েছে ১৪.৩ শতাংশ হারে। চলতি মাসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্স প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বাহ্যিক বিবেচনায় ইতিবাচক মনে হলেও আসলে তা নয়। দেশে সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করে কোটিপতি হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই। অথচ এখানেই শত শত কোটিপতির উদ্ভব ঘটেছে, যাদের বৈধ আয়ে কোটিপতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একজন যদি সৎভাবে জীবনযাপন করেন এবং অন্যজন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন; তাহলে যিনি দুর্নীতিতে নিমিজ্জিত হবেন, তার আয় বাড়বে। ফলে সৎ ব্যক্তির সঙ্গে তার অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে।
যারা ধনী হচ্ছেন তারা নিয়মবহির্ভূতভাবেই হচ্ছেন, একাই বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ছেন, দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করে নির্বিবাদে বিদেশে পাচার করছেন। এমন দৃষ্টান্ত অহরহ চোখে পড়ছে; যেখানে যিনি ব্যবসায়ী, তিনিই জনপ্রতিনিধি, তিনিই শিল্পপতি আবার তিনিই শ্রমিক নেতা। অর্থাৎ ক্ষমতা ও দখলদারিত্বের মৌরসীপাট্টা খুলে বসেছেন পুঁজিপতিরা এবং সেই আয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনাই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে কোনরকম অগ্রগতি নেই বাংলাদেশের।
অর্থনীতিতে বাস্তব অবস্থা হল যাদের বেশি করে ট্যাক্স দেয়ার কথা তারা কম ট্যাক্স বা কোন ট্যাক্সই দেয় না, আর যারা কম ট্যাক্স দেয়ার কথা তারাই বেশি ট্যাক্স দিচ্ছে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বা বিরোধ মেটানোর জন্য নিরপেক্ষ এজেন্সি, স্বচ্ছ কর ব্যবস্থা, সরকার ও কোম্পানিতে সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা- এসব সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ কি সেই লক্ষ্যে বেশিদূর এগোতে পেরেছে? ন্যায্যতা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, ব্যক্তির স্বাধীনতা যেখানে খর্ব হবে সেখানে আয়-অর্জনেও অব্যবস্থা প্রাধান্য পাবে সেটাই স্বাভাবিক।
রাজনীতি এখন লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিতে ভর করে কোটিপতিদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কেউ একজন যদি রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় সরকার সমর্থক হন; তাহলে তো তার কোনো অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হয় না। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে একশ্রেণীর ঋণগ্রহীতা তা বিদেশে পাচার করছে। অন্যদিকে প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরলেও ঋণ পাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটা শুধু কথার কথা। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই। দুর্নীতিবাজরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যে কোনো পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে পারে।
সমাজ থেকে আয়বৈষম্য কমাতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় আনতে হবে, যাতে সামাজিকভাবে ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।
বৈষম্য রোধের ক্ষেত্রে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, আয়বণ্টন উন্নত হবে- সর্বোপরি বৃদ্ধি পাবে প্রবৃদ্ধির হার।
রবিবার, ৩১ মে ২০২০ , ১৭ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ৭ শাওয়াল ১৪৪১
জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার আয়বৈষম্যও বাড়ছে। এর ফলে শুধু ধনীদের সম্পদ বাড়ছে। আর এতে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবেচনায় শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় আবারও উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে গত দশকে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) বেড়েছে ১৪.৩ শতাংশ হারে। চলতি মাসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্স প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বাহ্যিক বিবেচনায় ইতিবাচক মনে হলেও আসলে তা নয়। দেশে সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করে কোটিপতি হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই। অথচ এখানেই শত শত কোটিপতির উদ্ভব ঘটেছে, যাদের বৈধ আয়ে কোটিপতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একজন যদি সৎভাবে জীবনযাপন করেন এবং অন্যজন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন; তাহলে যিনি দুর্নীতিতে নিমিজ্জিত হবেন, তার আয় বাড়বে। ফলে সৎ ব্যক্তির সঙ্গে তার অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে।
যারা ধনী হচ্ছেন তারা নিয়মবহির্ভূতভাবেই হচ্ছেন, একাই বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ছেন, দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করে নির্বিবাদে বিদেশে পাচার করছেন। এমন দৃষ্টান্ত অহরহ চোখে পড়ছে; যেখানে যিনি ব্যবসায়ী, তিনিই জনপ্রতিনিধি, তিনিই শিল্পপতি আবার তিনিই শ্রমিক নেতা। অর্থাৎ ক্ষমতা ও দখলদারিত্বের মৌরসীপাট্টা খুলে বসেছেন পুঁজিপতিরা এবং সেই আয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনাই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে কোনরকম অগ্রগতি নেই বাংলাদেশের।
অর্থনীতিতে বাস্তব অবস্থা হল যাদের বেশি করে ট্যাক্স দেয়ার কথা তারা কম ট্যাক্স বা কোন ট্যাক্সই দেয় না, আর যারা কম ট্যাক্স দেয়ার কথা তারাই বেশি ট্যাক্স দিচ্ছে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বা বিরোধ মেটানোর জন্য নিরপেক্ষ এজেন্সি, স্বচ্ছ কর ব্যবস্থা, সরকার ও কোম্পানিতে সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা- এসব সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ কি সেই লক্ষ্যে বেশিদূর এগোতে পেরেছে? ন্যায্যতা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, ব্যক্তির স্বাধীনতা যেখানে খর্ব হবে সেখানে আয়-অর্জনেও অব্যবস্থা প্রাধান্য পাবে সেটাই স্বাভাবিক।
রাজনীতি এখন লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিতে ভর করে কোটিপতিদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কেউ একজন যদি রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় সরকার সমর্থক হন; তাহলে তো তার কোনো অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হয় না। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে একশ্রেণীর ঋণগ্রহীতা তা বিদেশে পাচার করছে। অন্যদিকে প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরলেও ঋণ পাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটা শুধু কথার কথা। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই। দুর্নীতিবাজরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যে কোনো পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে পারে।
সমাজ থেকে আয়বৈষম্য কমাতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় আনতে হবে, যাতে সামাজিকভাবে ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।
বৈষম্য রোধের ক্ষেত্রে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, আয়বণ্টন উন্নত হবে- সর্বোপরি বৃদ্ধি পাবে প্রবৃদ্ধির হার।