পশু-পাখি নির্যাতন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বিগত কয়েক দিন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিরীহ পশু-পাখির সঙ্গে পৈশাচিক আচরণ ও তাদের হত্যার বীভৎস ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। ফসল নষ্ট বা গৃহের খাবার চুরি করার অভিযোগে বিষ প্রয়োগে মাদারীপুরে বানর হত্যার একটি মর্মান্তিক ঘটনা আমার নজরে এনে এই নির্মম ঘটনাটি নিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছেন আমার টাকশালের এককালের সহকর্মী গাজী মিজানুর রহমান। মাদারীপুরের চরমুগরিয়ায় প্রায় আড়াই হাজার বানর রয়েছে।

নিরীহ বোবা পশুদের ওপর নির্যাতন যত্রতত্র। পার্শ্ববর্তী একটি বন থেকে লোকালয়ে আসার পর সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গলা টিপে একটি বানরকে নৃশংসভাবে হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক যুবক বানরের পেছনের দুই পা টেনে ধরে আছেন, আর অন্যজন বস্তা দিয়ে ওই বানরের গলা চেপে ধরেছে। সর্বশক্তি দিয়ে বানরটির বাঁচার চেষ্টার দৃশ্যটি বড়ই মর্মান্তিক। বহু উৎসুক নারী, পুরুষ ও শিশু দাঁড়িয়ে বানরটির নৃশংস হত্যার দৃশ্য উৎফুল্ল চিত্তে প্রত্যক্ষ করেছে। এই মৌলভীবাজারেই কিছুদিন আগে বিচার বসিয়ে কিছু লোক একটি বানরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে ফাঁসি দেয়। বানর ফলমূল, তরিতরকারি খায়; এইসব খাবারের অভাব হলে এরা কখনও কখনও বনের নিকটবর্তী গৃহস্থবাড়িতে ঢুকে কাপড়চোপড় নিয়ে টানাটানি করে, কলার কান্দি বা ভাতের গোটা হাড়ি নিয়ে পালায়। খাবারের সংকট হলে সব প্রাণীই চুরি করে, ডাকাতি করে, ছিনিয়ে নেয়। করোনার এই লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক কারণেই বানরগুলোর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে, খাবার না পেয়ে হয়তো মানুষের বাসাবাড়ি বা ক্ষেতের ফসলে হানা দিচ্ছে। আমি টাকশালে কর্মরত থাকাকালীন সমরাস্ত্র কারখানার অসংখ্য বানরকে আমার সহকর্মীদের বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ শুনেছি, অনেকে ক্ষোভে নালিশ করলেও আমি ছিলাম অনেকটা নির্বিকার। আমার নির্বিকার থাকার প্রধান কারণ, মানুষ আজকাল এত বৈষয়িক ও স্বার্থপর হয়ে গেছে যে, কেউ এখন আর ফল-গাছ রোপণ করে না, করলেও একটি ফলও পশু-পাখির জন্য স্পেয়ার করতে নারাজ।

পশু হত্যা মানুষের নেশা। আগের দিনে বাঘ শিকারীদের বাহবা দেয়া হতো, অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা শিকার করার কৃতিত্ব জাহির করার জন্য দেয়ালে বাঘ বা হরিণের চামড়া ঝুলিয়ে রাখতো। খাদ্যাভাব ছাড়াও ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে পশু-পাখি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মানুষের বসতির কাছাকাছি চলে আসে। কিছুদিন পূর্বে ভয়াবহ দাবানলে অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানির সংকট দেখা দেয়; তীব্র খরায় দাবানল বাহিত অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বনের পশুগুলো লোকালয়ে চলে এসেছিল। উট প্রচুর পানি পান করে বিধায় ওখানকার ১০ হাজার উটকে এক আদিবাসী নেতার আদেশে হেলিকপ্টার থেকে অস্ট্রেলিয়ান সরকার গুলি করে মেরে ফেলে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বন্য উট রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। মালয়েশিয়া ২০১২ সনে প্রায় এক লাখ বানর মেরে ফেলে। ভারতও মাঝে মাঝে এমন হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। কয়েক বছর আগে জাপানের একটি চিড়িয়াখানার ৫৭টি বানরকে মরণঘাতী ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়। বানরগুলোর শরীরে বিদেশি প্রজাতির জিন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমোদজনক খবরটি হচ্ছে, যারা এই নিরীহ বানরগুলোকে মেরেছে তারাই আবার বানরগুলোর আত্মার শান্তি কামনা করে বৌদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনা করেছে। কোথাও কোন প্রাণীর সংখ্যা নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি হলেও আইনানুযায়ী তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। কারণ সংখ্যা বেশি হলে খাদ্যের সংকট দেখা দেয় এবং এতে একই প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে মারামারি শুরু হয় এবং তাতে প্রজাতির সব প্রাণীর জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বার্ড ফ্লু-এর প্রকোপ থেকে বাঁচানোর জন্য রোগাক্রান্ত মুরগির সঙ্গে ভালো মুরগিকেও মেরে ফেলা হয়। আমাদের দেশে আগে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন কুকুর নিধন করতো, এখন করে না। দুই বছর পূর্বে মধুবাগ-মিরেরটেকে কুকুর মারার জন্য একজন লোকের ৬ মাস জেল হয়েছিল। পশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যে আইন ১৯২০ সনে ইংরেজেরা প্রণয়ন করে তার সংস্কার হয় ২০১৬ সনে। বর্তমান আইনে প্রাণী নির্যাতনের জন্য অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং অঙ্গহানি বা বিষ প্রয়োগের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

