ক্যাসিনোকাণ্ডের রাঘববোয়ালরা কি পার পেয়ে যাবে

ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ৭ মাস এবং ঠিকাদার জিকে শামীম প্রায় ২ মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইইউ) কেবিনে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে। চিকিৎসা শেষে তাদের কারাগারে ফেরত পাঠাতে বিএসএমএমইউকে পাঁচ দফা চিঠি দিয়েছে কারা প্রশাসন। অন্যদিকে ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে আটক মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক (ডাইরেক্টর ইনচার্জ) লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ) কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. মাহাবুবুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ক্যাসিনো কাণ্ড এবং জুয়ার বিরুদ্ধে কিছুদিন আগেই ব্যাপক হৈচৈ লক্ষ্য করা গেছে। সমাজের দৃশ্যপট সরগরম হয়ে উঠেছিল রাঘববোয়ালদের গ্রেফতারে। মনে করা হচ্ছিল, অনাচারের অবসান হবে, দুষ্টচক্র এবার নিশ্চিহ্ন হবে। কিন্তু এ দেশে সময়ের আবর্তে বিশেষ অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ধোয়া তুলসিপাতা বনে যায় কিংবা কৌশলে তাদের অপরাধ যে ঢেকে দেয়া যায় সেটা অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন। সেই চিরচেনা বিভ্রান্তির বেড়াজালেই ফিরতে হল রাষ্ট্রকে। উল্লিখিত পরিস্থিতি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে পরিচালিত সব অভিযান এক ধরনের লোক দেখানো নাটক। একে পাতানো খেলা বললেও অত্যুক্তি হয় না।

ক্যাসিনোর নামে এ টাকার খেলা কি বিচ্ছিন্ন কোন বিষয়? মোটেও তা নয়। বরং এ ক্যাসিনো রাষ্ট্রের দানবীয় ?দুর্বৃত্তায়নেরই বাইপ্রোডাক্ট। যে দুষ্টচক্র দমনে এত আয়োজন সে দুষ্টচক্রই রাষ্ট্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। কবে বা কোন আমল থেকে এ দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে তা বলা কঠিন। তবে এটা ঠিক যে, এই দুর্বৃত্তায়ন প্রতি বছরই বেড়েছে। মাঝেমধ্যে দু-এক বছর হয়তো গতি থেমেছে বা মুলতুবি হয়েছে, কিন্তু পরক্ষণে নতুন করে শুরু হয়েছে। আর এই দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ায় শুধু রাজনৈতিক নেতারাই এককভাবে দায়ী নন। বরং এই দুর্বৃত্তায়নের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। আর এই বৃত্তের বাইরে থাকা লোকেরাই এখন সংখ্যালঘু।

অবৈধ পথে উপার্জন তথা ঘুষ ও দুর্নীতির সব পথ খোলা রেখে, কিছু লোককে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ দিয়ে ক্যাসিনো, স্পা, মদের দোকান কিংবা বিউটি পার্লারে গিয়ে ঝটিকা আক্রমণ আখেরে কোন ফল দেবে না। কিছু লোক আটক হবে, কিছু লোকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হবে, কিছু লোক জেল খাটবে, কিছু লোক পালিয়ে যাবে, কিছু লোক আপস করবে; কিন্তু ঐ অবৈধ উপার্জন কাজে লাগিয়েই জালের বাইরে চলে যাবে সব রাঘববোয়াল এবং সময়-সুযোগমতো তারা আবার ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করবে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হবে, আরও অনেক অনাচারের নেটওয়ার্ক স্থাপন করবে। যারা শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিলেন তাদেরই কেউ কেউ হয়তো সেখানে সহায়তাও করবেন। সুতরাং রাষ্ট্রে দানবীয় দুর্বৃত্তায়নের সব পথ উন্মুক্ত রেখে এ জাতীয় লোক দেখানো জিরো টলারেন্স নীতি গণমাধ্যমের জন্য কিছু সংবাদের খোরাক জোগাবে বটে, আখেরে ফল শূন্য।

আমরা শূন্য ফলের রঙ্গমঞ্চ চাই না। স্বচ্ছ, সুস্থ এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা চাই। জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো চাই। ক্যাসিনো চক্রে জড়িতরা কেন ছাড়া পাচ্ছে, কেন কারাগারে থেকেও আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে সে প্রশ্নের উত্তর চাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথের অন্তরায়গুলো অবশ্যই দূর করা উচিত। অপকর্মে জড়িত যে কোনো ব্যক্তি, তা তিনি ব্যাংকলুটেরা, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত, ঋণখেলাপি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কিংবা প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তিই হন না কেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে যেন প্রত্যেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেটাই কাম্য। এর ব্যত্যয় হলে সমাজে অনাচারের পথ প্রশস্ত হবে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দীর্ঘায়িত হবে।

