আসুন, সুন্দরবন রক্ষা করি

সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’ তার দাপট দেখিয়ে বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় ঘূর্ণিঝড়টি সাত জেলার মোট ১৫ জন মানুষের প্রাণ কেড়েছে। কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, আম্ফানে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, প্রাথমিক হিসেবে ২৬টি জেলায় প্রায় ১১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে উপকূলে সুন্দরবন না থাকলে এই ক্ষতির পরিমাণ যে আরও কতগুন বেশি হতো-তা নিরুপণ করাও কষ্টকর। সিডর, আইলা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ের ফণী, বুলবুল ও আম্ফানের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার একমাত্র লড়াইটি চালিয়ে গেছে আমাদের পরম বন্ধু সুন্দরবন।

বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল হলো পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। আকৃতিতে অবতল হওয়া ও উষ্ণতর তাপমাত্রার দরুন বঙ্গোপসাগর হল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। ‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর তথ্যমতে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ৩৫টি মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টিই সংঘটিত হয়েছে এই বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলে। সে হিসেবে, এই অঞ্চলের ২৭তম ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সংঘটিত হয়ে গেল। আম্ফান এসে সুন্দরবনের জাতীয় গুরুত্বটি আমাদেরকে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল। অথচ প্রতিনিয়ত আমরা কেবল সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন করে চলছি! বনদস্যুদের থাবা, বন কর্মকর্তাদের আসাধু তৎপরতা ও লাগামহীন দুর্নীতি, বনবিভাগে দক্ষ জনবলের অভাব, সরকারের উদাসীনতা, বাঘ ও হরিণ শিকার, অগ্নিসংযোগ এবং বিষ দিয়ে মাছ আহরণের ফলে যুগের পর যুগ ধরে সুন্দরবনের অপরিমিত ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছি আমরা। উপরন্তু বনভূমির সীমানা ঘেঁষে শিল্পকারখানার অনুমোদন এবং সুন্দরবন মধ্যস্থ জলপথে কয়লা ও তেল পরিবহণের ফলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। অথচ এই সুন্দরবনই আমাদের সমুদ্র তীরবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র রক্ষাকবচ!

সুন্দরবনের সবুজ বেষ্টনী বাংলাদেশকে যুগের পর যুগ ধরে শুধু ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকেই রক্ষা করছে না, এটি অত্যাধিক জোয়ারের হাত থেকেও উপকূলীয় স্থলভাগকে রক্ষা করছে। নদী ও সাগরের মোহনায় ‘ডেলটা ফরমেশন’ এর মাধ্যমে স্থলভাগ বাড়িয়ে চলছে এই বনভূমি। সমুদ্র উপকূলের লবনাক্ততা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সুন্দরবন। দেশীয় বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল সরবারহ ও সরকারি রাজস্ব আয়ে রয়েছে এর বিস্তর ভূমিকা। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ম্যানগ্রোভ বনটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এর বাইরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও দূষণরোধে রয়েছে সুন্দরবনের অপরিসীম ভূমিকা। বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবন যে গ্রষ্টার দেয়া কত বড় আশীর্বাদতা আমাদের জনগণ ও সরকারকে অনুধাবন করা জরুরি।

আমাদের দেশের স্বার্থেই সুন্দরবন রক্ষা আজ আশু প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে। প্রকৃতির অপার দান এই সুন্দরবন যত বিনষ্ট হবে, বঙ্গোপসাগরের তা-বে বাংলাদেশের ধ্বংস তত বেশি নিকটবর্তী হবে। সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপণা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবন রক্ষায় সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই পরিকল্পনার আওতায় ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’ সংস্কার করে তা যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। অসাধু বন কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যূত করে অপরাধ অনুযায়ী আইনি শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বনদস্যুদের মোকাবিলায় সুন্দরবন অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকবল বাড়াতে হবে এবং বনদস্যুদের ধরতে সরকারি বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনসাধারণের বিকল্প আয়ের সংস্থান করতে হবে। বন্যপ্রানীর অভয়াশ্রম আওতা বৃদ্ধি করে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ এবং ফরেস্ট্রি বিভাগকে সুন্দরবন রক্ষার গবেষণায় কাজে লাগাতে হবে। বাঘ ও হরিণ শিকারের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে সুন্দরবন ঘেঁষে শিল্পকারখানার অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে এবং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তেল ও কয়লার পরিবহন বন্ধ করতে পারলে খুব ভালো হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন যতদিন আছে, ততদিন আমরা ঘূর্ণিঝড় -জলোচ্ছ্বাস, জোয়ার-লবণাক্ততা, সমুদ্রের উপকূলে ভাঙনের মতো বঙ্গোপসাগরীয় দুর্যোগ থেকে অনেক বেশি নিরাপদ থাকব। একইভাবে সুন্দরবন যতোটা বিনষ্ট হবে, দেশের ক্ষতিও ততটা ত্বরান্বিত হবে। তাই সরকার এবং নাগরিকদেরও স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সুন্দরবন রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া দরকার।

মো. ইমরান হোসেন

শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও খবর

শুক্রবার, ০৫ জুন ২০২০ , ২২ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১২ শাওয়াল ১৪৪১

