এপার-ওপার

জারিফ এ আলম

গতরাতে কালবোশৈখীর প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে শান্তিপুর গ্রামের ওপর দিয়ে। এই ঝড়ের হাত থেকে আশেপাশের অন্যান্য গ্রামও রক্ষা পায়নি। কারো বাড়ির ঘরের চাল উড়ে গেছে; আবার কারো বাড়ির গাছ উপড়ে গেছে। সকাল হতে না হতেই একটি কাকের কা-কা ধ্বনিতে হরিদাসের বাড়ির পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে। বিষয়টি যেমন করুণ, তেমনি বিরক্তির। এই কাকের একটি বাচ্চা ঝড়ের আক্রোশের শিকার। কাকটি ঝড়-বৃষ্টিতে টিকতে পারলেও বাচ্চাটিকে টেকানো যায়নি। কাকটি হয়তো অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিলো। কিন্তু কাকটির এতোটুকু বাচ্চা যে এখনো উড়তে শেখেনি তার বেঁচে থাকা সম্ভব হয়নি। তুমুল ঝড়ে প্রাণটি হারাতে হয়েছে। সকালে কাকটি তার জীর্ণশীর্ণ বাসার খোঁজ পেলেও বাচ্চাটিকে আর খুঁজে পায়নি। কিছু ছেলেমেয়ে আম কুড়োতে এসে কাকের এই মৃত বাচ্চাটিকে নিয়ে কোথায় উধাও করে ফেলেছে তার খোঁজ কে রাখে!

হরিদাসের বয়স্ক মা হয়তো ঘরের ভেতরে সাংসারিক কোনো কাজ করছিলেন। তিনি কাকের এই কা-কা ধ্বনি সহ্য করতে না পেরে কাক তাড়াতে এলেন। তিনি হুর! হুর! করে কাকটিকে তাড়াতে চেষ্টা করলেন বেশ কয়েকবার। নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন। তাতে খুব একটা কাজ হলো না। কাকটি শুধু এক ডাল থেতে আরেক ডালে গিয়ে স্থান বদল করলো।

হরিদাস দাওয়ায় বসে তার নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও বিষয়টি তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। দু-একবার চেয়ে দেখে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

হরিদাসের মা হরিদাসকে লক্ষ্য করে বললেন, ও হরি, কাউয়াটাকে একবারটি খেদিয়ে দে তো।

হরিদাস সরল হাসিতে বলে, শুধু শুধু কাকটিকে না তাড়ালি অয় না!

হরিদাসের মা বললেন, এসব তো মা-পিসিরা মান্যি করতো! কাক ডাকলে যে অমঙ্গল হয়। জেনেশুনে অঙ্গল ডেকে আনবো নাকি, এসব কী বলিস, বাবা!

হরিদাস বলল, তুমি যা জানো তা সব সত্যি হবি নাকি!

হরিদাসের মা বললেন, অতো কিছু বুঝি না বাবা। কাউয়াটাকে একটু খেদিয়ে দে না।

হরিদাস বলল, তুমি যাও না, আমার ম্যালা কাজ আছে।

এই বলে হরিদাস তার মুদি দোকানের দিকে চললো।

হরিদাস দোকান খুলে ধূপধুনো দিয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে দোকানে বসতেই তার এক কাকার সঙ্গে দেখা। এই কাকার নাম বিপিন। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা কম হলেও রাজনীতির বেশ খোঁজখবর রাখেন। দেশের কি হালচাল, গান্ধীজি কোথায় কেনো অনশন করলেন, জিন্নাহ সাহেবের কী অবস্থা, রাজনীতির নানা বিষয়ে তথ্য জানতে সবাই বিপিনের কাছ থেকেই জেনে নিতে পারে।

বিপিন হরিদাসকে জিজ্ঞেস করেন, কি হে হরি, কেমন আছিস?

হরিদাস ভক্তি নিয়ে জবাব দেয়, জি কাকা ভালো। ভগবান যেমন রাখে। আপনি কেমন আছেন?