আমার বাসার চারিদিকে ৪টি কুকুর থাকে, এদের বেরুবার রাস্তা বন্ধ। রাতে চিৎকার করে বলে সবাই নিজ বাসার গলিতে বেড়া দিয়ে এই ৪টি কুকুরের চলাফেরা আমার বাসার দুইদিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। আমি প্রতিদিন তাদের খাবার দিই, গত চার/পাঁচ দিন তাদের কোন শব্দ নেই; কেউ সম্ভবত বিষ মিশ্রিত খাবার দিয়েছে, একটির মরদেহ আমার বাসার নিচে পাওয়া গেছে, বাকি ৩টির কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে বিকট গন্ধ পাচ্ছি। আমি কেন খাবার দিন- প্রতিবেশী সবাই আমার প্রতি ক্ষুব্ধ। মানবজাতির সঙ্গে বসবাসের অভিলাষে পশুদের কয়েকটি প্রজাতি বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে- এদের মধ্যে রয়েছে কুকুর ও বিড়াল। এই দুটি প্রাণী বেকুব- বেকুব না হলে মানুষের সঙ্গে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর বসবাসের আগ্রহ জন্মাবে কেন? মানুষের চেয়ে পশু অনেক বেশি শান্তিপ্রিয় প্রাণী। সাপের গায়ে আঘাত না লাগলে সাপও ফণা তোলে না, বিড়াল তো মানুষ দেখলেই দৌড়ে পালায়, কুকুরকে বিরক্ত না করলে কুকুরও মানুষকে লক্ষ্য করে ঘেউ ঘেউ করে না। বাচ্চারা অতিরিক্ত জ্বালাতন করে বিধায় বাচ্চাদের দেখলে এরা একটু রুষ্ট হয়। মানুষ মনের ভয়েও এদের বিপজ্জনক মনে করে মিথ্যে অজুহাত তৈরি করে এদের প্রতিনিয়ত নির্যাতন করছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও এই প্রজাতির মতো নৃশংস বর্বর প্রাণী আর একটিও নেই। যে সব প্রাণীর মাংস মানুষ খায় না, যাদের চামড়া বা দাঁতও কাজে লাগে না সেই সব প্রাণীকেও মানুষ আনন্দ সহকারে হত্যা করে। যুক্তিহীন এই সব হত্যার পেছনে মানুষের আদিম পৈশাচিকতা কাজ করে। রাস্তা-ঘাটে চলাফেরার পথে অকারণে মানুষ নামক প্রাণীটি কুকুর, বিড়াল দেখলেই লাথি মারে, ইট মারে, লাঠি দিয়ে বাড়ি মারে। আঘাতের পর এই জীব দুটির আর্তচিৎকার শোনে অত্যাচারী নিষ্ঠুর মানুষগুলো হাসতে থাকে। মানুষ বা পশু পিটিয়ে মারার জন্য মানুষের জড় হতে সময় লাগে কয়েক মিনিট, কিন্তু একটি ভালো উদ্যোগে ডেকেও মানুষ আনা যায় না। অথচ তারা জানে না যে, আইনানুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া একটি পাগলা কুকুরকে মারা যায় না।

