নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ : জেআরসি কমিটির পর্যবেক্ষণ

মোস্তাফা জব্বার

জেআরসি কমিটি সফটওয়্যারের বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণে দেখতে পায় ১৯৯৬ সালে অর্থাৎ রিপোর্ট তৈরির আগের এক বছরে সফটওয়্যার সম্পৃক্ত প্রযুক্তি খাতে বিশ্ববাজার ছিল ২৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ খাত থেকে আয় করেছে ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৯৬ সালে প্রযুক্তি খাতে মার্কিন বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা সাড়ে ১২ ভাগ। একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সাড়া বিশ্বে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ মার্কিন নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়। পরবর্তী চার বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লাখ প্রোগ্রামার প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে ভারতীয় বাণিজ্য সংগঠন নাসকমের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভারত অভ্যন্তরীন বাজার থেকে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আন্তর্জাতিক রপ্তানি থেকে শূন্য দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ মোট ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছে। খুবই লক্ষণীয় বিষয় যে ভারত সফটওয়্যারের শিল্প খাতে তখনও ব্যাপকভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর অধিক নির্ভরশীল। তখনও তাদের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার হয়নি। কিন্তু রপ্তানি বাড়ানোর জন্য তাদের প্রচেষ্টা ছিল ব্যাপক।

জেআরসি কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, এই অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রুত বিকাশমান দেশ বিশেষ করে ভারত, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনের কর্মকৌশল ও সরকারি নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করতে সেই সব দেশে প্রতিনিধিদল পাঠাবে।

পরবর্তীতে সময়ের স্বল্পতা বিবেচনায় শুধু ভারতে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। সরকার জেআরসি কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দিয়েছিল দুই মাস। অবশ্য কমিটির কাজের পরিধি বিবেচনায় অতিরিক্ত আরো ছয় সপ্তাহ মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেআরসি কমিটির একটি প্রতিনিধিদল ভারতে শিক্ষা সফর করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল মুম্বাই, ব্যাঙালোর এবং কলকাতায় ভারতের শীর্ষ সফটওয়্যার শিল্প বিশেষ করে সফটওয়্যার এক্সপোর্ট হাউজ, ডেটা এন্ট্রি এক্সপোর্ট হাউজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক পরিদর্শন করে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল সফটওয়্যার শিল্প বিকাশে তাদের কার্যক্রমসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়াও জেআরসি প্রতিনিধিদল ভারতে ৯ থেকে ১০ হাজার জনবল সমৃদ্ধ কোম্পানি যারা বিস্তৃত স্পেকট্রামে কাজের সঙ্গে জড়িত সেই ধরনের বেশ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে।

কমিটির অপর একটি প্রতিনিধিদল ঢাকার মিরপুরে বিসিক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স পরিদর্শন করে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। প্রতিনিধিদলটি ঢাকার অদূরে নবনির্মিত টঙ্গী- আশুলিয়া সড়কের পাশে ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা নিরীক্ষার জন্য সাইট পরিদর্শন করে।

কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে আসে যে, ভারত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক সফটওয়্যার মার্কেটে প্রবেশ করেছে। কম্পিউটার খাতে বিদেশে কর্মরত ভারতীয় নাগরিকদের বিক্ষিপ্ত উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত এটি সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে। এ খাতে বিদেশে অনাবাসিক ভারতীয় নাগরিকগণ বিদেশে তাদের লিয়াঁজো কাজে লাগিয়েছে। অনাবাসিক ভারতীয় নাগরিকরা কেউ কেউ পরবর্তীতে দেশে ফিরে নিজেরাই সফটওয়্যার শিল্প স্থাপন করেছে। এক্ষেত্রে প্রবাসী ভারতীয় নাগরিকরা ভারতে ডেটা ও সফটওয়্যার শিল্পকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রযুক্তি খাতে বড় আকারের সুফল আসতে থাকায় ভারত সরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সময়ক্ষেপণ না করে এই শিল্পের দ্রুত বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সরকার ১৯৮৬ সালে কম্পিউটার সফটওয়্যার নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা প্রদানে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তি উপযোগী দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট দ্রুত বিস্তার লাভ করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহও পিছিয়ে থাকেনি, বাজার চাহিদা পুরণে বেসকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। এর ফলে পেশাদার কর্মীরাও নিজেদেরকে বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার বিরাট সুযোগ হাত ছাড়া করেনি এবং পণ্যের বিদেশি ক্রেতারাও আশ্বস্থ হতে পেরেছে যে ভারতের পারফরমেন্স উপযুক্ত মানের। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।

