খেলা

এলিজা খাতুন

ট্রেনের গতি ধীর হয়ে আসছে। সামনে স্টেশন। এখানেই নামবে জয়ন্ত। ভোর হওয়ার অনেক বাকি। শহর থেকে ভিটেবাড়ি পৌঁছাতে ঘণ্টা দুয়ের পথ। অবশ্য রোগী দেখার সময় বলেছে ন’টা থেকে। হাসপাতাল ছুটির দিনগুলোতে জয়ন্ত নিজ গ্রামে যায়; বিনে পয়সায় চিকিৎসা দেয় রোগীকে। এসময় গ্রামের দিকে যাবার কোনো বাহন পাওয়া যায় না। ভ্যান, অটো-রিকশা বা সিএনজি কোনকিছুই না। স্টেশনের বাইরে যদিও ক’খানা থাকে শীতে কাবু হয়ে অপেক্ষা করে চড়া ভাড়ার যাত্রি পাওয়ার। জয়ন্ত অযথা কনকনে ঠাণ্ডা অন্ধকার মাথায় নিয়ে পথে নামবেইবা কেন! লাগেজ নিয়ে ওয়েটিং রুমের দিকে এগোয়।

শেষ রাতের নিস্তব্ধতা স্টেশনের প্লাটফরমকে কাবু করতে পারেনি। হয়তো দিনের সরগরমতা সামান্য কিছু চুপসে আছে; এই যা। ডানে বামে পাটি পেতে সারি সারি কম্বল মোড়ানো ঘুমন্ত নিথর দেহ; ফাঁকা জায়গায় দেখেশুনে পা ফেলে ফেলে জয়ন্ত একটা দরজায় এসে ঢুকলো। ওয়েটিং রুমে বেঞ্চে ফাঁকা জায়গাটুকু যেন তার অপেক্ষাতেই ছিলো।

পায়ের কাছে লাগেজ রেখে বেঞ্চে পা তুলে গায়ের চাদরে পা ঢেকে বসলো। অন্ধকার একটু পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। বহুদিন পর গ্রামে যাচ্ছে, বরং স্টেশনে অপেক্ষার স্বাদ ছোটবেলাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। তেমন কিছু পরিবর্তন আসেনি সময়ের ব্যবধানে। স্টেশনের বিচিত্র চরিত্র সমন্বয়ে একটা কমোন দৃশ্যপট সময়ের সাথে সাথে চলমান। শুধু মুখগুলো পাল্টেছে। ছোটতে দেখা প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে থাকা জটাচুলের বৃদ্ধ পাগলটা নেই। “আমার আল্লা নবিজির নাম” গান গাওয়া পঙ্গু লোকটাকে আর দেখা যায়না গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করতে। ওয়েটিং রুমের অর্ধখোলা দরজা দিয়ে বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত চোখ চলে যায় জয়ন্তর। প্লাটফরমের নিচে তিন সারি রেললাইনের ওপারের আলো আঁধারী যেন টেনে নিচ্ছে দৃষ্টি। ওপারে দূরে কয়েকটি দোকানে চা, পান, সিগারেট এ রাতেও কম বিক্রি হচ্ছে না। একটু তফাতে ভাতের হোটেলের কর্মচারীগুলো অবসরে নেই। হোটেল দেখে জয়ন্তর পেটের ক্ষুধা যেন ভেতর থেকে নড়েচড়ে উঠছে।

মিটমিটে আলো, আবছা-আধারে ঢাকা রেললাইন, পাটি বিছিয়ে সারি সারি ঘুমন্ত মানুষের উপর দিয়ে যেন উড়ে আসছে ধারালো ছুরির মতো ঠাণ্ডা বাতাস। সেই সাথে কুয়াশায় মিশে মিশে তীক্ষèস্বরে উড়ে আসছে পুরোনো দিনের গান।

একবার উঠে ভেতরে ওয়াশরুমে যায় জয়ন্ত। চোখমুখে জলছিটা দিয়ে বের হয়ে আসার মুহূর্তে কিসের যেন একটা আওয়াজ শুনতে পায়। ফিরে এসে সিটে বসে। ততটা গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু মাথা থেকে সরছিলো না। আওয়াজটা কেমন অদ্ভুত!

এতক্ষণে গানের সাউন্ড আরেকটু জোর হলো, অদ্ভুত শব্দটা আর স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না। একদ- ঝিমুনি এলেও প্রশ্রয় পায় না জয়ন্তর সচেতন চোখে।

এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর বাইরে অন্ধকার সরতে লেগেছে, আবছা আলো ফুটতেই স্টেশনের ভোর কেমন ভালো লাগতে লাগলো জয়ন্তর। যেন আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠলো গোটা স্টেশন। আঁধার পুরোপুরি মুছে যেতে না যেতে কেউ কেউ পাটি গোটাচ্ছে, কেউ সেদ্ধ ডিমের পাত্র গলায় ঝুলিয়েছে, কেউ তাবিজ রুমাল চিরুরি, সেপ্টিপিন, তসবিহ্, মাদুলি, ন্যাপথলিন কাঠের স্ট্যান্ডফ্রেমে সাজিয়ে কাঁধে বাধিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটাহাঁটি, বনরুটি শনপাপড়ি, হাওয়াইমিঠাই, বেতফল, বাতাসা, চকলেট ওয়ালার আনাগোনা শুরু হলো এক এক করে। নামাজ শিক্ষার বই সহ আরো নানারকম ছবি সম্বলিত বই নিয়ে ঘুরছে কেউ কেউ।

