করোনার মতো মহামারী আগামীতে আরও আসবে

ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের হুঁশিয়ারি

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস এ পর্যন্ত ৪ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে এমন মৃত্যুযজ্ঞ চলমান থাকার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, মানুষের গড়ে তোলা সভ্যতায় বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণ এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ?‘নিখুঁত ব্যবস্থা’ রয়েছে। প্রাকৃতিক জগতে মানুষের অনুপ্রবেশ এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করছে। এর ফলে করোনার মতো মহামারী আগামীতে আবারও ফিরে আসার সম্ভাবণা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সংবাদ মাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে, এমন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সংক্রমক রোগ ও এর বিস্তার নিয়ে এ গবেষণাটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ‘প্যাটার্ন রিকগনিশন’ নামের তাদের তৈরি করা একটি পদ্ধতির মাধ্যমে এসব রোগ বিস্তারের প্রক্রিয়ায় কী কী সাদৃশ্য দেখা যায় তা চিহ্নিত করা সম্ভব। কোন কোন বন্যপ্রাণী মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ-তা এ পদ্ধতির মাধ্যমে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। মূলত ভবিষ্যতের যে কোনও রোগবিস্তারের জন্য প্রস্তুত থাকার বৈশ্বিক প্রয়াসেরই অংশ এটি।

‘আমরা পাঁচটি বুলেট থেকে বেঁচে গেছি’:

নতুন রোগের কোথায় ও কীভাবে বিস্তার ঘটে তা নিয়ে গবেষণা করে থাকেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক ম্যাথিউ বেলিস এ গবেষণা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘গত ২০ বছরে আমরা ছয়টি বড় বড় হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। সার্স, মার্স, ইবোলা, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সোয়াইন ফ্লু-এই পাঁচটি বুলেট আমরা এড়াতে পেরেছি। কিন্তু ছয় নম্বরটার হাত থেকে বাঁচতে পারিনি।’ সবচেয়ে বড় কথা, এটাই যে শেষ মহামারী- এমন নয়। সেক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী থেকে মানবদেহে আসা রোগগুলোর দিকে আরও গভীরভাবে নজর দিতে হবে।

এমন সতর্ককতারই অংশ হিসেবে অধ্যাপক ম্যাথিউ বেলিস ও তার গবেষণা সহযোগীরা এমন একটি প্যাটার্ন-রিকগনিশন পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যার সহায়তায় বন্যপ্রাণী থেকে আসা যত রোগের কথা জানা রয়েছে তার সবগুলোর উপাত্ত অনুসন্ধান করে দেখা যাবে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা হাজারো ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট (পরজীবী) এবং ভাইরাস সম্পর্কে জেনেছেন। অধ্যাপক বেলিসের পদ্ধতি দিয়ে এই অণুজীবগুলো যেসব প্রজাতির প্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে - তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সূত্রগুলো চিহ্নিত করা যাবে। এ সূত্রগুলো দিয়ে আবার এটাও বোঝা যাবে, কোন কোন অণুজীব মানুষের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যদি এভাবে কোন প্যাথোজেন (রোগ-সৃষ্টিকারী অণুজীব) চিহ্নিত হয়- তাহলে বিজ্ঞানীরা কোন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার আগেই তা ঠেকানোর উপায় উদ্ভাবনের গবেষণা চালাতে পারবেন।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বেলিস বলছেন, ঠিক কোন রোগ মহামারীর চেহারা নিতে পারে তার গবেষণা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আমরা এই প্রথম পদক্ষেপটির বিষয়ে অগ্রগতি ঘটাতে পেরেছি।

বিজ্ঞানীরা একমত, বন ধ্বংস এবং বন্যপ্রাণীর আবাসভূমিতে মানুষের ঢুকে পড়ার ফলে এখন ঘন ঘন এবং সহজেই প্রাণী থেকে মানুষে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এদিকে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক কেট জোনস বলছেন, মানুষ যেভাবে ইকোসিস্টেমকে বদলে দিয়ে কৃষি বা বৃক্ষরোপণ করছে, তাতে জীববৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে এবং মানুষের নানা রোগে সংক্রমণে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ছে। তবে সব রোগের ক্ষেত্রেই এমন হচ্ছে তা নয়।