জেআরসি কমিটির কর্মকা- ও সুপারিশ : কম্পিউটার সফটওয়্যার সার্ভিসে ভারতের বিশাল সফলতার পেছনে যে বিষয়গুলো কাজে লাগিয়েছে জেআরসি কমিটির সদস্যগণ সেগুলো দক্ষতার সঙ্গে চিহ্নিত করেন। সেই আলোকে কমিটি তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে কমিটি চারটি খাতে মোট ৪৫টি সুপারিশ তৈরি করে।

জেআরসি কমিটি আর্থিক, মানব সম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং বাজারজাতবিষয়ক চারটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। চিহ্নিত প্রতিটি ক্ষেত্রে কমিটি পৃথক পৃথকভাবে সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সরকারের আশুকরণীয় নির্ধারণ করে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। দেশের তথ্য প্রযুক্তি বিকাশে এই সুপারিশমালা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা প্রযুক্তি বিকাশের বিস্ময়কর সুচনা এগিয়ে যাওয়ার কা-ারি। জেআরসি কমিটির নিরলস প্রয়াস পৃথিবীতে চলমান তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে ভারতের দুই দশক পরে হলেও বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। এর আগে কোন শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশ শরিক হতে পারেনি।

প্রায় সাড়ে তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল কমিটির এই রিপোর্টটি সরকারের নিকট পেশ করা হয়। আর্থিক, মানব সম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো ও ডিজিটাল পণ্য বাজারবিষয়ক কমিটি চিহ্নিত এই চারটি ক্ষেত্রে সমস্যা এবং সম্ভাবনা বিষয়ে সরকারের কাছে পেশ করা সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন কীভাবে করা হবে রিপোর্টে সেই বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা হয়।

সুপারিশসমূহের গুরুত্বের বিচারে স্বল্প মেয়াদি ও মধ্যম মেয়াদি এই দুই ভাগে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি সুপারিশ করে। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, সেই বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনার সুপারিশ কমিটি করেনি। কমিটি আর্থিক খাতে ১০টা, মানব সম্পদ খাতে ৯টা, অবকাঠামো খাতে ১৪টা এবং বাজারজাতকরণ খাতে ১২টা মিলিয়ে মোট ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে। নিচে সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হলো।

আর্থিক খাত : আর্থিক বিষয়ে কমিটির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে উচ্চ আমদানী কর ও ভ্যাটের কারণে কম্পিউটার সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এর ফলে দেশে গ্রাহক পর্যায়ে কম্পিউটারের ব্যবহার হার খুবই সামান্য। দ্বিতীয়ত কোন প্রকার প্রণোদনা না থাকায় আমদানি কারকরাও কম্পিউটারের বাজার সম্প্রসারণে খুব বেশি একটা আগ্রহী নয়। তৃতীয়ত, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের অতিরিক্ত সুদের হার (তৎকালীন সময়ে শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ) উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে নিরোৎসাহিত করছে। চতুর্থত ব্যাংক ঋণে বিদ্যমান দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়া আমদানিকারকদের জন্য অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কমিটি চিহ্নিত করে।

