শিক্ষার বেহাল দশা ও করোনাভাইরাসের শিক্ষা

এ এন রাশেদা

১৯৭১ সালে অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা এনেছিলাম স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও আমাদের শুনতে হয় দেশের ৭৪৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র একজন করে শিক্ষক আছেন। তিনি স্কুলের ঘণ্টা বাজানো থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কার্যক্রম সবই সম্পন্ন করেন। আর ১ হাজার ১২৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে শিক্ষক আছেন মাত্র দু’জন। ৩ জন শিক্ষক নিয়ে পরিচালিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। [সূত্র : বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন : অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরমেন্স রিপোর্ট ২০১৯]। এ কথাগুলো বলা হলো শিক্ষার করুণ পরিণতি বোঝার জন্য। যেসব দেশকে আমরা উন্নত বলে জানি, সেসব দেশে প্রাইমারি শিক্ষা ও শিক্ষকদের অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় এবং অন্যান্য স্তরের শিক্ষকদেরও দেয়া হয়। ‘যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেয়া হয়। ফ্রান্সের আদালতে কেবল শিক্ষকদের চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। জাপানে সরকারের বিশেষ অনুমতি ছাড়া শিক্ষকদের গ্রেফতার করা যায় না। চীনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পদ শিক্ষকতা আর কোরিয়ায় শিক্ষকরা মন্ত্রীদের সমান সুযোগ পান।’ আর আমাদের দেশে শিক্ষকদের শহীদ মিনারে পুলিশ দ্বারা পিটিয়ে তক্তা বানানো হয়। পিপার স্প্রে করে চোখ অন্ধ করার চেষ্টা করা হয়; আরও কত কী। আর হ্যাঁ, প্রাইমারি শিক্ষার ব্যাপারে আরেকটি কথা না বললেই নয়। তা হলো সারাদেশে ২১ হাজার ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। প্রতিষ্ঠানে তাই লেখাপড়াও নেই। সে কারণে টিভির পর্দায় দেখা গেল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বেহাল দশা। শিশু শিক্ষার কী করুণ পরিণতি।

