‘আমাদের উদ্ধার করুন, বাঁচান’

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

শুধু সামপ্রতিককালে নয়, যখনই বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, সুন্দরবন প্রাকৃতিক রক্ষাব্যুহ হিসেবে তার পুরো হিন্টারল্যান্ড (পশিচমবঙ্গের দুটি জেলা এবং বাংলাদেশের ৩ জেলা (সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট) কে নিজে বুক পেতে দিয়ে রক্ষা করে। সিডরের সময় থেকেই সুন্দরবনের ভূমিকা অকুতজ্ঞ দেশ ও সমাজ এর কাছে মিডিয়াই প্রথম তুলে আনে। ২০০৭ সালের নভেম্বররে সিডর ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা সরাসরি সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক প্রাণহানিসহ সুন্দরবন অভ্যন্তরে সুপেয় পানির আধার (প্রায় ৩৪০টি) পুকুরগুলো লোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ায় খাবার পানির তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয় বনে বেঁচে যাওয়া প্রাণিসম্পদ।

খাদ্যাভাবে প্রাণিকুলের মধ্যে অন্তকলহ ও ডোমেইন বা অধিকৃত এলাকায় থাকতে হিংস্র সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। সিডরের পরে জনপদে বাঘ চলে আসা, লিভার সিরোসিস হয়ে বাঘের মৃত্যুর ঘটনাও রিপোর্ট হয়েছিল তখন। দীর্ঘদিন পড়ে ছিল বনের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাছপালা। সুন্দরবন ভেতরে পানির আধার সংস্কারসহ মৃত গাছপালা সংস্কারের জন্য দেরিতে হলেও বৈদেশিক সহায়তা পেয়েছিল, নিয়েছিল বাংলাদেশ।

বিশ্ব জলবায়ু আবহাওয়া মঞ্চ থেকেও ফান্ড পাওয়ার কসুর কম করেনি সুন্দরবনের দেশ দুটি। পশ্চিমবঙ্গ সুন্দরবন অভ্যন্তরে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণিসম্পদসহ অন্যান্য সম্পদ সংরক্ষণ কল্পে বড় বড় প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় পশ্চিমমবঙ্গে খোদ সুন্দরবনকে রক্ষার উদ্যোগ প্রকল্পে কাজ হলেও, বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাইরে লোকালয়ে ক্ষেত ভেড়ির উদ্ধার উন্নয়নে কিছু কাজ হলেও (সেগুলোও যে দুর্নীতিগ্রস্ততায় যথাযথ বাস্তবায়িত হয়নি, তা বোঝা যায় এবার সেবার বাঁধগুলোর ঠুনকো কার্যকারিতা দেখে) খোদ সুন্দরবন এর জীববৈচিত্র্য, প্রাণিসম্পদের সুরক্ষার কিছুই হয়নি। বরং স্বয়ং সুন্দরবনের প্রাকৃতিক শক্তি বিনাসের আয়োজনই চলেছে, চলছে। সুন্দরনের প্রকৃতি বিধ্বংসী প্রকল্প বা স্বার্থবাদী কার্যক্রম নেয়া হয়েছে।

কিছুদিন আগে বুলবুলের আক্রমণ থেকেও সুন্দরবন যেভাবে লোকালয়কে রক্ষা করেছে তা শুধু ছিটেফোঁটা উল্লেখেই সীমাবব্ধ ছিল, সুন্দরবন অভ্যন্তরের ক্ষয়ক্ষতির কোন দুশ্চিন্তা মাথাব্যথার কারণ হয়নি, মাথায় আসেইনি;, সবাই বেমালুম ভুলে যাওয়া শুরু করতেই গত ২০ মে আম্ফানের আস্ফালন আক্রোশ সুন্দরবনই আবার ঠেকিয়ে দিল।

বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসন লোকালয়ে কতটা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, কতজনের মাছের ঘের নষ্ট হয়েছে, কতটা বাঁধ ভেঙেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের কত টাকা নগদ সাহায্য দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি নিয়ে বড় জোর সংবাদ সম্মেলনেই আম্ফানের তা-ব উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু আম্ফানে সুন্দরবনের ভেতরে যে ব্যাপক হতাহত হয়েছে, প্রাণিসম্পদের এবং এবারও তাদের সুপেয় পানির আধার বিনষ্ট হয়ে যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য সমূহ সর্বনাশ সামনে অপেক্ষা করছে সে ব্যাপারে কোন রিপোর্ট বা কার্যক্রমের খবর বন বিভাগের কাছ থেকে নেয়া হয়নি, যারা প্রকৃত রক্ষক সুন্দরবনের সেই প্রাণিসম্পদের হাহাকার কেউ যেন শুনতে পাচ্ছেন না। অবিলম্বে সুপেয় পানির আধার উদ্ধার, প্রাণিকূল কোথাও ট্রাপড হয়ে আটকে থাকলে তাদের উদ্ধার, এমনকি প্রযোজ্য মতো তাদের খাবার সরবরাহ করার দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের অনিবার্যতাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে রীতিমতো অন্যায়। বনবিভাগের তরফ থেকে অবিলম্বে সবাইকে সত্যতথ্য জানানো উচিত। ঈদের ছুটি উদযাপনের অবকাশের বিলম্বে সুন্দরবনের প্রাণিকুলের জন্য আরও মর্মান্তিক পরিণতি কেন রোখা হবে না। সুন্দরবনের ভেতরে মৃত্যুপথযাত্রী, রক্তক্ষরণে ভোগা প্রাণিসম্পদের আকুল চিৎকার” ‘আমাদের উদ্ধার করুন, বাঁচান’- এটা সবাইকে শুনতেই হবে।

[লেখক : সাবেক সচিব]

মঙ্গলবার, ০২ জুন ২০২০ , ১৯ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ৯ শাওয়াল ১৪৪১

‘আমাদের উদ্ধার করুন, বাঁচান’

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

শুধু সামপ্রতিককালে নয়, যখনই বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, সুন্দরবন প্রাকৃতিক রক্ষাব্যুহ হিসেবে তার পুরো হিন্টারল্যান্ড (পশিচমবঙ্গের দুটি জেলা এবং বাংলাদেশের ৩ জেলা (সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট) কে নিজে বুক পেতে দিয়ে রক্ষা করে। সিডরের সময় থেকেই সুন্দরবনের ভূমিকা অকুতজ্ঞ দেশ ও সমাজ এর কাছে মিডিয়াই প্রথম তুলে আনে। ২০০৭ সালের নভেম্বররে সিডর ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা সরাসরি সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক প্রাণহানিসহ সুন্দরবন অভ্যন্তরে সুপেয় পানির আধার (প্রায় ৩৪০টি) পুকুরগুলো লোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ায় খাবার পানির তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয় বনে বেঁচে যাওয়া প্রাণিসম্পদ।

খাদ্যাভাবে প্রাণিকুলের মধ্যে অন্তকলহ ও ডোমেইন বা অধিকৃত এলাকায় থাকতে হিংস্র সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। সিডরের পরে জনপদে বাঘ চলে আসা, লিভার সিরোসিস হয়ে বাঘের মৃত্যুর ঘটনাও রিপোর্ট হয়েছিল তখন। দীর্ঘদিন পড়ে ছিল বনের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাছপালা। সুন্দরবন ভেতরে পানির আধার সংস্কারসহ মৃত গাছপালা সংস্কারের জন্য দেরিতে হলেও বৈদেশিক সহায়তা পেয়েছিল, নিয়েছিল বাংলাদেশ।