এই ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ হচ্ছে, কম্পিউটারের ওপর থেকে সকল ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার, ১০ বছরের জন্য কর রেয়াত, স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সফটওয়্যারের জন্য শতকরা ১৫ ভাগ অভ্যন্তরিণ মূল্য সুবিধা প্রদান, সফটওয়্যার ও ডেটা প্রসেসিং সার্ভিস রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসির পরিবর্তে সেলস কনট্রাকট অনুমোদন প্রদান, রপ্তানি খাতে ব্যাংক সুদের হার হ্রাস করা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার সুবিধা নিশ্চিত করতে সুদবিহীন ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্য তহবিল গঠন এবং আইটি গবেষণার জœ্য তহবিল গঠন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

মানব সম্পদ উন্নয়নে সুপারিশমালা : বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে বিভাগ স্তরে উন্নীত করে সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা, ১৯৯৯ সালের মধ্যে কমপক্ষে একহাজার প্রশিক্ষক তৈরি করতে বিসিসিকে ব্যবস্থা গ্রহণের নিন্দেশ প্রদান, স্নাতক স্তরে সকল শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বেসিক কম্পিউটার দক্ষতা বিষয়টি পাঠ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে কমিটি। কমিটি সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিআইটিএস এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারবিষয়ক ডিগ্রি বা ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে আসন সংখ্যা বাড়ানো, প্রতি দুই বছর অন্তর প্রয়োজনবোধে কোর্স ক্যারিকুলাম পর্যালোচনা ও উন্নত করা, জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা ও সনদ ব্যবস্থা উন্নয়নে বিসিসিকে শক্তিশালী করা, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইটি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী আইটি পেশাদারদের জন্য চাহিদাভিত্তিক উচ্চপর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বিসিসিকে শক্তিশালী করে দায়িত্ব প্রদান এবং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে কমিটি সুপারিশ পেশ করে।

অবকাঠামো খাত : সফটওয়্যারের জন্য কোন কপিরাইট প্রোটেকশন না থাকায় কমিটি ডব্লিউটিও চার্টার অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কপি রাইট আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ী উচ্চ গতির ডেটা এবং ভয়েজ কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপন, দেশে ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠা, সাশ্রয়ী দামে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা, ভিসেটের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা সহজলভ্য করার সুপারিশ করে। বিটিটিবির স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক ধীরগতি এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় বেসরকারি খাতকে নিজস্ব স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপনের সুযোগ প্রদান, বন্দরসমূহে ডিজিটাল পণ্যের কাস্টম ছাড়পত্র সময় সাপেক্ষ হওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই সব পণ্য খালাসের প্রয়োজনে মনোনীত নির্ধারিত বন্দরে পৃথক সেল তৈরি, বিসিসিতে কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সফটওয়্যার উন্নয়ন এবং ডেটা প্রসেসিং সার্ভিসে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এর আলোকে অ্যাসোসিয়েশন গঠনে উৎসাহিত করা, ডিজিটাল খাতের জন্য সার্বক্ষণিক ভিত্তিক ইপিবি থেকে একজন সহকারি পরিচালককে নিয়োজিত করার সুপারিশ করা হয়। জামিলুর রেজা কমিটি ঢাকার অদূরে টঙ্গী-আশুলিয়া রোডের সুবিধামতো স্থানে প্রয়োজনীয় সব সুবিধাসহ ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ বা আইটিভি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। এছাড়া একটি শক্তিশালী টেলিকম অবকাঠামো তৈরির জন্য দেশব্যাপী আইএসডিএন বা এইচডিএসএল অথবা এডিএসএল লাইন এবং একটি ফাইভার অপটিক ব্যাকবোন প্রতিষ্ঠায় বিটিটিবিকে নিন্দেশনা প্রদান, বাংলাদেশে একটি কমিউনিকেশন্স হাব প্রতিষ্ঠা এবং সফটওয়্যার এবং ডেটা প্রসেসিং সার্ভিসের উন্নয়নে নীতিমালা, কৌশল এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠনের জন্য সুপারিশমালা পেশ করা হয়।

