পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে

মোহাম্মদ শাহজাহান

সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে দু-তিন মাস ধরে সবকিছু বন্ধ রয়েছে। ফলে ধনী-গরিব সব দেশের অর্থনীতিই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো অনাহারে-অর্ধহারে দিনাতিপাত করছে। ফলে জীবন-জীবিকার স্বার্থে করোনা সংক্রমণ বাড়বে জেনেও বহু দেশ লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হচ্ছে। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি থাকার পর সরকার ঘোষণায় ৩১ মে রোববার থেকে বাংলাদেশের অফিস-আদালত, গণপরিবহন সবকিছু চলছে। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। প্রখমে গণপরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষনা থাকলেও গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা দিয়ে কিছু সময় পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়। সবকিছু খুলে দিয়ে গণপরিবহন বন্ধ রাখলে মানুষ চলাচল করবে কিভাবে? এর পর জানানো হয়, সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল করবে। সীমিত পরিসরের ব্যাখ্যায় বলা হয়, গণপরিবহন চলাচল করলেও তা নিয়ন্ত্রিতভাবে চলবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৫ জুন পর্যন্ত ছুটি থাকবে, তবে অনলাইন ক্লাস ও দূরশিক্ষণ চলবে। ব্যক্তিগত পরিবহনও চলাচল করবে। এ সময়ে বয়স্ক, অসুস্থ ও গর্ভবতী মহিলাদের কর্মস্থলে যোগদানের ব্যাপারে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ১৩টি স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস করবেন। রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের হওয়ার আগের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এই সময়ে অকারণে বের হলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। দোকানপাটসহ অন্য সবকিছুর ব্যাপারে পূর্বে সময়সূচি বহাল থাকবে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী আবারো স্মরণ করিয়ে দেন, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতেই সীমিত পরিসরে সব অফিস খোলার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রচণ্ডতার মধ্যেও সরকার কেন সবকিছু খুলে দিল? এই প্রশ্ন এখন সকলের। এ প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে- শুধু মানুষকে বাঁচাতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জীবন ও জীবিকা দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। কেউ হয়তো বলবেন, ‘জীবিকার চেয়ে জীবন বড়। জীবন না বাঁচলে জীবিকা দিয়ে কি হবে?’ আবার এ কথাও তো ঠিক, জীবিকা ছাড়া জীবন বাঁচানো যায় না। সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, সবকিছু খুলে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত নিরন্ন মানুষের পেটে ভাত যোগানোর লক্ষ্যেই নেয়া হয়েছে।

সবকিছু খুলে দেয়ার এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ হচ্ছে, যে ঢাকা শহরে ভিক্ষুক খুঁজে পাওয়া যেত না, কিছুদিন ধরে রাস্তায় বের হলে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন স্থানে নিরন্ন অসহায় নারীদের জটলা দেখা যায়। এরা ভিক্ষুক নয়। এতদিন তারা বাসাবাড়িতে কাজ করেছে, অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। আবার অনেক গরিব রিকশাওয়ালা, ছোট ছোট দোকাদারসহ অনেকের আয়-রোজগার বন্ধ। এসব পরিবারের অসহায় নারীরা শুধু ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির হয়ে দু মুঠো খাবার যোগানোর জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। এটাতো ঢাকা শহরের চিত্র নয়। অন্য শহরসহ সারা বাংলাতেই আজকে নিরন্ন মানুষের হাহাকার কম-বেশি রয়েছে। সরকার সাধ্যমতো সহযোগিতা করে যাচ্ছে, যা সবার জন্য পর্যাপ্ত নয় এবং সব ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছানোও সম্ভব হচ্ছে না। এখন জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে। সবাই জানেন, স্বাস্থ্যবিধির কথা। দৈনিক সংবাদ-এর একজন কলাম লেখকের সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘আমন্ত্রণ না জানালে করোনা এমনিতেই কারো কাছে আসে না।’ এই বাংলাদেশে লাখো মানুষের শরীরে করোনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কাজ জীবনের স্বার্থে- সামাজিক দূরত্ব তথা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। নির্বোধ, অবুঝ ছাড়া সবাই জীবনকে ভালোবাসে। মাত্র কয়েকটা দিন (জুন মাস) আমরা যদি শারীরিক দূরত্ব বজায়সহ বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হয়ে পরিবারকে সময় দেই, বের হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, ইনশাল্লাহ করোনা পরাজিত হবে। আবারো জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে এই বাংলায় মানুষই জয়ী হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদুল ফিতরের আগের দিন ২৪ মে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু করতে করোনাভাইরাস মহামারিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চলমান লকডাউন আরো শিথিল করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সব দেশই এরই মধ্যে লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, অনির্দিষ্টকালের জন্য মানুষের আয়-রোজগারে পথ বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে তো নয়ই। ঝড়ঝঞ্ঝা-মহামারী আসবে। সেগুলো মোকাবিলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের এই মহামারী সহসা দূর হবে না। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকবে না। যতদিন না কোনো প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই হয়তো আমাদের বাঁচতে হবে। জীবন-জীবিকার স্বার্থে চালু করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।’