বিপিন বলেন, দেশের অবস্থা ভালো নারে বুঝলি! দেশ নাকি ভাগ হয়ে যাবে। সব হিন্দুরা ইন্ডিয়া চলে যাবে। মুসলমানরা এই দেশে থাকবে।

হরিদাস বিস্ময় নিয়ে বলল, এসব কী বলছেন কাকা! আমাদের এই বাপ-ঠাকুরদার দেশ ছাড়ি কোথায় যাবো। জায়গা বলতে এই ভিটেটুকুন। তাও যদি ছেড়ে যেতি হয় আমরা উঠবো কোথায় গিয়ে?

বিপিন কিছুটা আশ্বাস আর সন্দেহের সুরে বললেন, এতো বড়ো বড়ো মানুষেরা পার্র্টিশন নিয়ে কথা বলছেন, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই ভাই ভাই করে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে সেখানে হয়তো দেশ ভাগ হবে না হয়তো।

হরিদাস চিন্তিত হয়ে বলল, ভগবান যেটা ভালো মনে করেন তাই হবে। আমরা আর কী করতে পারি!

বিপিন একটু আপত্তি জানিয়ে বললেন, দেখো হরি, কথায় কথায় ভগবানকে দায় ভার দিয়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নিজেরা সবসময় গা বাঁচিয়ে চলতে চাই। কিন্তু সুবিধা বলো আর অসুবিধাই বলো ভোগ করে কিন্তু মানুষেরাই।

হরিদাস কিছু না বলে না হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো বিপিনের দিকে।

কলকাতার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার পরে নোয়াখালী আর বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। সবই যেনো ঘটে চলেছে খুব দ্রুত। যাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই যারা দেশ-দুনিয়ার কিছুই বোঝে না, রাজনীতির কোনো ফাঁকফোকর বোঝে না, তাদের এখন শুধু অন্নের চিন্তা নয়, তার সঙ্গে আরেকটি চিন্তা যোগ হয়েছে সেটি হলো নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নিয়ে।

রাতে বিপিনের বাড়িতে জড়ো হয় কয়েকজন হিন্দু আর মুসলমান। উঠোনে সবাই মাদুর পেতে বসে কথা বলছিলো। হরিদাস দোকান বন্ধ করে সেও এসেছে। বিপিন হরিদাসকে দেখে বললেন, কি হে হরি, আজ যে বড়ো তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করলে?

আকাশে চাঁদ উঠলেও মেঘ এসে বারবার ঢেকে দিচ্ছে চাঁদের মুখ। একেই হয়তো বলে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি। এ-যেনো আশা-নিরাশার ছবি।

হরিদাস উত্তর দেয় অনেকটা ধরা গলায়, আমার এক পিসির ছেলে নোয়াখালির দাঙ্গায় মারা পড়েছে। তাই মনটা বেশি ভালো নেই, কাকা।

পিপিন চমকে ওঠেন। তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। আর জিজ্ঞেস করেন, বলো কী! তা তুমি দেখতে গেলে না?

হরিদাস অনুতাপের সুরে উত্তর দেয়, বেশ কিছুদিন ধরে তাদের সাথে আমাদের যোগযোগ নেই। আমরা খবর পেয়েছি তিন হপ্তা পরে।

বিপিন শুধু ্বললেন, ও!

হরিদাসের চোখের জল টপটপ করে পড়তে লাগলো।

বিপিন সকলকে বললেন, খবর পেয়ছি গান্ধীজী নোয়াখালী এসেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা মেটানোর জন্যে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় যায়!