ওয়েটিং রুমের পেছনের সেই অদ্ভুত শব্দটা আরো তীক্ষè হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। জয়ন্তকে ও পথেই যেতে হবে। লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। প্লাটফরমের গেটের সিঁড়ি থেকে নেমে বাইরে সড়ক সংলগ্ন চত্বরের এক কোণে চোখ আটকে গেলো জয়ন্তর। দশ বারোজনের একটা গোল চক্র। কী হচ্ছে ওখানে! কাতরানোর শব্দ এতো তীব্রমাত্রার হয়! কে কাতরায় এভাবে! উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ওদিকে জয়ন্তর এগিয়ে যাওয়াটাই এ মুহূর্তে স্বাভাবিক। ভিড়ের কাছে গিয়ে দু’একজনকে ঠেলে চক্রের মধ্যখানে দেখতেই গা শিউরে ওঠে জয়ন্তর। এ কী অবস্থা! রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাঁটু অব্দি উদোম দু’খানা পা। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে যন্ত্রণা ঠেক দেওয়ার কী অসহায় চেষ্টা তার! দু’পায়ের মোড়ামোড়িতে পায়ের গোড়ালি রক্তভেজা কাদায় মাখামাখি। এই প্রথম জয়ন্ত তার চোখের সামনে দেখছে প্রসবযন্ত্রণাবিদ্ধ নারীর ছটফট করার দৃশ্য! উপস্থিতজনেরা একে পাগলী বলে ডাকছে; বয়স বেশি নয় মনে হচ্ছে। চেহারা পোশাকে পাগলির যথার্থ ছাপ বিদ্যমান। ধুলো ময়লায় জট পাকানো চুল, শরীরে পুরু ময়লার স্তর, চোখের কোনে পিচুটি, পায়ের হাঁটু, গোড়ালি, গিরোয় গিরোয় চামড়া যেন কড়কড়ে বাকল হয়ে উঠেছে। এইসব অনুষঙ্গ আর শত তালিযুক্ত পোশাক পাগলী বলেই পাকাপোক্ত সার্টিফিকেট দেয় তাকে।

অথচ ‘পাগলী’ শব্দটার সবধরনের বৈশিষ্ট্যকে ধুলোয় মিশিয়ে রক্তের অক্ষরে মাটির বুকে সে লিখে দিতে চাইছে- সে একজন ‘মা’! এরই মধ্যে একে একে লোকজন বেড়ে চলেছে। পাগলীকে ঘিরে মানুষের পেছনে মানুষ যোগ হতে হতে চওড়া হতে লাগলো বেস্টনি। ভিড় ঠেলে শূন্যস্থান না পেয়ে দেয়ালের কার্নিশে, টেম্পুর ছাদে, পার্শবর্তী শিমুল গাছে উঠে পড়েছে অনেকেই। চ্যাংড়া থেকে মধ্যবয়সী অসংখ্য উৎসুক চোখ আছড়ে পড়ছে পাগলীর দিকে। এখানে অমনোযোগী চোখ খুঁজে পাওয়া যাবে না একটাও।

দর্শক-বেষ্টনি থেকে একজন এগিয়ে পাগলীকে বলল- “এই পাগলী! তোর বাচ্চার বাপ কিডা?”

ডানে বামে সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর মুখে তাকিয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ পাগলীর কালশিটে পড়া চোখদুটো তখন কিছু একটা হাতড়ে চলেছে। কিছু না পাওয়া দৃষ্টি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শূন্যে ফিরে গেলো। বাচ্চার জন্মদাতা খুঁজে পাওয়া না পাওয়া ওর কাছে কোনো বিশেষ বিষয় নয়; এমনই মনে হলো ওর অভিব্যক্তি। অবনত মুখ গাল কণ্ঠ চিরে চিরে উগরে আসছে অসহ্য কষ্ট। জয়ন্ত পাগলীর দিকে এগিয়ে যায়। হাতের লাগেজটা একটু তফাতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখে। এ অবস্থায় ওকে হাসপাতালে নেবার চিন্তা করলো; এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো ভ্যান চোখে পড়েনি। দূরে দু’তিনটে সিএনজি দাঁড়ানো থাকলেও জয়ন্তর ইশারায় সাড়া আসেনি কোনো।

পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং-এর মাঝখানে একটা ফাঁকা গলি মতো আড়াল চোখে পড়ল জয়ন্তর। এত লোকের মধ্যে কোনো মহিলাকেও দেখা যায়নি এখনও। উপস্থিত প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে জয়ন্ত বলল- “কেউ একজন আসুন তো আমার সাথে, ওকে ধরে ওপাশে আড়ালে নিই।” প্রাপ্তবয়স্ক কেউ এগায়নি। দু’তিনটে বালক এসে জয়ন্তর সাথে ওকে টেনে দেয়ালের ফাঁকে আড়ালে নিয়ে গেলো। পেছন পেছন আরো কয়েকজন এগিয়ে দেয়ালের কোনায় হুড়মুড়িয়ে একে অপরের পিঠে ভর দিলেও কেউ পিঠে ব্যথা পাচ্ছে বলে আপত্তি করেনি। মানিয়ে গুনিয়ে নেবার ব্যাপারটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই দৃশ্যখানা। জয়ন্ত ওদেরকে সরে যাবার জন্য বোঝায়। পাগলী হোক তবু ওকে একটা আড়াল দেওয়া উচিত সবার। গুঞ্জনের মধ্যে জয়ন্তর কথা চুরমার হয়ে যাচ্ছে উপস্থিত এক এক জনের কথা কানে ভেসে আসছে-

“ওকে হাসপাতালে পাঠালে ভালো হতো”/ “ওরে কেউ ভ্যানে তুলে দ্যাও”/ “ এত কষ্টের মধ্যেও দেখো পুতুল ছাড়েনি হাত থেকে”

ওদের আরো অন্যান্য কথার মধ্যে জয়ন্তর জানা হলো- পাগলীটা এই স্টেশনের এখানে সেখানে বসে পুতুলের সংসার সাজাতো। কখনও কখনও স্টেশনে অবস্থানকারী কিংবা বহিরাগত কেউ কেউ তামাসা করে ওর সাথে দু পাঁচ মিনিট পুতুল খেলতে বসতো। ওর পাশে বসে ছবি তুলতো। মাঝে কিছুদিন দেখা যায়নি, হয়তো অন্য কোন স্টেশনে বা অন্য কোনোখানে ছিল। ইদানীং সে পুতুলের সংসার পেতে না বসলেও পুতুল হাতে নিয়ে ওটার সাথে নাকি নানা কথা একা একা বকবক করে চলে। আর এই বালকগুলোর নিত্যদিনের খেলা পাগলীকে ক্ষ্যাপানো। পাগলী ক্ষিপ্ত হয়ে ওদের পেছনে তাড়া করলে খেলা জমে উঠতো।

জয়ন্ত ভিড় ঠেলে বেরিয়ে রাস্তার দিকে এদিক ওদিক চেয়ে খুঁজতে লাগলো চা এর দোকান। একজনকে জিজ্ঞাসা করলো- “এপাশে চা-এর দোকান কোথায়?” সে উত্তর দিল- “দাদা চা খেতে চাইলে এ মোড় ছেড়ে পরের মোড়ে চলে যান, বিন্দাস চা পাবেন কালুর দোকানে”। জয়ন্ত বলল- “চা-এর জন্য না, একটু গরম পানি দরকার”। লোকটা হা করে তাকিয়ে থাকলো। জয়ন্ত মোড়ের আরেকটা গলির দিকে ঢুকতেই সম্মুখে পেয়ে গেলো চা-সিঙাড়ার দোকান। জলের কেতলি উনুনে বসিয়েছে; একটা পাত্রও দিতে রাজি হলো। ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পাশে দাঁড়ানো দুজন লোকের কথা কানে আসে। চা-এর খদ্দের তারা। মর্নিংওয়াক শেষে চা-এর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

১ম জন- “কী আর বলবো! দেশে যেভাবে পাগলের সংখ্যা বাড়ছে! রাস্তাঘাটে প্রায়ই সামনে এসে পড়ে পাগল। এদের নির্দিষ্ট কোথাও আটকে রাখার ব্যবস্থা করা যায় না! যেখানে থাকা খাওয়া পোশাক-আশাক ঔষধ সবকিছু ফ্রী থাকবে ওদের; মানে বলতে চাচ্ছি সরকারি কোনো ব্যবস্থা।

২য় জন- কে করবে ব্যাবস্থা! সরকার! হা হা হা... অর্থের বিনিময়ে সুস্থ মানুষেরই স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জুটছে না! আর আপনি পাগল নিয়ে পড়লেন!

১ম জন- ভাবছি পরবর্তী টকশোতে “পাগল” ইস্যু নিয়ে বসা যায় কিনা!

২য়- তাহলে ছোট্ট একটা ডকুমেন্টারি অংশ জুড়ে দিতে পারেন, কিছু পাগল খুঁজে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারলেই জমে যাবে।

১ম জন- ওহ্ দারুণ আইডিয়া, সেক্ষেত্রে এই পাগলী টাকে দিয়েই শুরু হতে পারে তো!

২য় জন- আহা আমি তো সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম, এই পাগলীর যা অবস্থা এখন, সপ্তাহখানেক এই স্টেশনেই পড়ে থাকবে, আঁতুড় বাচ্চা নিয়ে।

১ম জন- তার মানে বলতে চাইছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে একে নিয়ে একটা ভিডিও ক্লিপসহ রির্পোট তৈরি করে ফেলি!

জয়ন্ত চমকে উঠলো চা-দোকানির ডাকে। জল গরম হয়ে গেছে। জয়ন্ত ওদের বাকি আলাপে কান না দিয়ে দোকানের কাপ পিরিচ ধোয়ার বড় গামলাটাতে গরম জল ঢেলে নিলো। ওদিকে পাগলীটার কী অবস্থা কে জানে!

