আমাদের রাজনীতি : আজি হতে শতবর্ষ পরে

এম আর খায়রুল উমাম

কিছুদিন পূর্বে আমরা পার করলাম ২৫ বৈশাখ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এই দিনে হঠাৎ করেই মনে হলো আগামী ৫০ বছর বা ১০০ বছর পর আমাদের রাজনীতি কেমন হবে। ইতোমধ্যেই আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করতে চলেছি। ৫০ বছরের রাজনীতি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। যদিও সেই দেখার মধ্যে পূর্ণতা আছে সে দাবি করার সাহস নেই। তাই ৫০ বছর বা ১০০ বছর পর রাজনীতির স্বরূপ প্রকাশ করা হয়তো সম্ভব হবে না। বরং সে চেষ্টা বাতুলতা হয়ে যাবে। তবে ১০০ বছর পর আমাদের রাজনীতিকে কেমন দেখতে চাই সেই স্বপ্নের কথা লেখা যেতেই পারে। রাজনীতির বর্তমান ধারা বিবেচনা করে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা বিবেচনা করে, আর্থ-সামাজিক বিবর্তন বিবেচনা করে, বিশ্বায়ন বিবেচনা করে, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিবেচনা করে কল্পনার জাল বিছানোর এ এক উদ্যোগ মাত্র।

বাংলাদেশ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ৩০ লক্ষ মানুষ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা কোনো কারণে বিপন্ন হতে পারে না। বাঙালির স্বাধীনতা অমর থাকবে। তাই স্বাধীনতা অর্জনকালীন সাধারণ মানুষের অন্তরে যে আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নই আগামীর জন্য প্রথম স্বপ্ন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনের অঙ্গীকারে ১৯৭১ সালে দলে দলে মানুষ মুক্তির সংগ্রামে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল। গত ৫০ বছরের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের এ চেতনা থেকে অনেক পিছিয়ে। এখন অনেকে মুখে এ চেতনার কথা বললে কী হবে অন্তরে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত ৫০ বছরে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে সামরিক শাসন ছিল। পৃথকভাবে দেখা হলে ক্ষেত্রে বিশেষে হয়তো পার্থক্য পাওয়া যাবে কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বেহাল দশাই ফুটে উঠছে। বহুজনের মঙ্গলে সার্বিক কল্যাণের কথা কারো মনে আছে বলে মনেই হয় না। ব্যক্তি প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় সবাই মশগুল। এতে করে ধারাবাহিকভাবে বৈষম্য আকাশছোঁয়া হয়েই চলেছে। সোনার বাংলা শ্মশান কেন পোস্টারের কথা কারো মনে নেই ফলে শোষণ অবারিত হয়েছে। মৌলবাদের হাত ধরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ দিনে দিনে গভীরে যাচ্ছে। এসবের প্রতিফলনে শিক্ষা ব্যবস্থা বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনের পথ হারিয়ে ফেলেছে। জাতি হিসেবে বিশ্ব সংসারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন জরুরি। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথাযথ বাস্তবায়ন হলেই সাধারণ জনগণের কাছে স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু চোরের খনি পেয়েছিলেন। সেই খনির উৎপাদন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে; আজ পর্যন্ত কেউ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সাধারণ মানুষ মনে করে খনির উৎপাদিত বস্তুর গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়ে এখন তা আর চোরের খনি নেই, ডাকাতের খনিতে রূপান্তর ঘটেছে। কারণ চুরি এখন আর কম্বলে সীমাবদ্ধ নেই, ব্যাংক, শেয়ারবাজার, সরকারি প্রকল্প, সেবা খাত, কৃষি ও শিল্পসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কোনো কিছুকেই চোরেরা ছাড় দিতে চায় না। সামান্য সুযোগ পেলেই তা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে। এরা অসমসাহসী এবং নির্ভিক ডাকাতদের মতো, নিজেদের স্বার্থের কাছে দেশ ও জাতি তুচ্ছ। হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি ও শেয়ার ধস, রিজার্ভ তসরুফ, এমএলএম কোম্পানি, মাদক ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্য, টেন্ডারের নামে হরিলুট, সিন্ডিকেটের নামে জিম্মি, প্রকল্প নয় ছয়, সেবায় স্পিড মানি ইত্যাদি সবকিছুই চলছে প্রকাশ্যে। কিছু ক্ষেত্রে মুখগুলো খুব পরিচিত। দেশে এখন ৬ লাখ টাকা দিয়ে একটা কলাগাছ কেনা হয়, প্রায় ২৮ হাজার টাকা দিয়ে একটা বালিশ ও ২৮ হাজার টাকা দিয়ে তার কভার কেনা হয়, ৬২ লাখ টাকা দিয়ে একটা নারকেলের চারা কেনা হয়। ১০০ টাকায় আদা এনে ৩০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। করোনার ত্রাণ দায়িত্বপ্রাপ্তদের গোডাউনে বা বক্স খাটের ভেতরে পাওয়া যায়। ডাকাতির কোনো শেষ নেই। কে কাকে দেখবে সেটাই সমস্যা। সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা। আগামীতে রাজনীতি যেন জনগণকে চোরের খনির উৎপাদন বন্ধ করে মুক্তি দেয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ যেন যথার্থতা লাভ করে। জনগণ প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত মালিক হিসেবে মূল্যায়িত হয়। দেশের মানুষ দু’দুটো সামরিক শাসন পার করে এখন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে চলেছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য যে ধরনের কেন্দ্রিকতা প্রয়োজন ছিল তার অনুপস্থিতি আজও লক্ষণীয়। রাজণীতিতে পরস্পরিক বিদ্বেষ, সংঘাত, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব লক্ষ্যে পৌঁছানোতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণগন্ত্র এক বিচিত্র পথে হাঁটছে। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে তাদের ভোট বিমুখ করে তুলেছে, দিনে দিনে জনগণ ভোট প্রদানের কোনো গরজ অনুভব করে না। বিখ্যাত মাগুরা নির্বাচনের পাশাপাশি ৫ শতাংশ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে দিয়ে সংশ্লিষ্টরা আজ উল্লাস প্রকাশ করছে। নির্বাচন কমিশনকে সরকারি প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী করার দাবি সবার কিন্তু কেউ দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। কল্পনা করি আগামীতে জনগণ নিজের ভোট নিজে দিচ্ছে। আবশ্যিকভাবে সবাই নিজের মতপ্রকাশে বাঁধাহীন থাকতে পারছে। একটা সহজ স্বাভাবিক দুর্নীতি মুক্ত নির্বাচন আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিষ্ঠার পরিচয় রাখতে পারছে। এতে পূর্ণ গণগন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা পাবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে প্রকৃতরূপে সাজাতে রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চা হবে, কর্মীদের ভোটে নেতা নির্বাচন হবে এবং কোনো নেতাই পরপর দুই মেয়াদের বেশি একই পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেবে না।