কিছু নামধারী ধার্মিক ‘নাপাক’ কুকুরের ওপর নির্যাতন বা হত্যাকে জায়েজ করতে চান। ওই লোকগুলো আবার দেশি মুরগি, কই, মাগুর, শিং, শৈল মাছ তৃপ্তি সহকারে খান; কিন্তু এই মুরগি ও মাছগুলো রীতিমতো মল, বিষ্টা খায়। পবিত্র কোরআনে কুকুর বিড়ালের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য আছে বলে আমার মনে হয়নি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল এমন জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোন পাখী উড়ে না কিন্তু এরা তোমাদের মতো এক একটি উম্মত’ (সূরা আনআম-৩৮)। কুকুর নিয়ে বিপরীতধর্মী হাদিস থাকলেও ধর্মে পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রয়েছে। পিপাসাকাতর এক কুকুরকে বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচারী নারী তার নিজের পায়ের মোজা খুলে ভিজিয়ে পানি পান করানোর কারণে তার অতীত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয় (বুখারি, হাদিস : ৩৪৬৭)। অন্য হাদিসে বিড়ালকে খাবার না দিয়ে বেঁধে রাখার জন্য একজনের দোজখে অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এখন ডাস্টবিন থেকে পচাগলা খাবার খেলেও বকধার্মিক কিছু লোক ঘরের পাশে রাস্তায় এদের সহ্য করতে পারে না।

আমাদের মনে রাখা দরকার, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হলেও প্রিয়জন হারানোর দুঃখ বা মৃত্যু যন্ত্রণার দিক থেকে পশু আর মানুষের অনুভূতি একই। একজন মানুষকে আঘাত করলে মানুষটি যতটুকু কষ্ট পায়, তেমনি একটি পশুকে আঘাত করলে পশুটিও ততটুকু যন্ত্রণা অনুভব করে। চা- স্টল বা খাবারের দোকানের সামনে কুকুর, বিড়াল সামান্য খাবারের আশায় ঘুরঘুর করে, কারো খাওয়ার সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে- এই তাকিয়ে থাকাটা অনেকে পছন্দ করেন না, লাথি মারেন, নতুবা ইট দিয়ে আঘাত করেন বা চেলাকাঠ দিয়ে পিটুনি দিয়ে সরাতে না পারলে গরম পানি গায়ে ঢেলে দেন।

ডারউইন তো বলেছেন, এক বিশেষ বানরের বিবর্তন থেকে মানুষের উৎপত্তি; ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সম্ভবত স্কুল, কলেজে এখন আর ডারউইন পড়ানো হয় না। বানরও মানুষের মতো বুদ্ধিমান- তবে মানুষের বিবর্তন ও বিকাশ বানরের চেয়ে একটু বেশি বলে আজ মানুষ বানরের ওপর কর্তৃত্ব করে তাদের হত্যা করছে। পশুর ওপর নির্যাতন করে ছাড় পাচ্ছে বিধায় মানুষ অমানুষ হচ্ছে। পাশ্চাত্যে রাস্তা-ঘাটে সাধারণত কুকুর দেখা যায় না; ওখানে প্রায় প্রতিটি পরিবার এক বা একাধিক বিড়াল বা কুকুর পোষে। পোষা কুকুর, বিড়ালকে তারা পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য করে থাকে। কেউ বেড়াতে গেলে তাদের পোষা বিড়াল বা কুকুরকেও ‘হাই’, ‘হ্যালো’ বলা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের মতো দেশে অবলা বানর, কুকুর, বেড়াল প্রভৃতি পশুপাখির কোন ভোটাধিকার না থাকায়, বক্তৃতা ও মিছিল করে সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় এদের জন্য কোন ত্রাণ বরাদ্দ হয় না, কেউ তাদের পক্ষ হয়ে কথাও বলে না; এদের পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বললে দলভারী পশু নির্যাতনকারীরা তাকে ‘পাগল’ বলে উপহাস করে। ফ্রেডরিখ নিৎশে তার ‘উইল টু পাওয়ার’ নামক গ্রন্থে মনুষ্য চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা প্রকৃতিতে মজা পাই গাছের ডাল ভেঙে, পাহাড়ের পাথর খুলে নিয়ে, বন্য পশুদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের খুঁচিয়ে মেরে’।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ৩১ মে ২০২০ , ১৭ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ৭ শাওয়াল ১৪৪১