কনকনে ঠা-া। কুয়াশাঢাকা চারিদিক। এখনও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। তবু বাড়ছে স্টেশনের ব্যস্ততা, ছুটছে ঘড়ির কাঁটা। তামাসা দেখা লোকজন যাদের ব্যবসায় খোলার সময় হলো তারা অনেকেই চলে গেছে। তারপরেও এখনোও বাকি যারা আছে, নেহাত কম নেই। কেউ কেউ স্থানীয় বস্তিবাসি। দেয়ালের ঘোপের মুখে দাঁড়িয়ে কয়েকজন একর পর এক প্রশ্ন করে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে পাগলীকে ক্ষ্যাপানোর চিরাচরিত রূপ পাল্টে গেল যেন! প্রত্যেকের অভিব্যক্তিতে চিন্তার ছাপ। এ মুহূর্তে এদের দৃষ্টিতে সন্তান প্রসবরত এই নারীর ‘পাগলী’ পরিচয়ই মুখ্য ও প্রকট নয়। পাগলী চেঁচিয়ে হাত উঁচু করে বলল- “যাহ্ ... তোরা যাহ্...”

স্থানীয় বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলো একটু দূরে খেলায় মেতেছে। তারা পাগলীর বিষয়তে কিছুক্ষণ আটকে থেকে যে যার মতো ছিটকে গেছে। অন্যপাশে খেলার জন্য জড় হয়েছে আবার।

হৈ চৈ ঠেলা ঠেলির ভেতর থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক পাগলীর পক্ষ নিয়ে ওদের তাড়াতে উদ্দ্যত হলো। পাগলী পেছন ও দুপাশ হাতড়ে দু’চারটে ভাঙা ইট-পাটকেল তুলে ছুঁড়ে মারতে লাগলো। উঠোনের ধান থেকে কাকপক্ষী তাড়াতে বারান্দায় বসা গেরস্থ যেমন লাঠিলগি উঁচু করে; অমন ভঙ্গিতে পাগলী হাতের শেষ পাটকেলটি উঁচু করলো। তীব্র যন্ত্রণায় মোড়ামোড়ি করতে করতে শেষঅব্দি পাটকেলটি হাতছাড়া করেনি।

পেছন থেকে জয়ন্ত গরম জলের গামলাটা ধরে নিয়ে পথের মুখ থেকে সবাইকে সরে যেতে বলল। কোনোরকম ভিড় ঠেলে গলির মুখ থেকে ঘোপের ভেতরে ঢুকতেই দ্যাখে পাগলীর গুরুতর অবস্থা। জয়ন্ত পাগলীর পা’দুখানা দু’পাশে সরায়। তার উরুর কাছে আটকে থাকা রক্তমাখা থকথকে মাংসের দলাটাকে মুক্ত করে আলতো ভাবে তুলে ধরে দু’হাতের পরে। ততক্ষণে পাগলীর দম যায় যায়; ভীষণরকম হাঁপাচ্ছে। জয়ন্তর কাণ্ড দেখে গুঞ্জনরত উপস্থিত লোকগুলো থ হয়ে যায়। জয়ন্ত উষ্ণ জলে বাচ্চাটিকে চুবিয়ে তুলে সম্মুখে ও আশেপাশে অনির্দিষ্ট ভাবে খোঁজে একটু শুকনো কাপড়।

পাগলী রক্তবর্ণ চোখে তাকালো ওদের দিকে, হাতের কাছের সেই পাটকেলটা হাতে তুলে না ছুঁড়েই কী ভেবে ফেলে দেয়। জয়ন্তর হাতে বাচ্চার নড়াচড়া দেখে আঁচল এগিয়ে পেতে দেয়। তাতে পেঁচিয়ে বাচ্চাটিকে পাগলীর কোলের কাছে দেয়। জয়ন্ত লাগেজপত্র যেখানে রেখেছিল হেঁটে যায় সেদিকে।

ঘোপের ভেতর থেকে রক্ত গড়াতে গড়াতে চলে আসে গলির মুখে। তা দেখে পিছু হটতে থাকে দাঁড়ানো লোকগুলো। বাচ্চা কেঁদে ওঠে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে। পাগলী ওকে আঁচলে ঢেকে আরেকটু বুকে জড়িয়ে নেয়। পাশে খেলায় মেতে থাকা ছেলেমেয়েগুলো হঠাৎ খেলা থামিয়ে বাচ্চার কাছে এলো। অন্যদিনের মতো বালকগুলোকে তাড়ানোর জন্য পাগলী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেনি আজ। বরং ওদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসছে। সমস্ত মুখ জুড়ে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে পড়ার সাথে সাথে যেন মায়া ঝরছে পাগলীর চোখমুখ থেকে। এই বালকদের সাথে খেলতে খেলতে ওর বাচ্চাও বড় হবে। বালকগুলো এক এক করে এসে কেউ হাত নাড়ছে, কেউ পা, কেউ মাথায় আঙুল ছুঁয়ে আদরের ভঙ্গিতে বলছে- “খেলবি?” আরেকজন বালক বলল- “এক্ষণে আইছে দুনিয়াতে, ও-কি দুনিয়ার খেলা জানে! আগে বড় হোক!”