বুধবার, ০৩ জুন ২০২০ , ২০ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১০ শাওয়াল ১৪৪১

ক্যাসিনোকাণ্ডের রাঘববোয়ালরা কি পার পেয়ে যাবে

ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ৭ মাস এবং ঠিকাদার জিকে শামীম প্রায় ২ মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইইউ) কেবিনে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে। চিকিৎসা শেষে তাদের কারাগারে ফেরত পাঠাতে বিএসএমএমইউকে পাঁচ দফা চিঠি দিয়েছে কারা প্রশাসন। অন্যদিকে ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে আটক মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক (ডাইরেক্টর ইনচার্জ) লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ) কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. মাহাবুবুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ক্যাসিনো কাণ্ড এবং জুয়ার বিরুদ্ধে কিছুদিন আগেই ব্যাপক হৈচৈ লক্ষ্য করা গেছে। সমাজের দৃশ্যপট সরগরম হয়ে উঠেছিল রাঘববোয়ালদের গ্রেফতারে। মনে করা হচ্ছিল, অনাচারের অবসান হবে, দুষ্টচক্র এবার নিশ্চিহ্ন হবে। কিন্তু এ দেশে সময়ের আবর্তে বিশেষ অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ধোয়া তুলসিপাতা বনে যায় কিংবা কৌশলে তাদের অপরাধ যে ঢেকে দেয়া যায় সেটা অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন। সেই চিরচেনা বিভ্রান্তির বেড়াজালেই ফিরতে হল রাষ্ট্রকে। উল্লিখিত পরিস্থিতি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে পরিচালিত সব অভিযান এক ধরনের লোক দেখানো নাটক। একে পাতানো খেলা বললেও অত্যুক্তি হয় না।

ক্যাসিনোর নামে এ টাকার খেলা কি বিচ্ছিন্ন কোন বিষয়? মোটেও তা নয়। বরং এ ক্যাসিনো রাষ্ট্রের দানবীয় ?দুর্বৃত্তায়নেরই বাইপ্রোডাক্ট। যে দুষ্টচক্র দমনে এত আয়োজন সে দুষ্টচক্রই রাষ্ট্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। কবে বা কোন আমল থেকে এ দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে তা বলা কঠিন। তবে এটা ঠিক যে, এই দুর্বৃত্তায়ন প্রতি বছরই বেড়েছে। মাঝেমধ্যে দু-এক বছর হয়তো গতি থেমেছে বা মুলতুবি হয়েছে, কিন্তু পরক্ষণে নতুন করে শুরু হয়েছে। আর এই দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ায় শুধু রাজনৈতিক নেতারাই এককভাবে দায়ী নন। বরং এই দুর্বৃত্তায়নের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। আর এই বৃত্তের বাইরে থাকা লোকেরাই এখন সংখ্যালঘু।

অবৈধ পথে উপার্জন তথা ঘুষ ও দুর্নীতির সব পথ খোলা রেখে, কিছু লোককে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ দিয়ে ক্যাসিনো, স্পা, মদের দোকান কিংবা বিউটি পার্লারে গিয়ে ঝটিকা আক্রমণ আখেরে কোন ফল দেবে না। কিছু লোক আটক হবে, কিছু লোকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হবে, কিছু লোক জেল খাটবে, কিছু লোক পালিয়ে যাবে, কিছু লোক আপস করবে; কিন্তু ঐ অবৈধ উপার্জন কাজে লাগিয়েই জালের বাইরে চলে যাবে সব রাঘববোয়াল এবং সময়-সুযোগমতো তারা আবার ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করবে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হবে, আরও অনেক অনাচারের নেটওয়ার্ক স্থাপন করবে। যারা শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিলেন তাদেরই কেউ কেউ হয়তো সেখানে সহায়তাও করবেন। সুতরাং রাষ্ট্রে দানবীয় দুর্বৃত্তায়নের সব পথ উন্মুক্ত রেখে এ জাতীয় লোক দেখানো জিরো টলারেন্স নীতি গণমাধ্যমের জন্য কিছু সংবাদের খোরাক জোগাবে বটে, আখেরে ফল শূন্য।

আমরা শূন্য ফলের রঙ্গমঞ্চ চাই না। স্বচ্ছ, সুস্থ এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা চাই। জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো চাই। ক্যাসিনো চক্রে জড়িতরা কেন ছাড়া পাচ্ছে, কেন কারাগারে থেকেও আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে সে প্রশ্নের উত্তর চাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথের অন্তরায়গুলো অবশ্যই দূর করা উচিত। অপকর্মে জড়িত যে কোনো ব্যক্তি, তা তিনি ব্যাংকলুটেরা, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত, ঋণখেলাপি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কিংবা প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তিই হন না কেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে যেন প্রত্যেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেটাই কাম্য। এর ব্যত্যয় হলে সমাজে অনাচারের পথ প্রশস্ত হবে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দীর্ঘায়িত হবে।