আসলে অফিস-আদালত, গণপরিবহন- সবকিছু একেবারে নিঃশর্ত খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়নি। সবকিছুই খুলে দেয়া হয়েছে শর্তসাপেক্ষে। সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকার সময়ে সবকিছু খুলে দেয়ার বিষয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও বাস্তবতার কারণে জীবন-জীবিকার সমন্বয় করেই চলতে হবে। এদিকে ছুটি আর না বাড়ানোর সরকারি ঘোষণার পর হাজার হাজার মানুষ কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন। সড়ক-মহাসড়কে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় বাড়ছে। মাওয়া-পাটুরিয়া-দৌলদিয়া ফেরিঘাটে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মানুষের ঢল দেখা যাচ্ছে। সর্বোচ্চ সংক্রমণের এই সময়ে মানুষের ভিড় আতঙ্কও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কর্তৃপক্ষের দেয়া ১১ শর্তে দূরপাল্লা ও নগর পরিবহন বাস চলতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেই ১১ শর্ত মেনে বাস চালানো আদৌ সম্ভব কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। মালিক-চালকরাই মনে করছেন, বিশেষ করে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ রুটের বাসে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন সবকিছু খুলে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তটি বিশেষজ্ঞ মহলে আত্মঘাতী মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল গরিব দেশে একাধারে দুই মাসের বেশি সময় (২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে) ধরে সরকারি অফিস-আদালতসহ প্রায় সবকিছু বন্ধ রয়েছে। সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করেও সকল নিরন্ন মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছাতে পারেনি, তা সম্ভবও ছিল না। এর উপর আকস্মিকভাবে ‘আম্ফান’ এর আঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকার মোড়ে মোড়ে নিরন্ন পরিবারের নারীরা সাহায্যের আশায় ভিড় জমাচ্ছে। এরা ভিক্ষুক নয় এবং এটা ঢাকা শহরের চিত্রও নয়। তাছাড়া করোনাভাইরাস খুব সহসাই চলে যাবে, সেকথাও বলার কোনো উপায় নেই। অতীত ইতিহাস কি বলে? প্লেগ দুই হাজার বছর ধরে বিশ্বে বিচরণ করেছে। ১৩৩১ সালে প্লেগ রোগে চীনের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোক মারা যায়। এরপর ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সাল পর্যন্ত চার বছরে উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় প্লেগ মহামারীতে অসংখ্য মানুষ মারা যান। এর প্রায় ৫ শতাধিক বছর পর আবার চীনে হানা দেয় প্লেগ। ওই সময় প্লেগ প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন শুধু ভারত উপমহাদেশেই এক কোটির ওপর (সোয়া কোটি) মানুষ মারা গিয়েছিল। এরপর প্লেগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়ার পর ধীরে ধীরে এর দাপট কমে যায়।