এরাই আসে হাইস্কুলে। এখানেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। কোথাও ক্লাসরুম নেই, প্রয়োজন অনুযায়ী লাইব্রেরি নেই, থাকলে লাইব্রেরিয়ান নেই, মাঠ নেই, বিজ্ঞান-সংস্কৃতির চর্চা নেই, টয়লেট ভীষণ রকম নোংরা বা নেই- ইত্যকার নানা সমস্যা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। গত ২৫ জানুয়ারি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট নিয়ে প্রধান সংবাদ করেছে ‘সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে- ভাড়া করা শিক্ষকেই নির্ভরতা।’ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক স্বল্পতা। এর ওপর অন্যদিকে আছে বড় ভাইদের নিষ্ঠুরতা। অত্যাচারে জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার মতো নির্মম কাহিনী। আরেকদিকে আছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হলরুম-কালচার; যা মধ্যযুগের বর্বরতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ প্রশাসন নির্বিকার। এই যখন শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র- তখন শিক্ষা কোথায়? আর এই পচাগলা ব্যবস্থার মধ্যে যেসব ব্যক্তি শিক্ষকতা পেশায় আসেন, তারা তো নমস্য। কিন্তু না, তাদের বৃহৎ এক অংশকে বেতন না দিয়ে বেগার খাটাবার সমস্ত ব্যবস্থা এদেশে শক্তভাবে পাকাপোক্ত। এমপিও (গড়হঃযষু চধু ড়ৎফবৎ) এবং এমপিও ছাড়া স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি স্কুল কলেজগুলো পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ৯০%। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার সিংহভাগই চলে বেসরকারিভাবে, তা দেশের কল্যাণকর তো বটেই। বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় তিন মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাহলে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন সংগ্রহ করবে? দেশে প্রায় ৫ হাজার ২৪২টি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী আছেন কর্মরত। তারা প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য অর্থ পেয়ে থাকেন, যাকে বেতন বলা যায় না। করোনার এই প্রার্দুভাবে তারা কীভাবে চলবেন? এসব শিক্ষক ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০১৮ এবং পূর্ববর্তী সময়ে এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে বহুবার অবস্থান ও অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন। ৫-১-২০১৮ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার একান্ত সচিব-১ অনশন স্থলে এসে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়েছেন এবং শিক্ষামন্ত্রী কাজ শুরু করেছেন।’ এই কাজের পরিপ্রেক্ষিতেই ২৯-৭-২০১৮ দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত হলো ‘সুখবরটি’ শিক্ষক নিয়োগ ও এমপিওভুক্তিতে ঘুষ-দুর্নীতি আরও বেড়েছে। এই সংবাদের সামান্য একটু অংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করছি- ‘এমপিওভুক্তির আবেদন উপজেলা থেকে জেলা শিক্ষা অফিস পর্যন্ত অনুমোদন পেতে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন পেতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং শিক্ষক নিয়োগে মহাপরিচালকের প্রতিনিধি পেতেও ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত শিক্ষা কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয় বলে মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ও অন্য একজন সংসদ-সদস্য শিক্ষা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ছিল সব স্কুল এমপিওভুক্ত করার। ১ জানুয়ারি ২০১৮ ‘সমকাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এমপিওর জন্য প্রয়োজন আরও ১৩শ’ কোটি টাকা। অথচ ঋণখেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা যখন মাফ হয়, বিদেশে পাচার হয়, ব্যাংক ডাকাতি হয়Ñ আরও কত কী? তখন ১৩শ’ কোটি টাকা কি খুব বেশি ছিল? প্রধানন্ত্রীর আশ্বাসের কি হলো? কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাজেটে বরাদ্দ না থাকলেও মাত্র কিছুদিন পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০ কোটি টাকা কওমি মাদরাসার জন্য হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফীকে দিলেন; অথচ কয়েক দিন পর তারা সরকারি অনুদান নেবেন না বলে জানালেন। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষকরা এই করোনাকালে কষ্টে আছেন উল্লেখ করে তাদের বিষয়টি অতি সত্বর দেখবেন বলে জানালেন (টিভির খবরে আমি এমনই শুনেছিলাম)। অথচ তারও কিছু বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা গেল। ৩০ নভেম্বর ২০১৯ ‘যুগান্তর’-এ প্রকাশিত হলো- ‘কোনো ক্লাসরুম, শিক্ষার্থী না থাকলেও এমপিওভুক্তির তালিকায় আছে নড়াইলের লোহাগড়ার চরব্রাহ্মণডাঙ্গা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা।’ এমন মাদরাসাপ্রীতির খবর আরো আছে। ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ দৈনিক কালের কণ্ঠ ‘জনকণ্ঠের’ বরাত দিয়ে লিখেছে ‘মাদরাসায় রেকর্ড বরাদ্দ’ শিরোনামে প্রতিবেদন। ‘সারা দেশে ১ হাজার ৬৮১টি মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সারা দেশে মাদরাসার উন্নয়নে খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা।’ কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের আওতায় মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর মাদরাসা উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর পুরাটাই সরকার দেবে। হায়রে কপাল! মাদরাসার উন্নয়নে ১৭ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেয়া যায়; আর সাধারণ ধারার শিক্ষকদের পেটভাতে বেঁচে থাকার জন্য ১৩শ’ কোটি টাকা দেয়া যায় না? পুরো বেতনও তো না নন-এমপিও শিক্ষকদের। সূত্র বলছে, ‘সরকার ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অর্থাৎ যেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেসব এলাকার প্রতি উপজেলায় দুটি করে মোট ১ হাজার ১০টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।’

অথচ সারাদেশে শিশুদের কিন্ডারগার্টেন নামক স্কুলে পাঁচ লাখ শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন (শিক্ষিকাই বেশি); যারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই বিভীষিকাময় সময়ে তাদের প্রতি তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেদনা সহানুভূতিমূলক বক্তব্য শোনা গেল না। তারা তো আগামীর সৈনিক শিশুদেরই পড়াচ্ছেন।