পশু-পাখি নির্যাতন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বিগত কয়েক দিন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিরীহ পশু-পাখির সঙ্গে পৈশাচিক আচরণ ও তাদের হত্যার বীভৎস ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। ফসল নষ্ট বা গৃহের খাবার চুরি করার অভিযোগে বিষ প্রয়োগে মাদারীপুরে বানর হত্যার একটি মর্মান্তিক ঘটনা আমার নজরে এনে এই নির্মম ঘটনাটি নিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছেন আমার টাকশালের এককালের সহকর্মী গাজী মিজানুর রহমান। মাদারীপুরের চরমুগরিয়ায় প্রায় আড়াই হাজার বানর রয়েছে।

নিরীহ বোবা পশুদের ওপর নির্যাতন যত্রতত্র। পার্শ্ববর্তী একটি বন থেকে লোকালয়ে আসার পর সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গলা টিপে একটি বানরকে নৃশংসভাবে হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক যুবক বানরের পেছনের দুই পা টেনে ধরে আছেন, আর অন্যজন বস্তা দিয়ে ওই বানরের গলা চেপে ধরেছে। সর্বশক্তি দিয়ে বানরটির বাঁচার চেষ্টার দৃশ্যটি বড়ই মর্মান্তিক। বহু উৎসুক নারী, পুরুষ ও শিশু দাঁড়িয়ে বানরটির নৃশংস হত্যার দৃশ্য উৎফুল্ল চিত্তে প্রত্যক্ষ করেছে। এই মৌলভীবাজারেই কিছুদিন আগে বিচার বসিয়ে কিছু লোক একটি বানরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে ফাঁসি দেয়। বানর ফলমূল, তরিতরকারি খায়; এইসব খাবারের অভাব হলে এরা কখনও কখনও বনের নিকটবর্তী গৃহস্থবাড়িতে ঢুকে কাপড়চোপড় নিয়ে টানাটানি করে, কলার কান্দি বা ভাতের গোটা হাড়ি নিয়ে পালায়। খাবারের সংকট হলে সব প্রাণীই চুরি করে, ডাকাতি করে, ছিনিয়ে নেয়। করোনার এই লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক কারণেই বানরগুলোর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে, খাবার না পেয়ে হয়তো মানুষের বাসাবাড়ি বা ক্ষেতের ফসলে হানা দিচ্ছে। আমি টাকশালে কর্মরত থাকাকালীন সমরাস্ত্র কারখানার অসংখ্য বানরকে আমার সহকর্মীদের বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ শুনেছি, অনেকে ক্ষোভে নালিশ করলেও আমি ছিলাম অনেকটা নির্বিকার। আমার নির্বিকার থাকার প্রধান কারণ, মানুষ আজকাল এত বৈষয়িক ও স্বার্থপর হয়ে গেছে যে, কেউ এখন আর ফল-গাছ রোপণ করে না, করলেও একটি ফলও পশু-পাখির জন্য স্পেয়ার করতে নারাজ।

পশু হত্যা মানুষের নেশা। আগের দিনে বাঘ শিকারীদের বাহবা দেয়া হতো, অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা শিকার করার কৃতিত্ব জাহির করার জন্য দেয়ালে বাঘ বা হরিণের চামড়া ঝুলিয়ে রাখতো। খাদ্যাভাব ছাড়াও ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে পশু-পাখি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মানুষের বসতির কাছাকাছি চলে আসে। কিছুদিন পূর্বে ভয়াবহ দাবানলে অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানির সংকট দেখা দেয়; তীব্র খরায় দাবানল বাহিত অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বনের পশুগুলো লোকালয়ে চলে এসেছিল। উট প্রচুর পানি পান করে বিধায় ওখানকার ১০ হাজার উটকে এক আদিবাসী নেতার আদেশে হেলিকপ্টার থেকে অস্ট্রেলিয়ান সরকার গুলি করে মেরে ফেলে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বন্য উট রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। মালয়েশিয়া ২০১২ সনে প্রায় এক লাখ বানর মেরে ফেলে। ভারতও মাঝে মাঝে এমন হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। কয়েক বছর আগে জাপানের একটি চিড়িয়াখানার ৫৭টি বানরকে মরণঘাতী ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়। বানরগুলোর শরীরে বিদেশি প্রজাতির জিন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমোদজনক খবরটি হচ্ছে, যারা এই নিরীহ বানরগুলোকে মেরেছে তারাই আবার বানরগুলোর আত্মার শান্তি কামনা করে বৌদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনা করেছে। কোথাও কোন প্রাণীর সংখ্যা নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি হলেও আইনানুযায়ী তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। কারণ সংখ্যা বেশি হলে খাদ্যের সংকট দেখা দেয় এবং এতে একই প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে মারামারি শুরু হয় এবং তাতে প্রজাতির সব প্রাণীর জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বার্ড ফ্লু-এর প্রকোপ থেকে বাঁচানোর জন্য রোগাক্রান্ত মুরগির সঙ্গে ভালো মুরগিকেও মেরে ফেলা হয়। আমাদের দেশে আগে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন কুকুর নিধন করতো, এখন করে না। দুই বছর পূর্বে মধুবাগ-মিরেরটেকে কুকুর মারার জন্য একজন লোকের ৬ মাস জেল হয়েছিল। পশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যে আইন ১৯২০ সনে ইংরেজেরা প্রণয়ন করে তার সংস্কার হয় ২০১৬ সনে। বর্তমান আইনে প্রাণী নির্যাতনের জন্য অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং অঙ্গহানি বা বিষ প্রয়োগের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