এরপর সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় তিন হাজার বছর অসংখ্য মানুষের প্রাণ সংহার করে গুটিবসন্ত বা ‘ভ্যারিওলা ভাইরাস’। আমরা ছোটকালে ষাটের দশকের শুরুতে গুটিবসন্ত ও কলেরার তাণ্ডব দেখেছি। কলেরা বসন্তে গ্রামে গ্রামে বহু মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু আমরা বা অন্য কোনো মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাননি। এই জমানায় করোনার ভয়ে বিশেষ বিমানে কয়েকজন টাকাওয়ালার দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর বের হয়েছে। কলেরা-বসন্তের দাপট আজকের করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক ভয়াবহ ছিল। গত ক’মাসে করোনা আক্রান্ত মানুষকে যেভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, যেভাবে স্বজনরা পর্যন্ত অমানবিকতা, অসভ্যতা ও বর্বরতা দেখাচ্ছে, আমরা ওই দৃশ্য তখন দেখিনি। মনে আছে, ওই সময় ফজরের নামাজের পর ভোর রাতে দল বেঁধে মানুষ পাড়ায় পাড়ায় যিকির করে উপরওয়ালার কাছে পানাহ (মুক্তি) চেয়েছে। প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের পর ক’দশক আগে গুটিবসন্তও বলতে গেলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। কলেরাও নিয়ন্ত্রণে। এরপর আসে ভয়াবহ এক ফ্লু যা ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত। ১৯১৮ সালে ভয়াবহ এই ফ্লুর তাণ্ডব শুরু হয়। মাত্র তিন বছরে (১৯১৮ থেকে ১৯২০) স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বে ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৯৬৮ সালে হংকং ফ্লুতে মারা যায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ। যে ক’টা ভয়াবহ মানববিধ্বংসী ভাইরাসের কথা বলা হলো, সবকটিই ছিল ছোঁয়াচে। ছোঁয়াছুয়ির মাধ্যমে এবং নাক দিয়ে মানুষের দেহে প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমিত হতো।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, উপরের উল্লিখিত ভাইরাসগুলো করোনার চেয়ে আরো বেশি ভয়াবহ ছিল। অবশ্য করোনা নিয়েও শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। ইতোমধ্যে গত ৬ মাসে বহুবার রূপ (ধরন) বদলিয়েছে করোনাভাইরাস। আগের ভাইরাসগুলোর কোনো কোনোটি ২ থেকে ৩ হাজার বছর পর্যন্ত বিশ্বের মানুষকে অতিষ্ঠ করেছে। সহসাই কোভিড-১৯ চলে যাবে, এমন কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘অন্তত আরও ২ বছর অর্থাৎ ২০২২ সাল পর্যন্ত করোনার ভয়াবহতা থাকবে এই ধরায়।’ হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের একজন মাহমারী বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ‘গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, করোনা নিজে থেকে এই বিশ্ব হতে চলে যাবে না। করোনাকে নিবৃত্ত করতে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ধীরে ধীরে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তথা ‘হার্ড ইমিউনিটি’র দিকে ধাবিত হতে হবে। কাজেই বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে লকডাউনের মেয়াদ আরো কিছুদিন বৃদ্ধি করলেও তাৎক্ষণিক লাভের কোন আশা নেই। করোনা নিয়ে আমরা একটু বেশিই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি এবং অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতাও বেশি দেখাচ্ছি। প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আরো অন্তত ১/২ বছর করোনাকে সঙ্গে নিয়েই এই বিশ্বের মানুষকে বাঁচতে হবে। কিন্তু কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গত ৫/৬ মাসে করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকে ধ্বংসের প্রায় দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনেতারা পর্যন্ত আজ হতাশ। এভাবে আর কতদিন চলতে পারে? যদি বিশ্বের ৯০/৯৫ শতাংশ মানুষকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হয়, এটাই যদি আমাদের ভাগ্যে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে করোনা আতঙ্কে কেন ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে অর্থনীতি ও গোটা বিশ্বের মানুষ। এমতাবস্থায় জোরের সঙ্গে বলতে চাই, করোনার প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত করোনাকে সঙ্গে নিয়েই যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। শত্রুকে ভয় পেলে চেপে ধরে। ভাইরাসকে মোকাবিলা করেই চলতে শিখতে হবে।