সরকারিভাবে স্বীকৃত একাধিক শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার জগতের মধ্যে দ্বন্দ্বে শিক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণ বিকশিত মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ। শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ নির্ধারণে সরকার নিয়োজিত কুদরাত-এ কুদা থেকে কবীর চৌধুরী পর্যন্ত কমিশন সমূহের সুপারিশগুলোর মধ্যে কমবেশি তফাৎ থাকা সত্ত্বেও মৌলিক পার্থক্য নেই বললেই চলে। শিক্ষাক্ষেত্রে সংবিধান, শিক্ষানীতি, কমিটির সুপারিশ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ লক্ষণীয়। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের স্বপ্নে পাওয়া কার্যক্রম চলমান। বহু আন্দোলনের পর শিক্ষানীতি হলেও মানবসম্পদ পরিকল্পনা না থাকার কারণে শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ এসে গিয়েছে। শুধু মানবসম্পদ পরিকল্পনা কেন, আমাদের শিল্পনীতি, কৃষিনীতি, বাণিজ্যনীতি, প্রশাসন পদ্ধতি কোনটাই বহুজনের কল্যাণে গড়ে তোলা হয়নি। তাই শিক্ষাব্যবস্থা জনকল্যাণে গড়ে তোলা হবে এমন কল্পনা এখনো বাতুলতা মাত্র। তাও কল্পনা করতে ইচ্ছা করে আগামী সময়ে সকলের জন্য মাতৃভাষা বাংলাকে মাধ্যম করে অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি চালু হবে। কারো জন্য বিশেষীকৃত ব্যবস্থা থাকবে না। মানবসম্পদ পরিকল্পনা করে দেশ ও জাতির প্রয়োজন বিবেচনায় জনবল তৈরিতে উচ্চশিক্ষা মেধাবীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রয়োজন বিবেচনায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে এবং তা বৈষম্যহীনভাবে ব্যয়িত হবে। শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদা ফিরে পাবে। আর্থিকভাবে শক্তিশালী হবে এবং শিক্ষকরা জীবনমুখী শিক্ষায় আন্তরিক হবে। এসবের মাধ্যমে সবার জন্য প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেবে। এ শিক্ষা মানুষকে চক্ষুস্মান করবে, বিনয়ী করবে, সুজন করবে। নিজের অধিকার ও দায়িত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানসম্পন্ন হবে।

