বিপদে যেন না করি ভয়

রণেশ মৈত্র

মানুষ নিতান্তই অসহায়। করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু আতঙ্কিত মানুষ যোগ দিচ্ছেন না করোনায় মৃত কোন আপনজনের জানাজায়। হিন্দুর শব দাহ করার জন্য দেহ কাঁধে নিয়ে কীর্ত্তন গাইতে শ্মশানযাত্রা ও দাহ করার জন্য শ্মশান বন্ধুও বহু ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না। মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ কলেরা বসন্তের রোগীদের মৃতদেহ নিয়ে অতীত যুগেও তো এমন কিছু ঘটতে দেখা যায়নি।

আজ আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ নতুন নতুন আবিষ্কারের যুগ। নতুন নতুন বিজয়ের যুগ। নতুন আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ সব ক্ষেত্রেই। এই বিজ্ঞান দেশ থেকে কলেরা তাড়িয়েছে বসন্তের (ঝসধষষ চড়ী) উচ্ছেদ সাধন করেছে। আরও বহু রোগের ক্ষেত্রের একই কথা।

কিন্তু করোনাভাইরাস অন্তত: আমাদের দেশে একটি নতুন ভাইরাস। গোটা পৃথিবীতেই। বিজ্ঞানীরা সব উন্নত দেশেই সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট আছেন এটিকে প্রতিরোধে সক্ষম এমন কোন টিকা বের করতে যার দ্বারা করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ করা যায়। খবরে জানা যায় ওই টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার বহুদূর এগিয়েছে এবং আশা করা যায় ২/১ মাসের মধ্যে প্রচেষ্টা সফল হবে। তবে ওই ভ্যাকসিন পৃথিবীর সব দেশের চাহিদা মেটানোর মতো ডোজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে স্বভাবতই তার চাইতে বেশ কিছু সময় লেগে যাবে।

ডিসেম্বরে চীনে করোনা আক্রান্তের খবর সর্ব প্রথম পাওয়া যায়। আজ তা অল্প দু’চারটি দেশ ব্যাতিরেকে গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেই সর্বাধিক।

যা হোক, ভাবতে হবে অন্তর্বর্তীকালী ব্যবস্থার কথা। সেটি হলো মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান, পি.পি.ই পরিধান, ঘন ঘন হাত ধোয়া, ঘর-দুয়ার প্রতিদিন দফায় দফায় জীবাণু মুক্ত করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, শারীরিক (সামাজিক) দূরত্ব বজায় রাখা, ঘরে থাকা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, গরম জল ঘন ঘন খাওয়া এইগুলো। এর সঙ্গে কোন সভা-সমাবেশের আয়োজন না করা এবং অন্যেরা করলেও তাতে অংশগ্রহণ না করা ইত্যাদি।

এই নির্দেশনাগুলো বিজ্ঞানসম্মত। তার মানে এই নয়, এগুলো মানলেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের আদৌ কোন আশঙ্কা থাকবে না। তবে নিশ্চিতভাবেই এগুলো মেনে চললে করোনা সংক্রমণ বহুলাংশে কম হবে।

তা, বেশকিছু লোক নির্দেশানগুলো মানলেও, অনেকে মানেননি। এক জেলা থেকে অপর জেলায় যাতায়াত নিষিদ্ধ রয়েছে সেই ২৬ মার্চ থেকে। কেন? যাতে যাত্রীরা ভাইরাস এক স্থান থেকে বহন করে নিয়ে অন্য স্থানে গিয়ে নতুন নতুন লোককে সংক্রমণের শিকারে পরিণত করতে না পারে। কিন্তু বাস না চললেও, ওই নির্দেশের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিকল্প যান বাহনে অনেকে এ জেলায়, সে জেলায় যাতায়াত অব্যাহত রাখলেন।

বিমান সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হলো অবশ্য কিন্তু অনেক দেরিতে। সেই ফাঁকে আমেরিকা, ইতালি, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে অনেক যাত্রী চলে এলেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা বহু ফ্লাইটে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সৌদি আরব, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে বহু বাংলাদেশি দেশে এলেন। এরা কেউ কেউ সংক্রমিত ছিলেন। কিন্তু সময় বিস্তর পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে আধুনিক টেস্টিং ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রীরা সকলে চলে গেলেন নিজ নিজ এলোকায়। সেই থেকে ঢাকায় সংক্রমণ শুরু।