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যু এবং পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের হার সবই প্রচণ্ড গতিতে বেড়ে চলছে। ১২তম সপ্তাহে ৩১ মে পর্যন্ত ৬৫০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে সরকার এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭ হাজার ১৫৩ জন ও সুস্থ হয়েছেন ৯ হাজার ৪৮১ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মাথায় মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নমুনা পরীক্ষার শনাক্তের হার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু। এ সময় নানা প্রস্তুতি নিয়ে সীমিত পরিসরে নানা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন চালু হলেও সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে সব দেশকে ৬টি পরামর্শ দিয়েছিল। এসব শর্ত পূরণ হলেই কেবল লকডাউন তুলে নেয়ার পক্ষে সংস্থাটি। এদিকে করোনার কারণে বন্ধ থাকা কর্মস্থলে পুনরায় কাজ শুরুর আগে কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। নির্দেশনা অনুসারে সব কর্মীকে এক সঙ্গে কাজে ফেরানো যাবে না এবং কর্মস্থলকে কাজে ফেরানোর উপযোগী করতে হবে। করোনা নিয়ে করণীয় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শ কমিটি সম্প্রতি একসভায় আরো কিছু সুপারিশ করেছে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ‘পৃথিবীর অন্য দেশের অভিজ্ঞতায় করোনা রোগের সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে রোগের সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা থাকে।’ পরামর্শক কমিটি হাসপাতালগুলোতে হাইপো অক্সিজেনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা করোনা রোগীর জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু বিষয়টির দিকে কোন গুরুত্বই দেয়া হয়নি। করোনা রোগীর জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন হাইপো অক্সিজেন সিএমএইচ ছাড়া অন্য কোন হাসপাতালে নেই। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে হেলাফিল্টার ও নেগেটিভ প্রেসার প্রয়োজন, যা দিয়ে আইসিইউ এর পুরো এরিয়া জীবাণুমুক্ত করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা নেই। তিন মাস সময় পেয়েও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন, সংক্রমণ বাড়ার গতি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে। পরিস্থিতি যে আরো জটিল আকার ধারণ করবে, এ ব্যাপারে কারো কোনো সংশয় নেই। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।

তবে একই সময়ে সারা দেশে সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে কম সংক্রমিত এলাকা, পরে মধ্যম সংক্রমিত এলাকা, আরো পরে বেশি সংক্রমিত এলাকার অঘোষিত লকডাউন শিথিল করলে ভালো হতো। অর্থাৎ সারা দেশে একবারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করে এলাকাভিত্তিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। অবশ্য এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। সরকারের ওপর পুরোপুরি ভরসা না করে প্রত্যেককে তার নিজের জীবনের দায়িত্ব নিতে হবে। গণপরিবহনে ও জনপরিসরে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা, মোট কথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় গাফিলতি নিজের জীবনকেই বিপন্ন করতে পারে- এই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা সবার থাকতে হবে। সরকারকে করোনার পরীক্ষা, রোগীদের চিকিৎসার পরিধি ও সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। করোনা হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সেগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি চিকিৎসক, নার্সসহ লোকবল আরও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার দিকেও বাড়তি নজর দিতে হবে সরকারকে। সর্বশেষে প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই কলামের ইতি টানতে চাই। একটি জাতীয় দৈনিকে (সমকাল, ৩০ মে ২০২০) তিনি লিখেছেন : “এবার প্রমাণিত হয়েছেÑ শেখ হাসিনা যতই দক্ষ ও বিজ্ঞ রাষ্ট্রপরিচালক হোন, তার প্রশাসন তেমন সচল নয়। গাড়ির এই অচল চাকা চালকের সব দক্ষতা ও সাফল্যকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। ... শেখ হাসিনা যদি করোনার এই বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে চান, তাহলে কেবল সুষ্ঠু নির্দেশনা দিলেই চলবে না, তাকে ধাক্কা দিয়ে তার অচল প্রশাসন সচল করতে হবে। যেমন করেছেন নিউজিল্যান্ডের নারী প্রধানমন্ত্রী। তাকে যদি কেউ ‘কর্তৃত্ববাদী’ বলে, বলুক। তার এই কর্তৃত্ববাদ মানুষকে বাঁচাবে, দেশকে বাঁচাবে।”

৩১ মে ২০২০

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com

বুধবার, ০৩ জুন ২০২০ , ২০ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১০ শাওয়াল ১৪৪১

পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে

মোহাম্মদ শাহজাহান

সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে দু-তিন মাস ধরে সবকিছু বন্ধ রয়েছে। ফলে ধনী-গরিব সব দেশের অর্থনীতিই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো অনাহারে-অর্ধহারে দিনাতিপাত করছে। ফলে জীবন-জীবিকার স্বার্থে করোনা সংক্রমণ বাড়বে জেনেও বহু দেশ লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হচ্ছে। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি থাকার পর সরকার ঘোষণায় ৩১ মে রোববার থেকে বাংলাদেশের অফিস-আদালত, গণপরিবহন সবকিছু চলছে। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। প্রখমে গণপরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষনা থাকলেও গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা দিয়ে কিছু সময় পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়। সবকিছু খুলে দিয়ে গণপরিবহন বন্ধ রাখলে মানুষ চলাচল করবে কিভাবে? এর পর জানানো হয়, সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল করবে। সীমিত পরিসরের ব্যাখ্যায় বলা হয়, গণপরিবহন চলাচল করলেও তা নিয়ন্ত্রিতভাবে চলবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৫ জুন পর্যন্ত ছুটি থাকবে, তবে অনলাইন ক্লাস ও দূরশিক্ষণ চলবে। ব্যক্তিগত পরিবহনও চলাচল করবে। এ সময়ে বয়স্ক, অসুস্থ ও গর্ভবতী মহিলাদের কর্মস্থলে যোগদানের ব্যাপারে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ১৩টি স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস করবেন। রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের হওয়ার আগের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এই সময়ে অকারণে বের হলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। দোকানপাটসহ অন্য সবকিছুর ব্যাপারে পূর্বে সময়সূচি বহাল থাকবে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী আবারো স্মরণ করিয়ে দেন, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতেই সীমিত পরিসরে সব অফিস খোলার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রচণ্ডতার মধ্যেও সরকার কেন সবকিছু খুলে দিল? এই প্রশ্ন এখন সকলের। এ প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে- শুধু মানুষকে বাঁচাতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জীবন ও জীবিকা দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। কেউ হয়তো বলবেন, ‘জীবিকার চেয়ে জীবন বড়। জীবন না বাঁচলে জীবিকা দিয়ে কি হবে?’ আবার এ কথাও তো ঠিক, জীবিকা ছাড়া জীবন বাঁচানো যায় না। সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, সবকিছু খুলে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত নিরন্ন মানুষের পেটে ভাত যোগানোর লক্ষ্যেই নেয়া হয়েছে।

সবকিছু খুলে দেয়ার এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ হচ্ছে, যে ঢাকা শহরে ভিক্ষুক খুঁজে পাওয়া যেত না, কিছুদিন ধরে রাস্তায় বের হলে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন স্থানে নিরন্ন অসহায় নারীদের জটলা দেখা যায়। এরা ভিক্ষুক নয়। এতদিন তারা বাসাবাড়িতে কাজ করেছে, অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। আবার অনেক গরিব রিকশাওয়ালা, ছোট ছোট দোকাদারসহ অনেকের আয়-রোজগার বন্ধ। এসব পরিবারের অসহায় নারীরা শুধু ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির হয়ে দু মুঠো খাবার যোগানোর জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। এটাতো ঢাকা শহরের চিত্র নয়। অন্য শহরসহ সারা বাংলাতেই আজকে নিরন্ন মানুষের হাহাকার কম-বেশি রয়েছে। সরকার সাধ্যমতো সহযোগিতা করে যাচ্ছে, যা সবার জন্য পর্যাপ্ত নয় এবং সব ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছানোও সম্ভব হচ্ছে না। এখন জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে। সবাই জানেন, স্বাস্থ্যবিধির কথা। দৈনিক সংবাদ-এর একজন কলাম লেখকের সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘আমন্ত্রণ না জানালে করোনা এমনিতেই কারো কাছে আসে না।’ এই বাংলাদেশে লাখো মানুষের শরীরে করোনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কাজ জীবনের স্বার্থে- সামাজিক দূরত্ব তথা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। নির্বোধ, অবুঝ ছাড়া সবাই জীবনকে ভালোবাসে। মাত্র কয়েকটা দিন (জুন মাস) আমরা যদি শারীরিক দূরত্ব বজায়সহ বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হয়ে পরিবারকে সময় দেই, বের হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, ইনশাল্লাহ করোনা পরাজিত হবে। আবারো জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে এই বাংলায় মানুষই জয়ী হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদুল ফিতরের আগের দিন ২৪ মে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু করতে করোনাভাইরাস মহামারিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চলমান লকডাউন আরো শিথিল করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সব দেশই এরই মধ্যে লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, অনির্দিষ্টকালের জন্য মানুষের আয়-রোজগারে পথ বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে তো নয়ই। ঝড়ঝঞ্ঝা-মহামারী আসবে। সেগুলো মোকাবিলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের এই মহামারী সহসা দূর হবে না। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকবে না। যতদিন না কোনো প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই হয়তো আমাদের বাঁচতে হবে। জীবন-জীবিকার স্বার্থে চালু করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।’

