ক্ষেপাবাউল বিদ্রোহী বীর বাঁধনহারা

শাফিকুর রাহী

কবিতার বরপুত্র সংগীতের মুকুটহীন সম্রাট বিদ্রোহের লাভায় প্রজ্জ্বলিত এক মানবিক মহান দেশপ্রেমী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অসাধারণ গানের বাণী আর সুরদ্যোতনায় মনোমুগ্ধ নান্দনিক জাদুকরী শব্দকলায় উপমহাদেশীয় বিদগ্ধজনের মনোমন্দিরে ভালোলাগা আর ভালোবাসার স্বপ্নবীজ বপন করেছিলেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তিনি যেমন বিদ্রোহী কবি হিসেবে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন, তার পাশাপাশি তিনি যে এক মহাপ্রেমিক ছিলেন তাঁর সৃজনশীল কর্মপ্রয়াসের ভেতর আমরা তা লক্ষ্য করে থাকি। তাঁর গানের সুরে ও কথামালার ভেতর দিয়ে তিনি প্রেমার্দ মানুষের মনোলোকে মন্ত্রমুগ্ধ সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছেন। যার মহত্তম সৃজনকলায় উতলা হয়েছে বহু প্রেমিকযুগল। কেউ প্রেমের জলসাঘরে হয়েছে আত্মহারা। কখনো কখনো সেটি নিজেকে ছাড়িয়ে দেশ দেশান্তরে অমরত্ব লাভ করেছে। তিনি মূলত বিদ্রোহী কবি হলেও তাঁর প্রেমেও যেন আমরা সে দ্রোহের বাণী শুনতে পাই। জানতে পারি তাঁর অভিমানী কণ্ঠকারুকলায় কীভাবে নিজের ভেতর পরম ভালোবাসার আকুতিকে প্রকাশ করেছেন মনমাতানো সংগীতের রূপরসে এক অনন্য সৃষ্টিসাধনায় নিজেকে আবিষ্কারের রুদ্ধ পথকে তিনি অতিক্রম করেছেন বহু জঞ্জালকে মাড়িয়ে আলোর পথের দিশারী হয়ে, দুর্বিসহ মনোযাতনার বিষবাষ্পে বাকরুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন মানবতার মুক্তির স্বকীয়তায় তেজদীপ্ত বাচনভঙ্গীতে।

বাঙালির মানসময়দানে তিনি এক উদাসী বাউল বেশে গেয়ে গেছেন সম্প্রীতির মহাবন্ধনের অমর কারুকাজের ভেতর নন্দনতত্ত্বের শিলালিপিতে। কখনো কখনো তাঁর কবি সত্তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন গানের বাণীতে আবেগীয় শব্দ চয়নে। তিনি অনেক বড়ো মাপের সুর সংগীতস্রষ্টা এক দ্রোহীমনীষী। যেমন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক অসাধারণ অন্ত্যমিল উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে জানান দিয়েছেন প্রকৃতির সৌন্দর্য ছাড়া রূপরঙবিহীন বিলকুল বেমানান মানুষের মনোলোকেও বাজে না আর প্রাণপাপিয়ার পিওপিও মধুর সুর। কী গভীর মনোবেদনায় অভিমানের সুরে রচনা করেন ‘আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান, বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান।’ প্রাণপ্রিয় কবি আপনার এ অভিমানের বেদনা বিদ্রোহী বিহগের আবেগীয় সুরবাণী সঠিক নয়, তা আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে। কারণ আপনাকে ভুলে যাবে এমন সভ্য সচেতন বাঙালি কিংবা বিশ্বের যে কোনো বিদগ্ধজনও কি কখনো আপনাকে ভোলার সে শক্তি সাহস রাখে? না, মোটেও না। আপনি অনন্তকাল মানুষের মনে আনন্দ আসরে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাঠে দারুণ ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তি ছড়াবেন আপন মহিমায় সৃজনের কহনকথায়। বাংলা গজলের প্রাণকাড়া নন্দিত সুর সংগীতে বেহালার মনমাতানো কুহকী-আকর্ষণে মানুষের মনে প্রেরণা যোগাবে কাল-কালান্তরে।

তিনি যখন লেখেন- ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে’। এ অসামান্য সংগীত রচনার সময় তিনি প্রকৃতির ভেতর এমনিভাবে প্রবেশ করেছেন যে, বাহিরে ঘরের চালায় কিংবা বৃক্ষশাখে মুশলধারায় বৃষ্টির স্বপ্নজাগানিয়া প্রাণকাঁপানো শরীর ও মনের ব্যাকুল আকুতি লক্ষ্য করা যায়। এমন অনেক অসাধারণ সুর ও বাণীতে মাতোয়ারা করেছেন দশদিগন্ত, রসিক নাগরিকের পুষ্পিত মনোউদ্যান। তিনি যখন লেখেন ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল’। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের মনোআকাক্সক্ষার গহীন বন-বনানীতে, বসন্ত বউরির কণ্ঠের সুরধ্বনিতে আপনার সংগীতের রমণীয় মানবিয়ার মধুর স্মৃতির ক্যাম্পাসে বারবার বেজে উঠবে নবজাগরণের স্বপ্নজাগানিয়া গানের অমর বাণী। তার বৈচিত্র্যময় বিচিত্রধারার কাব্যতরুলতায় আর সুর ও সংগীতের ঝংকারে নেচে উঠেছিলো দোলন চাঁপার মনোবীণার তার। সে উদাসী হাওয়ার অনল বানে কোন সোহাগীর অধরা অধরে-চোখের পদ্মপরাগে ভালোবাসার আলো-আঁধারে কাঁপন জাগায়? সে মনহরিণী শ্যামলিমা মানবীয়াকে নিয়ে তখন কবি লিখেন ‘চেওনা সুনয়না আর চেওনা এ নয়ন পানে’। তাঁর অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের বিদ্রোহী কবিতায় আমরা যেমনটি লক্ষ্য করে থাকি প্রেমের গান কবিতায়ও সে রকমটি অনুভব করা যায় যেমন- ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো’ কিংবা ‘আলগা করোগো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি’।

সৃষ্টির উন্মাদনায় ছিলেন মশগুল, আপন মহিমায় রচনা করেন

বীরবাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার গর্বিত উপাখ্যান। তার স্বপ্ন ও সম্ভাবনার স্বাবলীল সৃজন উপস্থাপনায় জয়বাংলার বিজয় কেতন উড়িয়ে দশদিগন্ত মাতিয়ে তুলেছিলেন বিদ্রোহী বীর কাব্য সৈনিক। জগৎখ্যাত সংগীতের সুর বাণীতে গণমানুষকে জাগ্রত করার প্রয়াসে লিখেন ‘জাগো অমৃত পিয়াসী’ কিংবা ‘জয় হোক সত্যের জয়’। এমন প্রতিবাদী ধারার গান-কবিতায় সাধারণ লোকজনও কিন্তু খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে নজরুলকে সমর্থন করেছেন। অনেক সময় একসঙ্গে জেগেও উঠেছেন মানবতার মুক্তির মিছিলে আবহমান বাংলার লোকায়িত শব্দালংকারে দরদী মনের গাঁথুনিতে প্রকাশ করেন অসাধারণ সৃষ্টিসাধক বিদ্রোহী বীর নজরুল। এমন অনেক আবেগীত সংগীতকলায় পাঠক হৃদয়ে তোলপাড় তোলে, চারিদিকে গুঞ্জরণ ওঠে- এয়ছা কেয়ছা প্রেমী হায় ভাইয়া’! আদতেই মহৎপ্রেমী ছাড়া এ ধরনের দ্রোহী কবিতা রচনা কোনোভাবেই সম্ভম নয় কিংবা গানের বেলায়ও সে একই কথা আসবে। বস্তুত যে যতো বেশি বিদ্রোহী সে ততবেশি প্রেমীও বটে।

যে কবি’র মনাকাশে প্রেম বিরহের মানবীয় সুর বেজে ওঠে মনোআকাক্সক্ষায় অজানা-অচেনা প্রান্তরে উড়ে-ঘুরে বেড়াবেন বলে। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি’ তাঁর সৃজনসাধনায় বারবার উচ্চারিত বিরহ বিচ্ছেদের সুর-বাণী আর ভালোবাসার আলো-আঁধারে তিনি নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন, বহুমাত্রিকতায় তা প্রকাশের ব্যাকুল আকুতিও লক্ষ্য করা যায় তার নিজস্ব ভাষাশৈলীতে সুন্দরের অপূর্ব বাঁশরী সুরে। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম আমাদের অমূল্য সম্পদ, তাঁকে যতো বেশি পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে ততই জাতির জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের অমর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানতে হলে সমাজের সচেতন নাগরিককে নজরুলকে আবিষ্কার করতে হবে নতুন করে নতুনভাবে।