বহু দিন ধরে চললো যেই লুকোচুরির খেলা। না মানছেন মেডিকেল নির্দেশনা সাধারণ মানুষদের একাংশ না সরকার সময়ের ব্যবস্থা উপযুক্তভাবে যথাসময়ে নিলেন।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং বাণিজ্যমন্ত্রী, শ্রমপ্রতিমন্ত্রী, শ্রমিক নেতারা অভিনব খেল দেখালেন। লাখো শ্রমিক চলে এলেন ঢাকায় আবার তারা ফিরে যেতে বাধ্য হলেন রোগের বীজ বহন করে। যেন ওই ভাইরাস গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তাদের ঢাকা আসা হয়েছিল আবার ফেরত পাঠানো হলো। ছুটলেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দরিদ্র শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে, রিকশায়, স্কুটারে শত শত কিলোমিটার রাস্তা। অমানুষিক পথযাত্র আহার নিদ্রা ত্যাগ করে।

২৬ মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণার বেশকিছু কাল (বিলম্বের কারণ অজানা) পর মসজিদে নামায (তারাবি) না পড়ে বাড়িতে পড়তে অনুরোধ জানালেন ধর্মমন্ত্রী। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব কেউ যাতে স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ না করেন তা দেখার। কিন্তু তিনি চুপচাপ। আবার ধর্মমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষিত হলো কিনা তার কোন খোঁজখবর তিনি নিলেন না। ভাবখানা এই, বাংলাদেশে বাইতুল মোকাররমই বুঝি একমাত্র মসজিদ। জানি না, বাদ-বাকি লাখ লাখ মসজিদে কি ঘটছে সে খবর তিনি বা তার মন্ত্রণালয় রাখেন কি না। তবে কানে আসছে সব মসজিদেই বিপুলসংখ্যক রোজদার (করোনার কারণে এবার রোজদারের সংখ্যাও বেশি) নিকটস্থ মসজিদে গিয়ে তারাবি নামাজ আদায় করে থাকেন। বিন্দুমাত্র বাধা নেই।

পরিণতি?

সম্প্রতি জনকণ্ঠে পরিণতি সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। ‘সংক্রমণের হার বাড়ছে, বিপজ্জনক পরিস্থিতির আভাষ’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ

প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃত্যুর দিক বিবেচনায় রেকর্ড ভাঙছে করোনা। এ যাবত একদিনে সর্বোচ্চ ২৫৪৫ জন আক্রান্ত ও ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে ৩০ মে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৮ মার্চ প্রথম দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়। প্রায় আড়াই মাসের মধ্যে চলতি মাস অর্থাৎ গেল ৩১ মে পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৪৯,৫৩২ জন রোগী। চলতি মাসেই অর্থাৎ ৩১ মে মে পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৭২ জন। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি হয়েছে চলতি মাসেই। আক্রান্তেরও বেশিরভাগ এ মাসেই।

সব মিলিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় সামনের দিনগুলোতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এই পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক লকডাউন ঘোষণার পাশাপাশি যানবাহন ও মানুষ চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গেল ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীন থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ এ গোটা বিশ্বকে চোখ রাঙাচ্ছে। বাড়তি মৃত্যু আর আক্রান্তের ঢল। বৈশ্বিক এ মহামারী থামাতে দেশে দেশে নেওয়া হয়েছে নানামুখী ব্যবস্থা। সে তুলনায় আমাদের দেশে কঠোর ব্যস্থঅর মধ্যে কারফিউ, জরুরি অবস্থা বা পুরোপুরি লকডাউন কোনটাই হয়নি।

এই যখন অবস্থা তখন করোনা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল বা কোন কোন ক্ষেত্রে তা তুলে নেয়ায় সংকটের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগী ও মৃত্যু। বিশেষ করে ১০ মে থেকে মার্কেট শপিং মল ও দোকান-পাট খোলার ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিস্থি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম নৌরুট মাদারীপুর জেলায় শিবচরের কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জন্য ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই নৌ রুটটিই সহজতর। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে এ নৌরুটে গত মার্চ মাসের ২৪ তারিখে থেকে লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে জরুরি প্রয়োজনে ফেরি চালু রেখেছে কর্তৃপক্ষ। গত কয়েকদিন ধরেই ঘাট এলাকায় ঢাকামুখী মানুষের স্রোত। সব মিলিয়ে শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে। সড়ক মহাসড়কে চলছে যানবাহন। পণ্যবাহী পরিবহন দিয়ে মানুষ নেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক চরিত্রে ফিরেছে রাজধানী ঢাকা। বাস ছাড়া চলছে অন্য সব ধরনের যানবাহন।