আসলে অফিস-আদালত, গণপরিবহন- সবকিছু একেবারে নিঃশর্ত খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়নি। সবকিছুই খুলে দেয়া হয়েছে শর্তসাপেক্ষে। সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকার সময়ে সবকিছু খুলে দেয়ার বিষয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও বাস্তবতার কারণে জীবন-জীবিকার সমন্বয় করেই চলতে হবে। এদিকে ছুটি আর না বাড়ানোর সরকারি ঘোষণার পর হাজার হাজার মানুষ কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন। সড়ক-মহাসড়কে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় বাড়ছে। মাওয়া-পাটুরিয়া-দৌলদিয়া ফেরিঘাটে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মানুষের ঢল দেখা যাচ্ছে। সর্বোচ্চ সংক্রমণের এই সময়ে মানুষের ভিড় আতঙ্কও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কর্তৃপক্ষের দেয়া ১১ শর্তে দূরপাল্লা ও নগর পরিবহন বাস চলতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেই ১১ শর্ত মেনে বাস চালানো আদৌ সম্ভব কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। মালিক-চালকরাই মনে করছেন, বিশেষ করে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ রুটের বাসে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন সবকিছু খুলে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তটি বিশেষজ্ঞ মহলে আত্মঘাতী মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল গরিব দেশে একাধারে দুই মাসের বেশি সময় (২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে) ধরে সরকারি অফিস-আদালতসহ প্রায় সবকিছু বন্ধ রয়েছে। সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করেও সকল নিরন্ন মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছাতে পারেনি, তা সম্ভবও ছিল না। এর উপর আকস্মিকভাবে ‘আম্ফান’ এর আঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকার মোড়ে মোড়ে নিরন্ন পরিবারের নারীরা সাহায্যের আশায় ভিড় জমাচ্ছে। এরা ভিক্ষুক নয় এবং এটা ঢাকা শহরের চিত্রও নয়। তাছাড়া করোনাভাইরাস খুব সহসাই চলে যাবে, সেকথাও বলার কোনো উপায় নেই। অতীত ইতিহাস কি বলে? প্লেগ দুই হাজার বছর ধরে বিশ্বে বিচরণ করেছে। ১৩৩১ সালে প্লেগ রোগে চীনের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোক মারা যায়। এরপর ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সাল পর্যন্ত চার বছরে উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় প্লেগ মহামারীতে অসংখ্য মানুষ মারা যান। এর প্রায় ৫ শতাধিক বছর পর আবার চীনে হানা দেয় প্লেগ। ওই সময় প্লেগ প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন শুধু ভারত উপমহাদেশেই এক কোটির ওপর (সোয়া কোটি) মানুষ মারা গিয়েছিল। এরপর প্লেগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়ার পর ধীরে ধীরে এর দাপট কমে যায়।

