বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জন

ড. আনু মাহ্মুদ

এই উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা ও মানবতাবাদী চিন্তাবিদ মানবেন্দ্রনাথ রায় বিপ্লবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, দরিদ্র বা নিপীড়িত হলেই মানুষ বিপ্লবী হয় না। একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত বিপ্লবী ও বিপ্লবের নেতা বলা যায় তখনই, যখন তিনি তার নিজের স্বার্থকে দেশের জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে এক করে নিতে সক্ষম হন। জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান।

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের সময়কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। তবে তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী বিপ্লবী। ব্যতিক্রমধর্ম এ কারণে যে, আমরা সাধারণত যে বিপ্লবীদের কথা জানি, তারা ছিলেন তাত্ত্বিক বিপ্লবী। তারা কোন বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে জনগণের ওপর সেই আদর্শকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। জনগণের সঙ্গে তারা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি, জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছেন। আবার অনেক সময় নেহাত কৌশলগত কারণে এই বিপ্লবী নেতারা কোন অর্ধশিক্ষিত ধর্মীয় নেতার ওপর ভর করে তার মাধ্যমে সহজে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। জনগণের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিতেও দ্বিধা করেননি।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ব্যতিক্রমধর্মী দিক হলো, তিনি জনগণের অভিলক্ষ্য বা ‘অবজেকটিভ আসপিরেশন’ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাদের ওপর ভিত্তি করে মূল সমস্যাবলি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং সেগুলো নিরসনের পথ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি জনগণের মধ্যে মিশে গিয়ে তাদের বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে তাদের চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন। বস্তুত চিন্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিপ্লব ছাড়া কোন বিপ্লবই সফল হয় না। শেখ মুজিবের নিজের চিন্তা-চেতনায় ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।

তিনি বিভাগ-পূর্ব ভারতে ছাত্রজীবনে মুসলিম লীগের সম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি তখন পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন এ ভেবে যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের দরিদ্র জনসাধারণ, যারা অধিকাংশই মুসলমান, তারা অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করবে; তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। ধর্মভিত্তিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম জাতীয়তাবাদ যে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, সে সম্বন্ধে তার কোন ধারণা ছিল না। বস্তুত এ দেশের মুসলমানদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের ঐতিহ্য তখনও দানা বাঁধেনি। তারা দীর্ঘকাল প্যান-ইসলামের স্বপ্নে বিভোর থেকেছে। খিলাফলত আন্দোলনের সময় বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তারা নিজের দেশের স্বার্থের চেয়ে তুর্কি খিলাফতের জন্য বেশি চিহ্নিত ছিল।

এই শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত বাংলার মুসলমান সমাজের যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন তারা ছিলেন উচ্চবংশীয় ‘আশরাফ’ শ্রেণীভুক্ত। তারা বাংলার অধিবাসী হলেও নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে ঘৃণা বোধ করতেন। তাদের মাতৃভাষা ছিল উর্দু এবং বাংলা ভাষাকে তারা অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। গ্রামবাংলার অধিকাংশ দরিদ্র মুসলিম জনসাধারণ ছিল বাংলাভাষী, তাদের ‘আতরাফ’ অর্থাৎ নিম্নবংশোদ্ভূত বলে অভিহিত করা হতো। ‘আশরাফ’ শ্রেণীর মুসলমানরা ‘আতরাফ’ শ্রেণীর লোকদের হেয় চোখে দেখত। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু ‘আশরাফ’ শ্রেণীভুক্ত মুসলমানরা ছিল শিক্ষিত এবং অধিকাংশই নগরবাসী, বাংলার গোটা মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব ছিল তাদের হাতেই। উনিশ শতকের বাংলার মুসলিম নেতা ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফ থেকে শুরু করে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, এমনকি খাজা নাজিমুদ্দীন, যিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন-এরা সবাই এ গোষ্ঠীর লোক ছিলেন।

বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের জাগরণ ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মাধমে এ দেশের মুসলমান জনগণের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের ব্যাপক প্রসার লাভ ঘটে। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল, সে সময় মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, সেটা ছিল আমাদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে মূল কথা। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’

পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই বাঙালিত্বের চেতনা শেখ মুজিবকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিল। তিনি পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে এ দেশের রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক ধারায় প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব এ দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, ভাব-ভাবনার সঙ্গে নিজেকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন যে, অচিরেই তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

যেদিন ১৯৪৮ সালে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বললেন, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেদিন থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত শেখ মুজিবুর রহমানের কানে বেসুরো ঠেকতে লাগল। পদে পদে তাল কাটতে লাগল। সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য সৎ হতে পারে না।

সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত এই অঞ্চলের পাট। সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে ওই অঞ্চলে সুতা। সোনালি আঁশকে করা হলো গলার ফাঁস ওই অঞ্চলের হুকুম না হলে এ অঞ্চলে কোন কাজের চাকা ঘোরে না। সামরিক শক্তি পুরোপুরি পশ্চিম ভাগে। এখানকার সাগরে নৌবাহিনীর একটি ডিঙ্গি নৌকাও ছিল না। সব ব্যাপারেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে ছিল। ন্যায্য অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল।

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার-বিবেচনায় এরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি ভাবলেন, এখনই এর প্রতিরোধ না করলে অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যাগুরু বাঙালিরা সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবহ রায়তপ্রজায় পরিণত হবে। গোটা পূর্ব বাংলা শুধু কাঁচামাল উৎপাদনকারী একটি অনুন্নত কৃষি অঞ্চল হয়ে থাকবে। তিনি বুঝতে পারলেন-কেবল আবেদন, নিবেদন ও দরখাস্ত পেশ করে অবস্থার উন্নতি হবে না। অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন কঠিন সংগ্রামের। তার সংগ্রামী জীবনে তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। তাতে তিনি ভীত নন।

পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ৬ দফা দাবি উত্থাপন করলেন। পূর্ব বাংলার আপামর জনসাধারণ সেই ৬ দফাকে তাদের মুক্তির সনদ রূপেই গ্রহণ করল। আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হলো। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষিপ্ত হলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলো। শেখ মুজিবকে বন্দি করে রাখা হলো ক্যান্টনমেন্টে। সেখানেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বসল। কিন্তু ঊনসত্তরের সমগ্র পূর্ব বাংলাজুড়ে অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের চাপে পাক সরকার নতিস্বীকারে বাধ্য হলো। ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হলো এবং জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান সসম্মানে মুক্ত হলেন।

ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ত্বরিত প্রস্থানের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ করলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সত্তর সালে সারা দেশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠত অর্জন করে বিজয়ী হয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চে পূর্ব ঘোষিত জাতীয় সংসদ অধিবেশন বাতিল করায় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন যে, তারা কিছুতেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তার ৬ দফা দাবি সামাল দেয়ার জন্য আপসের অভিনয় করেছে মাত্র।

তিনি ভাবলেন, ৬ দফায় যদি এত ভয় তবে এক দফা-পূর্ণ স্বাধীনতা। তার নির্দেশে সরকারের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো। ৭ মার্চে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমাবেশে তার ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিচালিত নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে সেদিনের শেষ প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পরক্ষণেই বন্দি হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ে। সেদিনই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিশ্ব জনমতের চাপে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি তার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে বিজয়ী বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করে জাতির পিতার আসন অলঙ্কৃত করেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সফলতার অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভিত্তি ৬ দফার মাধ্যমেই পাকিস্তানি শাসক-গোষ্ঠীর শক্তিধর আইয়ুব শাহির ক্ষমতার সনদ ভেঙে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে সাফল্য অর্জন করে জাতির পিতার আসন লাভ করতে সফল হয়েছিলেন।

[লেখক : প্রাবন্ধিক, অর্থনীতির বিশ্লেষক, কলামিস্ট]

anumahmud@yahoo.com

শুক্রবার, ০৫ জুন ২০২০ , ২২ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১২ শাওয়াল ১৪৪১

বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জন

ড. আনু মাহ্মুদ

এই উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা ও মানবতাবাদী চিন্তাবিদ মানবেন্দ্রনাথ রায় বিপ্লবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, দরিদ্র বা নিপীড়িত হলেই মানুষ বিপ্লবী হয় না। একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত বিপ্লবী ও বিপ্লবের নেতা বলা যায় তখনই, যখন তিনি তার নিজের স্বার্থকে দেশের জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে এক করে নিতে সক্ষম হন। জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান।

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের সময়কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। তবে তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী বিপ্লবী। ব্যতিক্রমধর্ম এ কারণে যে, আমরা সাধারণত যে বিপ্লবীদের কথা জানি, তারা ছিলেন তাত্ত্বিক বিপ্লবী। তারা কোন বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে জনগণের ওপর সেই আদর্শকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। জনগণের সঙ্গে তারা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি, জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছেন। আবার অনেক সময় নেহাত কৌশলগত কারণে এই বিপ্লবী নেতারা কোন অর্ধশিক্ষিত ধর্মীয় নেতার ওপর ভর করে তার মাধ্যমে সহজে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। জনগণের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিতেও দ্বিধা করেননি।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ব্যতিক্রমধর্মী দিক হলো, তিনি জনগণের অভিলক্ষ্য বা ‘অবজেকটিভ আসপিরেশন’ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাদের ওপর ভিত্তি করে মূল সমস্যাবলি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং সেগুলো নিরসনের পথ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি জনগণের মধ্যে মিশে গিয়ে তাদের বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে তাদের চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন। বস্তুত চিন্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিপ্লব ছাড়া কোন বিপ্লবই সফল হয় না। শেখ মুজিবের নিজের চিন্তা-চেতনায় ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।

তিনি বিভাগ-পূর্ব ভারতে ছাত্রজীবনে মুসলিম লীগের সম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি তখন পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন এ ভেবে যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের দরিদ্র জনসাধারণ, যারা অধিকাংশই মুসলমান, তারা অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করবে; তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। ধর্মভিত্তিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম জাতীয়তাবাদ যে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, সে সম্বন্ধে তার কোন ধারণা ছিল না। বস্তুত এ দেশের মুসলমানদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের ঐতিহ্য তখনও দানা বাঁধেনি। তারা দীর্ঘকাল প্যান-ইসলামের স্বপ্নে বিভোর থেকেছে। খিলাফলত আন্দোলনের সময় বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তারা নিজের দেশের স্বার্থের চেয়ে তুর্কি খিলাফতের জন্য বেশি চিহ্নিত ছিল।

এই শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত বাংলার মুসলমান সমাজের যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন তারা ছিলেন উচ্চবংশীয় ‘আশরাফ’ শ্রেণীভুক্ত। তারা বাংলার অধিবাসী হলেও নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে ঘৃণা বোধ করতেন। তাদের মাতৃভাষা ছিল উর্দু এবং বাংলা ভাষাকে তারা অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। গ্রামবাংলার অধিকাংশ দরিদ্র মুসলিম জনসাধারণ ছিল বাংলাভাষী, তাদের ‘আতরাফ’ অর্থাৎ নিম্নবংশোদ্ভূত বলে অভিহিত করা হতো। ‘আশরাফ’ শ্রেণীর মুসলমানরা ‘আতরাফ’ শ্রেণীর লোকদের হেয় চোখে দেখত। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু ‘আশরাফ’ শ্রেণীভুক্ত মুসলমানরা ছিল শিক্ষিত এবং অধিকাংশই নগরবাসী, বাংলার গোটা মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব ছিল তাদের হাতেই। উনিশ শতকের বাংলার মুসলিম নেতা ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফ থেকে শুরু করে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, এমনকি খাজা নাজিমুদ্দীন, যিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন-এরা সবাই এ গোষ্ঠীর লোক ছিলেন।

বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের জাগরণ ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মাধমে এ দেশের মুসলমান জনগণের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের ব্যাপক প্রসার লাভ ঘটে। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল, সে সময় মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, সেটা ছিল আমাদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে মূল কথা। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’

পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই বাঙালিত্বের চেতনা শেখ মুজিবকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিল। তিনি পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে এ দেশের রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক ধারায় প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব এ দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, ভাব-ভাবনার সঙ্গে নিজেকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন যে, অচিরেই তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

যেদিন ১৯৪৮ সালে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বললেন, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেদিন থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত শেখ মুজিবুর রহমানের কানে বেসুরো ঠেকতে লাগল। পদে পদে তাল কাটতে লাগল। সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য সৎ হতে পারে না।

সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত এই অঞ্চলের পাট। সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে ওই অঞ্চলে সুতা। সোনালি আঁশকে করা হলো গলার ফাঁস ওই অঞ্চলের হুকুম না হলে এ অঞ্চলে কোন কাজের চাকা ঘোরে না। সামরিক শক্তি পুরোপুরি পশ্চিম ভাগে। এখানকার সাগরে নৌবাহিনীর একটি ডিঙ্গি নৌকাও ছিল না। সব ব্যাপারেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে ছিল। ন্যায্য অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল।

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার-বিবেচনায় এরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি ভাবলেন, এখনই এর প্রতিরোধ না করলে অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যাগুরু বাঙালিরা সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবহ রায়তপ্রজায় পরিণত হবে। গোটা পূর্ব বাংলা শুধু কাঁচামাল উৎপাদনকারী একটি অনুন্নত কৃষি অঞ্চল হয়ে থাকবে। তিনি বুঝতে পারলেন-কেবল আবেদন, নিবেদন ও দরখাস্ত পেশ করে অবস্থার উন্নতি হবে না। অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন কঠিন সংগ্রামের। তার সংগ্রামী জীবনে তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। তাতে তিনি ভীত নন।

পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ৬ দফা দাবি উত্থাপন করলেন। পূর্ব বাংলার আপামর জনসাধারণ সেই ৬ দফাকে তাদের মুক্তির সনদ রূপেই গ্রহণ করল। আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হলো। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষিপ্ত হলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলো। শেখ মুজিবকে বন্দি করে রাখা হলো ক্যান্টনমেন্টে। সেখানেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বসল। কিন্তু ঊনসত্তরের সমগ্র পূর্ব বাংলাজুড়ে অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের চাপে পাক সরকার নতিস্বীকারে বাধ্য হলো। ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হলো এবং জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান সসম্মানে মুক্ত হলেন।

ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ত্বরিত প্রস্থানের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ করলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সত্তর সালে সারা দেশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠত অর্জন করে বিজয়ী হয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চে পূর্ব ঘোষিত জাতীয় সংসদ অধিবেশন বাতিল করায় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন যে, তারা কিছুতেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তার ৬ দফা দাবি সামাল দেয়ার জন্য আপসের অভিনয় করেছে মাত্র।

তিনি ভাবলেন, ৬ দফায় যদি এত ভয় তবে এক দফা-পূর্ণ স্বাধীনতা। তার নির্দেশে সরকারের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো। ৭ মার্চে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমাবেশে তার ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিচালিত নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে সেদিনের শেষ প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পরক্ষণেই বন্দি হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ে। সেদিনই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিশ্ব জনমতের চাপে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি তার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে বিজয়ী বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করে জাতির পিতার আসন অলঙ্কৃত করেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সফলতার অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভিত্তি ৬ দফার মাধ্যমেই পাকিস্তানি শাসক-গোষ্ঠীর শক্তিধর আইয়ুব শাহির ক্ষমতার সনদ ভেঙে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে সাফল্য অর্জন করে জাতির পিতার আসন লাভ করতে সফল হয়েছিলেন।

[লেখক : প্রাবন্ধিক, অর্থনীতির বিশ্লেষক, কলামিস্ট]

anumahmud@yahoo.com