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০

খেলা

এলিজা খাতুন

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

ট্রেনের গতি ধীর হয়ে আসছে। সামনে স্টেশন। এখানেই নামবে জয়ন্ত। ভোর হওয়ার অনেক বাকি। শহর থেকে ভিটেবাড়ি পৌঁছাতে ঘণ্টা দুয়ের পথ। অবশ্য রোগী দেখার সময় বলেছে ন’টা থেকে। হাসপাতাল ছুটির দিনগুলোতে জয়ন্ত নিজ গ্রামে যায়; বিনে পয়সায় চিকিৎসা দেয় রোগীকে। এসময় গ্রামের দিকে যাবার কোনো বাহন পাওয়া যায় না। ভ্যান, অটো-রিকশা বা সিএনজি কোনকিছুই না। স্টেশনের বাইরে যদিও ক’খানা থাকে শীতে কাবু হয়ে অপেক্ষা করে চড়া ভাড়ার যাত্রি পাওয়ার। জয়ন্ত অযথা কনকনে ঠাণ্ডা অন্ধকার মাথায় নিয়ে পথে নামবেইবা কেন! লাগেজ নিয়ে ওয়েটিং রুমের দিকে এগোয়।

শেষ রাতের নিস্তব্ধতা স্টেশনের প্লাটফরমকে কাবু করতে পারেনি। হয়তো দিনের সরগরমতা সামান্য কিছু চুপসে আছে; এই যা। ডানে বামে পাটি পেতে সারি সারি কম্বল মোড়ানো ঘুমন্ত নিথর দেহ; ফাঁকা জায়গায় দেখেশুনে পা ফেলে ফেলে জয়ন্ত একটা দরজায় এসে ঢুকলো। ওয়েটিং রুমে বেঞ্চে ফাঁকা জায়গাটুকু যেন তার অপেক্ষাতেই ছিলো।

পায়ের কাছে লাগেজ রেখে বেঞ্চে পা তুলে গায়ের চাদরে পা ঢেকে বসলো। অন্ধকার একটু পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। বহুদিন পর গ্রামে যাচ্ছে, বরং স্টেশনে অপেক্ষার স্বাদ ছোটবেলাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। তেমন কিছু পরিবর্তন আসেনি সময়ের ব্যবধানে। স্টেশনের বিচিত্র চরিত্র সমন্বয়ে একটা কমোন দৃশ্যপট সময়ের সাথে সাথে চলমান। শুধু মুখগুলো পাল্টেছে। ছোটতে দেখা প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে থাকা জটাচুলের বৃদ্ধ পাগলটা নেই। “আমার আল্লা নবিজির নাম” গান গাওয়া পঙ্গু লোকটাকে আর দেখা যায়না গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করতে। ওয়েটিং রুমের অর্ধখোলা দরজা দিয়ে বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত চোখ চলে যায় জয়ন্তর। প্লাটফরমের নিচে তিন সারি রেললাইনের ওপারের আলো আঁধারী যেন টেনে নিচ্ছে দৃষ্টি। ওপারে দূরে কয়েকটি দোকানে চা, পান, সিগারেট এ রাতেও কম বিক্রি হচ্ছে না। একটু তফাতে ভাতের হোটেলের কর্মচারীগুলো অবসরে নেই। হোটেল দেখে জয়ন্তর পেটের ক্ষুধা যেন ভেতর থেকে নড়েচড়ে উঠছে।

মিটমিটে আলো, আবছা-আধারে ঢাকা রেললাইন, পাটি বিছিয়ে সারি সারি ঘুমন্ত মানুষের উপর দিয়ে যেন উড়ে আসছে ধারালো ছুরির মতো ঠাণ্ডা বাতাস। সেই সাথে কুয়াশায় মিশে মিশে তীক্ষèস্বরে উড়ে আসছে পুরোনো দিনের গান।

একবার উঠে ভেতরে ওয়াশরুমে যায় জয়ন্ত। চোখমুখে জলছিটা দিয়ে বের হয়ে আসার মুহূর্তে কিসের যেন একটা আওয়াজ শুনতে পায়। ফিরে এসে সিটে বসে। ততটা গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু মাথা থেকে সরছিলো না। আওয়াজটা কেমন অদ্ভুত!

এতক্ষণে গানের সাউন্ড আরেকটু জোর হলো, অদ্ভুত শব্দটা আর স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না। একদ- ঝিমুনি এলেও প্রশ্রয় পায় না জয়ন্তর সচেতন চোখে।

এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর বাইরে অন্ধকার সরতে লেগেছে, আবছা আলো ফুটতেই স্টেশনের ভোর কেমন ভালো লাগতে লাগলো জয়ন্তর। যেন আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠলো গোটা স্টেশন। আঁধার পুরোপুরি মুছে যেতে না যেতে কেউ কেউ পাটি গোটাচ্ছে, কেউ সেদ্ধ ডিমের পাত্র গলায় ঝুলিয়েছে, কেউ তাবিজ রুমাল চিরুরি, সেপ্টিপিন, তসবিহ্, মাদুলি, ন্যাপথলিন কাঠের স্ট্যান্ডফ্রেমে সাজিয়ে কাঁধে বাধিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটাহাঁটি, বনরুটি শনপাপড়ি, হাওয়াইমিঠাই, বেতফল, বাতাসা, চকলেট ওয়ালার আনাগোনা শুরু হলো এক এক করে। নামাজ শিক্ষার বই সহ আরো নানারকম ছবি সম্বলিত বই নিয়ে ঘুরছে কেউ কেউ।