এরপর সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় তিন হাজার বছর অসংখ্য মানুষের প্রাণ সংহার করে গুটিবসন্ত বা ‘ভ্যারিওলা ভাইরাস’। আমরা ছোটকালে ষাটের দশকের শুরুতে গুটিবসন্ত ও কলেরার তাণ্ডব দেখেছি। কলেরা বসন্তে গ্রামে গ্রামে বহু মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু আমরা বা অন্য কোনো মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাননি। এই জমানায় করোনার ভয়ে বিশেষ বিমানে কয়েকজন টাকাওয়ালার দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর বের হয়েছে। কলেরা-বসন্তের দাপট আজকের করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক ভয়াবহ ছিল। গত ক’মাসে করোনা আক্রান্ত মানুষকে যেভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, যেভাবে স্বজনরা পর্যন্ত অমানবিকতা, অসভ্যতা ও বর্বরতা দেখাচ্ছে, আমরা ওই দৃশ্য তখন দেখিনি। মনে আছে, ওই সময় ফজরের নামাজের পর ভোর রাতে দল বেঁধে মানুষ পাড়ায় পাড়ায় যিকির করে উপরওয়ালার কাছে পানাহ (মুক্তি) চেয়েছে। প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের পর ক’দশক আগে গুটিবসন্তও বলতে গেলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। কলেরাও নিয়ন্ত্রণে। এরপর আসে ভয়াবহ এক ফ্লু যা ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত। ১৯১৮ সালে ভয়াবহ এই ফ্লুর তাণ্ডব শুরু হয়। মাত্র তিন বছরে (১৯১৮ থেকে ১৯২০) স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বে ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৯৬৮ সালে হংকং ফ্লুতে মারা যায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ। যে ক’টা ভয়াবহ মানববিধ্বংসী ভাইরাসের কথা বলা হলো, সবকটিই ছিল ছোঁয়াচে। ছোঁয়াছুয়ির মাধ্যমে এবং নাক দিয়ে মানুষের দেহে প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমিত হতো।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, উপরের উল্লিখিত ভাইরাসগুলো করোনার চেয়ে আরো বেশি ভয়াবহ ছিল। অবশ্য করোনা নিয়েও শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। ইতোমধ্যে গত ৬ মাসে বহুবার রূপ (ধরন) বদলিয়েছে করোনাভাইরাস। আগের ভাইরাসগুলোর কোনো কোনোটি ২ থেকে ৩ হাজার বছর পর্যন্ত বিশ্বের মানুষকে অতিষ্ঠ করেছে। সহসাই কোভিড-১৯ চলে যাবে, এমন কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘অন্তত আরও ২ বছর অর্থাৎ ২০২২ সাল পর্যন্ত করোনার ভয়াবহতা থাকবে এই ধরায়।’ হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের একজন মাহমারী বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ‘গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, করোনা নিজে থেকে এই বিশ্ব হতে চলে যাবে না। করোনাকে নিবৃত্ত করতে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ধীরে ধীরে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তথা ‘হার্ড ইমিউনিটি’র দিকে ধাবিত হতে হবে। কাজেই বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে লকডাউনের মেয়াদ আরো কিছুদিন বৃদ্ধি করলেও তাৎক্ষণিক লাভের কোন আশা নেই। করোনা নিয়ে আমরা একটু বেশিই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি এবং অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতাও বেশি দেখাচ্ছি। প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আরো অন্তত ১/২ বছর করোনাকে সঙ্গে নিয়েই এই বিশ্বের মানুষকে বাঁচতে হবে। কিন্তু কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গত ৫/৬ মাসে করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকে ধ্বংসের প্রায় দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনেতারা পর্যন্ত আজ হতাশ। এভাবে আর কতদিন চলতে পারে? যদি বিশ্বের ৯০/৯৫ শতাংশ মানুষকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হয়, এটাই যদি আমাদের ভাগ্যে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে করোনা আতঙ্কে কেন ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে অর্থনীতি ও গোটা বিশ্বের মানুষ। এমতাবস্থায় জোরের সঙ্গে বলতে চাই, করোনার প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত করোনাকে সঙ্গে নিয়েই যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। শত্রুকে ভয় পেলে চেপে ধরে। ভাইরাসকে মোকাবিলা করেই চলতে শিখতে হবে।