কল্পনার জাল এভাবে এগিয়ে নিয়ে গেলে কলেবর অনেক লম্বা হয়ে যাবে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা, আইনের শাসন, দলীয়করণের প্রবণতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জনকল্যাণের নীতি কৌশল, করাতের দাঁতের প্রশাসন পদ্ধতি, পরমতসহিষ্ণুতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি কত না বিষয় স্বপ্নে চলে আসে। বিশ্বকবি সাহসী ছিলেন তাই সব কথা লিখতে বলতে পারতেন। কবির সাহসের ভাগীদার হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রচ- সাহসেরও অংশীদার হতে পারলাম না। এতে করে আপোসকামিতার পাশাপাশি মিথ্যা বলার প্রবণতা পেয়ে বসেছে। দিনে দিনে যেন সত্য বলার সাহস হারিয়ে ফেলছি। একটা সত্যকে একশটা মিথ্যা দিয়ে আড়াল করা সম্ভব হয় না জেনেও একটার পর একটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত মিথ্যা কথা বরতে বলতে সত্য কথা বলতেই যেন ভুলে গিয়েছি। সত্যের আশ্রয় পাওয়ার জন্য আদর্শ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পদ-পদবি, সম্মান-মর্যাদা ব্যক্তিগত অর্জনে কোনকিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি মিথ্যায় পরিপূর্ণ। কল্পনা করতে ইচ্ছা করে আগামীর বাংলাদেশে মানুষ তার নিজ ধর্ম মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়ে মতবাদগুলোর প্রতি নিজেদের দুর্বলতা ঠেলে সরিয়ে বের হয়ে আসবে। সমাজের সর্বস্তরে সত্যের চর্চা হবে। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয় হবে। শুধু স্বজাতির শাসনের স্বাধীনতায় আনন্দ উপভোগ করবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রাপ্তি ঘটবে।

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুন ২০২০ , ২১ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১১ শাওয়াল ১৪৪১

আমাদের রাজনীতি : আজি হতে শতবর্ষ পরে

এম আর খায়রুল উমাম

কিছুদিন পূর্বে আমরা পার করলাম ২৫ বৈশাখ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এই দিনে হঠাৎ করেই মনে হলো আগামী ৫০ বছর বা ১০০ বছর পর আমাদের রাজনীতি কেমন হবে। ইতোমধ্যেই আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করতে চলেছি। ৫০ বছরের রাজনীতি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। যদিও সেই দেখার মধ্যে পূর্ণতা আছে সে দাবি করার সাহস নেই। তাই ৫০ বছর বা ১০০ বছর পর রাজনীতির স্বরূপ প্রকাশ করা হয়তো সম্ভব হবে না। বরং সে চেষ্টা বাতুলতা হয়ে যাবে। তবে ১০০ বছর পর আমাদের রাজনীতিকে কেমন দেখতে চাই সেই স্বপ্নের কথা লেখা যেতেই পারে। রাজনীতির বর্তমান ধারা বিবেচনা করে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা বিবেচনা করে, আর্থ-সামাজিক বিবর্তন বিবেচনা করে, বিশ্বায়ন বিবেচনা করে, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিবেচনা করে কল্পনার জাল বিছানোর এ এক উদ্যোগ মাত্র।

