বাবু মল্লিক
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে কাজী মোতাহার হোসেনের বয়সের তফাৎ ছিল বছর দুয়েকের, মোতাহার হোসেন ছিলেন জ্যেষ্ঠ আর নজরুল কনিষ্ঠ। অবশ্য এই দূরত্ব তাঁদের ব্যক্তিগত মধুর সম্পর্কের মধ্যে কোনো সীমারেখা হতে পারে নি। তাঁরা ধরাধাম থেকে বিদায়ও নেন বছর পাঁচেকের ব্যবধানে। কাজী নজরুল ইসলাম ইহজগতে ছিলেন ৭৭ বছর আর কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর চেয়ে বছরসাতেক বেশি ছিলেন। তাঁদের পরস্পর প্রথম সাক্ষাৎ, আলাপ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে মোতাহার হোসেন লিখিত পুস্তকে বিবৃত আছে।
কবি নজরুলের বাংলাদেশ বা পূর্ব-বাংলার জীবন সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেনই তাঁর ‘স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বিস্তৃত লিখেছেন, এতে নজরুল জীবনের অনেক গুরত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। নজরুল জীবন-চরিতাকারগণ কাজী মোতাহার হোসেন লিখিত এই গ্রন্থটির তথ্যসমূহ যথেষ্ট সমাদর করেছেন বলেই জানি। আর, কবির কলকাতার জীবন সম্পর্কে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ লিখিত দু’টি গ্রন্থ- ‘কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে’ ও ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ও যথেষ্ট তথ্যনির্ভর, প্রমাণিক এবং গ্রহণযোগ্য।
কবির সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখাসাক্ষাৎ বা পরিচয় হয়েছিল ১৯২০ সালের দিকে, কলকাতা কলেজ স্ট্র্রীটে আরেকবার তালতলা বাজারের এক গলির মধ্যেকার একটা মেসে। সে সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন- ‘যতদূর মনে পড়ে নজরুলকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯২০/২১ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সামনে কলেজ স্ট্রীটের একটা মেসের দোতলায়।’
অন্যত্র লিখেছেন কাজী মোতাহার হোসেন- ‘কবি নজরুলের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ কবে হয়েছিল, ঠিক মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে কলকাতার তালতলা বাজারের কোন এক গলিতে বস্তি এলাকার কোন ক্ষুদ্র কোঠায় একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করিতে গিয়েছিলাম, আর একবার মেডিকেল স্ট্রীটের [বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস, ৩২ কলেজ স্ট্রীট] কোন মেসের দোতলায়।’
তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বছর সাতেক পরে ঢাকায়, ১৯২৭ সালে কবি মুসলিম সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলে। মোতাহার হোসেন খুব সহজ সরলভাবেই লিখেছেন কবি নজরুলের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগের সেসব কথা। তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘১৯২৭ সনের আগে... নজরুলের সঙ্গে আমার যেসব দেখাশোনা হয়েছিল তা অনেকটা দূর থেকে কোন বিখ্যাত লোকের সঙ্গে গুণগ্রাহী লোকের মতো। কিন্তু ১৯২৭ সালে ২৭শে ফেব্রুয়ারি যখন নজরুল ইসলাম আমাদের নিমন্ত্রণে ঢাকায় এসে এখানকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী গীত গাইলেন আর সে সুরের বিপুল উচ্ছ্বাসে উপস্থিত সুধীগণ এমনকি মোল্লা-মৌলবীগণ পর্যন্ত উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তখন সেই জাদুকরি প্রভাবে সকলের সঙ্গে আমিও মোহিত হয়ে গেলাম। এবারই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার সত্যিকার পরিচয় এবং হৃদ্যতা জন্মে।’ বর্তমান রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমার গ্রামের কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে এভাবেই কবি নজরুলের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
কবি নজরুলের বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রত্যাগমনের কিছুকাল আগে থেকে, ১৯১৭ সালে মোতাহার হোসেন কলকাতায়ই ছিলেন। কবি নজরুলের সঙ্গে তখন কলকাতায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর মাধ্যমে এয়াকুব আলী চৌধুরী ও রওশন আলী চৌধুরীর সাথে যোগাযোগের একটা সূত্র উন্মুক্ত হচ্ছিল। ১৯২০ সালের ১০ অক্টোবর হুগলি জেলার তালতলায় সাজেদা খাতুনকে বিয়ের সূত্রে কাজী মোতাহারের হুগলি যাতায়াত এবং পাংশার চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রেও কাজী নজরুলের সাথে পরিচয়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে।