আসুন, সুন্দরবন রক্ষা করি

সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’ তার দাপট দেখিয়ে বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় ঘূর্ণিঝড়টি সাত জেলার মোট ১৫ জন মানুষের প্রাণ কেড়েছে। কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, আম্ফানে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, প্রাথমিক হিসেবে ২৬টি জেলায় প্রায় ১১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে উপকূলে সুন্দরবন না থাকলে এই ক্ষতির পরিমাণ যে আরও কতগুন বেশি হতো-তা নিরুপণ করাও কষ্টকর। সিডর, আইলা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ের ফণী, বুলবুল ও আম্ফানের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার একমাত্র লড়াইটি চালিয়ে গেছে আমাদের পরম বন্ধু সুন্দরবন।

বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল হলো পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। আকৃতিতে অবতল হওয়া ও উষ্ণতর তাপমাত্রার দরুন বঙ্গোপসাগর হল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। ‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর তথ্যমতে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ৩৫টি মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টিই সংঘটিত হয়েছে এই বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলে। সে হিসেবে, এই অঞ্চলের ২৭তম ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সংঘটিত হয়ে গেল। আম্ফান এসে সুন্দরবনের জাতীয় গুরুত্বটি আমাদেরকে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল। অথচ প্রতিনিয়ত আমরা কেবল সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন করে চলছি! বনদস্যুদের থাবা, বন কর্মকর্তাদের আসাধু তৎপরতা ও লাগামহীন দুর্নীতি, বনবিভাগে দক্ষ জনবলের অভাব, সরকারের উদাসীনতা, বাঘ ও হরিণ শিকার, অগ্নিসংযোগ এবং বিষ দিয়ে মাছ আহরণের ফলে যুগের পর যুগ ধরে সুন্দরবনের অপরিমিত ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছি আমরা। উপরন্তু বনভূমির সীমানা ঘেঁষে শিল্পকারখানার অনুমোদন এবং সুন্দরবন মধ্যস্থ জলপথে কয়লা ও তেল পরিবহণের ফলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। অথচ এই সুন্দরবনই আমাদের সমুদ্র তীরবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র রক্ষাকবচ!

সুন্দরবনের সবুজ বেষ্টনী বাংলাদেশকে যুগের পর যুগ ধরে শুধু ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকেই রক্ষা করছে না, এটি অত্যাধিক জোয়ারের হাত থেকেও উপকূলীয় স্থলভাগকে রক্ষা করছে। নদী ও সাগরের মোহনায় ‘ডেলটা ফরমেশন’ এর মাধ্যমে স্থলভাগ বাড়িয়ে চলছে এই বনভূমি। সমুদ্র উপকূলের লবনাক্ততা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সুন্দরবন। দেশীয় বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল সরবারহ ও সরকারি রাজস্ব আয়ে রয়েছে এর বিস্তর ভূমিকা। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ম্যানগ্রোভ বনটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এর বাইরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও দূষণরোধে রয়েছে সুন্দরবনের অপরিসীম ভূমিকা। বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবন যে গ্রষ্টার দেয়া কত বড় আশীর্বাদতা আমাদের জনগণ ও সরকারকে অনুধাবন করা জরুরি।

আমাদের দেশের স্বার্থেই সুন্দরবন রক্ষা আজ আশু প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে। প্রকৃতির অপার দান এই সুন্দরবন যত বিনষ্ট হবে, বঙ্গোপসাগরের তা-বে বাংলাদেশের ধ্বংস তত বেশি নিকটবর্তী হবে। সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপণা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবন রক্ষায় সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই পরিকল্পনার আওতায় ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’ সংস্কার করে তা যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। অসাধু বন কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যূত করে অপরাধ অনুযায়ী আইনি শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বনদস্যুদের মোকাবিলায় সুন্দরবন অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকবল বাড়াতে হবে এবং বনদস্যুদের ধরতে সরকারি বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনসাধারণের বিকল্প আয়ের সংস্থান করতে হবে। বন্যপ্রানীর অভয়াশ্রম আওতা বৃদ্ধি করে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ এবং ফরেস্ট্রি বিভাগকে সুন্দরবন রক্ষার গবেষণায় কাজে লাগাতে হবে। বাঘ ও হরিণ শিকারের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে সুন্দরবন ঘেঁষে শিল্পকারখানার অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে এবং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তেল ও কয়লার পরিবহন বন্ধ করতে পারলে খুব ভালো হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন যতদিন আছে, ততদিন আমরা ঘূর্ণিঝড় -জলোচ্ছ্বাস, জোয়ার-লবণাক্ততা, সমুদ্রের উপকূলে ভাঙনের মতো বঙ্গোপসাগরীয় দুর্যোগ থেকে অনেক বেশি নিরাপদ থাকব। একইভাবে সুন্দরবন যতোটা বিনষ্ট হবে, দেশের ক্ষতিও ততটা ত্বরান্বিত হবে। তাই সরকার এবং নাগরিকদেরও স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সুন্দরবন রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া দরকার।

মো. ইমরান হোসেন

শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।