বাংলাদেশ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ৩০ লক্ষ মানুষ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা কোনো কারণে বিপন্ন হতে পারে না। বাঙালির স্বাধীনতা অমর থাকবে। তাই স্বাধীনতা অর্জনকালীন সাধারণ মানুষের অন্তরে যে আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নই আগামীর জন্য প্রথম স্বপ্ন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনের অঙ্গীকারে ১৯৭১ সালে দলে দলে মানুষ মুক্তির সংগ্রামে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল। গত ৫০ বছরের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের এ চেতনা থেকে অনেক পিছিয়ে। এখন অনেকে মুখে এ চেতনার কথা বললে কী হবে অন্তরে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত ৫০ বছরে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে সামরিক শাসন ছিল। পৃথকভাবে দেখা হলে ক্ষেত্রে বিশেষে হয়তো পার্থক্য পাওয়া যাবে কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বেহাল দশাই ফুটে উঠছে। বহুজনের মঙ্গলে সার্বিক কল্যাণের কথা কারো মনে আছে বলে মনেই হয় না। ব্যক্তি প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় সবাই মশগুল। এতে করে ধারাবাহিকভাবে বৈষম্য আকাশছোঁয়া হয়েই চলেছে। সোনার বাংলা শ্মশান কেন পোস্টারের কথা কারো মনে নেই ফলে শোষণ অবারিত হয়েছে। মৌলবাদের হাত ধরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ দিনে দিনে গভীরে যাচ্ছে। এসবের প্রতিফলনে শিক্ষা ব্যবস্থা বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনের পথ হারিয়ে ফেলেছে। জাতি হিসেবে বিশ্ব সংসারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন জরুরি। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথাযথ বাস্তবায়ন হলেই সাধারণ জনগণের কাছে স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু চোরের খনি পেয়েছিলেন। সেই খনির উৎপাদন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে; আজ পর্যন্ত কেউ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সাধারণ মানুষ মনে করে খনির উৎপাদিত বস্তুর গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়ে এখন তা আর চোরের খনি নেই, ডাকাতের খনিতে রূপান্তর ঘটেছে। কারণ চুরি এখন আর কম্বলে সীমাবদ্ধ নেই, ব্যাংক, শেয়ারবাজার, সরকারি প্রকল্প, সেবা খাত, কৃষি ও শিল্পসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কোনো কিছুকেই চোরেরা ছাড় দিতে চায় না। সামান্য সুযোগ পেলেই তা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে। এরা অসমসাহসী এবং নির্ভিক ডাকাতদের মতো, নিজেদের স্বার্থের কাছে দেশ ও জাতি তুচ্ছ। হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি ও শেয়ার ধস, রিজার্ভ তসরুফ, এমএলএম কোম্পানি, মাদক ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্য, টেন্ডারের নামে হরিলুট, সিন্ডিকেটের নামে জিম্মি, প্রকল্প নয় ছয়, সেবায় স্পিড মানি ইত্যাদি সবকিছুই চলছে প্রকাশ্যে। কিছু ক্ষেত্রে মুখগুলো খুব পরিচিত। দেশে এখন ৬ লাখ টাকা দিয়ে একটা কলাগাছ কেনা হয়, প্রায় ২৮ হাজার টাকা দিয়ে একটা বালিশ ও ২৮ হাজার টাকা দিয়ে তার কভার কেনা হয়, ৬২ লাখ টাকা দিয়ে একটা নারকেলের চারা কেনা হয়। ১০০ টাকায় আদা এনে ৩০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। করোনার ত্রাণ দায়িত্বপ্রাপ্তদের গোডাউনে বা বক্স খাটের ভেতরে পাওয়া যায়। ডাকাতির কোনো শেষ নেই। কে কাকে দেখবে সেটাই সমস্যা। সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা। আগামীতে রাজনীতি যেন জনগণকে চোরের খনির উৎপাদন বন্ধ করে মুক্তি দেয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ যেন যথার্থতা লাভ করে। জনগণ প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত মালিক হিসেবে মূল্যায়িত হয়। দেশের মানুষ দু’দুটো সামরিক শাসন পার করে এখন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে চলেছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য যে ধরনের কেন্দ্রিকতা প্রয়োজন ছিল তার অনুপস্থিতি আজও লক্ষণীয়। রাজণীতিতে পরস্পরিক বিদ্বেষ, সংঘাত, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব লক্ষ্যে পৌঁছানোতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণগন্ত্র এক বিচিত্র পথে হাঁটছে। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে তাদের ভোট বিমুখ করে তুলেছে, দিনে দিনে জনগণ ভোট প্রদানের কোনো গরজ অনুভব করে না। বিখ্যাত মাগুরা নির্বাচনের পাশাপাশি ৫ শতাংশ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে দিয়ে সংশ্লিষ্টরা আজ উল্লাস প্রকাশ করছে। নির্বাচন কমিশনকে সরকারি প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী করার দাবি সবার কিন্তু কেউ দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। কল্পনা করি আগামীতে জনগণ নিজের ভোট নিজে দিচ্ছে। আবশ্যিকভাবে সবাই নিজের মতপ্রকাশে বাঁধাহীন থাকতে পারছে। একটা সহজ স্বাভাবিক দুর্নীতি মুক্ত নির্বাচন আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিষ্ঠার পরিচয় রাখতে পারছে। এতে পূর্ণ গণগন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা পাবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে প্রকৃতরূপে সাজাতে রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চা হবে, কর্মীদের ভোটে নেতা নির্বাচন হবে এবং কোনো নেতাই পরপর দুই মেয়াদের বেশি একই পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেবে না।