আজ আর আসর বসলো না। তেমন কোনো আলাপও হলো না। হরিদাসের এই দুঃখজনক খবরই মূলত প্রধান কারণ।

গান্ধীজী ছমাস

ধরে নোয়াখালী থাকলেন। এই ভেবে যে, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সমঝোতা করে কোনো সুরাহা করা যায় কিনা। এরই মধ্যে নোয়াখালীর মানুষের নামে গান্ধীজীর ছাগল চুরির অপবাদ জুটলো। এ যেনো তার আসল উদ্দেশ্যকে চাপা দেয়ার চেষ্টা। ছমাস অতিক্রান্ত করে গান্ধীজী নোয়াখালী ত্যাগ করলেন।

বিপিন সমাজ-দেশ নিয়ে এতো সচেতন কিন্তু রাজনীতির বিষয় আশয় তার মাথায় এখন কিছুই ঢুকছে না। সবকিছু যেনো মুর্হূতেই ঘটে যাচ্ছে। বিপিনের বন্ধু পরিমল কী এক জরুরি বিষয় নিয়ে দেখা করতে এলেন। একসময় দুজনে কথা বলতে শুরু করলে রাত পার হয়ে যেতো, কথা ফুরোতো না।

রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিপিন আর পরিমলের জমিয়ে আড্ডা বসলো। পরিমলের পান খাওয়ার অভ্যাস। পান চিবোতে চিবোতে বললেন, আমি আর এখানে থাকছি না।

বিপিন কৌতূহল চেপে বললেন, এখানে থাকবি না তো যাবি কোথায়?

পরিমল বললেন, কলিকাতায় যাবো কলিতায়। এখানে তো ঠাঁই হবে না। কবে কার হাতে কাটা পড়ি তার কি আর ঠিক আছে!

-তা তোর বাবা-মা ভাইবোন এদের কোনো ব্যবস্থা হলো?

-এদের ব্যবস্থা আগেই করে ফেলেছি। ওদের সবাইকে কলিকাতার এক পিসেমশাইয়ের বাড়িতে পাাঠিয়ে দিয়েছি। মাঠের জমি বেচাবিক্রি শেষ। এখন পৈতৃক ভিটেটুকু, এটুকু বেচলেই নিশ্চিন্ত হতে পারি।

বিপিন এবার সত্যি সত্যি অবাক না হয়ে পারলেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন আবার, তোর বাবা-মা এসব বিক্রি করে কলিতায় যেতে রাজি হলো? তাদের নিজের হাতে গড়া এই বাড়ি, সাত পুরুষের গচ্ছিত এই ভিটে, বাঁধানো পুকুর ঘাট, মাঠের জমি এসব ছেড়ে যেতে মায়া হলো না!

পরিমল বলল, মায়া বলতে মায়া। আমি ওদের বলেছি, ভিটে চাইলে প্রাণও যাবে, যে-রকম নীরেন চাচার গিয়েছে। বাড়িতে আগুনে পুড়ে মরবে। বাড়িতে মৃত্যু বাড়িতেই শশ্মান। আর যদি প্রাণ বাঁচাতে চাও ভিটে ছাড়তে হবে। তোমরাই বলো কী করতে চাও। অগত্যা আর কী করবে বাড়ি ছাড়বার সিদ্ধান্তই ফাইনাল।

বিপিন বললেন, তুই তো কায়দা করে সবাইকে কলিকাতায় পাঠিয়ে দিলি; তুই তো এখন নিশ্চিন্ত। আর যারা এই দেশে থাকবে তাদের কী গতি হবে!

-তাদের কী হবে আমি জানি না। বাড়িটা বিক্রি করবো কোনো কাস্টমার পেলে খবর দিস। অবশ্য আরো কজনকে বলে রেখেছি।

বিপিনি এসব কথায় কান না দিয়ে বললেন, আচ্ছা, তোর বীরেন কাকা নাকি নীরেন কাকা তার ওই অবস্থা হলো কী করে?

পরিমল পানের পিক জানালার বাইরে বার কয়েক ফেলে বললেন, সেবার কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা হলো না, ওপারের হিন্দুরা মুসলমানদের কাটলো আর এপারের মুসলমানরা ভাবলো আমরা কেনো পিছিয়ে পড়বো? মারো কাটো। আগুন দিলো কয়েকটা হিন্দু বাড়িতে। সবাই পালিয়ে বাঁচতে পারলেও বাঁচতে পারলেন না নীরেন কাকা। তার ঘরের দরোজা বন্ধ করে আগুন দেয়া হলো। দশ বছরের মেয়েকে নিয়ে পুড়ে একেবারে অঙ্গার। শালা রাজনীতি মানেই সর্বনাশ হবে গরিব হাড়-হাভাতের। এ যেনো রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ায় প্রাণ যাবার মতো অবস্থা।

বিপিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। তাকে চিন্তিত দেখে পরিমল বললেন, তা তুই কী করবি ভেবেছিস কিছু?