অজস্র অমূল্য সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে আমাদের চোখের আড়ালে। আমরা সেসব আবিষ্কারের ভেতর দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেবো বাঙালির গর্বিত সমস্ত শিল্পকলার অসামান্য কৃতিত্বের চিত্রপট কতোটা গভীর ও রমণীয় রূপরসে ভরপুর। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়- নয় কিছু মহীয়ান গাহি সাম্যের গান...। সৃজন বেদনায় কেউ আছে না, কাতর হয়ে পড়ে, নজরুল ছিলো তার ঠিক বিপরীত তিনি সৃজন বেদনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন। বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামের বসন্ত কুমার সেন গুপ্ত আর গিরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান আশালতা সেন গুপ্ত (দোলন) কবি নজরুলের সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হয় ২৫ এপ্রিল ১৯২৪ পশ্চিমবঙ্গের এক নিকট আত্মীয়ের বাসায়। তাদের দু’জনের সে গভীর প্রেম সম্পর্কে নানাজন নানাভাবে লিখলেও আজো হয়তো অনেক অজানা তথ্য রয়ে গেছে গুপ্তধনের মতো নজরুল গবেষকদের চোখের আড়ালে। আজকে আমি সে অজানা তথ্য প্রকাশের জন্য লিখতেও বসিনি। আমার লেখার বিষয় বিদ্রোহী কবির মনমাতানো প্রাণ কাঁপানো গানের সুর-বাণী এবং তার জীবনের ঘটে যাওয়া প্রেমময় মধুর স্মরলিপির ক্ষুদ্র একটি অংশের উপর লেখার যতসামান্য চেষ্টা করবো।

বাঁধনহারা কবির গভীর গোপন প্রেমের মালা কোন রূপসী মায়াবীর ভাগ্যললাটে বাঁধা হবে এ নিয়ে কবির মনে তোলপাড় তোলে। তিনি প্রথম দেখায় হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন যে শ্যামলিমা বালিকার মন্ত্রমুগ্ধ প্রেমের জাদুকরী আকর্ষণে তার নাম আশালতা সেনগুপ্ত, কবির দেয়া নাম প্রমীলা। যদিও তাঁর কুমিল্লায় আসা হয় পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে- তাঁরই আমন্ত্রণে। বিদগ্ধজনের আলোচনায় সমালোচনায় জানা যায়, আলী আকবর খান খুব চালাক মানুষ ছিলেন বিধায় তারই ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস-এর সঙ্গে নজরুলের বিয়ের আয়োজনও করেছিলেন। নিয়তির এক অলৌকিক বিধানের বাহিরে যাওয়ার কারোরই সুযোগ নেই বলেই হয়তো সে বিয়ে বাড়ির সাজসাজ রঙ তামাশায় মুহূর্তেই নিরাশার অন্ধকারে সব ঢেকে যায়। কারণ আকবর সাহেবের সঙ্গে তাঁর ভাগ্নির একটি রুমে কী এক গোপন আলাপকালে নজরুল সেটি নিজ চোখে দেখার পর আর এক মুহূর্তও ওখানে থাকেননি। নজরুলের সঙ্গে ছিলেন বোধহয় দোলনের মা- আর চাচাত ভাই। নজরুলের চোখে বর্ষণধারা দেখতে পেয়ে তারা দু’জনও কবির সঙ্গে নৌকাযোগে ওই বাড়ি ত্যাগ করেন লুকিয়ে খুব গোপনে। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টিমুখর রাতের আঁধারে তারা দৌলতপুর ছেড়ে চলে আসেন কুমিল্লার কান্দির পাড়ে। এখানে আসার পর দোলনের মায়ের আদর সোহাগে কবি মুগ্ধ।

তাই অনেকদিন ছিলেন এ বাসায়। সেই থেকে অনেকবার নজরুল কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের দোলনের বাসায় বেড়াতে এসেছেন- কবি’র উদাসী মন বোধহয় খুঁজে পেয়েছিলো মায়ের মমতামাখানো স্নেহের পরশ আর দোলনের মধুর প্রেমেমগ্ন এক বাঁধনহারা পথ ভুলে পথের সন্ধানে গেয়ে উঠেন জীবনজয়ের গান। দেশপ্রেম-নারী প্রেম আর ঈশ্বরপ্রেমে বেহুঁশ বেভুল না হলে হয়তো কোনো মানুষই সৃষ্টির অপূর্ব সৌন্দর্যের রূপরসে সৃজনবেদনায় উল্কাবেগে ছুটে চলতে পারে না কখনো বাধার আঁধার ভাঙার নেশায়। নজরুল ছোট বেলায় যেভাবে অভাবের তাড়নায়-ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েও বাধাগ্রস্ত হয়েছেন, এতো কিছুর পরও তিনি কখনো দমে যাননি, কারণ তিনি লড়াই করেই জয়ী হবার প্রত্যয়ে বীরের বেশে সকল অন্যায় অনিয়মের নিয়ম ভাঙার সংগ্রামে হুংকার ছাড়েন কবিতা আর সংগীতের বৈশাখী ঝড়ে। তাঁর সে সব শব্দ বিন্যাসের ভেতর লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একজন প্রেম ও দ্রোহের কবির মনো-আকাক্সক্ষা কীভাবে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে বিস্ফারিত হয়- কবির সে বিদ্রোহী কবিতা থেকে-

‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত,

আমি সেই দিন হব শান্ত’

এমন জগৎখ্যাত কবিতা বিশ্বের কোনো মহাকবিও লিখতে পারেনি যা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমূল্য রচনা সম্ভারের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী কবিতাটি।

যার মানবিক যাত্রাকাল শুরু হয়েছিলো প্রাচীনকালের কোনো এক অধরা অপ্সরার রূপলাবণ্যের মন্ত্রমুগ্ধ মধুর পুষ্পধারায়। যা কি না আজো সেভাবে বিকশিত হয়নি বিধায় আমরা আমাদের চিনতে কিংবা জানতে শিখিনি, আর যে জাতি নিজেকে জানতে বা বুঝতে শিখবে না সে কখনো বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখতে জানবে না। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কবির সে সুর ধরেই কিন্তু বাঙালির প্রতিটি গ্রামে-গ্রঞ্জে ঘরে ঘরে গিয়ে নিজ তাগিদেই জনমানুষকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন ধীরে ধীরে। আর সে কারণেই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন বাকরুদ্ধ কবিকে। তারই ধারাবাহিকতায় কবি’র একটি কবিতাকে বাংলাদেশের রণসংগীতের মর্যাদাও দেয়া হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। কবিতাটি যেমন- ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নি¤েœ উতলা ধরণীতল’। জাতীয় কবি নজরুলের যেসব গান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সেসবের মধ্যে রয়েছে দেশাত্মবোধক, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাংলা গজল এবং তাঁর রচিত হামদ-নাতের সংখ্যাও কম নয়। কবির যাপিত জীবনের কথা ভাবতে গেলে অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়, এতো উত্থান-পতনের মাঝেও তিনি কখনো দমে যাননি। জীবন চলার পথে বারবার হোঁচট খেয়েছেন, আবার রুখে দাঁড়িয়েছেন আপন শক্তিতে, নিজস্ব মহিমায়।