আমার বাসার চারিদিকে ৪টি কুকুর থাকে, এদের বেরুবার রাস্তা বন্ধ। রাতে চিৎকার করে বলে সবাই নিজ বাসার গলিতে বেড়া দিয়ে এই ৪টি কুকুরের চলাফেরা আমার বাসার দুইদিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। আমি প্রতিদিন তাদের খাবার দিই, গত চার/পাঁচ দিন তাদের কোন শব্দ নেই; কেউ সম্ভবত বিষ মিশ্রিত খাবার দিয়েছে, একটির মরদেহ আমার বাসার নিচে পাওয়া গেছে, বাকি ৩টির কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে বিকট গন্ধ পাচ্ছি। আমি কেন খাবার দিন- প্রতিবেশী সবাই আমার প্রতি ক্ষুব্ধ। মানবজাতির সঙ্গে বসবাসের অভিলাষে পশুদের কয়েকটি প্রজাতি বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে- এদের মধ্যে রয়েছে কুকুর ও বিড়াল। এই দুটি প্রাণী বেকুব- বেকুব না হলে মানুষের সঙ্গে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর বসবাসের আগ্রহ জন্মাবে কেন? মানুষের চেয়ে পশু অনেক বেশি শান্তিপ্রিয় প্রাণী। সাপের গায়ে আঘাত না লাগলে সাপও ফণা তোলে না, বিড়াল তো মানুষ দেখলেই দৌড়ে পালায়, কুকুরকে বিরক্ত না করলে কুকুরও মানুষকে লক্ষ্য করে ঘেউ ঘেউ করে না। বাচ্চারা অতিরিক্ত জ্বালাতন করে বিধায় বাচ্চাদের দেখলে এরা একটু রুষ্ট হয়। মানুষ মনের ভয়েও এদের বিপজ্জনক মনে করে মিথ্যে অজুহাত তৈরি করে এদের প্রতিনিয়ত নির্যাতন করছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও এই প্রজাতির মতো নৃশংস বর্বর প্রাণী আর একটিও নেই। যে সব প্রাণীর মাংস মানুষ খায় না, যাদের চামড়া বা দাঁতও কাজে লাগে না সেই সব প্রাণীকেও মানুষ আনন্দ সহকারে হত্যা করে। যুক্তিহীন এই সব হত্যার পেছনে মানুষের আদিম পৈশাচিকতা কাজ করে। রাস্তা-ঘাটে চলাফেরার পথে অকারণে মানুষ নামক প্রাণীটি কুকুর, বিড়াল দেখলেই লাথি মারে, ইট মারে, লাঠি দিয়ে বাড়ি মারে। আঘাতের পর এই জীব দুটির আর্তচিৎকার শোনে অত্যাচারী নিষ্ঠুর মানুষগুলো হাসতে থাকে। মানুষ বা পশু পিটিয়ে মারার জন্য মানুষের জড় হতে সময় লাগে কয়েক মিনিট, কিন্তু একটি ভালো উদ্যোগে ডেকেও মানুষ আনা যায় না। অথচ তারা জানে না যে, আইনানুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া একটি পাগলা কুকুরকে মারা যায় না।