বিশ্ব জলবায়ু আবহাওয়া মঞ্চ থেকেও ফান্ড পাওয়ার কসুর কম করেনি সুন্দরবনের দেশ দুটি। পশ্চিমবঙ্গ সুন্দরবন অভ্যন্তরে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণিসম্পদসহ অন্যান্য সম্পদ সংরক্ষণ কল্পে বড় বড় প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় পশ্চিমমবঙ্গে খোদ সুন্দরবনকে রক্ষার উদ্যোগ প্রকল্পে কাজ হলেও, বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাইরে লোকালয়ে ক্ষেত ভেড়ির উদ্ধার উন্নয়নে কিছু কাজ হলেও (সেগুলোও যে দুর্নীতিগ্রস্ততায় যথাযথ বাস্তবায়িত হয়নি, তা বোঝা যায় এবার সেবার বাঁধগুলোর ঠুনকো কার্যকারিতা দেখে) খোদ সুন্দরবন এর জীববৈচিত্র্য, প্রাণিসম্পদের সুরক্ষার কিছুই হয়নি। বরং স্বয়ং সুন্দরবনের প্রাকৃতিক শক্তি বিনাসের আয়োজনই চলেছে, চলছে। সুন্দরনের প্রকৃতি বিধ্বংসী প্রকল্প বা স্বার্থবাদী কার্যক্রম নেয়া হয়েছে।

কিছুদিন আগে বুলবুলের আক্রমণ থেকেও সুন্দরবন যেভাবে লোকালয়কে রক্ষা করেছে তা শুধু ছিটেফোঁটা উল্লেখেই সীমাবব্ধ ছিল, সুন্দরবন অভ্যন্তরের ক্ষয়ক্ষতির কোন দুশ্চিন্তা মাথাব্যথার কারণ হয়নি, মাথায় আসেইনি;, সবাই বেমালুম ভুলে যাওয়া শুরু করতেই গত ২০ মে আম্ফানের আস্ফালন আক্রোশ সুন্দরবনই আবার ঠেকিয়ে দিল।

বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসন লোকালয়ে কতটা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, কতজনের মাছের ঘের নষ্ট হয়েছে, কতটা বাঁধ ভেঙেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের কত টাকা নগদ সাহায্য দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি নিয়ে বড় জোর সংবাদ সম্মেলনেই আম্ফানের তা-ব উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু আম্ফানে সুন্দরবনের ভেতরে যে ব্যাপক হতাহত হয়েছে, প্রাণিসম্পদের এবং এবারও তাদের সুপেয় পানির আধার বিনষ্ট হয়ে যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য সমূহ সর্বনাশ সামনে অপেক্ষা করছে সে ব্যাপারে কোন রিপোর্ট বা কার্যক্রমের খবর বন বিভাগের কাছ থেকে নেয়া হয়নি, যারা প্রকৃত রক্ষক সুন্দরবনের সেই প্রাণিসম্পদের হাহাকার কেউ যেন শুনতে পাচ্ছেন না। অবিলম্বে সুপেয় পানির আধার উদ্ধার, প্রাণিকূল কোথাও ট্রাপড হয়ে আটকে থাকলে তাদের উদ্ধার, এমনকি প্রযোজ্য মতো তাদের খাবার সরবরাহ করার দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের অনিবার্যতাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে রীতিমতো অন্যায়। বনবিভাগের তরফ থেকে অবিলম্বে সবাইকে সত্যতথ্য জানানো উচিত। ঈদের ছুটি উদযাপনের অবকাশের বিলম্বে সুন্দরবনের প্রাণিকুলের জন্য আরও মর্মান্তিক পরিণতি কেন রোখা হবে না। সুন্দরবনের ভেতরে মৃত্যুপথযাত্রী, রক্তক্ষরণে ভোগা প্রাণিসম্পদের আকুল চিৎকার” ‘আমাদের উদ্ধার করুন, বাঁচান’- এটা সবাইকে শুনতেই হবে।

[লেখক : সাবেক সচিব]