বিবেকের খোলা জানালায় সৃজনসাধনায় নিজেকে সারাক্ষণ সক্রিয় রেখেছেন এক অলৌকিক শক্তির মন্ত্রমুগ্ধ ধ্যান তপস্যায়- যা আজো বিস্মিত করে সচেতন পাঠককে। তিনি কীভাবে এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে এ বিপুল ঝড়োয়া সম্ভার রচনার ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে, এ চরম দুঃসহ যাপিত জীবনেও তিনি কীভাবে নিজেকে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে সর্বদা সম্পৃক্ত রেখেছেন! নজরুল নানা রঙে নানা ঢঙে গান রচনায় মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন- ‘তোর রূপে সই গাহন করে জুড়িয়ে গা’ কিংবা ‘সই ভালো করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে’ এবং ‘নয়ন যেন বারণ মানে না’ কবি’র এমন মনো আকর্ষণীয় সংগীতের বাণীতে গুঞ্জরণ ওঠে প্রেমিক যুগলের আনন্দ আড্ডায়। জীবনের গান গাইতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে যার আত্মার জমিন সেই তো বোঝে কেবল একজনমের অপমান অবহেলার মর্মবেদনা। কীভাবে একজন রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সচেতন কবিকে কুরে কুরে খায় পাওয়া না পাওয়ার অব্যক্ত বেদনার নিদারুণ অনল, যা ভাষায় বর্ণনা করা বড় কঠিন। নজরুল ওই সময় এতো দুঃখ-কষ্টের মাঝেও কাউকেই কখনো বুঝতে দেননি যে, তিনি বড় অভাব-দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন।

তাঁর সৃষ্টির ব্যাপক বিস্তারের ভেতর দিয়ে আমরা লক্ষ্য করি যে তিনি সুখে-দুঃখে সর্বক্ষণ মগ্ন থাকতেন সৃজন বেদনায়, প্রেম প্রণয়ের দারুণ পিপিসায়ও মশগুল থেকেছেন। যেমন- ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী’ কিংবা ‘চোখের নেশার ভালোবাসায়’ কবি তাঁর এমন অনেক গান কবিতার ছন্দ-তালে হৃদয় স্পন্দিত করেছেন, সুরের মায়া জালে আকৃষ্ট করেছেন সাধারণ পাঠকহৃদয়। রসিক নাগরের হৃদয় বীণায় বারবার অনুরণিত হয় প্রাণপাগল করা সংগীতের সুর বাণীতে। তাঁর চলনে বলনে এক রাজকীয় স্বভাবসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কিংবা পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় নজরুল গবেষকরা কীভাবে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এড়িয়েই শুধু যাননি এ বিষয়ে তেমন কোনো জোরালো ভূমিকাও কেউ নেননি বলে প্রতীয়মান হয়। বাঁধনহারা ভবঘুরে কবি’র জীবনের যেটুকু সফলতা অর্জিত হয়েছিলো তা কেবলমাত্র আশালতা সেন গুপ্ত ও তাঁর মা গিরিবালা দেবীর মায়া-মমতায় সোহাগ ভালোবাসায় এবং কবির আত্মবিশ্বাসের কারণে। নজরুল যে কান্না-হাসির অসীমাংসিত খেলাঘরে বসত গড়ে নিজেকে বারবার জানান দিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদী ধারার গান কবিতা রচনার মাধ্যমে। অল্প সময়ের মধ্যে তাই ওই দু’জন মহীয়সী মনীষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য নজরুলের সাহিত্য সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে শাশুড়ি শ্রীমতি গিরিবালা দেবী, কবিপত্নী আশালতা সেন গুপ্ত (প্রমীলার) মানবিক সহযোগিতা আর বিশ্বস্ত মনোবন্ধুর প্রেমের পরম পরশে।

প্রমীলার বাবা বসন্ত কুমার সেন গুপ্ত মারা যাওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে তাঁর মা গিরিবালা দেবী দোলনকে নিয়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় নামক স্থানে চলেন আসেন ১৯২০-২১ সালের দিকে সম্ভবত। মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রাম ছেড়ে আসার সে বেদনাবিধুর স্মৃতি মা-মেয়েকে দীর্ঘকাল ধরে আবেগাপ্লুত করেছে। জগতের কোনো মানুষই কিন্তু খুব সহজে নিজ জন্মগ্রামকে ভুলতে পারে না। কুমিল্লা শহরে থাকতেন দোলনের চাচা ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত তাঁরই ভাড়া বাসায় দোলনের সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয় এপ্রিল ১৯২১, ২২ চৈত্র ১৩২৬ সালের কোনো এক বসন্তের রোদেলা বিকেলে। প্রথম দেখাতেই নজরুল দোলনের প্রেমে মশগুল হয়ে যান। দোলনের কোকিল কালো চোখের মায়াবী আবাহনে কবিমন আনন্দে নেচে ওঠে আপনের প্রাণকাড়া লুকোচুরি খেলায়। দোলনের মনের বীণায়ও দোলা লাগে কবির প্রেমময় সাদর সম্ভাষণে উদাসী চোখের ভাষায়। নজরুলের মানবিক কথামালা আর জগৎজয়ের বিপুল বিস্তারে চমকিত হলো অত্র জনপদের তাবৎ বিদগ্ধজন। ওই আমলে হিন্দু-মুসলিমের বিবাহ বন্ধনের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারতেন না, বিধায় দোলনের মা গিরিবালা দেবীকে ভীষণ বিপদে পড়তে হয়েছিল।

একদিকে নজরুল দোলনের গভীর প্রেমের সম্পর্কের কথা চারিদিকে জানাজানি হওয়ার পর ঠিকভাবে চলাফেরাও ছিল বড় কষ্টকর। এ দুঃসাধ্যকে সাধনের আপ্রাণ চেষ্টায় দোলনের মা প্রাথমিকভাবে সফল হলেও তাদের বিবাহ দেওয়াটা বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণে গিরিবালা দেবীকে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কুমিল্লা ছেড়ে তারা চলে আসেন পশ্চিম বঙ্গের দূরসম্পর্কিত আত্মীয়ের বাসায়, এখানে এসে প্রথমেই বিষয়টি গোপন রাখা হয়, কারণ কেউ যেন বুঝতে না পারে যে একজন মুসলিমের সঙ্গে আশালতা সেন গুপ্ত (দোলনের) বিবাহের জন্য তারা এখানে কুমিল্লা থেকে পালিয়ে এসেছে। যদিও পরবর্তীতে বিষয়টি আর তেমন গোপন থাকেনি। ফলে নানা জনের নানা কথায় নজরুলের শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবীকে ভীষণভাবে মর্মাহত হতে হয়েছে, বহু অপমানও সইতে হয় তাকে। এসব নানা কারণে কবির দেয়া নাম প্রমীলা দেবীকেও কম কষ্ট সইতে হয়নি। সমাজের সকল অপমান-লাঞ্ছনার পরও কিন্তু দোলন এবং তার মা তারা দু’জনই কিন্তু নজরুলের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তা ধীরে ধীরে সকল বাধা বিপত্তিকে সামলিয়ে উঠেছিলেন বিশাল এক স্বপ্নজয়ের রাজপুত্রের অমীমাংসিত জীবনকাহিনী।

যা লিখতে গেলে রূপকথার গল্পকেও হার মানতে বাধ্য করবে, জীবন সংগ্রামী কবির চরম দুঃসময়ে যেভাবে নির্ভয়ে শুধু এগিয়ে এলেন না তা পুরোপুরি সফল সমাধানের রূপরেখা প্রণয়ন করলেন দোলন ও তার মা। নজরুলের নতুন সৃষ্টির উত্থানের পেছনের শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন দোলন ও তার মা। কবির এ নবজাগরণের ধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো আরেক নতুন ইতিহাস রচিত হতো। তা সম্ভব হয়নি ভাগ্য বিধাতার নিয়ন্ত্রিত নিয়তির ফলে কিংবা দুরারোগ্য পক্ষাঘাতের কবলে পড়ে শেষমেশ কবি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন- যা দেশপ্রেমী যে কোনো সচেতন মানুষকেই আবেগ আপ্লুত করে, ভীষণ ভাবায়; কী কারণে এমনটি হলো? প্রকৃতির এ লীলাখেলায় কারো কোনো হাত নেই জানি, তবুও এ আশাহত আহত ঈগলের মনের তারে হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় করে, কেন এমন হলো? হায় বিশ্ববিধি এ কেমন মনোযাতনায় ভোগে এক চির বাঁধনহারা উদাসী কবি’র মনোভূমি। কবি’র অসংখ্য সংগীতের শব্দকলায় বিবৃত হয়েছে মানব-মানবীর প্রেমের সুরঝঙ্কার, ঠিক তেমনিভাবে রচিত হয়েছে দেশপ্রেমের নতুন জাগরণের মর্মবাণী। তাঁর রচনায় মা-মাটি-মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধের হৃদয়ছেঁড়া সুর ও বাণী অনুরণিত হয়েছে বারবার যেমন ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি।’

সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার অনেক মাধ্যম থাকে, থাকে জীবনভাঙা সংগ্রামের অলিখিত ইতিহাস। সেক্ষেত্রে একজন কবি’র বেলায় এমন নিদারুণ মনভাঙা নিঃশব্দ রোদনের কষ্টকরুণ মর্মগাথায় দখিনা বাতাসও বুঝি গতিহারায়! স্রোতাস্বীনি- কালিন্দী আর উত্তাল সুনীল পাথারও নাকি স্তম্ভিত হয় এক উদাসী ক্ষেপাবাউলের শিকল ভাঙার দ্রোহী গর্জনে। একজন প্রকৃত কবির মনোকষ্ট যখন বিশ্বমানবতার মুক্তির ধ্যানমগ্ন তপস্যায় একাকার হয়ে যায় তখন সে মনে মনে হাসে আর ভাবে চৈত্রদাহে পোড়া শ্যামল মাটির বুকে এ বুঝি আচমকা ফুটে উঠলো তার সারাজনমের সাধনার চম্পাকলি-দোলনচাঁপা কিংবা ভালোবাসার রঙিন গোলাপ। যে ফুলেল মালা পড়াবার মনোআকাক্সক্ষা বহু জনমের, সে রূপবতী রূপসীর দীঘল কেশের খোঁপায় পড়াবে লাল-কালো গোলাপের সুমধুর ঘ্রাণের সুরভিত ছন্দে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কিছু একটা লেখা এ সর্বস্ব হারানোর মর্মবেদনায় বুকভাঙা কষ্টে জর্জরিত দুর্ভাগার কোনোভাবে সম্ভব নয়। তারপরও কবি বলে কথা, কিছু একটা লেখার অপচেষ্টা করতে তো আর বাধা নেই।

কেনো জানি আমার বারবার মনে হয়েছে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বিদ্রোহী কবি নজরুলের কবিতা থেকেও অনেক বেশি মনোআকর্ষণীয় তাদের সংগীত। তারা দু’জনই কবিতা, গদ্য ও অন্যান্য সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে নিজেদের গূঢ় গভীরভাবে জড়িয়ে না রাখলেও শুধু সংগীতের প্রাণকাড়া সুরবাণী কাল-কালান্তরে অতীব উজ্জ্বল কালপুরুষের অসামান্য প্রভায় সচেতন নাগরিকের মনোলোকে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। বাঙালি মানসে দোল খাবে অনন্তকাল তাদের মানবিয়ার-মরমিয়া সুরধ্বনি। আমাদের জাগ্রত করবে তাদের অমূল্য সৃজনের শৈল্পীক শব্দকলায়। উজ্জ্বল আগামীর বীরতারুণ্যের মনোমাঠে স্বপ্নজাগাবে নজরুলের অসাধারণ গান-কবিতায় প্রেমকহনের মনোআকর্ষণীয় সৌন্দর্যের সপ্তকলায়। বাঙালির ত্যাগের যে মহিমান্বিত উজ্জ্বল অতীত রয়েছে তা বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল। নজরুল সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন এই বলে যে, বাঙালি জাতির যে অনন্য গর্বিত ইতিহাস রয়েছে, জগতে এমনটি অন্য জাতির আছে বলে কবি’র জানা নেই।

সময় এসেছে, আমাদের মেধাসিক্ত বীরতারুণ্যের দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে- নিজেকে জানবো, নিজেকে জানাবো এ সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ভেতর রচনা করতে হবে উজ্জ্বল আগামীর সোনালি সড়ক। তাদের সকলকেই দলবদ্ধভাবে বিশ্বের তাবৎ লোকালয় যে জ্ঞান অন্বেষণে নিজস্ব তাগিদেই বেরিয়ে পড়তে হবে নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের লক্ষ্যে। আমরা যদি কবি নজরুলের জীবন সংগ্রামের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই! তাঁর জীবন শুরু হয়েছিলো মক্তবের শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তাঁকে অভাবের তাড়নায় রুটির দোকানে স্বল্প বেতনের চাকরি করতে হয়েছে, লেটোদলে গান গাইতে হয়েছে এবং কি তারই নিজের লেখায় সুর দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে পায়ে হেঁটে বেড়ায়েছেন সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে কি আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর। এসব প্রতিবাদী ধারার গান-কবিতার জন্য তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে, এখন আমরা যাকে বলে থাকি যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। সে ব্রিটিশ বিরোধী সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক আন্দোলনকে সামনে রেখে কবিতা লিখতে গিয়েও নজরুলকে কারাগারের অন্ধ সেলে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে।

তাঁর সেসব গান-কবিতায় আজো সচেতন নাগরিক সমাজকে আন্দোলিত ও আলোড়িত করে আর দেশপ্রেমে মানুষকে জাগরণের প্রেরণা যোগায়। যেমন ‘মোরা ঝর্নার মতো চঞ্চল, মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়’ কিংবা ‘দুুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে’... একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কবির অনেক গান-কবিতায় বীরগেরিলা- মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসের দীপ্তপ্রভায় করেছেন বলিয়ান। এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তখনকার বড় বড় রাজনৈতিক নেতার থেকে কবি নজরুলের ভূমিকা কোনো অংশেই কম ছিলো না বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবির প্রতিবাদী ধারার রচনা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করার গৌরব অর্জন করেছে। তিনি যখন লেখেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/ রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণবেদি’ কিংবা ‘লাথি মার ভাঙ রে তালা/ যত সব বন্দিশালায়/ আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা /ফেল উপাড়ি’। কবি নজরুল একদিকে যেমন বিদ্রোহী তাঁর চলনে বলনে রচনায়, অন্যদিকে সে মহাপ্রেমীও বটে, তাঁর সে প্রেম ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়ে কখনো কখনো দেশপ্রেম আর মানব প্রেমের শব্দশৈলীতে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন তাঁর কাব্যভুবন। তিনি আগা-গোড়া একজন রাজনৈতিক সচেতন কবি হিসেবেও খ্যাতির স্বর্ণচূড়ায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন।

তিনি বিদ্রোহী কবিতায় যখন লেখেন ‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’ কিংবা ‘মহাবিশ্বের রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত’। তাঁর পাশাপাশি তিনি লিখেছেন আধ্যাত্মিক প্রেমের অমর সংগীত ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়’। তাঁর সবচে জনপ্রিয় বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষের মনোলোকে সেটি যেভাবে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে ভীষণ গতিতে সঞ্চারিত হতে লাগলো- তা আজকের পারমাণবিক দানবীয় ত্রাসের যুগে এসেও কি তা ভাবা যায়? তাঁর মনের গভীরে লালিত স্বপ্নকলা রাঙিয়ে তুলবে যে প্রেমপিপাসু কোনো এক কাম-কামিনী-মালতি মালঞ্চের নির্জন কুঞ্জবনে। কবি ভাবেন আর হাসেন এ কেমন পিপাসার ঢেউ ভাঙে মনের অতলে! আত্মভোলা উদাসী কবির চোখে দারুণ সুন্দরের পদ্মপরাগ আচমকা দুলে ওঠে দখিণা বাতাসে আর তখনই তিনি লিখেন ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ’।

কবি নজরুলের এমন অনেক জনপ্রিয় সংগীত আজো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় আনন্দ-বেদনায়, হাসি কান্নায়। এ প্রেমার্দ কবির মনোতপস্যায় বারবার উচ্চারিত হয় মানবতার অমরগাথা। তাঁর জনপ্রিয় গান-কবিতা বাঙালির দ্রোহী মানসপটে নিরন্তর প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। দেশপ্রেম আর মানব প্রেমের সুরধারা আজো বাঙালির অন্তর্লোক স্পন্দিত করে। ব্যতিক্রমধারার প্রাজ্ঞ এই দার্শনিক কবি ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তোলেন আলোকিত আগামী গড়ার প্রেরণায়। তাঁর স্বল্প সময়ের সৃষ্টিশীল রচনা সম্ভারে আজো বিবেকবান মানুষ চমকিত হয়। বাঙালি তাকে তাঁর অমর সৃষ্টিশৈলির জন্য স্মরণ করে এবং স্মরণ করবে অনন্তকাল ধরে।

image

কাজী নজরুল ইসলাম / জন্ম : ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ (২৪ মে ১৮৯৯); মৃত্যু : ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ (২৯ আগস্ট ১৯৭৬)

আরও খবর
নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক
কবি কাজী নজরুল ও কাজী মোতাহার প্রসঙ্গ
সাময়িকী কবিতা
খেলা
এপার-ওপার
ভূমধ্যসাগরের রত্নময়ী আলেকজান্দ্রিয়ায়
কবিতাগুচ্ছ