বর্তমানে টেকনিক্যাল শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করে প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই বলছেন, ‘ভালো কথা, দেশে ১০ হাজার ৪৫২টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯ হাজার ৭৫৯টি বেসরকারি। সরকারি মাত্র ৬৯৩টি। বেসরকারিতে প্রায় দুই লাখ শিক্ষক কর্মচারী। করোনাভাইরাসের সুপারসনিক গতিতে এগিয়ে চলাকালে বেতন দেয়ার সামর্থ্য কি সব প্রতিষ্ঠানের আছে? ছাত্র বেতনের ওপর যারা নির্ভর করে চলে?

বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সবচাইতে কদর্য ও নিষ্ঠুর প্রতারণামূলক কাজ ‘এসিটি’ অর্থাৎ স্কুল পর্যায়ে অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষকদের নিয়োগদান-প্রক্রিয়া নিয়ে। বর্তমান সরকার কর্তৃক ২০১৫ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদে আকর্ষণীয় বেতনে নিজ জেলার সর্বোচ্চ মেধাবীদের ‘সেকায়েপ’ প্রকল্পের অধীনে সারাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫ হাজার দুইশ’ জন বিষয়ভিত্তিক (ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান) অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষক (এসিটি) ৩ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যাদের মডেল শিক্ষক বলা হতো। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মডেল শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি প্রকল্প শেষে এসব শিক্ষককে পরবর্তী প্রোগ্রামে স্থানান্তরের কথা ছিল। এসব শিক্ষকদের নিয়মিত ও অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক সাফল্য যেমন বেড়েছিল, তেমনি করে পড়া রোধ, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ ও বাল্যবিবাহ কমিয়ে এনে সর্বোপরি শিক্ষার মান উন্নয়নে অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন। অথচ শর্ত অনুযায়ী তাদের নিয়োগ বর্ধিত না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন প্রজেক্টে শিক্ষকপ্রতি লাখ লাখ টাকা ঘুষ আদায়ের মহাপরিকল্পনায় এসব শিক্ষক বাদ দিয়ে ‘এসইডিপি’ নামে নতুন প্রোগ্রামে ১২ হাজার শিক্ষক নেয়ার পাঁয়তারা করছে। এর বিরুদ্ধে শেষমেশ গত ৫ মার্চ ২০২০ ‘এসিটিরা’ প্রেসক্লাবের সামনে ৪ দিন সকাল-সন্ধ্যা কর্মসূচি পালন করেছেন এবং শেষে আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তা স্থগিত করেছেন। এখন বিগত যৌবনে তারা কোথায় যাবে আর এই করোনাকালে কীভাবে চলবে? ত্রাণ নিয়ে? মেধাবী শিক্ষার্থীদের কি এই প্রতিদান! তারা তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তো আবেদনও করছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া আটকে থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন অথচ ‘এসিটি’ শিক্ষকদের কথা কেন ভুলে গেলেন?

১৬ মে ২০২০ দৈনিক কালের কণ্ঠ একটি ভালো রিপোর্ট করেছে- ‘করোনায় দিশাহারা ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী’। তারা হাইলাইট করেছে বেতনের সঙ্গে বন্ধ প্রাইভেট টিউশনিও। সবচেয়ে বেশি বিপদে নন-এমপিও শিক্ষকরা। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের বেতন বন্ধ, বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও ভালো নেই, নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না ৭৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, টিউশন ফি পরিশোধে আগ্রহী নন অভিভাবকরা, সরকারের কাছে প্রণোদনার আবেদনেও সাড়া নেই।’