ওয়েটিং রুমের পেছনের সেই অদ্ভুত শব্দটা আরো তীক্ষè হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। জয়ন্তকে ও পথেই যেতে হবে। লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। প্লাটফরমের গেটের সিঁড়ি থেকে নেমে বাইরে সড়ক সংলগ্ন চত্বরের এক কোণে চোখ আটকে গেলো জয়ন্তর। দশ বারোজনের একটা গোল চক্র। কী হচ্ছে ওখানে! কাতরানোর শব্দ এতো তীব্রমাত্রার হয়! কে কাতরায় এভাবে! উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ওদিকে জয়ন্তর এগিয়ে যাওয়াটাই এ মুহূর্তে স্বাভাবিক। ভিড়ের কাছে গিয়ে দু’একজনকে ঠেলে চক্রের মধ্যখানে দেখতেই গা শিউরে ওঠে জয়ন্তর। এ কী অবস্থা! রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাঁটু অব্দি উদোম দু’খানা পা। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে যন্ত্রণা ঠেক দেওয়ার কী অসহায় চেষ্টা তার! দু’পায়ের মোড়ামোড়িতে পায়ের গোড়ালি রক্তভেজা কাদায় মাখামাখি। এই প্রথম জয়ন্ত তার চোখের সামনে দেখছে প্রসবযন্ত্রণাবিদ্ধ নারীর ছটফট করার দৃশ্য! উপস্থিতজনেরা একে পাগলী বলে ডাকছে; বয়স বেশি নয় মনে হচ্ছে। চেহারা পোশাকে পাগলির যথার্থ ছাপ বিদ্যমান। ধুলো ময়লায় জট পাকানো চুল, শরীরে পুরু ময়লার স্তর, চোখের কোনে পিচুটি, পায়ের হাঁটু, গোড়ালি, গিরোয় গিরোয় চামড়া যেন কড়কড়ে বাকল হয়ে উঠেছে। এইসব অনুষঙ্গ আর শত তালিযুক্ত পোশাক পাগলী বলেই পাকাপোক্ত সার্টিফিকেট দেয় তাকে।

অথচ ‘পাগলী’ শব্দটার সবধরনের বৈশিষ্ট্যকে ধুলোয় মিশিয়ে রক্তের অক্ষরে মাটির বুকে সে লিখে দিতে চাইছে- সে একজন ‘মা’! এরই মধ্যে একে একে লোকজন বেড়ে চলেছে। পাগলীকে ঘিরে মানুষের পেছনে মানুষ যোগ হতে হতে চওড়া হতে লাগলো বেস্টনি। ভিড় ঠেলে শূন্যস্থান না পেয়ে দেয়ালের কার্নিশে, টেম্পুর ছাদে, পার্শবর্তী শিমুল গাছে উঠে পড়েছে অনেকেই। চ্যাংড়া থেকে মধ্যবয়সী অসংখ্য উৎসুক চোখ আছড়ে পড়ছে পাগলীর দিকে। এখানে অমনোযোগী চোখ খুঁজে পাওয়া যাবে না একটাও।

দর্শক-বেষ্টনি থেকে একজন এগিয়ে পাগলীকে বলল- “এই পাগলী! তোর বাচ্চার বাপ কিডা?”

ডানে বামে সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর মুখে তাকিয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ পাগলীর কালশিটে পড়া চোখদুটো তখন কিছু একটা হাতড়ে চলেছে। কিছু না পাওয়া দৃষ্টি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শূন্যে ফিরে গেলো। বাচ্চার জন্মদাতা খুঁজে পাওয়া না পাওয়া ওর কাছে কোনো বিশেষ বিষয় নয়; এমনই মনে হলো ওর অভিব্যক্তি। অবনত মুখ গাল কণ্ঠ চিরে চিরে উগরে আসছে অসহ্য কষ্ট। জয়ন্ত পাগলীর দিকে এগিয়ে যায়। হাতের লাগেজটা একটু তফাতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখে। এ অবস্থায় ওকে হাসপাতালে নেবার চিন্তা করলো; এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো ভ্যান চোখে পড়েনি। দূরে দু’তিনটে সিএনজি দাঁড়ানো থাকলেও জয়ন্তর ইশারায় সাড়া আসেনি কোনো।

পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং-এর মাঝখানে একটা ফাঁকা গলি মতো আড়াল চোখে পড়ল জয়ন্তর। এত লোকের মধ্যে কোনো মহিলাকেও দেখা যায়নি এখনও। উপস্থিত প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে জয়ন্ত বলল- “কেউ একজন আসুন তো আমার সাথে, ওকে ধরে ওপাশে আড়ালে নিই।” প্রাপ্তবয়স্ক কেউ এগায়নি। দু’তিনটে বালক এসে জয়ন্তর সাথে ওকে টেনে দেয়ালের ফাঁকে আড়ালে নিয়ে গেলো। পেছন পেছন আরো কয়েকজন এগিয়ে দেয়ালের কোনায় হুড়মুড়িয়ে একে অপরের পিঠে ভর দিলেও কেউ পিঠে ব্যথা পাচ্ছে বলে আপত্তি করেনি। মানিয়ে গুনিয়ে নেবার ব্যাপারটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই দৃশ্যখানা। জয়ন্ত ওদেরকে সরে যাবার জন্য বোঝায়। পাগলী হোক তবু ওকে একটা আড়াল দেওয়া উচিত সবার। গুঞ্জনের মধ্যে জয়ন্তর কথা চুরমার হয়ে যাচ্ছে উপস্থিত এক এক জনের কথা কানে ভেসে আসছে-

“ওকে হাসপাতালে পাঠালে ভালো হতো”/ “ওরে কেউ ভ্যানে তুলে দ্যাও”/ “ এত কষ্টের মধ্যেও দেখো পুতুল ছাড়েনি হাত থেকে”

ওদের আরো অন্যান্য কথার মধ্যে জয়ন্তর জানা হলো- পাগলীটা এই স্টেশনের এখানে সেখানে বসে পুতুলের সংসার সাজাতো। কখনও কখনও স্টেশনে অবস্থানকারী কিংবা বহিরাগত কেউ কেউ তামাসা করে ওর সাথে দু পাঁচ মিনিট পুতুল খেলতে বসতো। ওর পাশে বসে ছবি তুলতো। মাঝে কিছুদিন দেখা যায়নি, হয়তো অন্য কোন স্টেশনে বা অন্য কোনোখানে ছিল। ইদানীং সে পুতুলের সংসার পেতে না বসলেও পুতুল হাতে নিয়ে ওটার সাথে নাকি নানা কথা একা একা বকবক করে চলে। আর এই বালকগুলোর নিত্যদিনের খেলা পাগলীকে ক্ষ্যাপানো। পাগলী ক্ষিপ্ত হয়ে ওদের পেছনে তাড়া করলে খেলা জমে উঠতো।

জয়ন্ত ভিড় ঠেলে বেরিয়ে রাস্তার দিকে এদিক ওদিক চেয়ে খুঁজতে লাগলো চা এর দোকান। একজনকে জিজ্ঞাসা করলো- “এপাশে চা-এর দোকান কোথায়?” সে উত্তর দিল- “দাদা চা খেতে চাইলে এ মোড় ছেড়ে পরের মোড়ে চলে যান, বিন্দাস চা পাবেন কালুর দোকানে”। জয়ন্ত বলল- “চা-এর জন্য না, একটু গরম পানি দরকার”। লোকটা হা করে তাকিয়ে থাকলো। জয়ন্ত মোড়ের আরেকটা গলির দিকে ঢুকতেই সম্মুখে পেয়ে গেলো চা-সিঙাড়ার দোকান। জলের কেতলি উনুনে বসিয়েছে; একটা পাত্রও দিতে রাজি হলো। ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পাশে দাঁড়ানো দুজন লোকের কথা কানে আসে। চা-এর খদ্দের তারা। মর্নিংওয়াক শেষে চা-এর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

১ম জন- “কী আর বলবো! দেশে যেভাবে পাগলের সংখ্যা বাড়ছে! রাস্তাঘাটে প্রায়ই সামনে এসে পড়ে পাগল। এদের নির্দিষ্ট কোথাও আটকে রাখার ব্যবস্থা করা যায় না! যেখানে থাকা খাওয়া পোশাক-আশাক ঔষধ সবকিছু ফ্রী থাকবে ওদের; মানে বলতে চাচ্ছি সরকারি কোনো ব্যবস্থা।

২য় জন- কে করবে ব্যাবস্থা! সরকার! হা হা হা... অর্থের বিনিময়ে সুস্থ মানুষেরই স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জুটছে না! আর আপনি পাগল নিয়ে পড়লেন!

১ম জন- ভাবছি পরবর্তী টকশোতে “পাগল” ইস্যু নিয়ে বসা যায় কিনা!

২য়- তাহলে ছোট্ট একটা ডকুমেন্টারি অংশ জুড়ে দিতে পারেন, কিছু পাগল খুঁজে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারলেই জমে যাবে।

১ম জন- ওহ্ দারুণ আইডিয়া, সেক্ষেত্রে এই পাগলী টাকে দিয়েই শুরু হতে পারে তো!

২য় জন- আহা আমি তো সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম, এই পাগলীর যা অবস্থা এখন, সপ্তাহখানেক এই স্টেশনেই পড়ে থাকবে, আঁতুড় বাচ্চা নিয়ে।

১ম জন- তার মানে বলতে চাইছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে একে নিয়ে একটা ভিডিও ক্লিপসহ রির্পোট তৈরি করে ফেলি!

জয়ন্ত চমকে উঠলো চা-দোকানির ডাকে। জল গরম হয়ে গেছে। জয়ন্ত ওদের বাকি আলাপে কান না দিয়ে দোকানের কাপ পিরিচ ধোয়ার বড় গামলাটাতে গরম জল ঢেলে নিলো। ওদিকে পাগলীটার কী অবস্থা কে জানে!