বিপিন নিরাসক্তভাবে উত্তর দেন, আমি এই ভূ-খণ্ড ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। মৃত্যু নিয়ে অতো ভাবনাচিন্তা নেই। একটি ভাবনাই শুধু তাড়িয়ে বেড়ায় আর সেটি হলো, হিন্দু-মুসলমান একই আলোবাতাসে বেড়ে উঠলেও কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না, এতোই অসহিষ্ণু আমরা! এতোই আমাদের ঘৃণা-বিদ্বেষ এক ভাইয়ের রক্ত দিয়ে হাত রঞ্জিত করে আরেক ভাই উল্লাস করছে, ভাবা যায়!

পরিমল হাই তুলতে তুলতে জবাব দেন, ওতো ভাবাভাবির কাজ নেই। জীবন আগে আগে। বাকিসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।

বিপিন কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। পরিমল তাকে থামিয়ে দিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললেন, আর বেশি বকিস নাতো, একটু ঘুমুতে দে। এই বলে পরিমল সটান হয়ে শুয়ে পড়েন।

পত্রপত্রিকা মারফত অনেকেই জানতে পেরেছেন নেহেরু বলেছেন, পার্টিশন হলে মানুষ নতুন করে জীবন পরিচালিত করতে পারবে। কিন্তু সেটা কতোটুকু হবে সেটাই দেখার বিষয় এমন কথাই অনেকে বলেছেন।

হরিদাস তার বউ ইন্দুকে বলল, আমাদের তো এই দেশ ছাড়তি হবি, জানো কি কিছু?

ইন্দু বলল, মিনসের যে কথা, এ দেশ ছাড়ি কোথায় যাবো!

হরিদাস বলল, যখন ছাড়ি যেতি হবি তখন দেখবেখন।

ইন্দু প্রায় আর্তনাদ করে বলল, কী সব্বনেশে কথা গো! এই দেশ ছাড়ি গেলে আমরা যাবো কোথায়? আমাদের আর তো থাকার জায়গা নাইকো। মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুনও কি রক্ষে পাবে না?

হরিদাস ধমক দিয়ে বলে, না বুঝেই কান্না করবে না। মোটাবুদ্ধির মেয়েমানুষ যারা তারা না বুঝেই কান্না করে। তোমার কি মোটাবুদ্ধি?

ইন্দুর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ায় ইন্দু চুপে হয়ে যায়। আঁচল দিযে বার কয়েক চোখ মোছে।

হরিদাস এবার সান্ত¡না দিয়ে বলে, কান্না করি কী হবি, কপালটাই যে মন্দ! দোষ করে বড়ো মানুষে জ্বালা পোহাতি হয় আমাদের। এখন আবার দেশছাড়া!

এই বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হরিদাস।

হরিদাসকে সত্যি সত্যি পোটলাপুঁটলি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হলো। এক রাতের ব্যবধানে দুটি আলাদা দেশ হয়ে গেলো। হাঁটাপথেই হরিদাসের সঙ্গে বিপিনের দেখা। বিপিনের চোখমুখে চিন্তার ছাপ। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, হ্যাঁরে, চললি!

হরিদাস আর্দ্র কণ্ঠে শুধু বলল, হ্যাঁ, বিপিন কাকা। আমরা যে উদ্বাস্তু, আমাদের ঠঁিইটুকু যদি কেড়ে নিলো, প্রাণটুকু কেনো নিলো না! বলতে বলতে ভারি হয়ে গেলো কণ্ঠ।

পিপিন কোনো কথা বলতে পারলেন না। তার অন্তর্গত কান্না আসলে হরিদাসের বোঝার উপায় নেই। হরিদাসের মতো হাজার হরিদাস বুঝতেই পারলো না তাদের কী অপরাধ! কেনো তারা আজ দেশছাড়া!