পণ্য বাজারজাত খাত : বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল খাতে প্রণোদনা বিষয়টি অবহিত করার মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনে উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলে কমিটি মনে করে। এই পরিস্থিতিতে সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরার জন্য সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আইটি পেশাদারদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের বাছাইকৃত স্থানে সেমিনার ও বৈঠকের ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের সাহায্যে তাদের সমর্থন লাভের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ, সরকারি অথবা বেসরকারি সেক্টরের সব প্রতিষ্ঠানে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত সফটওয়্যার এপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে ম্যানুয়েল সিস্টেমের ডকুমেন্ট ও রেকর্ডসমূহ কম্পিউটার সিস্টেমে প্রতিস্থাপনে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহিত করা, নিয়মিত ভিত্তিতে আইটি সংগঠন এবং ইপিবি সদস্যদের সমন্বিত প্রতিনিধিদলকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং উত্তর আমেরিকায় মার্কটিং মিশনে প্রেরণ, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইন্টারনেটে হোম পেজ ব্যবস্থা করা, অন্যদেশ থেকে সাব কন্টাক্ট ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগানো, ডিজিটাল পণ্য ও সার্ভিসবিষয়ক আন্তর্জাতিক সব গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য ইপিবির সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট ট্রেডবডিকে নির্দেশনা প্রদান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে স্থায়ী লিয়াঁজো অফিস স্থাপনে ইপিবিকে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা, বাংলাদেশি আইটি পেশাদারদের নিয়ে ডেটা বেস তৈরি করার জন্য বিসিসিকে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান, পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে আইটি ইন্ডাস্ট্রি সদস্যগণকে আইএসও ৯০০ এবং এসইআই সনদের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করা এবং আইটি মানবসম্পদের বৈশ্বিক চাহিদা কাজে লাগাতে অধিক পরিমাণে দক্ষ আইটি পেশাদার তৈরির সুপারিশ পেশ করা হয়।

ঢাকা। ২৯ মে, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ০২ জুন ২০২০ , ১৯ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ৯ শাওয়াল ১৪৪১

নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ : জেআরসি কমিটির পর্যবেক্ষণ

মোস্তাফা জব্বার

জেআরসি কমিটি সফটওয়্যারের বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণে দেখতে পায় ১৯৯৬ সালে অর্থাৎ রিপোর্ট তৈরির আগের এক বছরে সফটওয়্যার সম্পৃক্ত প্রযুক্তি খাতে বিশ্ববাজার ছিল ২৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ খাত থেকে আয় করেছে ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৯৬ সালে প্রযুক্তি খাতে মার্কিন বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা সাড়ে ১২ ভাগ। একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সাড়া বিশ্বে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ মার্কিন নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়। পরবর্তী চার বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লাখ প্রোগ্রামার প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে ভারতীয় বাণিজ্য সংগঠন নাসকমের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভারত অভ্যন্তরীন বাজার থেকে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আন্তর্জাতিক রপ্তানি থেকে শূন্য দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ মোট ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছে। খুবই লক্ষণীয় বিষয় যে ভারত সফটওয়্যারের শিল্প খাতে তখনও ব্যাপকভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর অধিক নির্ভরশীল। তখনও তাদের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার হয়নি। কিন্তু রপ্তানি বাড়ানোর জন্য তাদের প্রচেষ্টা ছিল ব্যাপক।

জেআরসি কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, এই অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রুত বিকাশমান দেশ বিশেষ করে ভারত, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনের কর্মকৌশল ও সরকারি নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করতে সেই সব দেশে প্রতিনিধিদল পাঠাবে।