তবে প্রণোদনার ব্যাপারে শিক্ষক হিসেবে ভিন্নমত প্রকাশ করা যায়। কারণ আমাদের সংবিধান প্রদত্ত চারটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে ‘শিক্ষা’ একটি। তাই শিক্ষার ব্যয়ভার রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। চিকিৎসা ও বাসস্থানও চাই। স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও কোনো সরকার নজর দেয়নি মানুষের মৌলিক অধিকার পরিপূরণের। করোনাভাইরাস সেদিকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

শ্রমিকের বাসস্থান বাসযোগ্য নয়। সবকিছু মিলিয়ে একেবারেই মানবেতর। নিরাপদ তো নয়ই। তাই শুধু মালিক বাঁচলে হবে না, শ্রমিককেও বাঁচতে হবে। দরকার বাসযোগ্য বাসস্থান। ভালো আহার, ভালো চিকিৎসা আর সন্তানের ভালো শিক্ষা। শেষ করব প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক শ্রদ্ধাভাজন কবীর চৌধুরীর বক্তব্য দিয়ে। ১৯৮৫ সালের ৪ জুন ‘আমাদের শিক্ষার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন : ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে আজ যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছি আমরা, তা শুধু একক ও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার সংকট নয়। এর সঙ্গে জড়িত আমাদের কৃষির সংকট, শিল্পের সংকট, তথা অর্থনীতির সংকট। আমাদের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত প্রগতিশীল মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়ার ফলে সৃষ্ট সংকট; তথা রাজনীতির সংকট। সমাজজীবনে দুর্নীতি, উৎকোচ, নারী নির্যাতন, খুন-রাহাজানি-ছিনতাই, কিশোর অপরাধ প্রভৃতির সংকট; তথা সামাজিক সংকট। শিক্ষার সংকট মোচন করতে চাইলে আমাদের সামগ্রিক সংকটের প্রকৃতি উপলব্ধি করতে হবে এবং জাতীয় ভিত্তিতে সুসমন্বিত ব্যাপক কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বক্তব্য আজও সত্য। বর্তমান সময় সে দাবিই করে।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপক নটরডেম কলেজ, সম্পাদক শিক্ষাবার্তা।

বুধবার, ০৩ জুন ২০২০ , ২০ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১০ শাওয়াল ১৪৪১

শিক্ষার বেহাল দশা ও করোনাভাইরাসের শিক্ষা

এ এন রাশেদা

১৯৭১ সালে অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা এনেছিলাম স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও আমাদের শুনতে হয় দেশের ৭৪৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র একজন করে শিক্ষক আছেন। তিনি স্কুলের ঘণ্টা বাজানো থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কার্যক্রম সবই সম্পন্ন করেন। আর ১ হাজার ১২৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে শিক্ষক আছেন মাত্র দু’জন। ৩ জন শিক্ষক নিয়ে পরিচালিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। [সূত্র : বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন : অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরমেন্স রিপোর্ট ২০১৯]। এ কথাগুলো বলা হলো শিক্ষার করুণ পরিণতি বোঝার জন্য। যেসব দেশকে আমরা উন্নত বলে জানি, সেসব দেশে প্রাইমারি শিক্ষা ও শিক্ষকদের অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় এবং অন্যান্য স্তরের শিক্ষকদেরও দেয়া হয়। ‘যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেয়া হয়। ফ্রান্সের আদালতে কেবল শিক্ষকদের চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। জাপানে সরকারের বিশেষ অনুমতি ছাড়া শিক্ষকদের গ্রেফতার করা যায় না। চীনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পদ শিক্ষকতা আর কোরিয়ায় শিক্ষকরা মন্ত্রীদের সমান সুযোগ পান।’ আর আমাদের দেশে শিক্ষকদের শহীদ মিনারে পুলিশ দ্বারা পিটিয়ে তক্তা বানানো হয়। পিপার স্প্রে করে চোখ অন্ধ করার চেষ্টা করা হয়; আরও কত কী। আর হ্যাঁ, প্রাইমারি শিক্ষার ব্যাপারে আরেকটি কথা না বললেই নয়। তা হলো সারাদেশে ২১ হাজার ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। প্রতিষ্ঠানে তাই লেখাপড়াও নেই। সে কারণে টিভির পর্দায় দেখা গেল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বেহাল দশা। শিশু শিক্ষার কী করুণ পরিণতি।