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০

এপার-ওপার

জারিফ এ আলম

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

গতরাতে কালবোশৈখীর প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে শান্তিপুর গ্রামের ওপর দিয়ে। এই ঝড়ের হাত থেকে আশেপাশের অন্যান্য গ্রামও রক্ষা পায়নি। কারো বাড়ির ঘরের চাল উড়ে গেছে; আবার কারো বাড়ির গাছ উপড়ে গেছে। সকাল হতে না হতেই একটি কাকের কা-কা ধ্বনিতে হরিদাসের বাড়ির পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে। বিষয়টি যেমন করুণ, তেমনি বিরক্তির। এই কাকের একটি বাচ্চা ঝড়ের আক্রোশের শিকার। কাকটি ঝড়-বৃষ্টিতে টিকতে পারলেও বাচ্চাটিকে টেকানো যায়নি। কাকটি হয়তো অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিলো। কিন্তু কাকটির এতোটুকু বাচ্চা যে এখনো উড়তে শেখেনি তার বেঁচে থাকা সম্ভব হয়নি। তুমুল ঝড়ে প্রাণটি হারাতে হয়েছে। সকালে কাকটি তার জীর্ণশীর্ণ বাসার খোঁজ পেলেও বাচ্চাটিকে আর খুঁজে পায়নি। কিছু ছেলেমেয়ে আম কুড়োতে এসে কাকের এই মৃত বাচ্চাটিকে নিয়ে কোথায় উধাও করে ফেলেছে তার খোঁজ কে রাখে!

হরিদাসের বয়স্ক মা হয়তো ঘরের ভেতরে সাংসারিক কোনো কাজ করছিলেন। তিনি কাকের এই কা-কা ধ্বনি সহ্য করতে না পেরে কাক তাড়াতে এলেন। তিনি হুর! হুর! করে কাকটিকে তাড়াতে চেষ্টা করলেন বেশ কয়েকবার। নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করলেন। তাতে খুব একটা কাজ হলো না। কাকটি শুধু এক ডাল থেতে আরেক ডালে গিয়ে স্থান বদল করলো।

হরিদাস দাওয়ায় বসে তার নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও বিষয়টি তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। দু-একবার চেয়ে দেখে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

হরিদাসের মা হরিদাসকে লক্ষ্য করে বললেন, ও হরি, কাউয়াটাকে একবারটি খেদিয়ে দে তো।

হরিদাস সরল হাসিতে বলে, শুধু শুধু কাকটিকে না তাড়ালি অয় না!

হরিদাসের মা বললেন, এসব তো মা-পিসিরা মান্যি করতো! কাক ডাকলে যে অমঙ্গল হয়। জেনেশুনে অঙ্গল ডেকে আনবো নাকি, এসব কী বলিস, বাবা!

হরিদাস বলল, তুমি যা জানো তা সব সত্যি হবি নাকি!

হরিদাসের মা বললেন, অতো কিছু বুঝি না বাবা। কাউয়াটাকে একটু খেদিয়ে দে না।

হরিদাস বলল, তুমি যাও না, আমার ম্যালা কাজ আছে।

এই বলে হরিদাস তার মুদি দোকানের দিকে চললো।

হরিদাস দোকান খুলে ধূপধুনো দিয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে দোকানে বসতেই তার এক কাকার সঙ্গে দেখা। এই কাকার নাম বিপিন। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা কম হলেও রাজনীতির বেশ খোঁজখবর রাখেন। দেশের কি হালচাল, গান্ধীজি কোথায় কেনো অনশন করলেন, জিন্নাহ সাহেবের কী অবস্থা, রাজনীতির নানা বিষয়ে তথ্য জানতে সবাই বিপিনের কাছ থেকেই জেনে নিতে পারে।

বিপিন হরিদাসকে জিজ্ঞেস করেন, কি হে হরি, কেমন আছিস?

হরিদাস ভক্তি নিয়ে জবাব দেয়, জি কাকা ভালো। ভগবান যেমন রাখে। আপনি কেমন আছেন?