অধ্যাপক জোনসের মতে, ‘কিছু বন্যপ্রাণী যারা মানুষের উৎপাতের বিষয়ে সবচেয়ে সহিষ্ণু- যেমন কিছু প্রজাতির ইঁদুর তারা অনেক সময় রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। ফলে জীববৈচিত্র্য হারানোর ফলে এমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে যাতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর ঝুঁকিপূর্ণ সংস্পর্শ বেড়ে যাচ্ছে। তাতে কিছু কিছু ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া বা প্যারাসাইটের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে।’ এ ক্ষেত্রে কিছু রোগ বিস্তারের কথা বলা যায়- যেখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর ‘মধ্যবর্তী পর্বের’ (ইন্টারফেস) যে ঝুঁকি- তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে।

মানুষ-বন্যপ্রাণীর মাঝের ‘ইন্টারফেস’ :

১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এটি একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ যা এক ধরনের বাদুড়ের মধ্যে দিয়ে বাহিত হয়। ওই সংক্রমণ বনভূমির প্রান্তে থাকা একটি শূকরের খামারে প্রথম ছড়ায়। ফলের গাছে এসে জঙ্গলের বাদুড় ফল খেতো। তাদের আধা-খাওয়া ফল মাটিতে পড়লে তা খেতো শূকর। ওই ফলে লেগে থাকতো বাদুড়ের মুখের লালা- যা থেকে শূকরের দেহে সংক্রমণ হয়। এই সংক্রমিত শূকরের দেখাশোনা করতো খামারের ২৫০ জনেরও বেশি কর্মী। ফলে তাদের দেহেও দেখা দেয় এ ভাইরাস সংক্রমণ। তাদের মধ্যে শতাধিক কর্মীর মৃত্যু হয়।

এদিকে আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওমিটারস-এর পক্ষ থেকে গতকাল দেয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চল মহামারী করোনায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৭৩ লাখ ২৩ হাজার ৭৬১ জন। এর মধ্যে ৪ লাখ ১৩ হাজার ৭৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি সুস্থ হয়েছে ৩৬ লাখ ৩ হাজার ৮৯৩ জন।

এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস জনিত রোগ কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর হার সম্পর্কে এখনও গবেষণা চলছে। তবে অনুমাণ করা হয়, যত মানুষ প্রাণঘাতী করোনায় সংক্রমিত হয় তার প্রায় ১ শতাংশ মারা যায়। নিপাহ ভাইরাসের ক্ষেত্রে মারা যায় সংক্রমিতদের ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় ও কেনিয়ার আন্তর্জাতিক গবাদিপশু গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক এরিক ফেভরে বলছেন, যেসব এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাবের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, সেসব জায়গায় গবেষকদের সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে।

বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও খামারের মতো স্থানে মানুষের কর্মকা- -এ দুয়ের মধ্যে যদি এ রকম কোন মধ্যবর্তী পর্বের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সেটা হয়ে উঠতে পারে নতুন রোগ ছড়ানোর হটস্পট। যেমন বনভূমির কাছে একটি পশুপালনের খামার বা যেসব বাজারে প্রাণী বেচাকেনা হয়-এগেুলোই হচ্ছে এমন জায়গা, যেখানে মানুষ আর বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের পার্থক্য ঝাপসা হয়ে যায়। এগুলো থেকেই রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফেভরে বলেন, ‘ এ রকম মধ্যবর্তী পর্ব কোথাও তৈরি হচ্ছে কিনা তার ওপর আমাদের সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে। অস্বাভাবিক কোন কিছু দেখলেই সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।’

অপরদিকে মানব বসতি আছে এমন জায়গায় প্রতি বছর তিন থেকে চার বার নতুন রোগের উদ্ভব হয়। শুধু এশিয়া বা আফ্রিকা নয়, ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রেও এটা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বেলিস বলেন, ‘নতুন রোগের বিষয়ে নজরদারির গুরুত্ব এখন আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পৃথিবীতে মহামারী ছড়ানোর জন্য প্রায় আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছি।’ তার সঙ্গে একমত পোষণ করে অধ্যাপক ফেভরে বলেন, করোনাভাইরাসের মতো ঘটনা আগামীতে বার বার ঘটতে পারে। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে যে, কীভাবে মানুষের কর্মকা- প্রাকৃতিক জগতের ওপর প্রভাব ফেলছে।

বৃহস্পতিবার, ১১ জুন ২০২০ , ২৮ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১৮ শাওয়াল ১৪৪১