এরাই আসে হাইস্কুলে। এখানেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। কোথাও ক্লাসরুম নেই, প্রয়োজন অনুযায়ী লাইব্রেরি নেই, থাকলে লাইব্রেরিয়ান নেই, মাঠ নেই, বিজ্ঞান-সংস্কৃতির চর্চা নেই, টয়লেট ভীষণ রকম নোংরা বা নেই- ইত্যকার নানা সমস্যা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। গত ২৫ জানুয়ারি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট নিয়ে প্রধান সংবাদ করেছে ‘সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে- ভাড়া করা শিক্ষকেই নির্ভরতা।’ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক স্বল্পতা। এর ওপর অন্যদিকে আছে বড় ভাইদের নিষ্ঠুরতা। অত্যাচারে জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার মতো নির্মম কাহিনী। আরেকদিকে আছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হলরুম-কালচার; যা মধ্যযুগের বর্বরতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ প্রশাসন নির্বিকার। এই যখন শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র- তখন শিক্ষা কোথায়? আর এই পচাগলা ব্যবস্থার মধ্যে যেসব ব্যক্তি শিক্ষকতা পেশায় আসেন, তারা তো নমস্য। কিন্তু না, তাদের বৃহৎ এক অংশকে বেতন না দিয়ে বেগার খাটাবার সমস্ত ব্যবস্থা এদেশে শক্তভাবে পাকাপোক্ত। এমপিও (গড়হঃযষু চধু ড়ৎফবৎ) এবং এমপিও ছাড়া স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি স্কুল কলেজগুলো পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ৯০%। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার সিংহভাগই চলে বেসরকারিভাবে, তা দেশের কল্যাণকর তো বটেই। বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় তিন মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাহলে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন সংগ্রহ করবে? দেশে প্রায় ৫ হাজার ২৪২টি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী আছেন কর্মরত। তারা প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য অর্থ পেয়ে থাকেন, যাকে বেতন বলা যায় না। করোনার এই প্রার্দুভাবে তারা কীভাবে চলবেন? এসব শিক্ষক ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০১৮ এবং পূর্ববর্তী সময়ে এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে বহুবার অবস্থান ও অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন। ৫-১-২০১৮ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার একান্ত সচিব-১ অনশন স্থলে এসে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়েছেন এবং শিক্ষামন্ত্রী কাজ শুরু করেছেন।’ এই কাজের পরিপ্রেক্ষিতেই ২৯-৭-২০১৮ দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত হলো ‘সুখবরটি’ শিক্ষক নিয়োগ ও এমপিওভুক্তিতে ঘুষ-দুর্নীতি আরও বেড়েছে। এই সংবাদের সামান্য একটু অংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করছি- ‘এমপিওভুক্তির আবেদন উপজেলা থেকে জেলা শিক্ষা অফিস পর্যন্ত অনুমোদন পেতে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন পেতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং শিক্ষক নিয়োগে মহাপরিচালকের প্রতিনিধি পেতেও ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত শিক্ষা কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয় বলে মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ও অন্য একজন সংসদ-সদস্য শিক্ষা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ছিল সব স্কুল এমপিওভুক্ত করার। ১ জানুয়ারি ২০১৮ ‘সমকাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এমপিওর জন্য প্রয়োজন আরও ১৩শ’ কোটি টাকা। অথচ ঋণখেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা যখন মাফ হয়, বিদেশে পাচার হয়, ব্যাংক ডাকাতি হয়Ñ আরও কত কী? তখন ১৩শ’ কোটি টাকা কি খুব বেশি ছিল? প্রধানন্ত্রীর আশ্বাসের কি হলো? কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাজেটে বরাদ্দ না থাকলেও মাত্র কিছুদিন পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০ কোটি টাকা কওমি মাদরাসার জন্য হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফীকে দিলেন; অথচ কয়েক দিন পর তারা সরকারি অনুদান নেবেন না বলে জানালেন। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষকরা এই করোনাকালে কষ্টে আছেন উল্লেখ করে তাদের বিষয়টি অতি সত্বর দেখবেন বলে জানালেন (টিভির খবরে আমি এমনই শুনেছিলাম)। অথচ তারও কিছু বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা গেল। ৩০ নভেম্বর ২০১৯ ‘যুগান্তর’-এ প্রকাশিত হলো- ‘কোনো ক্লাসরুম, শিক্ষার্থী না থাকলেও এমপিওভুক্তির তালিকায় আছে নড়াইলের লোহাগড়ার চরব্রাহ্মণডাঙ্গা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা।’ এমন মাদরাসাপ্রীতির খবর আরো আছে। ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ দৈনিক কালের কণ্ঠ ‘জনকণ্ঠের’ বরাত দিয়ে লিখেছে ‘মাদরাসায় রেকর্ড বরাদ্দ’ শিরোনামে প্রতিবেদন। ‘সারা দেশে ১ হাজার ৬৮১টি মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সারা দেশে মাদরাসার উন্নয়নে খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা।’ কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের আওতায় মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর মাদরাসা উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর পুরাটাই সরকার দেবে। হায়রে কপাল! মাদরাসার উন্নয়নে ১৭ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেয়া যায়; আর সাধারণ ধারার শিক্ষকদের পেটভাতে বেঁচে থাকার জন্য ১৩শ’ কোটি টাকা দেয়া যায় না? পুরো বেতনও তো না নন-এমপিও শিক্ষকদের। সূত্র বলছে, ‘সরকার ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অর্থাৎ যেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেসব এলাকার প্রতি উপজেলায় দুটি করে মোট ১ হাজার ১০টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।’