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০

ক্ষেপাবাউল বিদ্রোহী বীর বাঁধনহারা

শাফিকুর রাহী

image

কাজী নজরুল ইসলাম / জন্ম : ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ (২৪ মে ১৮৯৯); মৃত্যু : ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ (২৯ আগস্ট ১৯৭৬)

কবিতার বরপুত্র সংগীতের মুকুটহীন সম্রাট বিদ্রোহের লাভায় প্রজ্জ্বলিত এক মানবিক মহান দেশপ্রেমী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অসাধারণ গানের বাণী আর সুরদ্যোতনায় মনোমুগ্ধ নান্দনিক জাদুকরী শব্দকলায় উপমহাদেশীয় বিদগ্ধজনের মনোমন্দিরে ভালোলাগা আর ভালোবাসার স্বপ্নবীজ বপন করেছিলেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তিনি যেমন বিদ্রোহী কবি হিসেবে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন, তার পাশাপাশি তিনি যে এক মহাপ্রেমিক ছিলেন তাঁর সৃজনশীল কর্মপ্রয়াসের ভেতর আমরা তা লক্ষ্য করে থাকি। তাঁর গানের সুরে ও কথামালার ভেতর দিয়ে তিনি প্রেমার্দ মানুষের মনোলোকে মন্ত্রমুগ্ধ সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছেন। যার মহত্তম সৃজনকলায় উতলা হয়েছে বহু প্রেমিকযুগল। কেউ প্রেমের জলসাঘরে হয়েছে আত্মহারা। কখনো কখনো সেটি নিজেকে ছাড়িয়ে দেশ দেশান্তরে অমরত্ব লাভ করেছে। তিনি মূলত বিদ্রোহী কবি হলেও তাঁর প্রেমেও যেন আমরা সে দ্রোহের বাণী শুনতে পাই। জানতে পারি তাঁর অভিমানী কণ্ঠকারুকলায় কীভাবে নিজের ভেতর পরম ভালোবাসার আকুতিকে প্রকাশ করেছেন মনমাতানো সংগীতের রূপরসে এক অনন্য সৃষ্টিসাধনায় নিজেকে আবিষ্কারের রুদ্ধ পথকে তিনি অতিক্রম করেছেন বহু জঞ্জালকে মাড়িয়ে আলোর পথের দিশারী হয়ে, দুর্বিসহ মনোযাতনার বিষবাষ্পে বাকরুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন মানবতার মুক্তির স্বকীয়তায় তেজদীপ্ত বাচনভঙ্গীতে।

বাঙালির মানসময়দানে তিনি এক উদাসী বাউল বেশে গেয়ে গেছেন সম্প্রীতির মহাবন্ধনের অমর কারুকাজের ভেতর নন্দনতত্ত্বের শিলালিপিতে। কখনো কখনো তাঁর কবি সত্তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন গানের বাণীতে আবেগীয় শব্দ চয়নে। তিনি অনেক বড়ো মাপের সুর সংগীতস্রষ্টা এক দ্রোহীমনীষী। যেমন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক অসাধারণ অন্ত্যমিল উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে জানান দিয়েছেন প্রকৃতির সৌন্দর্য ছাড়া রূপরঙবিহীন বিলকুল বেমানান মানুষের মনোলোকেও বাজে না আর প্রাণপাপিয়ার পিওপিও মধুর সুর। কী গভীর মনোবেদনায় অভিমানের সুরে রচনা করেন ‘আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান, বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান।’ প্রাণপ্রিয় কবি আপনার এ অভিমানের বেদনা বিদ্রোহী বিহগের আবেগীয় সুরবাণী সঠিক নয়, তা আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে। কারণ আপনাকে ভুলে যাবে এমন সভ্য সচেতন বাঙালি কিংবা বিশ্বের যে কোনো বিদগ্ধজনও কি কখনো আপনাকে ভোলার সে শক্তি সাহস রাখে? না, মোটেও না। আপনি অনন্তকাল মানুষের মনে আনন্দ আসরে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাঠে দারুণ ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তি ছড়াবেন আপন মহিমায় সৃজনের কহনকথায়। বাংলা গজলের প্রাণকাড়া নন্দিত সুর সংগীতে বেহালার মনমাতানো কুহকী-আকর্ষণে মানুষের মনে প্রেরণা যোগাবে কাল-কালান্তরে।

তিনি যখন লেখেন- ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে’। এ অসামান্য সংগীত রচনার সময় তিনি প্রকৃতির ভেতর এমনিভাবে প্রবেশ করেছেন যে, বাহিরে ঘরের চালায় কিংবা বৃক্ষশাখে মুশলধারায় বৃষ্টির স্বপ্নজাগানিয়া প্রাণকাঁপানো শরীর ও মনের ব্যাকুল আকুতি লক্ষ্য করা যায়। এমন অনেক অসাধারণ সুর ও বাণীতে মাতোয়ারা করেছেন দশদিগন্ত, রসিক নাগরিকের পুষ্পিত মনোউদ্যান। তিনি যখন লেখেন ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল’। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের মনোআকাক্সক্ষার গহীন বন-বনানীতে, বসন্ত বউরির কণ্ঠের সুরধ্বনিতে আপনার সংগীতের রমণীয় মানবিয়ার মধুর স্মৃতির ক্যাম্পাসে বারবার বেজে উঠবে নবজাগরণের স্বপ্নজাগানিয়া গানের অমর বাণী। তার বৈচিত্র্যময় বিচিত্রধারার কাব্যতরুলতায় আর সুর ও সংগীতের ঝংকারে নেচে উঠেছিলো দোলন চাঁপার মনোবীণার তার। সে উদাসী হাওয়ার অনল বানে কোন সোহাগীর অধরা অধরে-চোখের পদ্মপরাগে ভালোবাসার আলো-আঁধারে কাঁপন জাগায়? সে মনহরিণী শ্যামলিমা মানবীয়াকে নিয়ে তখন কবি লিখেন ‘চেওনা সুনয়না আর চেওনা এ নয়ন পানে’। তাঁর অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের বিদ্রোহী কবিতায় আমরা যেমনটি লক্ষ্য করে থাকি প্রেমের গান কবিতায়ও সে রকমটি অনুভব করা যায় যেমন- ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো’ কিংবা ‘আলগা করোগো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি’।

সৃষ্টির উন্মাদনায় ছিলেন মশগুল, আপন মহিমায় রচনা করেন

বীরবাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার গর্বিত উপাখ্যান। তার স্বপ্ন ও সম্ভাবনার স্বাবলীল সৃজন উপস্থাপনায় জয়বাংলার বিজয় কেতন উড়িয়ে দশদিগন্ত মাতিয়ে তুলেছিলেন বিদ্রোহী বীর কাব্য সৈনিক। জগৎখ্যাত সংগীতের সুর বাণীতে গণমানুষকে জাগ্রত করার প্রয়াসে লিখেন ‘জাগো অমৃত পিয়াসী’ কিংবা ‘জয় হোক সত্যের জয়’। এমন প্রতিবাদী ধারার গান-কবিতায় সাধারণ লোকজনও কিন্তু খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে নজরুলকে সমর্থন করেছেন। অনেক সময় একসঙ্গে জেগেও উঠেছেন মানবতার মুক্তির মিছিলে আবহমান বাংলার লোকায়িত শব্দালংকারে দরদী মনের গাঁথুনিতে প্রকাশ করেন অসাধারণ সৃষ্টিসাধক বিদ্রোহী বীর নজরুল। এমন অনেক আবেগীত সংগীতকলায় পাঠক হৃদয়ে তোলপাড় তোলে, চারিদিকে গুঞ্জরণ ওঠে- এয়ছা কেয়ছা প্রেমী হায় ভাইয়া’! আদতেই মহৎপ্রেমী ছাড়া এ ধরনের দ্রোহী কবিতা রচনা কোনোভাবেই সম্ভম নয় কিংবা গানের বেলায়ও সে একই কথা আসবে। বস্তুত যে যতো বেশি বিদ্রোহী সে ততবেশি প্রেমীও বটে।