পরবর্তীতে সময়ের স্বল্পতা বিবেচনায় শুধু ভারতে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। সরকার জেআরসি কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দিয়েছিল দুই মাস। অবশ্য কমিটির কাজের পরিধি বিবেচনায় অতিরিক্ত আরো ছয় সপ্তাহ মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেআরসি কমিটির একটি প্রতিনিধিদল ভারতে শিক্ষা সফর করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল মুম্বাই, ব্যাঙালোর এবং কলকাতায় ভারতের শীর্ষ সফটওয়্যার শিল্প বিশেষ করে সফটওয়্যার এক্সপোর্ট হাউজ, ডেটা এন্ট্রি এক্সপোর্ট হাউজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক পরিদর্শন করে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল সফটওয়্যার শিল্প বিকাশে তাদের কার্যক্রমসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়াও জেআরসি প্রতিনিধিদল ভারতে ৯ থেকে ১০ হাজার জনবল সমৃদ্ধ কোম্পানি যারা বিস্তৃত স্পেকট্রামে কাজের সঙ্গে জড়িত সেই ধরনের বেশ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে।

কমিটির অপর একটি প্রতিনিধিদল ঢাকার মিরপুরে বিসিক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স পরিদর্শন করে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। প্রতিনিধিদলটি ঢাকার অদূরে নবনির্মিত টঙ্গী- আশুলিয়া সড়কের পাশে ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা নিরীক্ষার জন্য সাইট পরিদর্শন করে।

কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে আসে যে, ভারত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক সফটওয়্যার মার্কেটে প্রবেশ করেছে। কম্পিউটার খাতে বিদেশে কর্মরত ভারতীয় নাগরিকদের বিক্ষিপ্ত উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত এটি সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে। এ খাতে বিদেশে অনাবাসিক ভারতীয় নাগরিকগণ বিদেশে তাদের লিয়াঁজো কাজে লাগিয়েছে। অনাবাসিক ভারতীয় নাগরিকরা কেউ কেউ পরবর্তীতে দেশে ফিরে নিজেরাই সফটওয়্যার শিল্প স্থাপন করেছে। এক্ষেত্রে প্রবাসী ভারতীয় নাগরিকরা ভারতে ডেটা ও সফটওয়্যার শিল্পকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রযুক্তি খাতে বড় আকারের সুফল আসতে থাকায় ভারত সরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সময়ক্ষেপণ না করে এই শিল্পের দ্রুত বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সরকার ১৯৮৬ সালে কম্পিউটার সফটওয়্যার নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা প্রদানে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তি উপযোগী দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট দ্রুত বিস্তার লাভ করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহও পিছিয়ে থাকেনি, বাজার চাহিদা পুরণে বেসকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। এর ফলে পেশাদার কর্মীরাও নিজেদেরকে বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার বিরাট সুযোগ হাত ছাড়া করেনি এবং পণ্যের বিদেশি ক্রেতারাও আশ্বস্থ হতে পেরেছে যে ভারতের পারফরমেন্স উপযুক্ত মানের। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।

জেআরসি কমিটির কর্মকা- ও সুপারিশ : কম্পিউটার সফটওয়্যার সার্ভিসে ভারতের বিশাল সফলতার পেছনে যে বিষয়গুলো কাজে লাগিয়েছে জেআরসি কমিটির সদস্যগণ সেগুলো দক্ষতার সঙ্গে চিহ্নিত করেন। সেই আলোকে কমিটি তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে কমিটি চারটি খাতে মোট ৪৫টি সুপারিশ তৈরি করে।

জেআরসি কমিটি আর্থিক, মানব সম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং বাজারজাতবিষয়ক চারটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। চিহ্নিত প্রতিটি ক্ষেত্রে কমিটি পৃথক পৃথকভাবে সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সরকারের আশুকরণীয় নির্ধারণ করে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। দেশের তথ্য প্রযুক্তি বিকাশে এই সুপারিশমালা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা প্রযুক্তি বিকাশের বিস্ময়কর সুচনা এগিয়ে যাওয়ার কা-ারি। জেআরসি কমিটির নিরলস প্রয়াস পৃথিবীতে চলমান তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে ভারতের দুই দশক পরে হলেও বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। এর আগে কোন শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশ শরিক হতে পারেনি।