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যু এবং পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের হার সবই প্রচণ্ড গতিতে বেড়ে চলছে। ১২তম সপ্তাহে ৩১ মে পর্যন্ত ৬৫০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে সরকার এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭ হাজার ১৫৩ জন ও সুস্থ হয়েছেন ৯ হাজার ৪৮১ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মাথায় মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নমুনা পরীক্ষার শনাক্তের হার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু। এ সময় নানা প্রস্তুতি নিয়ে সীমিত পরিসরে নানা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন চালু হলেও সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে সব দেশকে ৬টি পরামর্শ দিয়েছিল। এসব শর্ত পূরণ হলেই কেবল লকডাউন তুলে নেয়ার পক্ষে সংস্থাটি। এদিকে করোনার কারণে বন্ধ থাকা কর্মস্থলে পুনরায় কাজ শুরুর আগে কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। নির্দেশনা অনুসারে সব কর্মীকে এক সঙ্গে কাজে ফেরানো যাবে না এবং কর্মস্থলকে কাজে ফেরানোর উপযোগী করতে হবে। করোনা নিয়ে করণীয় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শ কমিটি সম্প্রতি একসভায় আরো কিছু সুপারিশ করেছে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ‘পৃথিবীর অন্য দেশের অভিজ্ঞতায় করোনা রোগের সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে রোগের সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা থাকে।’ পরামর্শক কমিটি হাসপাতালগুলোতে হাইপো অক্সিজেনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা করোনা রোগীর জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু বিষয়টির দিকে কোন গুরুত্বই দেয়া হয়নি। করোনা রোগীর জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন হাইপো অক্সিজেন সিএমএইচ ছাড়া অন্য কোন হাসপাতালে নেই। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে হেলাফিল্টার ও নেগেটিভ প্রেসার প্রয়োজন, যা দিয়ে আইসিইউ এর পুরো এরিয়া জীবাণুমুক্ত করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা নেই। তিন মাস সময় পেয়েও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন, সংক্রমণ বাড়ার গতি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে। পরিস্থিতি যে আরো জটিল আকার ধারণ করবে, এ ব্যাপারে কারো কোনো সংশয় নেই। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।

তবে একই সময়ে সারা দেশে সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে কম সংক্রমিত এলাকা, পরে মধ্যম সংক্রমিত এলাকা, আরো পরে বেশি সংক্রমিত এলাকার অঘোষিত লকডাউন শিথিল করলে ভালো হতো। অর্থাৎ সারা দেশে একবারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করে এলাকাভিত্তিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। অবশ্য এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। সরকারের ওপর পুরোপুরি ভরসা না করে প্রত্যেককে তার নিজের জীবনের দায়িত্ব নিতে হবে। গণপরিবহনে ও জনপরিসরে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা, মোট কথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় গাফিলতি নিজের জীবনকেই বিপন্ন করতে পারে- এই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা সবার থাকতে হবে। সরকারকে করোনার পরীক্ষা, রোগীদের চিকিৎসার পরিধি ও সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। করোনা হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সেগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি চিকিৎসক, নার্সসহ লোকবল আরও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার দিকেও বাড়তি নজর দিতে হবে সরকারকে। সর্বশেষে প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই কলামের ইতি টানতে চাই। একটি জাতীয় দৈনিকে (সমকাল, ৩০ মে ২০২০) তিনি লিখেছেন : “এবার প্রমাণিত হয়েছেÑ শেখ হাসিনা যতই দক্ষ ও বিজ্ঞ রাষ্ট্রপরিচালক হোন, তার প্রশাসন তেমন সচল নয়। গাড়ির এই অচল চাকা চালকের সব দক্ষতা ও সাফল্যকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। ... শেখ হাসিনা যদি করোনার এই বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে চান, তাহলে কেবল সুষ্ঠু নির্দেশনা দিলেই চলবে না, তাকে ধাক্কা দিয়ে তার অচল প্রশাসন সচল করতে হবে। যেমন করেছেন নিউজিল্যান্ডের নারী প্রধানমন্ত্রী। তাকে যদি কেউ ‘কর্তৃত্ববাদী’ বলে, বলুক। তার এই কর্তৃত্ববাদ মানুষকে বাঁচাবে, দেশকে বাঁচাবে।”

৩১ মে ২০২০

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com