করোনার মতো মহামারী আগামীতে আরও আসবে

ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের হুঁশিয়ারি

image

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস এ পর্যন্ত ৪ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে এমন মৃত্যুযজ্ঞ চলমান থাকার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, মানুষের গড়ে তোলা সভ্যতায় বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণ এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ?‘নিখুঁত ব্যবস্থা’ রয়েছে। প্রাকৃতিক জগতে মানুষের অনুপ্রবেশ এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করছে। এর ফলে করোনার মতো মহামারী আগামীতে আবারও ফিরে আসার সম্ভাবণা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সংবাদ মাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে, এমন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সংক্রমক রোগ ও এর বিস্তার নিয়ে এ গবেষণাটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ‘প্যাটার্ন রিকগনিশন’ নামের তাদের তৈরি করা একটি পদ্ধতির মাধ্যমে এসব রোগ বিস্তারের প্রক্রিয়ায় কী কী সাদৃশ্য দেখা যায় তা চিহ্নিত করা সম্ভব। কোন কোন বন্যপ্রাণী মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ-তা এ পদ্ধতির মাধ্যমে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। মূলত ভবিষ্যতের যে কোনও রোগবিস্তারের জন্য প্রস্তুত থাকার বৈশ্বিক প্রয়াসেরই অংশ এটি।

‘আমরা পাঁচটি বুলেট থেকে বেঁচে গেছি’:

নতুন রোগের কোথায় ও কীভাবে বিস্তার ঘটে তা নিয়ে গবেষণা করে থাকেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক ম্যাথিউ বেলিস এ গবেষণা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘গত ২০ বছরে আমরা ছয়টি বড় বড় হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। সার্স, মার্স, ইবোলা, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সোয়াইন ফ্লু-এই পাঁচটি বুলেট আমরা এড়াতে পেরেছি। কিন্তু ছয় নম্বরটার হাত থেকে বাঁচতে পারিনি।’ সবচেয়ে বড় কথা, এটাই যে শেষ মহামারী- এমন নয়। সেক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী থেকে মানবদেহে আসা রোগগুলোর দিকে আরও গভীরভাবে নজর দিতে হবে।

এমন সতর্ককতারই অংশ হিসেবে অধ্যাপক ম্যাথিউ বেলিস ও তার গবেষণা সহযোগীরা এমন একটি প্যাটার্ন-রিকগনিশন পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যার সহায়তায় বন্যপ্রাণী থেকে আসা যত রোগের কথা জানা রয়েছে তার সবগুলোর উপাত্ত অনুসন্ধান করে দেখা যাবে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা হাজারো ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট (পরজীবী) এবং ভাইরাস সম্পর্কে জেনেছেন। অধ্যাপক বেলিসের পদ্ধতি দিয়ে এই অণুজীবগুলো যেসব প্রজাতির প্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে - তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সূত্রগুলো চিহ্নিত করা যাবে। এ সূত্রগুলো দিয়ে আবার এটাও বোঝা যাবে, কোন কোন অণুজীব মানুষের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যদি এভাবে কোন প্যাথোজেন (রোগ-সৃষ্টিকারী অণুজীব) চিহ্নিত হয়- তাহলে বিজ্ঞানীরা কোন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার আগেই তা ঠেকানোর উপায় উদ্ভাবনের গবেষণা চালাতে পারবেন।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বেলিস বলছেন, ঠিক কোন রোগ মহামারীর চেহারা নিতে পারে তার গবেষণা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আমরা এই প্রথম পদক্ষেপটির বিষয়ে অগ্রগতি ঘটাতে পেরেছি।

বিজ্ঞানীরা একমত, বন ধ্বংস এবং বন্যপ্রাণীর আবাসভূমিতে মানুষের ঢুকে পড়ার ফলে এখন ঘন ঘন এবং সহজেই প্রাণী থেকে মানুষে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এদিকে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক কেট জোনস বলছেন, মানুষ যেভাবে ইকোসিস্টেমকে বদলে দিয়ে কৃষি বা বৃক্ষরোপণ করছে, তাতে জীববৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে এবং মানুষের নানা রোগে সংক্রমণে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ছে। তবে সব রোগের ক্ষেত্রেই এমন হচ্ছে তা নয়।