অথচ সারাদেশে শিশুদের কিন্ডারগার্টেন নামক স্কুলে পাঁচ লাখ শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন (শিক্ষিকাই বেশি); যারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই বিভীষিকাময় সময়ে তাদের প্রতি তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেদনা সহানুভূতিমূলক বক্তব্য শোনা গেল না। তারা তো আগামীর সৈনিক শিশুদেরই পড়াচ্ছেন।

বর্তমানে টেকনিক্যাল শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করে প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই বলছেন, ‘ভালো কথা, দেশে ১০ হাজার ৪৫২টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯ হাজার ৭৫৯টি বেসরকারি। সরকারি মাত্র ৬৯৩টি। বেসরকারিতে প্রায় দুই লাখ শিক্ষক কর্মচারী। করোনাভাইরাসের সুপারসনিক গতিতে এগিয়ে চলাকালে বেতন দেয়ার সামর্থ্য কি সব প্রতিষ্ঠানের আছে? ছাত্র বেতনের ওপর যারা নির্ভর করে চলে?

বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সবচাইতে কদর্য ও নিষ্ঠুর প্রতারণামূলক কাজ ‘এসিটি’ অর্থাৎ স্কুল পর্যায়ে অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষকদের নিয়োগদান-প্রক্রিয়া নিয়ে। বর্তমান সরকার কর্তৃক ২০১৫ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদে আকর্ষণীয় বেতনে নিজ জেলার সর্বোচ্চ মেধাবীদের ‘সেকায়েপ’ প্রকল্পের অধীনে সারাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫ হাজার দুইশ’ জন বিষয়ভিত্তিক (ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান) অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষক (এসিটি) ৩ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যাদের মডেল শিক্ষক বলা হতো। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মডেল শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি প্রকল্প শেষে এসব শিক্ষককে পরবর্তী প্রোগ্রামে স্থানান্তরের কথা ছিল। এসব শিক্ষকদের নিয়মিত ও অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক সাফল্য যেমন বেড়েছিল, তেমনি করে পড়া রোধ, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ ও বাল্যবিবাহ কমিয়ে এনে সর্বোপরি শিক্ষার মান উন্নয়নে অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন। অথচ শর্ত অনুযায়ী তাদের নিয়োগ বর্ধিত না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন প্রজেক্টে শিক্ষকপ্রতি লাখ লাখ টাকা ঘুষ আদায়ের মহাপরিকল্পনায় এসব শিক্ষক বাদ দিয়ে ‘এসইডিপি’ নামে নতুন প্রোগ্রামে ১২ হাজার শিক্ষক নেয়ার পাঁয়তারা করছে। এর বিরুদ্ধে শেষমেশ গত ৫ মার্চ ২০২০ ‘এসিটিরা’ প্রেসক্লাবের সামনে ৪ দিন সকাল-সন্ধ্যা কর্মসূচি পালন করেছেন এবং শেষে আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তা স্থগিত করেছেন। এখন বিগত যৌবনে তারা কোথায় যাবে আর এই করোনাকালে কীভাবে চলবে? ত্রাণ নিয়ে? মেধাবী শিক্ষার্থীদের কি এই প্রতিদান! তারা তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তো আবেদনও করছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া আটকে থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন অথচ ‘এসিটি’ শিক্ষকদের কথা কেন ভুলে গেলেন?

