জীবনকে বাঁচিয়ে স্থিতিশীল করে জীবিকা

সরকার ‘জীবন ও জীবিকার’ সমন্বয় করে করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সারাদেশের ‘সাধারণ ছুটি’ বাতিল করে ‘সীমিত আকারে’ সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, গণপরিবহন খুলে দিয়েছে। ১ জুন থেকে শুরু হওয়া এই ‘সীমিত আকারে’ খুলে দেয়ার ব্যাপারটি চলবে ১৫ জুন পর্যন্ত। তারপর সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা জানা যায়নি। তবে কয়েকজন মন্ত্রী এবং সরকারি মহলের কথাবার্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে সরকারের এটি পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ। যদি এই ‘সীমিত আকারে’ খুলে দেয়ার সময় সংক্রমণ ও মৃত্যু অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় তবে সরকার অন্যরকম ‘কিছু’ করার কথা ভাবলেও ভাবতে পারে। কিন্তু এ অন্যরকম ‘কিছুটা’ যে কী, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।

সরকারের ‘সীমিত আকারে’ সব কিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন মূলত ব্যবসায়ীদের একাংশের চাপে সরকার জীবন এবং জীবিকাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, কারণ সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে বাস্তবে ‘জীবন’ উপেক্ষিত হয়েছে এবং জীবিকা প্রাধান্য পেয়েছে। জুন ১ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে সেটা আসলে জীবনকে নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছে। অর্থনীতি চালু রাখতে হবে, অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে বলে যে কথা বলা হচ্ছে- সেটা বাস্তবে ‘জীবনের বিনিময়ে জীবনকে অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার’ নীতি হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

কারণ একদিকে যেমন করোণা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যু এখন বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী এবং কতদিন পর্যন্ত এই ঊর্ধ্বমুখিনতা ও মৃত্যুর হার অব্যাহত থাকবে- সেটা সরকার তো নয়ই, কোন বিশেষজ্ঞও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না। অর্থাৎ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সম্পর্কে কোন পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্ট ধারণা না নিয়েই সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বমুখিনতার সময় অর্থনীতিকে সচল বা চাঙ্গা রাখতে হবে বলে ‘সীমিত আকারে’ হলেও সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে মাত্র ১৫ দিনে অর্থনীতির চাকা কতটা সচল হবে, ঊর্ধ্বমুখী হবে বা প্রাণ ফিরে পাবে- সেটা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এটা একপ্রকার অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবে কোন কোন বিশেষ ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির বিশেষ কোন সুবিধা হতে পারে বৈকি। এটা যদি সত্যি হয় তবে বিশেষ কয়েকজন ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির স্বার্থে জীবনকে জীবিকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার এ নীতি বা সিদ্ধান্ত কতটা গ্রহণযোগ্য- সেই প্রশ্ন করতেই হবে।

এই বাস্তবতায় রিসার্জেন্ট বাংলাদেশ নামক সংগঠন আয়োজিত ‘কোভিড-১৯, লকডাউন এক্সিট স্ট্র্যাটেজি ফ্রেমওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে এমসিসিআই’র সভাপতি বলেছেন, ‘গুরুত্ব দিতে হবে জীবন বাঁচানোর ওপর। এরপর আসবে ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বাজেটের ঘাটতির কথা।’ সংলাপে অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে সব সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিল্প কর্মকাণ্ডের ওপর ‘হার্ড লকডাউন’ আরোপ করে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে এমসিসিআই সভাপতি আরো বলেছেন, শাটডাউন বা লকডাউন পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে অর্থনীতি চালু করার লক্ষ্যে সরকারের জোনিং-ব্যবস্থা সুফল দেবে।

আমরাও মনে করি জীবন-জীবিকার সমন্বয় বা মুখোমুখি করার সময় এটা নয়। জীবনকে রক্ষা করেই জীবিকা অব্যাহত রাখার নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হবে সঠিক নীতি ও পন্থা। আমাদের প্রত্যাশা সরকারের নীতি-নির্ধারণ পর্যায়ে উল্লিখিত ভার্চুয়াল সংলাপের সুপারিশগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হবে এবং সেই আলোকে নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।

শনিবার, ০৬ জুন ২০২০ , ২৩ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১৩ শাওয়াল ১৪৪১