বাংলাদেশের সংক্রামক রোগবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এর অন্যতম উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে সংক্রমণের হার দিনে দিনে বাড়ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতিক সময়ে কলকারখানা এবং দোকানপাট খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে যে শৈথিল্য দেখা গেছে সে কারণে হয়তো সংক্রমণের হার কিছুটা বেড়েছে। এটার ফল দেখতে হয়তো আমাদের সামনের সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষার করতে হবে। এখন আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিদিন যাতে ১৫ হাজার টেস্ট করা যায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। এ মাসের মধ্যেই প্রতিদিন ১০,০০০ টেস্টের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চান তারা। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় টেস্টের এ সংখ্যা নগণ্য। প্রায় আড়াই মাসেও দিনে ১০ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অন্যতম উপদেষ্টা আবু জমিল ফয়সাল বলেন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় এখন এটা কি বেড়ে যাবে? বাড়তেও পারে।

সংক্রমণের বর্তমান ধারা বজায় থাকলে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছুট হলেও চেষ্টা করা যাবে, অন্যথায় পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, যদি এই সপ্তাহে আর একটা লাফ না দেয়, তা হলে শহরাঞ্চলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও একটু সময় পাওয়া যাবে। সব কিছু মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের জন্য সব পক্ষ থেকেই আরও কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।

সরকারের অভ্যন্তরেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্তু সরকারি কাজকর্মে এর প্রতিফলন নগণ্য। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু হাসপাতালের পরিস্থিতি, ডাক্তারের সংখ্যা, তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা কোথায়?

নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও জীবন বাজি রেখে রোগীর সেবা করে চলেছেন। প্রাণও দিচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকারি উদ্যোগ প্রচেষ্টা তেমন একটা চোখে পড়ছে না কারও।

[লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুন ২০২০ , ২১ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১১ শাওয়াল ১৪৪১

বিপদে যেন না করি ভয়

রণেশ মৈত্র

মানুষ নিতান্তই অসহায়। করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু আতঙ্কিত মানুষ যোগ দিচ্ছেন না করোনায় মৃত কোন আপনজনের জানাজায়। হিন্দুর শব দাহ করার জন্য দেহ কাঁধে নিয়ে কীর্ত্তন গাইতে শ্মশানযাত্রা ও দাহ করার জন্য শ্মশান বন্ধুও বহু ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না। মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ কলেরা বসন্তের রোগীদের মৃতদেহ নিয়ে অতীত যুগেও তো এমন কিছু ঘটতে দেখা যায়নি।

আজ আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ নতুন নতুন আবিষ্কারের যুগ। নতুন নতুন বিজয়ের যুগ। নতুন আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ সব ক্ষেত্রেই। এই বিজ্ঞান দেশ থেকে কলেরা তাড়িয়েছে বসন্তের (ঝসধষষ চড়ী) উচ্ছেদ সাধন করেছে। আরও বহু রোগের ক্ষেত্রের একই কথা।

কিন্তু করোনাভাইরাস অন্তত: আমাদের দেশে একটি নতুন ভাইরাস। গোটা পৃথিবীতেই। বিজ্ঞানীরা সব উন্নত দেশেই সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট আছেন এটিকে প্রতিরোধে সক্ষম এমন কোন টিকা বের করতে যার দ্বারা করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ করা যায়। খবরে জানা যায় ওই টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার বহুদূর এগিয়েছে এবং আশা করা যায় ২/১ মাসের মধ্যে প্রচেষ্টা সফল হবে। তবে ওই ভ্যাকসিন পৃথিবীর সব দেশের চাহিদা মেটানোর মতো ডোজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে স্বভাবতই তার চাইতে বেশ কিছু সময় লেগে যাবে।

ডিসেম্বরে চীনে করোনা আক্রান্তের খবর সর্ব প্রথম পাওয়া যায়। আজ তা অল্প দু’চারটি দেশ ব্যাতিরেকে গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেই সর্বাধিক।