যে কবি’র মনাকাশে প্রেম বিরহের মানবীয় সুর বেজে ওঠে মনোআকাক্সক্ষায় অজানা-অচেনা প্রান্তরে উড়ে-ঘুরে বেড়াবেন বলে। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি’ তাঁর সৃজনসাধনায় বারবার উচ্চারিত বিরহ বিচ্ছেদের সুর-বাণী আর ভালোবাসার আলো-আঁধারে তিনি নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন, বহুমাত্রিকতায় তা প্রকাশের ব্যাকুল আকুতিও লক্ষ্য করা যায় তার নিজস্ব ভাষাশৈলীতে সুন্দরের অপূর্ব বাঁশরী সুরে। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম আমাদের অমূল্য সম্পদ, তাঁকে যতো বেশি পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে ততই জাতির জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের অমর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানতে হলে সমাজের সচেতন নাগরিককে নজরুলকে আবিষ্কার করতে হবে নতুন করে নতুনভাবে।

অজস্র অমূল্য সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে আমাদের চোখের আড়ালে। আমরা সেসব আবিষ্কারের ভেতর দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেবো বাঙালির গর্বিত সমস্ত শিল্পকলার অসামান্য কৃতিত্বের চিত্রপট কতোটা গভীর ও রমণীয় রূপরসে ভরপুর। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়- নয় কিছু মহীয়ান গাহি সাম্যের গান...। সৃজন বেদনায় কেউ আছে না, কাতর হয়ে পড়ে, নজরুল ছিলো তার ঠিক বিপরীত তিনি সৃজন বেদনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন। বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামের বসন্ত কুমার সেন গুপ্ত আর গিরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান আশালতা সেন গুপ্ত (দোলন) কবি নজরুলের সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হয় ২৫ এপ্রিল ১৯২৪ পশ্চিমবঙ্গের এক নিকট আত্মীয়ের বাসায়। তাদের দু’জনের সে গভীর প্রেম সম্পর্কে নানাজন নানাভাবে লিখলেও আজো হয়তো অনেক অজানা তথ্য রয়ে গেছে গুপ্তধনের মতো নজরুল গবেষকদের চোখের আড়ালে। আজকে আমি সে অজানা তথ্য প্রকাশের জন্য লিখতেও বসিনি। আমার লেখার বিষয় বিদ্রোহী কবির মনমাতানো প্রাণ কাঁপানো গানের সুর-বাণী এবং তার জীবনের ঘটে যাওয়া প্রেমময় মধুর স্মরলিপির ক্ষুদ্র একটি অংশের উপর লেখার যতসামান্য চেষ্টা করবো।

বাঁধনহারা কবির গভীর গোপন প্রেমের মালা কোন রূপসী মায়াবীর ভাগ্যললাটে বাঁধা হবে এ নিয়ে কবির মনে তোলপাড় তোলে। তিনি প্রথম দেখায় হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন যে শ্যামলিমা বালিকার মন্ত্রমুগ্ধ প্রেমের জাদুকরী আকর্ষণে তার নাম আশালতা সেনগুপ্ত, কবির দেয়া নাম প্রমীলা। যদিও তাঁর কুমিল্লায় আসা হয় পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে- তাঁরই আমন্ত্রণে। বিদগ্ধজনের আলোচনায় সমালোচনায় জানা যায়, আলী আকবর খান খুব চালাক মানুষ ছিলেন বিধায় তারই ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস-এর সঙ্গে নজরুলের বিয়ের আয়োজনও করেছিলেন। নিয়তির এক অলৌকিক বিধানের বাহিরে যাওয়ার কারোরই সুযোগ নেই বলেই হয়তো সে বিয়ে বাড়ির সাজসাজ রঙ তামাশায় মুহূর্তেই নিরাশার অন্ধকারে সব ঢেকে যায়। কারণ আকবর সাহেবের সঙ্গে তাঁর ভাগ্নির একটি রুমে কী এক গোপন আলাপকালে নজরুল সেটি নিজ চোখে দেখার পর আর এক মুহূর্তও ওখানে থাকেননি। নজরুলের সঙ্গে ছিলেন বোধহয় দোলনের মা- আর চাচাত ভাই। নজরুলের চোখে বর্ষণধারা দেখতে পেয়ে তারা দু’জনও কবির সঙ্গে নৌকাযোগে ওই বাড়ি ত্যাগ করেন লুকিয়ে খুব গোপনে। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টিমুখর রাতের আঁধারে তারা দৌলতপুর ছেড়ে চলে আসেন কুমিল্লার কান্দির পাড়ে। এখানে আসার পর দোলনের মায়ের আদর সোহাগে কবি মুগ্ধ।

তাই অনেকদিন ছিলেন এ বাসায়। সেই থেকে অনেকবার নজরুল কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের দোলনের বাসায় বেড়াতে এসেছেন- কবি’র উদাসী মন বোধহয় খুঁজে পেয়েছিলো মায়ের মমতামাখানো স্নেহের পরশ আর দোলনের মধুর প্রেমেমগ্ন এক বাঁধনহারা পথ ভুলে পথের সন্ধানে গেয়ে উঠেন জীবনজয়ের গান। দেশপ্রেম-নারী প্রেম আর ঈশ্বরপ্রেমে বেহুঁশ বেভুল না হলে হয়তো কোনো মানুষই সৃষ্টির অপূর্ব সৌন্দর্যের রূপরসে সৃজনবেদনায় উল্কাবেগে ছুটে চলতে পারে না কখনো বাধার আঁধার ভাঙার নেশায়। নজরুল ছোট বেলায় যেভাবে অভাবের তাড়নায়-ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েও বাধাগ্রস্ত হয়েছেন, এতো কিছুর পরও তিনি কখনো দমে যাননি, কারণ তিনি লড়াই করেই জয়ী হবার প্রত্যয়ে বীরের বেশে সকল অন্যায় অনিয়মের নিয়ম ভাঙার সংগ্রামে হুংকার ছাড়েন কবিতা আর সংগীতের বৈশাখী ঝড়ে। তাঁর সে সব শব্দ বিন্যাসের ভেতর লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একজন প্রেম ও দ্রোহের কবির মনো-আকাক্সক্ষা কীভাবে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে বিস্ফারিত হয়- কবির সে বিদ্রোহী কবিতা থেকে-

‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত,

আমি সেই দিন হব শান্ত’

এমন জগৎখ্যাত কবিতা বিশ্বের কোনো মহাকবিও লিখতে পারেনি যা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমূল্য রচনা সম্ভারের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী কবিতাটি।

যার মানবিক যাত্রাকাল শুরু হয়েছিলো প্রাচীনকালের কোনো এক অধরা অপ্সরার রূপলাবণ্যের মন্ত্রমুগ্ধ মধুর পুষ্পধারায়। যা কি না আজো সেভাবে বিকশিত হয়নি বিধায় আমরা আমাদের চিনতে কিংবা জানতে শিখিনি, আর যে জাতি নিজেকে জানতে বা বুঝতে শিখবে না সে কখনো বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখতে জানবে না। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কবির সে সুর ধরেই কিন্তু বাঙালির প্রতিটি গ্রামে-গ্রঞ্জে ঘরে ঘরে গিয়ে নিজ তাগিদেই জনমানুষকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন ধীরে ধীরে। আর সে কারণেই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন বাকরুদ্ধ কবিকে। তারই ধারাবাহিকতায় কবি’র একটি কবিতাকে বাংলাদেশের রণসংগীতের মর্যাদাও দেয়া হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। কবিতাটি যেমন- ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নি¤েœ উতলা ধরণীতল’। জাতীয় কবি নজরুলের যেসব গান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সেসবের মধ্যে রয়েছে দেশাত্মবোধক, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাংলা গজল এবং তাঁর রচিত হামদ-নাতের সংখ্যাও কম নয়। কবির যাপিত জীবনের কথা ভাবতে গেলে অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়, এতো উত্থান-পতনের মাঝেও তিনি কখনো দমে যাননি। জীবন চলার পথে বারবার হোঁচট খেয়েছেন, আবার রুখে দাঁড়িয়েছেন আপন শক্তিতে, নিজস্ব মহিমায়।