জীবন ও জীবিকা মুখোমুখি নয়

জীবনকে বাঁচিয়ে স্থিতিশীল করে জীবিকা

সরকার ‘জীবন ও জীবিকার’ সমন্বয় করে করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সারাদেশের ‘সাধারণ ছুটি’ বাতিল করে ‘সীমিত আকারে’ সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, গণপরিবহন খুলে দিয়েছে। ১ জুন থেকে শুরু হওয়া এই ‘সীমিত আকারে’ খুলে দেয়ার ব্যাপারটি চলবে ১৫ জুন পর্যন্ত। তারপর সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা জানা যায়নি। তবে কয়েকজন মন্ত্রী এবং সরকারি মহলের কথাবার্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে সরকারের এটি পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ। যদি এই ‘সীমিত আকারে’ খুলে দেয়ার সময় সংক্রমণ ও মৃত্যু অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় তবে সরকার অন্যরকম ‘কিছু’ করার কথা ভাবলেও ভাবতে পারে। কিন্তু এ অন্যরকম ‘কিছুটা’ যে কী, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।

সরকারের ‘সীমিত আকারে’ সব কিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন মূলত ব্যবসায়ীদের একাংশের চাপে সরকার জীবন এবং জীবিকাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, কারণ সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে বাস্তবে ‘জীবন’ উপেক্ষিত হয়েছে এবং জীবিকা প্রাধান্য পেয়েছে। জুন ১ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে সেটা আসলে জীবনকে নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছে। অর্থনীতি চালু রাখতে হবে, অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে বলে যে কথা বলা হচ্ছে- সেটা বাস্তবে ‘জীবনের বিনিময়ে জীবনকে অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার’ নীতি হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

কারণ একদিকে যেমন করোণা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যু এখন বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী এবং কতদিন পর্যন্ত এই ঊর্ধ্বমুখিনতা ও মৃত্যুর হার অব্যাহত থাকবে- সেটা সরকার তো নয়ই, কোন বিশেষজ্ঞও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না। অর্থাৎ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সম্পর্কে কোন পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্ট ধারণা না নিয়েই সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বমুখিনতার সময় অর্থনীতিকে সচল বা চাঙ্গা রাখতে হবে বলে ‘সীমিত আকারে’ হলেও সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে মাত্র ১৫ দিনে অর্থনীতির চাকা কতটা সচল হবে, ঊর্ধ্বমুখী হবে বা প্রাণ ফিরে পাবে- সেটা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এটা একপ্রকার অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবে কোন কোন বিশেষ ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির বিশেষ কোন সুবিধা হতে পারে বৈকি। এটা যদি সত্যি হয় তবে বিশেষ কয়েকজন ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির স্বার্থে জীবনকে জীবিকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার এ নীতি বা সিদ্ধান্ত কতটা গ্রহণযোগ্য- সেই প্রশ্ন করতেই হবে।

এই বাস্তবতায় রিসার্জেন্ট বাংলাদেশ নামক সংগঠন আয়োজিত ‘কোভিড-১৯, লকডাউন এক্সিট স্ট্র্যাটেজি ফ্রেমওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে এমসিসিআই’র সভাপতি বলেছেন, ‘গুরুত্ব দিতে হবে জীবন বাঁচানোর ওপর। এরপর আসবে ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বাজেটের ঘাটতির কথা।’ সংলাপে অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে সব সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিল্প কর্মকাণ্ডের ওপর ‘হার্ড লকডাউন’ আরোপ করে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে এমসিসিআই সভাপতি আরো বলেছেন, শাটডাউন বা লকডাউন পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে অর্থনীতি চালু করার লক্ষ্যে সরকারের জোনিং-ব্যবস্থা সুফল দেবে।

আমরাও মনে করি জীবন-জীবিকার সমন্বয় বা মুখোমুখি করার সময় এটা নয়। জীবনকে রক্ষা করেই জীবিকা অব্যাহত রাখার নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হবে সঠিক নীতি ও পন্থা। আমাদের প্রত্যাশা সরকারের নীতি-নির্ধারণ পর্যায়ে উল্লিখিত ভার্চুয়াল সংলাপের সুপারিশগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হবে এবং সেই আলোকে নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।