প্রায় সাড়ে তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল কমিটির এই রিপোর্টটি সরকারের নিকট পেশ করা হয়। আর্থিক, মানব সম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো ও ডিজিটাল পণ্য বাজারবিষয়ক কমিটি চিহ্নিত এই চারটি ক্ষেত্রে সমস্যা এবং সম্ভাবনা বিষয়ে সরকারের কাছে পেশ করা সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন কীভাবে করা হবে রিপোর্টে সেই বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা হয়।

সুপারিশসমূহের গুরুত্বের বিচারে স্বল্প মেয়াদি ও মধ্যম মেয়াদি এই দুই ভাগে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি সুপারিশ করে। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, সেই বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনার সুপারিশ কমিটি করেনি। কমিটি আর্থিক খাতে ১০টা, মানব সম্পদ খাতে ৯টা, অবকাঠামো খাতে ১৪টা এবং বাজারজাতকরণ খাতে ১২টা মিলিয়ে মোট ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে। নিচে সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হলো।

আর্থিক খাত : আর্থিক বিষয়ে কমিটির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে উচ্চ আমদানী কর ও ভ্যাটের কারণে কম্পিউটার সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এর ফলে দেশে গ্রাহক পর্যায়ে কম্পিউটারের ব্যবহার হার খুবই সামান্য। দ্বিতীয়ত কোন প্রকার প্রণোদনা না থাকায় আমদানি কারকরাও কম্পিউটারের বাজার সম্প্রসারণে খুব বেশি একটা আগ্রহী নয়। তৃতীয়ত, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের অতিরিক্ত সুদের হার (তৎকালীন সময়ে শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ) উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে নিরোৎসাহিত করছে। চতুর্থত ব্যাংক ঋণে বিদ্যমান দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়া আমদানিকারকদের জন্য অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কমিটি চিহ্নিত করে।

এই ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ হচ্ছে, কম্পিউটারের ওপর থেকে সকল ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার, ১০ বছরের জন্য কর রেয়াত, স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সফটওয়্যারের জন্য শতকরা ১৫ ভাগ অভ্যন্তরিণ মূল্য সুবিধা প্রদান, সফটওয়্যার ও ডেটা প্রসেসিং সার্ভিস রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসির পরিবর্তে সেলস কনট্রাকট অনুমোদন প্রদান, রপ্তানি খাতে ব্যাংক সুদের হার হ্রাস করা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার সুবিধা নিশ্চিত করতে সুদবিহীন ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্য তহবিল গঠন এবং আইটি গবেষণার জœ্য তহবিল গঠন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

মানব সম্পদ উন্নয়নে সুপারিশমালা : বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে বিভাগ স্তরে উন্নীত করে সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা, ১৯৯৯ সালের মধ্যে কমপক্ষে একহাজার প্রশিক্ষক তৈরি করতে বিসিসিকে ব্যবস্থা গ্রহণের নিন্দেশ প্রদান, স্নাতক স্তরে সকল শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বেসিক কম্পিউটার দক্ষতা বিষয়টি পাঠ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে কমিটি। কমিটি সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিআইটিএস এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারবিষয়ক ডিগ্রি বা ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে আসন সংখ্যা বাড়ানো, প্রতি দুই বছর অন্তর প্রয়োজনবোধে কোর্স ক্যারিকুলাম পর্যালোচনা ও উন্নত করা, জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা ও সনদ ব্যবস্থা উন্নয়নে বিসিসিকে শক্তিশালী করা, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইটি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী আইটি পেশাদারদের জন্য চাহিদাভিত্তিক উচ্চপর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বিসিসিকে শক্তিশালী করে দায়িত্ব প্রদান এবং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে কমিটি সুপারিশ পেশ করে।