যা হোক, ভাবতে হবে অন্তর্বর্তীকালী ব্যবস্থার কথা। সেটি হলো মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান, পি.পি.ই পরিধান, ঘন ঘন হাত ধোয়া, ঘর-দুয়ার প্রতিদিন দফায় দফায় জীবাণু মুক্ত করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, শারীরিক (সামাজিক) দূরত্ব বজায় রাখা, ঘরে থাকা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, গরম জল ঘন ঘন খাওয়া এইগুলো। এর সঙ্গে কোন সভা-সমাবেশের আয়োজন না করা এবং অন্যেরা করলেও তাতে অংশগ্রহণ না করা ইত্যাদি।

এই নির্দেশনাগুলো বিজ্ঞানসম্মত। তার মানে এই নয়, এগুলো মানলেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের আদৌ কোন আশঙ্কা থাকবে না। তবে নিশ্চিতভাবেই এগুলো মেনে চললে করোনা সংক্রমণ বহুলাংশে কম হবে।

তা, বেশকিছু লোক নির্দেশানগুলো মানলেও, অনেকে মানেননি। এক জেলা থেকে অপর জেলায় যাতায়াত নিষিদ্ধ রয়েছে সেই ২৬ মার্চ থেকে। কেন? যাতে যাত্রীরা ভাইরাস এক স্থান থেকে বহন করে নিয়ে অন্য স্থানে গিয়ে নতুন নতুন লোককে সংক্রমণের শিকারে পরিণত করতে না পারে। কিন্তু বাস না চললেও, ওই নির্দেশের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিকল্প যান বাহনে অনেকে এ জেলায়, সে জেলায় যাতায়াত অব্যাহত রাখলেন।

বিমান সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হলো অবশ্য কিন্তু অনেক দেরিতে। সেই ফাঁকে আমেরিকা, ইতালি, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে অনেক যাত্রী চলে এলেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা বহু ফ্লাইটে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সৌদি আরব, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে বহু বাংলাদেশি দেশে এলেন। এরা কেউ কেউ সংক্রমিত ছিলেন। কিন্তু সময় বিস্তর পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে আধুনিক টেস্টিং ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রীরা সকলে চলে গেলেন নিজ নিজ এলোকায়। সেই থেকে ঢাকায় সংক্রমণ শুরু।

বহু দিন ধরে চললো যেই লুকোচুরির খেলা। না মানছেন মেডিকেল নির্দেশনা সাধারণ মানুষদের একাংশ না সরকার সময়ের ব্যবস্থা উপযুক্তভাবে যথাসময়ে নিলেন।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং বাণিজ্যমন্ত্রী, শ্রমপ্রতিমন্ত্রী, শ্রমিক নেতারা অভিনব খেল দেখালেন। লাখো শ্রমিক চলে এলেন ঢাকায় আবার তারা ফিরে যেতে বাধ্য হলেন রোগের বীজ বহন করে। যেন ওই ভাইরাস গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তাদের ঢাকা আসা হয়েছিল আবার ফেরত পাঠানো হলো। ছুটলেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দরিদ্র শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে, রিকশায়, স্কুটারে শত শত কিলোমিটার রাস্তা। অমানুষিক পথযাত্র আহার নিদ্রা ত্যাগ করে।

২৬ মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণার বেশকিছু কাল (বিলম্বের কারণ অজানা) পর মসজিদে নামায (তারাবি) না পড়ে বাড়িতে পড়তে অনুরোধ জানালেন ধর্মমন্ত্রী। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব কেউ যাতে স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ না করেন তা দেখার। কিন্তু তিনি চুপচাপ। আবার ধর্মমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষিত হলো কিনা তার কোন খোঁজখবর তিনি নিলেন না। ভাবখানা এই, বাংলাদেশে বাইতুল মোকাররমই বুঝি একমাত্র মসজিদ। জানি না, বাদ-বাকি লাখ লাখ মসজিদে কি ঘটছে সে খবর তিনি বা তার মন্ত্রণালয় রাখেন কি না। তবে কানে আসছে সব মসজিদেই বিপুলসংখ্যক রোজদার (করোনার কারণে এবার রোজদারের সংখ্যাও বেশি) নিকটস্থ মসজিদে গিয়ে তারাবি নামাজ আদায় করে থাকেন। বিন্দুমাত্র বাধা নেই।

পরিণতি?