১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে কাজী মোতাহার হোসেন সেখানে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পরই ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠন হয়, আব্দুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ প্রমুখদের নেতৃত্বে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠন হলে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁদের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়, শেষোক্ত উভয় কাজীই ছিলেন পাংশার চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের অনুজপ্রতিম। কাজী মোতাহারদের উদ্যোগে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠন সূত্রেই কবি নজরুলের সঙ্গে পূর্ববাংলার লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ শুরু হয়। অবশ্য মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন করে ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ শুরুর সাথে কর্মশক্তি ছিল আবুল হুসেনের, চিন্তাশক্তি ছিল কাজী আব্দুল ওদুদের। নৈতিক সমর্থন ছিল নবযুগের আর (কারও কারও মতে) হৃদয় শক্তি ছিল কাজী মোতাহার হোসেনের। ‘শিখা’ পত্রিকা ছিল তাদের মুখপত্র- এরা শিখা গোষ্ঠি নামেও পরিচিত ছিলেন। মোতাহর হোসেন কয়েক বছর ‘শিখা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এখানেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে মোতাহার হোসেনের প্রথম পরিচয়, বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা হয়। কবি তাঁকে ‘মোতিহার’ বলে সম্বোধন করতেন। ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতার আলোকে কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় তাঁকে উদ্দেশ্য করে ‘দাড়ি গিলাপ’ নামে একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন। আমরা এও জানি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম মহিলা গ্রাজুয়েট শামসুন্নাহার এর প্রতি নজরুলের যে প্রেম বন্দনা প্রতিফলিত হয়েছিল তা ওই ‘মোতিহার’কে কেন্দ্র করেই। কাজী মোতাহারের কাছে লিখিত কবির একগুচ্ছ পত্র থেকে উভয়ের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯২৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর প্রথম সম্মেলনও কবি নজরুল উদ্বোধন করেছিলেন। সেখানে রাজবাড়ীর প্রখ্যাত কাজী যুগল নজরুল সান্নিধ্যের নিকটতম ছিলেন বলেই জানা যাচ্ছে- ‘১৯২৭ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমিতির প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের তিনি উদ্বোধক হন, এবার ঢাকায় এসে তিনি কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে ফজিলাতুন্নেসার সাথে পরিচিত হন। ফজিলাতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী।’
কলকাতা-গোয়ালন্দ রেলপথের এই ভ্রমনের পথে কবি একবার কাজী মোতাহারের গ্রামের বাড়ি পাংশার বাগমারা গ্রামেও একবার গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। যদিও কাজী মোতাহারের স্মৃতিকথা/ আত্মজীবনী গ্রন্থ, কাজী আব্দুল ওদুদ-এর লেখায় কোথাও এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ মেলে না। পাংশার গবেষক প্রফেসর আবুল হোসেন মল্লিক এই নিবন্ধকারকে সম্প্রতি জানিয়েছেন, বাগমারা আগমনের জনশ্রুতির কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া না গেলেও কবি যে সেখানে একবার এসে থাকতে পারেন- তা জোর দিয়ে অস্বীকার করা যায় না। তবে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে ১৯৩৩ সালে একবার কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিধন্য থানা শহর পাংশা ডাকবাংলার মাঠে কবিতা পাঠ, বক্তৃতা-বিবৃতি আর গানের আসর জমিয়েছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ এই লেখকের ‘ফরিদপুরে কবি নজরুল’ এবং ‘পাংশায় কবি নজরুল’ নিবন্ধে বিবৃত হয়েছে।
babumollik11@gmail.com
বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০
বাবু মল্লিক
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে কাজী মোতাহার হোসেনের বয়সের তফাৎ ছিল বছর দুয়েকের, মোতাহার হোসেন ছিলেন জ্যেষ্ঠ আর নজরুল কনিষ্ঠ। অবশ্য এই দূরত্ব তাঁদের ব্যক্তিগত মধুর সম্পর্কের মধ্যে কোনো সীমারেখা হতে পারে নি। তাঁরা ধরাধাম থেকে বিদায়ও নেন বছর পাঁচেকের ব্যবধানে। কাজী নজরুল ইসলাম ইহজগতে ছিলেন ৭৭ বছর আর কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর চেয়ে বছরসাতেক বেশি ছিলেন। তাঁদের পরস্পর প্রথম সাক্ষাৎ, আলাপ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে মোতাহার হোসেন লিখিত পুস্তকে বিবৃত আছে।
কবি নজরুলের বাংলাদেশ বা পূর্ব-বাংলার জীবন সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেনই তাঁর ‘স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বিস্তৃত লিখেছেন, এতে নজরুল জীবনের অনেক গুরত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। নজরুল জীবন-চরিতাকারগণ কাজী মোতাহার হোসেন লিখিত এই গ্রন্থটির তথ্যসমূহ যথেষ্ট সমাদর করেছেন বলেই জানি। আর, কবির কলকাতার জীবন সম্পর্কে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ লিখিত দু’টি গ্রন্থ- ‘কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে’ ও ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ও যথেষ্ট তথ্যনির্ভর, প্রমাণিক এবং গ্রহণযোগ্য।
কবির সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখাসাক্ষাৎ বা পরিচয় হয়েছিল ১৯২০ সালের দিকে, কলকাতা কলেজ স্ট্র্রীটে আরেকবার তালতলা বাজারের এক গলির মধ্যেকার একটা মেসে। সে সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন- ‘যতদূর মনে পড়ে নজরুলকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯২০/২১ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সামনে কলেজ স্ট্রীটের একটা মেসের দোতলায়।’
অন্যত্র লিখেছেন কাজী মোতাহার হোসেন- ‘কবি নজরুলের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ কবে হয়েছিল, ঠিক মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে কলকাতার তালতলা বাজারের কোন এক গলিতে বস্তি এলাকার কোন ক্ষুদ্র কোঠায় একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করিতে গিয়েছিলাম, আর একবার মেডিকেল স্ট্রীটের [বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস, ৩২ কলেজ স্ট্রীট] কোন মেসের দোতলায়।’
তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বছর সাতেক পরে ঢাকায়, ১৯২৭ সালে কবি মুসলিম সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলে। মোতাহার হোসেন খুব সহজ সরলভাবেই লিখেছেন কবি নজরুলের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগের সেসব কথা। তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘১৯২৭ সনের আগে... নজরুলের সঙ্গে আমার যেসব দেখাশোনা হয়েছিল তা অনেকটা দূর থেকে কোন বিখ্যাত লোকের সঙ্গে গুণগ্রাহী লোকের মতো। কিন্তু ১৯২৭ সালে ২৭শে ফেব্রুয়ারি যখন নজরুল ইসলাম আমাদের নিমন্ত্রণে ঢাকায় এসে এখানকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী গীত গাইলেন আর সে সুরের বিপুল উচ্ছ্বাসে উপস্থিত সুধীগণ এমনকি মোল্লা-মৌলবীগণ পর্যন্ত উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তখন সেই জাদুকরি প্রভাবে সকলের সঙ্গে আমিও মোহিত হয়ে গেলাম। এবারই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার সত্যিকার পরিচয় এবং হৃদ্যতা জন্মে।’ বর্তমান রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমার গ্রামের কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে এভাবেই কবি নজরুলের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
কবি নজরুলের বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রত্যাগমনের কিছুকাল আগে থেকে, ১৯১৭ সালে মোতাহার হোসেন কলকাতায়ই ছিলেন। কবি নজরুলের সঙ্গে তখন কলকাতায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর মাধ্যমে এয়াকুব আলী চৌধুরী ও রওশন আলী চৌধুরীর সাথে যোগাযোগের একটা সূত্র উন্মুক্ত হচ্ছিল। ১৯২০ সালের ১০ অক্টোবর হুগলি জেলার তালতলায় সাজেদা খাতুনকে বিয়ের সূত্রে কাজী মোতাহারের হুগলি যাতায়াত এবং পাংশার চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রেও কাজী নজরুলের সাথে পরিচয়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে।