বিপিন বলেন, দেশের অবস্থা ভালো নারে বুঝলি! দেশ নাকি ভাগ হয়ে যাবে। সব হিন্দুরা ইন্ডিয়া চলে যাবে। মুসলমানরা এই দেশে থাকবে।

হরিদাস বিস্ময় নিয়ে বলল, এসব কী বলছেন কাকা! আমাদের এই বাপ-ঠাকুরদার দেশ ছাড়ি কোথায় যাবো। জায়গা বলতে এই ভিটেটুকুন। তাও যদি ছেড়ে যেতি হয় আমরা উঠবো কোথায় গিয়ে?

বিপিন কিছুটা আশ্বাস আর সন্দেহের সুরে বললেন, এতো বড়ো বড়ো মানুষেরা পার্র্টিশন নিয়ে কথা বলছেন, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই ভাই ভাই করে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে সেখানে হয়তো দেশ ভাগ হবে না হয়তো।

হরিদাস চিন্তিত হয়ে বলল, ভগবান যেটা ভালো মনে করেন তাই হবে। আমরা আর কী করতে পারি!

বিপিন একটু আপত্তি জানিয়ে বললেন, দেখো হরি, কথায় কথায় ভগবানকে দায় ভার দিয়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নিজেরা সবসময় গা বাঁচিয়ে চলতে চাই। কিন্তু সুবিধা বলো আর অসুবিধাই বলো ভোগ করে কিন্তু মানুষেরাই।

হরিদাস কিছু না বলে না হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো বিপিনের দিকে।

কলকাতার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার পরে নোয়াখালী আর বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। সবই যেনো ঘটে চলেছে খুব দ্রুত। যাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই যারা দেশ-দুনিয়ার কিছুই বোঝে না, রাজনীতির কোনো ফাঁকফোকর বোঝে না, তাদের এখন শুধু অন্নের চিন্তা নয়, তার সঙ্গে আরেকটি চিন্তা যোগ হয়েছে সেটি হলো নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নিয়ে।

রাতে বিপিনের বাড়িতে জড়ো হয় কয়েকজন হিন্দু আর মুসলমান। উঠোনে সবাই মাদুর পেতে বসে কথা বলছিলো। হরিদাস দোকান বন্ধ করে সেও এসেছে। বিপিন হরিদাসকে দেখে বললেন, কি হে হরি, আজ যে বড়ো তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করলে?

আকাশে চাঁদ উঠলেও মেঘ এসে বারবার ঢেকে দিচ্ছে চাঁদের মুখ। একেই হয়তো বলে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি। এ-যেনো আশা-নিরাশার ছবি।

হরিদাস উত্তর দেয় অনেকটা ধরা গলায়, আমার এক পিসির ছেলে নোয়াখালির দাঙ্গায় মারা পড়েছে। তাই মনটা বেশি ভালো নেই, কাকা।

পিপিন চমকে ওঠেন। তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। আর জিজ্ঞেস করেন, বলো কী! তা তুমি দেখতে গেলে না?

হরিদাস অনুতাপের সুরে উত্তর দেয়, বেশ কিছুদিন ধরে তাদের সাথে আমাদের যোগযোগ নেই। আমরা খবর পেয়েছি তিন হপ্তা পরে।

বিপিন শুধু ্বললেন, ও!

হরিদাসের চোখের জল টপটপ করে পড়তে লাগলো।

বিপিন সকলকে বললেন, খবর পেয়ছি গান্ধীজী নোয়াখালী এসেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা মেটানোর জন্যে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় যায়!