সম্প্রতি জনকণ্ঠে পরিণতি সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। ‘সংক্রমণের হার বাড়ছে, বিপজ্জনক পরিস্থিতির আভাষ’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ

প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃত্যুর দিক বিবেচনায় রেকর্ড ভাঙছে করোনা। এ যাবত একদিনে সর্বোচ্চ ২৫৪৫ জন আক্রান্ত ও ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে ৩০ মে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৮ মার্চ প্রথম দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়। প্রায় আড়াই মাসের মধ্যে চলতি মাস অর্থাৎ গেল ৩১ মে পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৪৯,৫৩২ জন রোগী। চলতি মাসেই অর্থাৎ ৩১ মে মে পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৭২ জন। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি হয়েছে চলতি মাসেই। আক্রান্তেরও বেশিরভাগ এ মাসেই।

সব মিলিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় সামনের দিনগুলোতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এই পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক লকডাউন ঘোষণার পাশাপাশি যানবাহন ও মানুষ চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গেল ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীন থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ এ গোটা বিশ্বকে চোখ রাঙাচ্ছে। বাড়তি মৃত্যু আর আক্রান্তের ঢল। বৈশ্বিক এ মহামারী থামাতে দেশে দেশে নেওয়া হয়েছে নানামুখী ব্যবস্থা। সে তুলনায় আমাদের দেশে কঠোর ব্যস্থঅর মধ্যে কারফিউ, জরুরি অবস্থা বা পুরোপুরি লকডাউন কোনটাই হয়নি।

এই যখন অবস্থা তখন করোনা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল বা কোন কোন ক্ষেত্রে তা তুলে নেয়ায় সংকটের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগী ও মৃত্যু। বিশেষ করে ১০ মে থেকে মার্কেট শপিং মল ও দোকান-পাট খোলার ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিস্থি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম নৌরুট মাদারীপুর জেলায় শিবচরের কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জন্য ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই নৌ রুটটিই সহজতর। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে এ নৌরুটে গত মার্চ মাসের ২৪ তারিখে থেকে লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে জরুরি প্রয়োজনে ফেরি চালু রেখেছে কর্তৃপক্ষ। গত কয়েকদিন ধরেই ঘাট এলাকায় ঢাকামুখী মানুষের স্রোত। সব মিলিয়ে শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে। সড়ক মহাসড়কে চলছে যানবাহন। পণ্যবাহী পরিবহন দিয়ে মানুষ নেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক চরিত্রে ফিরেছে রাজধানী ঢাকা। বাস ছাড়া চলছে অন্য সব ধরনের যানবাহন।

বাংলাদেশের সংক্রামক রোগবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এর অন্যতম উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে সংক্রমণের হার দিনে দিনে বাড়ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতিক সময়ে কলকারখানা এবং দোকানপাট খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে যে শৈথিল্য দেখা গেছে সে কারণে হয়তো সংক্রমণের হার কিছুটা বেড়েছে। এটার ফল দেখতে হয়তো আমাদের সামনের সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষার করতে হবে। এখন আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিদিন যাতে ১৫ হাজার টেস্ট করা যায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। এ মাসের মধ্যেই প্রতিদিন ১০,০০০ টেস্টের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চান তারা। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় টেস্টের এ সংখ্যা নগণ্য। প্রায় আড়াই মাসেও দিনে ১০ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অন্যতম উপদেষ্টা আবু জমিল ফয়সাল বলেন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় এখন এটা কি বেড়ে যাবে? বাড়তেও পারে।

সংক্রমণের বর্তমান ধারা বজায় থাকলে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছুট হলেও চেষ্টা করা যাবে, অন্যথায় পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, যদি এই সপ্তাহে আর একটা লাফ না দেয়, তা হলে শহরাঞ্চলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও একটু সময় পাওয়া যাবে। সব কিছু মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের জন্য সব পক্ষ থেকেই আরও কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।

সরকারের অভ্যন্তরেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্তু সরকারি কাজকর্মে এর প্রতিফলন নগণ্য। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু হাসপাতালের পরিস্থিতি, ডাক্তারের সংখ্যা, তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা কোথায়?

নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও জীবন বাজি রেখে রোগীর সেবা করে চলেছেন। প্রাণও দিচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকারি উদ্যোগ প্রচেষ্টা তেমন একটা চোখে পড়ছে না কারও।

[লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com