বিবেকের খোলা জানালায় সৃজনসাধনায় নিজেকে সারাক্ষণ সক্রিয় রেখেছেন এক অলৌকিক শক্তির মন্ত্রমুগ্ধ ধ্যান তপস্যায়- যা আজো বিস্মিত করে সচেতন পাঠককে। তিনি কীভাবে এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে এ বিপুল ঝড়োয়া সম্ভার রচনার ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে, এ চরম দুঃসহ যাপিত জীবনেও তিনি কীভাবে নিজেকে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে সর্বদা সম্পৃক্ত রেখেছেন! নজরুল নানা রঙে নানা ঢঙে গান রচনায় মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন- ‘তোর রূপে সই গাহন করে জুড়িয়ে গা’ কিংবা ‘সই ভালো করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে’ এবং ‘নয়ন যেন বারণ মানে না’ কবি’র এমন মনো আকর্ষণীয় সংগীতের বাণীতে গুঞ্জরণ ওঠে প্রেমিক যুগলের আনন্দ আড্ডায়। জীবনের গান গাইতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে যার আত্মার জমিন সেই তো বোঝে কেবল একজনমের অপমান অবহেলার মর্মবেদনা। কীভাবে একজন রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সচেতন কবিকে কুরে কুরে খায় পাওয়া না পাওয়ার অব্যক্ত বেদনার নিদারুণ অনল, যা ভাষায় বর্ণনা করা বড় কঠিন। নজরুল ওই সময় এতো দুঃখ-কষ্টের মাঝেও কাউকেই কখনো বুঝতে দেননি যে, তিনি বড় অভাব-দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন।

তাঁর সৃষ্টির ব্যাপক বিস্তারের ভেতর দিয়ে আমরা লক্ষ্য করি যে তিনি সুখে-দুঃখে সর্বক্ষণ মগ্ন থাকতেন সৃজন বেদনায়, প্রেম প্রণয়ের দারুণ পিপিসায়ও মশগুল থেকেছেন। যেমন- ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী’ কিংবা ‘চোখের নেশার ভালোবাসায়’ কবি তাঁর এমন অনেক গান কবিতার ছন্দ-তালে হৃদয় স্পন্দিত করেছেন, সুরের মায়া জালে আকৃষ্ট করেছেন সাধারণ পাঠকহৃদয়। রসিক নাগরের হৃদয় বীণায় বারবার অনুরণিত হয় প্রাণপাগল করা সংগীতের সুর বাণীতে। তাঁর চলনে বলনে এক রাজকীয় স্বভাবসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কিংবা পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় নজরুল গবেষকরা কীভাবে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এড়িয়েই শুধু যাননি এ বিষয়ে তেমন কোনো জোরালো ভূমিকাও কেউ নেননি বলে প্রতীয়মান হয়। বাঁধনহারা ভবঘুরে কবি’র জীবনের যেটুকু সফলতা অর্জিত হয়েছিলো তা কেবলমাত্র আশালতা সেন গুপ্ত ও তাঁর মা গিরিবালা দেবীর মায়া-মমতায় সোহাগ ভালোবাসায় এবং কবির আত্মবিশ্বাসের কারণে। নজরুল যে কান্না-হাসির অসীমাংসিত খেলাঘরে বসত গড়ে নিজেকে বারবার জানান দিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদী ধারার গান কবিতা রচনার মাধ্যমে। অল্প সময়ের মধ্যে তাই ওই দু’জন মহীয়সী মনীষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য নজরুলের সাহিত্য সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে শাশুড়ি শ্রীমতি গিরিবালা দেবী, কবিপত্নী আশালতা সেন গুপ্ত (প্রমীলার) মানবিক সহযোগিতা আর বিশ্বস্ত মনোবন্ধুর প্রেমের পরম পরশে।

প্রমীলার বাবা বসন্ত কুমার সেন গুপ্ত মারা যাওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে তাঁর মা গিরিবালা দেবী দোলনকে নিয়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় নামক স্থানে চলেন আসেন ১৯২০-২১ সালের দিকে সম্ভবত। মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রাম ছেড়ে আসার সে বেদনাবিধুর স্মৃতি মা-মেয়েকে দীর্ঘকাল ধরে আবেগাপ্লুত করেছে। জগতের কোনো মানুষই কিন্তু খুব সহজে নিজ জন্মগ্রামকে ভুলতে পারে না। কুমিল্লা শহরে থাকতেন দোলনের চাচা ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত তাঁরই ভাড়া বাসায় দোলনের সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয় এপ্রিল ১৯২১, ২২ চৈত্র ১৩২৬ সালের কোনো এক বসন্তের রোদেলা বিকেলে। প্রথম দেখাতেই নজরুল দোলনের প্রেমে মশগুল হয়ে যান। দোলনের কোকিল কালো চোখের মায়াবী আবাহনে কবিমন আনন্দে নেচে ওঠে আপনের প্রাণকাড়া লুকোচুরি খেলায়। দোলনের মনের বীণায়ও দোলা লাগে কবির প্রেমময় সাদর সম্ভাষণে উদাসী চোখের ভাষায়। নজরুলের মানবিক কথামালা আর জগৎজয়ের বিপুল বিস্তারে চমকিত হলো অত্র জনপদের তাবৎ বিদগ্ধজন। ওই আমলে হিন্দু-মুসলিমের বিবাহ বন্ধনের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারতেন না, বিধায় দোলনের মা গিরিবালা দেবীকে ভীষণ বিপদে পড়তে হয়েছিল।

একদিকে নজরুল দোলনের গভীর প্রেমের সম্পর্কের কথা চারিদিকে জানাজানি হওয়ার পর ঠিকভাবে চলাফেরাও ছিল বড় কষ্টকর। এ দুঃসাধ্যকে সাধনের আপ্রাণ চেষ্টায় দোলনের মা প্রাথমিকভাবে সফল হলেও তাদের বিবাহ দেওয়াটা বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণে গিরিবালা দেবীকে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কুমিল্লা ছেড়ে তারা চলে আসেন পশ্চিম বঙ্গের দূরসম্পর্কিত আত্মীয়ের বাসায়, এখানে এসে প্রথমেই বিষয়টি গোপন রাখা হয়, কারণ কেউ যেন বুঝতে না পারে যে একজন মুসলিমের সঙ্গে আশালতা সেন গুপ্ত (দোলনের) বিবাহের জন্য তারা এখানে কুমিল্লা থেকে পালিয়ে এসেছে। যদিও পরবর্তীতে বিষয়টি আর তেমন গোপন থাকেনি। ফলে নানা জনের নানা কথায় নজরুলের শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবীকে ভীষণভাবে মর্মাহত হতে হয়েছে, বহু অপমানও সইতে হয় তাকে। এসব নানা কারণে কবির দেয়া নাম প্রমীলা দেবীকেও কম কষ্ট সইতে হয়নি। সমাজের সকল অপমান-লাঞ্ছনার পরও কিন্তু দোলন এবং তার মা তারা দু’জনই কিন্তু নজরুলের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তা ধীরে ধীরে সকল বাধা বিপত্তিকে সামলিয়ে উঠেছিলেন বিশাল এক স্বপ্নজয়ের রাজপুত্রের অমীমাংসিত জীবনকাহিনী।

যা লিখতে গেলে রূপকথার গল্পকেও হার মানতে বাধ্য করবে, জীবন সংগ্রামী কবির চরম দুঃসময়ে যেভাবে নির্ভয়ে শুধু এগিয়ে এলেন না তা পুরোপুরি সফল সমাধানের রূপরেখা প্রণয়ন করলেন দোলন ও তার মা। নজরুলের নতুন সৃষ্টির উত্থানের পেছনের শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন দোলন ও তার মা। কবির এ নবজাগরণের ধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো আরেক নতুন ইতিহাস রচিত হতো। তা সম্ভব হয়নি ভাগ্য বিধাতার নিয়ন্ত্রিত নিয়তির ফলে কিংবা দুরারোগ্য পক্ষাঘাতের কবলে পড়ে শেষমেশ কবি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন- যা দেশপ্রেমী যে কোনো সচেতন মানুষকেই আবেগ আপ্লুত করে, ভীষণ ভাবায়; কী কারণে এমনটি হলো? প্রকৃতির এ লীলাখেলায় কারো কোনো হাত নেই জানি, তবুও এ আশাহত আহত ঈগলের মনের তারে হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় করে, কেন এমন হলো? হায় বিশ্ববিধি এ কেমন মনোযাতনায় ভোগে এক চির বাঁধনহারা উদাসী কবি’র মনোভূমি। কবি’র অসংখ্য সংগীতের শব্দকলায় বিবৃত হয়েছে মানব-মানবীর প্রেমের সুরঝঙ্কার, ঠিক তেমনিভাবে রচিত হয়েছে দেশপ্রেমের নতুন জাগরণের মর্মবাণী। তাঁর রচনায় মা-মাটি-মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধের হৃদয়ছেঁড়া সুর ও বাণী অনুরণিত হয়েছে বারবার যেমন ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি।’

সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার অনেক মাধ্যম থাকে, থাকে জীবনভাঙা সংগ্রামের অলিখিত ইতিহাস। সেক্ষেত্রে একজন কবি’র বেলায় এমন নিদারুণ মনভাঙা নিঃশব্দ রোদনের কষ্টকরুণ মর্মগাথায় দখিনা বাতাসও বুঝি গতিহারায়! স্রোতাস্বীনি- কালিন্দী আর উত্তাল সুনীল পাথারও নাকি স্তম্ভিত হয় এক উদাসী ক্ষেপাবাউলের শিকল ভাঙার দ্রোহী গর্জনে। একজন প্রকৃত কবির মনোকষ্ট যখন বিশ্বমানবতার মুক্তির ধ্যানমগ্ন তপস্যায় একাকার হয়ে যায় তখন সে মনে মনে হাসে আর ভাবে চৈত্রদাহে পোড়া শ্যামল মাটির বুকে এ বুঝি আচমকা ফুটে উঠলো তার সারাজনমের সাধনার চম্পাকলি-দোলনচাঁপা কিংবা ভালোবাসার রঙিন গোলাপ। যে ফুলেল মালা পড়াবার মনোআকাক্সক্ষা বহু জনমের, সে রূপবতী রূপসীর দীঘল কেশের খোঁপায় পড়াবে লাল-কালো গোলাপের সুমধুর ঘ্রাণের সুরভিত ছন্দে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কিছু একটা লেখা এ সর্বস্ব হারানোর মর্মবেদনায় বুকভাঙা কষ্টে জর্জরিত দুর্ভাগার কোনোভাবে সম্ভব নয়। তারপরও কবি বলে কথা, কিছু একটা লেখার অপচেষ্টা করতে তো আর বাধা নেই।

কেনো জানি আমার বারবার মনে হয়েছে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বিদ্রোহী কবি নজরুলের কবিতা থেকেও অনেক বেশি মনোআকর্ষণীয় তাদের সংগীত। তারা দু’জনই কবিতা, গদ্য ও অন্যান্য সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে নিজেদের গূঢ় গভীরভাবে জড়িয়ে না রাখলেও শুধু সংগীতের প্রাণকাড়া সুরবাণী কাল-কালান্তরে অতীব উজ্জ্বল কালপুরুষের অসামান্য প্রভায় সচেতন নাগরিকের মনোলোকে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। বাঙালি মানসে দোল খাবে অনন্তকাল তাদের মানবিয়ার-মরমিয়া সুরধ্বনি। আমাদের জাগ্রত করবে তাদের অমূল্য সৃজনের শৈল্পীক শব্দকলায়। উজ্জ্বল আগামীর বীরতারুণ্যের মনোমাঠে স্বপ্নজাগাবে নজরুলের অসাধারণ গান-কবিতায় প্রেমকহনের মনোআকর্ষণীয় সৌন্দর্যের সপ্তকলায়। বাঙালির ত্যাগের যে মহিমান্বিত উজ্জ্বল অতীত রয়েছে তা বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল। নজরুল সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন এই বলে যে, বাঙালি জাতির যে অনন্য গর্বিত ইতিহাস রয়েছে, জগতে এমনটি অন্য জাতির আছে বলে কবি’র জানা নেই।

সময় এসেছে, আমাদের মেধাসিক্ত বীরতারুণ্যের দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে- নিজেকে জানবো, নিজেকে জানাবো এ সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ভেতর রচনা করতে হবে উজ্জ্বল আগামীর সোনালি সড়ক। তাদের সকলকেই দলবদ্ধভাবে বিশ্বের তাবৎ লোকালয় যে জ্ঞান অন্বেষণে নিজস্ব তাগিদেই বেরিয়ে পড়তে হবে নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের লক্ষ্যে। আমরা যদি কবি নজরুলের জীবন সংগ্রামের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই! তাঁর জীবন শুরু হয়েছিলো মক্তবের শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তাঁকে অভাবের তাড়নায় রুটির দোকানে স্বল্প বেতনের চাকরি করতে হয়েছে, লেটোদলে গান গাইতে হয়েছে এবং কি তারই নিজের লেখায় সুর দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে পায়ে হেঁটে বেড়ায়েছেন সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে কি আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর। এসব প্রতিবাদী ধারার গান-কবিতার জন্য তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে, এখন আমরা যাকে বলে থাকি যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। সে ব্রিটিশ বিরোধী সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক আন্দোলনকে সামনে রেখে কবিতা লিখতে গিয়েও নজরুলকে কারাগারের অন্ধ সেলে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে।

তাঁর সেসব গান-কবিতায় আজো সচেতন নাগরিক সমাজকে আন্দোলিত ও আলোড়িত করে আর দেশপ্রেমে মানুষকে জাগরণের প্রেরণা যোগায়। যেমন ‘মোরা ঝর্নার মতো চঞ্চল, মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়’ কিংবা ‘দুুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে’... একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কবির অনেক গান-কবিতায় বীরগেরিলা- মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসের দীপ্তপ্রভায় করেছেন বলিয়ান। এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তখনকার বড় বড় রাজনৈতিক নেতার থেকে কবি নজরুলের ভূমিকা কোনো অংশেই কম ছিলো না বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবির প্রতিবাদী ধারার রচনা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করার গৌরব অর্জন করেছে। তিনি যখন লেখেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/ রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণবেদি’ কিংবা ‘লাথি মার ভাঙ রে তালা/ যত সব বন্দিশালায়/ আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা /ফেল উপাড়ি’। কবি নজরুল একদিকে যেমন বিদ্রোহী তাঁর চলনে বলনে রচনায়, অন্যদিকে সে মহাপ্রেমীও বটে, তাঁর সে প্রেম ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়ে কখনো কখনো দেশপ্রেম আর মানব প্রেমের শব্দশৈলীতে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন তাঁর কাব্যভুবন। তিনি আগা-গোড়া একজন রাজনৈতিক সচেতন কবি হিসেবেও খ্যাতির স্বর্ণচূড়ায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন।

তিনি বিদ্রোহী কবিতায় যখন লেখেন ‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’ কিংবা ‘মহাবিশ্বের রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত’। তাঁর পাশাপাশি তিনি লিখেছেন আধ্যাত্মিক প্রেমের অমর সংগীত ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়’। তাঁর সবচে জনপ্রিয় বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষের মনোলোকে সেটি যেভাবে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে ভীষণ গতিতে সঞ্চারিত হতে লাগলো- তা আজকের পারমাণবিক দানবীয় ত্রাসের যুগে এসেও কি তা ভাবা যায়? তাঁর মনের গভীরে লালিত স্বপ্নকলা রাঙিয়ে তুলবে যে প্রেমপিপাসু কোনো এক কাম-কামিনী-মালতি মালঞ্চের নির্জন কুঞ্জবনে। কবি ভাবেন আর হাসেন এ কেমন পিপাসার ঢেউ ভাঙে মনের অতলে! আত্মভোলা উদাসী কবির চোখে দারুণ সুন্দরের পদ্মপরাগ আচমকা দুলে ওঠে দখিণা বাতাসে আর তখনই তিনি লিখেন ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ’।

কবি নজরুলের এমন অনেক জনপ্রিয় সংগীত আজো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় আনন্দ-বেদনায়, হাসি কান্নায়। এ প্রেমার্দ কবির মনোতপস্যায় বারবার উচ্চারিত হয় মানবতার অমরগাথা। তাঁর জনপ্রিয় গান-কবিতা বাঙালির দ্রোহী মানসপটে নিরন্তর প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। দেশপ্রেম আর মানব প্রেমের সুরধারা আজো বাঙালির অন্তর্লোক স্পন্দিত করে। ব্যতিক্রমধারার প্রাজ্ঞ এই দার্শনিক কবি ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তোলেন আলোকিত আগামী গড়ার প্রেরণায়। তাঁর স্বল্প সময়ের সৃষ্টিশীল রচনা সম্ভারে আজো বিবেকবান মানুষ চমকিত হয়। বাঙালি তাকে তাঁর অমর সৃষ্টিশৈলির জন্য স্মরণ করে এবং স্মরণ করবে অনন্তকাল ধরে।