অবকাঠামো খাত : সফটওয়্যারের জন্য কোন কপিরাইট প্রোটেকশন না থাকায় কমিটি ডব্লিউটিও চার্টার অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কপি রাইট আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ী উচ্চ গতির ডেটা এবং ভয়েজ কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপন, দেশে ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠা, সাশ্রয়ী দামে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা, ভিসেটের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা সহজলভ্য করার সুপারিশ করে। বিটিটিবির স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক ধীরগতি এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় বেসরকারি খাতকে নিজস্ব স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপনের সুযোগ প্রদান, বন্দরসমূহে ডিজিটাল পণ্যের কাস্টম ছাড়পত্র সময় সাপেক্ষ হওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই সব পণ্য খালাসের প্রয়োজনে মনোনীত নির্ধারিত বন্দরে পৃথক সেল তৈরি, বিসিসিতে কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সফটওয়্যার উন্নয়ন এবং ডেটা প্রসেসিং সার্ভিসে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এর আলোকে অ্যাসোসিয়েশন গঠনে উৎসাহিত করা, ডিজিটাল খাতের জন্য সার্বক্ষণিক ভিত্তিক ইপিবি থেকে একজন সহকারি পরিচালককে নিয়োজিত করার সুপারিশ করা হয়। জামিলুর রেজা কমিটি ঢাকার অদূরে টঙ্গী-আশুলিয়া রোডের সুবিধামতো স্থানে প্রয়োজনীয় সব সুবিধাসহ ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ বা আইটিভি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। এছাড়া একটি শক্তিশালী টেলিকম অবকাঠামো তৈরির জন্য দেশব্যাপী আইএসডিএন বা এইচডিএসএল অথবা এডিএসএল লাইন এবং একটি ফাইভার অপটিক ব্যাকবোন প্রতিষ্ঠায় বিটিটিবিকে নিন্দেশনা প্রদান, বাংলাদেশে একটি কমিউনিকেশন্স হাব প্রতিষ্ঠা এবং সফটওয়্যার এবং ডেটা প্রসেসিং সার্ভিসের উন্নয়নে নীতিমালা, কৌশল এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠনের জন্য সুপারিশমালা পেশ করা হয়।

পণ্য বাজারজাত খাত : বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল খাতে প্রণোদনা বিষয়টি অবহিত করার মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনে উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলে কমিটি মনে করে। এই পরিস্থিতিতে সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরার জন্য সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আইটি পেশাদারদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের বাছাইকৃত স্থানে সেমিনার ও বৈঠকের ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের সাহায্যে তাদের সমর্থন লাভের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ, সরকারি অথবা বেসরকারি সেক্টরের সব প্রতিষ্ঠানে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত সফটওয়্যার এপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে ম্যানুয়েল সিস্টেমের ডকুমেন্ট ও রেকর্ডসমূহ কম্পিউটার সিস্টেমে প্রতিস্থাপনে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহিত করা, নিয়মিত ভিত্তিতে আইটি সংগঠন এবং ইপিবি সদস্যদের সমন্বিত প্রতিনিধিদলকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং উত্তর আমেরিকায় মার্কটিং মিশনে প্রেরণ, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইন্টারনেটে হোম পেজ ব্যবস্থা করা, অন্যদেশ থেকে সাব কন্টাক্ট ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগানো, ডিজিটাল পণ্য ও সার্ভিসবিষয়ক আন্তর্জাতিক সব গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য ইপিবির সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট ট্রেডবডিকে নির্দেশনা প্রদান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে স্থায়ী লিয়াঁজো অফিস স্থাপনে ইপিবিকে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা, বাংলাদেশি আইটি পেশাদারদের নিয়ে ডেটা বেস তৈরি করার জন্য বিসিসিকে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান, পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে আইটি ইন্ডাস্ট্রি সদস্যগণকে আইএসও ৯০০ এবং এসইআই সনদের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করা এবং আইটি মানবসম্পদের বৈশ্বিক চাহিদা কাজে লাগাতে অধিক পরিমাণে দক্ষ আইটি পেশাদার তৈরির সুপারিশ পেশ করা হয়।

ঢাকা। ২৯ মে, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com