আজ আর আসর বসলো না। তেমন কোনো আলাপও হলো না। হরিদাসের এই দুঃখজনক খবরই মূলত প্রধান কারণ।

গান্ধীজী ছমাস

ধরে নোয়াখালী থাকলেন। এই ভেবে যে, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সমঝোতা করে কোনো সুরাহা করা যায় কিনা। এরই মধ্যে নোয়াখালীর মানুষের নামে গান্ধীজীর ছাগল চুরির অপবাদ জুটলো। এ যেনো তার আসল উদ্দেশ্যকে চাপা দেয়ার চেষ্টা। ছমাস অতিক্রান্ত করে গান্ধীজী নোয়াখালী ত্যাগ করলেন।

বিপিন সমাজ-দেশ নিয়ে এতো সচেতন কিন্তু রাজনীতির বিষয় আশয় তার মাথায় এখন কিছুই ঢুকছে না। সবকিছু যেনো মুর্হূতেই ঘটে যাচ্ছে। বিপিনের বন্ধু পরিমল কী এক জরুরি বিষয় নিয়ে দেখা করতে এলেন। একসময় দুজনে কথা বলতে শুরু করলে রাত পার হয়ে যেতো, কথা ফুরোতো না।

রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিপিন আর পরিমলের জমিয়ে আড্ডা বসলো। পরিমলের পান খাওয়ার অভ্যাস। পান চিবোতে চিবোতে বললেন, আমি আর এখানে থাকছি না।

বিপিন কৌতূহল চেপে বললেন, এখানে থাকবি না তো যাবি কোথায়?

পরিমল বললেন, কলিকাতায় যাবো কলিতায়। এখানে তো ঠাঁই হবে না। কবে কার হাতে কাটা পড়ি তার কি আর ঠিক আছে!

-তা তোর বাবা-মা ভাইবোন এদের কোনো ব্যবস্থা হলো?

-এদের ব্যবস্থা আগেই করে ফেলেছি। ওদের সবাইকে কলিকাতার এক পিসেমশাইয়ের বাড়িতে পাাঠিয়ে দিয়েছি। মাঠের জমি বেচাবিক্রি শেষ। এখন পৈতৃক ভিটেটুকু, এটুকু বেচলেই নিশ্চিন্ত হতে পারি।

বিপিন এবার সত্যি সত্যি অবাক না হয়ে পারলেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন আবার, তোর বাবা-মা এসব বিক্রি করে কলিতায় যেতে রাজি হলো? তাদের নিজের হাতে গড়া এই বাড়ি, সাত পুরুষের গচ্ছিত এই ভিটে, বাঁধানো পুকুর ঘাট, মাঠের জমি এসব ছেড়ে যেতে মায়া হলো না!

পরিমল বলল, মায়া বলতে মায়া। আমি ওদের বলেছি, ভিটে চাইলে প্রাণও যাবে, যে-রকম নীরেন চাচার গিয়েছে। বাড়িতে আগুনে পুড়ে মরবে। বাড়িতে মৃত্যু বাড়িতেই শশ্মান। আর যদি প্রাণ বাঁচাতে চাও ভিটে ছাড়তে হবে। তোমরাই বলো কী করতে চাও। অগত্যা আর কী করবে বাড়ি ছাড়বার সিদ্ধান্তই ফাইনাল।

বিপিন বললেন, তুই তো কায়দা করে সবাইকে কলিকাতায় পাঠিয়ে দিলি; তুই তো এখন নিশ্চিন্ত। আর যারা এই দেশে থাকবে তাদের কী গতি হবে!

-তাদের কী হবে আমি জানি না। বাড়িটা বিক্রি করবো কোনো কাস্টমার পেলে খবর দিস। অবশ্য আরো কজনকে বলে রেখেছি।

বিপিনি এসব কথায় কান না দিয়ে বললেন, আচ্ছা, তোর বীরেন কাকা নাকি নীরেন কাকা তার ওই অবস্থা হলো কী করে?

পরিমল পানের পিক জানালার বাইরে বার কয়েক ফেলে বললেন, সেবার কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা হলো না, ওপারের হিন্দুরা মুসলমানদের কাটলো আর এপারের মুসলমানরা ভাবলো আমরা কেনো পিছিয়ে পড়বো? মারো কাটো। আগুন দিলো কয়েকটা হিন্দু বাড়িতে। সবাই পালিয়ে বাঁচতে পারলেও বাঁচতে পারলেন না নীরেন কাকা। তার ঘরের দরোজা বন্ধ করে আগুন দেয়া হলো। দশ বছরের মেয়েকে নিয়ে পুড়ে একেবারে অঙ্গার। শালা রাজনীতি মানেই সর্বনাশ হবে গরিব হাড়-হাভাতের। এ যেনো রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ায় প্রাণ যাবার মতো অবস্থা।

বিপিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। তাকে চিন্তিত দেখে পরিমল বললেন, তা তুই কী করবি ভেবেছিস কিছু?