সরকারিভাবে স্বীকৃত একাধিক শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার জগতের মধ্যে দ্বন্দ্বে শিক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণ বিকশিত মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ। শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ নির্ধারণে সরকার নিয়োজিত কুদরাত-এ কুদা থেকে কবীর চৌধুরী পর্যন্ত কমিশন সমূহের সুপারিশগুলোর মধ্যে কমবেশি তফাৎ থাকা সত্ত্বেও মৌলিক পার্থক্য নেই বললেই চলে। শিক্ষাক্ষেত্রে সংবিধান, শিক্ষানীতি, কমিটির সুপারিশ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ লক্ষণীয়। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের স্বপ্নে পাওয়া কার্যক্রম চলমান। বহু আন্দোলনের পর শিক্ষানীতি হলেও মানবসম্পদ পরিকল্পনা না থাকার কারণে শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ এসে গিয়েছে। শুধু মানবসম্পদ পরিকল্পনা কেন, আমাদের শিল্পনীতি, কৃষিনীতি, বাণিজ্যনীতি, প্রশাসন পদ্ধতি কোনটাই বহুজনের কল্যাণে গড়ে তোলা হয়নি। তাই শিক্ষাব্যবস্থা জনকল্যাণে গড়ে তোলা হবে এমন কল্পনা এখনো বাতুলতা মাত্র। তাও কল্পনা করতে ইচ্ছা করে আগামী সময়ে সকলের জন্য মাতৃভাষা বাংলাকে মাধ্যম করে অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি চালু হবে। কারো জন্য বিশেষীকৃত ব্যবস্থা থাকবে না। মানবসম্পদ পরিকল্পনা করে দেশ ও জাতির প্রয়োজন বিবেচনায় জনবল তৈরিতে উচ্চশিক্ষা মেধাবীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রয়োজন বিবেচনায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে এবং তা বৈষম্যহীনভাবে ব্যয়িত হবে। শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদা ফিরে পাবে। আর্থিকভাবে শক্তিশালী হবে এবং শিক্ষকরা জীবনমুখী শিক্ষায় আন্তরিক হবে। এসবের মাধ্যমে সবার জন্য প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেবে। এ শিক্ষা মানুষকে চক্ষুস্মান করবে, বিনয়ী করবে, সুজন করবে। নিজের অধিকার ও দায়িত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানসম্পন্ন হবে।

কল্পনার জাল এভাবে এগিয়ে নিয়ে গেলে কলেবর অনেক লম্বা হয়ে যাবে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা, আইনের শাসন, দলীয়করণের প্রবণতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জনকল্যাণের নীতি কৌশল, করাতের দাঁতের প্রশাসন পদ্ধতি, পরমতসহিষ্ণুতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি কত না বিষয় স্বপ্নে চলে আসে। বিশ্বকবি সাহসী ছিলেন তাই সব কথা লিখতে বলতে পারতেন। কবির সাহসের ভাগীদার হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রচ- সাহসেরও অংশীদার হতে পারলাম না। এতে করে আপোসকামিতার পাশাপাশি মিথ্যা বলার প্রবণতা পেয়ে বসেছে। দিনে দিনে যেন সত্য বলার সাহস হারিয়ে ফেলছি। একটা সত্যকে একশটা মিথ্যা দিয়ে আড়াল করা সম্ভব হয় না জেনেও একটার পর একটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত মিথ্যা কথা বরতে বলতে সত্য কথা বলতেই যেন ভুলে গিয়েছি। সত্যের আশ্রয় পাওয়ার জন্য আদর্শ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পদ-পদবি, সম্মান-মর্যাদা ব্যক্তিগত অর্জনে কোনকিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি মিথ্যায় পরিপূর্ণ। কল্পনা করতে ইচ্ছা করে আগামীর বাংলাদেশে মানুষ তার নিজ ধর্ম মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়ে মতবাদগুলোর প্রতি নিজেদের দুর্বলতা ঠেলে সরিয়ে বের হয়ে আসবে। সমাজের সর্বস্তরে সত্যের চর্চা হবে। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয় হবে। শুধু স্বজাতির শাসনের স্বাধীনতায় আনন্দ উপভোগ করবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রাপ্তি ঘটবে।