অধ্যাপক জোনসের মতে, ‘কিছু বন্যপ্রাণী যারা মানুষের উৎপাতের বিষয়ে সবচেয়ে সহিষ্ণু- যেমন কিছু প্রজাতির ইঁদুর তারা অনেক সময় রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। ফলে জীববৈচিত্র্য হারানোর ফলে এমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে যাতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর ঝুঁকিপূর্ণ সংস্পর্শ বেড়ে যাচ্ছে। তাতে কিছু কিছু ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া বা প্যারাসাইটের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে।’ এ ক্ষেত্রে কিছু রোগ বিস্তারের কথা বলা যায়- যেখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর ‘মধ্যবর্তী পর্বের’ (ইন্টারফেস) যে ঝুঁকি- তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে।

মানুষ-বন্যপ্রাণীর মাঝের ‘ইন্টারফেস’ :

১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এটি একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ যা এক ধরনের বাদুড়ের মধ্যে দিয়ে বাহিত হয়। ওই সংক্রমণ বনভূমির প্রান্তে থাকা একটি শূকরের খামারে প্রথম ছড়ায়। ফলের গাছে এসে জঙ্গলের বাদুড় ফল খেতো। তাদের আধা-খাওয়া ফল মাটিতে পড়লে তা খেতো শূকর। ওই ফলে লেগে থাকতো বাদুড়ের মুখের লালা- যা থেকে শূকরের দেহে সংক্রমণ হয়। এই সংক্রমিত শূকরের দেখাশোনা করতো খামারের ২৫০ জনেরও বেশি কর্মী। ফলে তাদের দেহেও দেখা দেয় এ ভাইরাস সংক্রমণ। তাদের মধ্যে শতাধিক কর্মীর মৃত্যু হয়।

এদিকে আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওমিটারস-এর পক্ষ থেকে গতকাল দেয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চল মহামারী করোনায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৭৩ লাখ ২৩ হাজার ৭৬১ জন। এর মধ্যে ৪ লাখ ১৩ হাজার ৭৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি সুস্থ হয়েছে ৩৬ লাখ ৩ হাজার ৮৯৩ জন।

এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস জনিত রোগ কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর হার সম্পর্কে এখনও গবেষণা চলছে। তবে অনুমাণ করা হয়, যত মানুষ প্রাণঘাতী করোনায় সংক্রমিত হয় তার প্রায় ১ শতাংশ মারা যায়। নিপাহ ভাইরাসের ক্ষেত্রে মারা যায় সংক্রমিতদের ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় ও কেনিয়ার আন্তর্জাতিক গবাদিপশু গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক এরিক ফেভরে বলছেন, যেসব এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাবের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, সেসব জায়গায় গবেষকদের সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে।

বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও খামারের মতো স্থানে মানুষের কর্মকা- -এ দুয়ের মধ্যে যদি এ রকম কোন মধ্যবর্তী পর্বের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সেটা হয়ে উঠতে পারে নতুন রোগ ছড়ানোর হটস্পট। যেমন বনভূমির কাছে একটি পশুপালনের খামার বা যেসব বাজারে প্রাণী বেচাকেনা হয়-এগেুলোই হচ্ছে এমন জায়গা, যেখানে মানুষ আর বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের পার্থক্য ঝাপসা হয়ে যায়। এগুলো থেকেই রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফেভরে বলেন, ‘ এ রকম মধ্যবর্তী পর্ব কোথাও তৈরি হচ্ছে কিনা তার ওপর আমাদের সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে। অস্বাভাবিক কোন কিছু দেখলেই সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।’

অপরদিকে মানব বসতি আছে এমন জায়গায় প্রতি বছর তিন থেকে চার বার নতুন রোগের উদ্ভব হয়। শুধু এশিয়া বা আফ্রিকা নয়, ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রেও এটা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বেলিস বলেন, ‘নতুন রোগের বিষয়ে নজরদারির গুরুত্ব এখন আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পৃথিবীতে মহামারী ছড়ানোর জন্য প্রায় আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছি।’ তার সঙ্গে একমত পোষণ করে অধ্যাপক ফেভরে বলেন, করোনাভাইরাসের মতো ঘটনা আগামীতে বার বার ঘটতে পারে। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে যে, কীভাবে মানুষের কর্মকা- প্রাকৃতিক জগতের ওপর প্রভাব ফেলছে।