কিছু নামধারী ধার্মিক ‘নাপাক’ কুকুরের ওপর নির্যাতন বা হত্যাকে জায়েজ করতে চান। ওই লোকগুলো আবার দেশি মুরগি, কই, মাগুর, শিং, শৈল মাছ তৃপ্তি সহকারে খান; কিন্তু এই মুরগি ও মাছগুলো রীতিমতো মল, বিষ্টা খায়। পবিত্র কোরআনে কুকুর বিড়ালের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য আছে বলে আমার মনে হয়নি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল এমন জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোন পাখী উড়ে না কিন্তু এরা তোমাদের মতো এক একটি উম্মত’ (সূরা আনআম-৩৮)। কুকুর নিয়ে বিপরীতধর্মী হাদিস থাকলেও ধর্মে পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রয়েছে। পিপাসাকাতর এক কুকুরকে বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচারী নারী তার নিজের পায়ের মোজা খুলে ভিজিয়ে পানি পান করানোর কারণে তার অতীত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয় (বুখারি, হাদিস : ৩৪৬৭)। অন্য হাদিসে বিড়ালকে খাবার না দিয়ে বেঁধে রাখার জন্য একজনের দোজখে অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এখন ডাস্টবিন থেকে পচাগলা খাবার খেলেও বকধার্মিক কিছু লোক ঘরের পাশে রাস্তায় এদের সহ্য করতে পারে না।

আমাদের মনে রাখা দরকার, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হলেও প্রিয়জন হারানোর দুঃখ বা মৃত্যু যন্ত্রণার দিক থেকে পশু আর মানুষের অনুভূতি একই। একজন মানুষকে আঘাত করলে মানুষটি যতটুকু কষ্ট পায়, তেমনি একটি পশুকে আঘাত করলে পশুটিও ততটুকু যন্ত্রণা অনুভব করে। চা- স্টল বা খাবারের দোকানের সামনে কুকুর, বিড়াল সামান্য খাবারের আশায় ঘুরঘুর করে, কারো খাওয়ার সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে- এই তাকিয়ে থাকাটা অনেকে পছন্দ করেন না, লাথি মারেন, নতুবা ইট দিয়ে আঘাত করেন বা চেলাকাঠ দিয়ে পিটুনি দিয়ে সরাতে না পারলে গরম পানি গায়ে ঢেলে দেন।

ডারউইন তো বলেছেন, এক বিশেষ বানরের বিবর্তন থেকে মানুষের উৎপত্তি; ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সম্ভবত স্কুল, কলেজে এখন আর ডারউইন পড়ানো হয় না। বানরও মানুষের মতো বুদ্ধিমান- তবে মানুষের বিবর্তন ও বিকাশ বানরের চেয়ে একটু বেশি বলে আজ মানুষ বানরের ওপর কর্তৃত্ব করে তাদের হত্যা করছে। পশুর ওপর নির্যাতন করে ছাড় পাচ্ছে বিধায় মানুষ অমানুষ হচ্ছে। পাশ্চাত্যে রাস্তা-ঘাটে সাধারণত কুকুর দেখা যায় না; ওখানে প্রায় প্রতিটি পরিবার এক বা একাধিক বিড়াল বা কুকুর পোষে। পোষা কুকুর, বিড়ালকে তারা পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য করে থাকে। কেউ বেড়াতে গেলে তাদের পোষা বিড়াল বা কুকুরকেও ‘হাই’, ‘হ্যালো’ বলা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের মতো দেশে অবলা বানর, কুকুর, বেড়াল প্রভৃতি পশুপাখির কোন ভোটাধিকার না থাকায়, বক্তৃতা ও মিছিল করে সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় এদের জন্য কোন ত্রাণ বরাদ্দ হয় না, কেউ তাদের পক্ষ হয়ে কথাও বলে না; এদের পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বললে দলভারী পশু নির্যাতনকারীরা তাকে ‘পাগল’ বলে উপহাস করে। ফ্রেডরিখ নিৎশে তার ‘উইল টু পাওয়ার’ নামক গ্রন্থে মনুষ্য চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা প্রকৃতিতে মজা পাই গাছের ডাল ভেঙে, পাহাড়ের পাথর খুলে নিয়ে, বন্য পশুদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের খুঁচিয়ে মেরে’।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com