বিপিন নিরাসক্তভাবে উত্তর দেন, আমি এই ভূ-খণ্ড ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। মৃত্যু নিয়ে অতো ভাবনাচিন্তা নেই। একটি ভাবনাই শুধু তাড়িয়ে বেড়ায় আর সেটি হলো, হিন্দু-মুসলমান একই আলোবাতাসে বেড়ে উঠলেও কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না, এতোই অসহিষ্ণু আমরা! এতোই আমাদের ঘৃণা-বিদ্বেষ এক ভাইয়ের রক্ত দিয়ে হাত রঞ্জিত করে আরেক ভাই উল্লাস করছে, ভাবা যায়!

পরিমল হাই তুলতে তুলতে জবাব দেন, ওতো ভাবাভাবির কাজ নেই। জীবন আগে আগে। বাকিসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।

বিপিন কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। পরিমল তাকে থামিয়ে দিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললেন, আর বেশি বকিস নাতো, একটু ঘুমুতে দে। এই বলে পরিমল সটান হয়ে শুয়ে পড়েন।

পত্রপত্রিকা মারফত অনেকেই জানতে পেরেছেন নেহেরু বলেছেন, পার্টিশন হলে মানুষ নতুন করে জীবন পরিচালিত করতে পারবে। কিন্তু সেটা কতোটুকু হবে সেটাই দেখার বিষয় এমন কথাই অনেকে বলেছেন।

হরিদাস তার বউ ইন্দুকে বলল, আমাদের তো এই দেশ ছাড়তি হবি, জানো কি কিছু?

ইন্দু বলল, মিনসের যে কথা, এ দেশ ছাড়ি কোথায় যাবো!

হরিদাস বলল, যখন ছাড়ি যেতি হবি তখন দেখবেখন।

ইন্দু প্রায় আর্তনাদ করে বলল, কী সব্বনেশে কথা গো! এই দেশ ছাড়ি গেলে আমরা যাবো কোথায়? আমাদের আর তো থাকার জায়গা নাইকো। মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুনও কি রক্ষে পাবে না?

হরিদাস ধমক দিয়ে বলে, না বুঝেই কান্না করবে না। মোটাবুদ্ধির মেয়েমানুষ যারা তারা না বুঝেই কান্না করে। তোমার কি মোটাবুদ্ধি?

ইন্দুর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ায় ইন্দু চুপে হয়ে যায়। আঁচল দিযে বার কয়েক চোখ মোছে।

হরিদাস এবার সান্ত¡না দিয়ে বলে, কান্না করি কী হবি, কপালটাই যে মন্দ! দোষ করে বড়ো মানুষে জ্বালা পোহাতি হয় আমাদের। এখন আবার দেশছাড়া!

এই বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হরিদাস।

হরিদাসকে সত্যি সত্যি পোটলাপুঁটলি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হলো। এক রাতের ব্যবধানে দুটি আলাদা দেশ হয়ে গেলো। হাঁটাপথেই হরিদাসের সঙ্গে বিপিনের দেখা। বিপিনের চোখমুখে চিন্তার ছাপ। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, হ্যাঁরে, চললি!

হরিদাস আর্দ্র কণ্ঠে শুধু বলল, হ্যাঁ, বিপিন কাকা। আমরা যে উদ্বাস্তু, আমাদের ঠঁিইটুকু যদি কেড়ে নিলো, প্রাণটুকু কেনো নিলো না! বলতে বলতে ভারি হয়ে গেলো কণ্ঠ।

পিপিন কোনো কথা বলতে পারলেন না। তার অন্তর্গত কান্না আসলে হরিদাসের বোঝার উপায় নেই। হরিদাসের মতো হাজার হরিদাস বুঝতেই পারলো না তাদের কী অপরাধ! কেনো তারা আজ দেশছাড়া!