কনকনে ঠা-া। কুয়াশাঢাকা চারিদিক। এখনও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। তবু বাড়ছে স্টেশনের ব্যস্ততা, ছুটছে ঘড়ির কাঁটা। তামাসা দেখা লোকজন যাদের ব্যবসায় খোলার সময় হলো তারা অনেকেই চলে গেছে। তারপরেও এখনোও বাকি যারা আছে, নেহাত কম নেই। কেউ কেউ স্থানীয় বস্তিবাসি। দেয়ালের ঘোপের মুখে দাঁড়িয়ে কয়েকজন একর পর এক প্রশ্ন করে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে পাগলীকে ক্ষ্যাপানোর চিরাচরিত রূপ পাল্টে গেল যেন! প্রত্যেকের অভিব্যক্তিতে চিন্তার ছাপ। এ মুহূর্তে এদের দৃষ্টিতে সন্তান প্রসবরত এই নারীর ‘পাগলী’ পরিচয়ই মুখ্য ও প্রকট নয়। পাগলী চেঁচিয়ে হাত উঁচু করে বলল- “যাহ্ ... তোরা যাহ্...”

স্থানীয় বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলো একটু দূরে খেলায় মেতেছে। তারা পাগলীর বিষয়তে কিছুক্ষণ আটকে থেকে যে যার মতো ছিটকে গেছে। অন্যপাশে খেলার জন্য জড় হয়েছে আবার।

হৈ চৈ ঠেলা ঠেলির ভেতর থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক পাগলীর পক্ষ নিয়ে ওদের তাড়াতে উদ্দ্যত হলো। পাগলী পেছন ও দুপাশ হাতড়ে দু’চারটে ভাঙা ইট-পাটকেল তুলে ছুঁড়ে মারতে লাগলো। উঠোনের ধান থেকে কাকপক্ষী তাড়াতে বারান্দায় বসা গেরস্থ যেমন লাঠিলগি উঁচু করে; অমন ভঙ্গিতে পাগলী হাতের শেষ পাটকেলটি উঁচু করলো। তীব্র যন্ত্রণায় মোড়ামোড়ি করতে করতে শেষঅব্দি পাটকেলটি হাতছাড়া করেনি।

পেছন থেকে জয়ন্ত গরম জলের গামলাটা ধরে নিয়ে পথের মুখ থেকে সবাইকে সরে যেতে বলল। কোনোরকম ভিড় ঠেলে গলির মুখ থেকে ঘোপের ভেতরে ঢুকতেই দ্যাখে পাগলীর গুরুতর অবস্থা। জয়ন্ত পাগলীর পা’দুখানা দু’পাশে সরায়। তার উরুর কাছে আটকে থাকা রক্তমাখা থকথকে মাংসের দলাটাকে মুক্ত করে আলতো ভাবে তুলে ধরে দু’হাতের পরে। ততক্ষণে পাগলীর দম যায় যায়; ভীষণরকম হাঁপাচ্ছে। জয়ন্তর কাণ্ড দেখে গুঞ্জনরত উপস্থিত লোকগুলো থ হয়ে যায়। জয়ন্ত উষ্ণ জলে বাচ্চাটিকে চুবিয়ে তুলে সম্মুখে ও আশেপাশে অনির্দিষ্ট ভাবে খোঁজে একটু শুকনো কাপড়।

পাগলী রক্তবর্ণ চোখে তাকালো ওদের দিকে, হাতের কাছের সেই পাটকেলটা হাতে তুলে না ছুঁড়েই কী ভেবে ফেলে দেয়। জয়ন্তর হাতে বাচ্চার নড়াচড়া দেখে আঁচল এগিয়ে পেতে দেয়। তাতে পেঁচিয়ে বাচ্চাটিকে পাগলীর কোলের কাছে দেয়। জয়ন্ত লাগেজপত্র যেখানে রেখেছিল হেঁটে যায় সেদিকে।

ঘোপের ভেতর থেকে রক্ত গড়াতে গড়াতে চলে আসে গলির মুখে। তা দেখে পিছু হটতে থাকে দাঁড়ানো লোকগুলো। বাচ্চা কেঁদে ওঠে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে। পাগলী ওকে আঁচলে ঢেকে আরেকটু বুকে জড়িয়ে নেয়। পাশে খেলায় মেতে থাকা ছেলেমেয়েগুলো হঠাৎ খেলা থামিয়ে বাচ্চার কাছে এলো। অন্যদিনের মতো বালকগুলোকে তাড়ানোর জন্য পাগলী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেনি আজ। বরং ওদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসছে। সমস্ত মুখ জুড়ে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে পড়ার সাথে সাথে যেন মায়া ঝরছে পাগলীর চোখমুখ থেকে। এই বালকদের সাথে খেলতে খেলতে ওর বাচ্চাও বড় হবে। বালকগুলো এক এক করে এসে কেউ হাত নাড়ছে, কেউ পা, কেউ মাথায় আঙুল ছুঁয়ে আদরের ভঙ্গিতে বলছে- “খেলবি?” আরেকজন বালক বলল- “এক্ষণে আইছে দুনিয়াতে, ও-কি দুনিয়ার খেলা জানে! আগে বড় হোক!”