১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে কাজী মোতাহার হোসেন সেখানে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পরই ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠন হয়, আব্দুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ প্রমুখদের নেতৃত্বে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠন হলে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁদের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়, শেষোক্ত উভয় কাজীই ছিলেন পাংশার চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের অনুজপ্রতিম। কাজী মোতাহারদের উদ্যোগে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠন সূত্রেই কবি নজরুলের সঙ্গে পূর্ববাংলার লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ শুরু হয়। অবশ্য মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন করে ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ শুরুর সাথে কর্মশক্তি ছিল আবুল হুসেনের, চিন্তাশক্তি ছিল কাজী আব্দুল ওদুদের। নৈতিক সমর্থন ছিল নবযুগের আর (কারও কারও মতে) হৃদয় শক্তি ছিল কাজী মোতাহার হোসেনের। ‘শিখা’ পত্রিকা ছিল তাদের মুখপত্র- এরা শিখা গোষ্ঠি নামেও পরিচিত ছিলেন। মোতাহর হোসেন কয়েক বছর ‘শিখা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এখানেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে মোতাহার হোসেনের প্রথম পরিচয়, বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা হয়। কবি তাঁকে ‘মোতিহার’ বলে সম্বোধন করতেন। ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতার আলোকে কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় তাঁকে উদ্দেশ্য করে ‘দাড়ি গিলাপ’ নামে একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন। আমরা এও জানি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম মহিলা গ্রাজুয়েট শামসুন্নাহার এর প্রতি নজরুলের যে প্রেম বন্দনা প্রতিফলিত হয়েছিল তা ওই ‘মোতিহার’কে কেন্দ্র করেই। কাজী মোতাহারের কাছে লিখিত কবির একগুচ্ছ পত্র থেকে উভয়ের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯২৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর প্রথম সম্মেলনও কবি নজরুল উদ্বোধন করেছিলেন। সেখানে রাজবাড়ীর প্রখ্যাত কাজী যুগল নজরুল সান্নিধ্যের নিকটতম ছিলেন বলেই জানা যাচ্ছে- ‘১৯২৭ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমিতির প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের তিনি উদ্বোধক হন, এবার ঢাকায় এসে তিনি কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে ফজিলাতুন্নেসার সাথে পরিচিত হন। ফজিলাতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী।’
কলকাতা-গোয়ালন্দ রেলপথের এই ভ্রমনের পথে কবি একবার কাজী মোতাহারের গ্রামের বাড়ি পাংশার বাগমারা গ্রামেও একবার গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। যদিও কাজী মোতাহারের স্মৃতিকথা/ আত্মজীবনী গ্রন্থ, কাজী আব্দুল ওদুদ-এর লেখায় কোথাও এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ মেলে না। পাংশার গবেষক প্রফেসর আবুল হোসেন মল্লিক এই নিবন্ধকারকে সম্প্রতি জানিয়েছেন, বাগমারা আগমনের জনশ্রুতির কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া না গেলেও কবি যে সেখানে একবার এসে থাকতে পারেন- তা জোর দিয়ে অস্বীকার করা যায় না। তবে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে ১৯৩৩ সালে একবার কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিধন্য থানা শহর পাংশা ডাকবাংলার মাঠে কবিতা পাঠ, বক্তৃতা-বিবৃতি আর গানের আসর জমিয়েছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ এই লেখকের ‘ফরিদপুরে কবি নজরুল’ এবং ‘পাংশায় কবি নজরুল’ নিবন্ধে বিবৃত হয়েছে।
babumollik11@gmail.com