১৬ মে ২০২০ দৈনিক কালের কণ্ঠ একটি ভালো রিপোর্ট করেছে- ‘করোনায় দিশাহারা ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী’। তারা হাইলাইট করেছে বেতনের সঙ্গে বন্ধ প্রাইভেট টিউশনিও। সবচেয়ে বেশি বিপদে নন-এমপিও শিক্ষকরা। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের বেতন বন্ধ, বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও ভালো নেই, নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না ৭৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, টিউশন ফি পরিশোধে আগ্রহী নন অভিভাবকরা, সরকারের কাছে প্রণোদনার আবেদনেও সাড়া নেই।’

তবে প্রণোদনার ব্যাপারে শিক্ষক হিসেবে ভিন্নমত প্রকাশ করা যায়। কারণ আমাদের সংবিধান প্রদত্ত চারটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে ‘শিক্ষা’ একটি। তাই শিক্ষার ব্যয়ভার রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। চিকিৎসা ও বাসস্থানও চাই। স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও কোনো সরকার নজর দেয়নি মানুষের মৌলিক অধিকার পরিপূরণের। করোনাভাইরাস সেদিকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

শ্রমিকের বাসস্থান বাসযোগ্য নয়। সবকিছু মিলিয়ে একেবারেই মানবেতর। নিরাপদ তো নয়ই। তাই শুধু মালিক বাঁচলে হবে না, শ্রমিককেও বাঁচতে হবে। দরকার বাসযোগ্য বাসস্থান। ভালো আহার, ভালো চিকিৎসা আর সন্তানের ভালো শিক্ষা। শেষ করব প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক শ্রদ্ধাভাজন কবীর চৌধুরীর বক্তব্য দিয়ে। ১৯৮৫ সালের ৪ জুন ‘আমাদের শিক্ষার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন : ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে আজ যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছি আমরা, তা শুধু একক ও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার সংকট নয়। এর সঙ্গে জড়িত আমাদের কৃষির সংকট, শিল্পের সংকট, তথা অর্থনীতির সংকট। আমাদের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত প্রগতিশীল মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়ার ফলে সৃষ্ট সংকট; তথা রাজনীতির সংকট। সমাজজীবনে দুর্নীতি, উৎকোচ, নারী নির্যাতন, খুন-রাহাজানি-ছিনতাই, কিশোর অপরাধ প্রভৃতির সংকট; তথা সামাজিক সংকট। শিক্ষার সংকট মোচন করতে চাইলে আমাদের সামগ্রিক সংকটের প্রকৃতি উপলব্ধি করতে হবে এবং জাতীয় ভিত্তিতে সুসমন্বিত ব্যাপক কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বক্তব্য আজও সত্য। বর্তমান সময় সে দাবিই করে।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপক নটরডেম কলেজ, সম্পাদক শিক্ষাবার্তা।