ফজল হাসান
ভ্রমণ : চার
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির নিচের তলায় চারটি মিউজিয়াম রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাদাত মিউজিয়াম অন্যতম। বাকি তিনটি মিউজিয়াম হলো অ্যান্টিক্যুইটিজ্ মিউজিয়াম, পাণ্ডুলিপি মিউজিয়াম এবং হিস্ট্রি অব সায়েন্স মিউজিয়াম। অ্যান্টিক্যুইটিজ্ মিউজিয়ামে ইসলাম প্রসারের আগ পর্যন্ত মিশরের ইতিহাস, বিশেষ করে ফ্যারাও থেকে শুরু করে রোমান সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন রাখা হয়েছে। এসব নিদর্শনের মধ্যে আছে ভূমধ্যসাগরের তলদেশ থেকে উদ্ধারকৃত নানান ধরনের পুরাকীর্তি। পাণ্ডুলিপি মিউজিয়ামে রয়েছে ছয় হাজারের বেশি দূর্লভ গ্রন্থ, মূল্যবান দলিল এবং দুষ্প্রাপ্য মানচিত্র। অন্যদিকে প্রদর্শনীর হিস্ট্রি অব সায়েন্স মিউজিয়ামে আছে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থাবলী। আমাদের দুর্ভাগ্যই যে, সময়ের স্বল্পতার জন্য সবগুলো মিউজিয়াম ঘুরে দেখতে পারিনি। তবে কৌতূহলী হয়ে সাদাত মিউজিয়ামে ঢুকেছিলাম। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত পরের পর্বে আছে।
পরিশেষে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি সম্পর্কে একটা কথাই বলার আছে এবং তাহলো প্রাচীন সময়ে লাইব্রেরির প্রবেশ পথে দালানের গায়ে খোদাই করে লেখা ছিল অ ঝধহরঃড়ৎরঁস ভড়ৎ ঃযব গরহফ, অর্থাৎ মনের জন্য স্বাস্থ্যকর স্থান। আসলেই তাই। এতে কোনো খাদ নেই। কেননা জ্ঞানপিপাসু এবং শিক্ষার্থীরা সেই লাইব্রেরিতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে মনের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি দেখা শেষ করে আমরা সিঁড়ি বেয়ে ভবনের নিচের তলায় নামি। সেখানে মিশরের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের স্মৃতি রক্ষার্থে প্ল্যানেটোরিয়ামের পাশেই রয়েছে সাদাত মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে ঢোকার মুখে ডান পাশে রয়েছে তার স্ট্যাচু। আমি দাঁড়িয়ে স্ট্যাচুর পাশে লেখা পড়ছিলাম। একসময় স্ট্যাচুর পাশে দাঁড়িতে সেলফি তোলার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু উল্টোদিকে বসা একজন হিজাব পরা নারী নিরাপত্তাকর্মী কেমন করে আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল, তার উত্তর আমার জানা নেই। যাহোক, ভদ্রমহিলা কাছে এসে চোস্ত ইংরেজিতে জানতে চাইলো আমি কি ছবি তুলতে চাই কিনা। আমি হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ি। তিনি কাছে এসে মোবাইল নিয়ে পেছনে সরে গিয়ে আমার ছবি তোলেন। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে করিডোর পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি।
সাদাত মিউজিয়ামটি মিসেস জেহান আল-সাদাত [আনোয়ার সাদাতের স্ত্রী] এবং মিসেস সুজান মোবারক [মিশরের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারকের স্ত্রী] ২০০৯ সালে মিউজিয়ামটি উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে আনোয়ার সাদাত (জন্ম ১৯১৮ এবং মৃত্যু ১৯৮১) ছিলেন মিশরের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তার আগে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর একজন চৌকষ কর্নেল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দেল নাসেরের মৃত্যুর পর ১৯৭০ সালে তিনি মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনোয়ার সাদাত ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুর যুদ্ধে মিশরকে নেতৃত্বে দিয়ে ইজরায়েলের দখল থেকে সিনাই উপত্যকা উদ্ধার করেন, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইজরায়েল দখল করেছিল। সেই ইয়ম কিপুর যুদ্ধের পরে তিনি মিশর এবং স্বল্প সময়ের জন্য আরব বিশ্বে সময় নায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে ইজরায়েলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক শান্তি চুক্তি করার জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে ইজরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগিনের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। বলা হয়, ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ পার্টির বিদ্রোহী আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সেই শান্তি চুক্তি। এ বিষয়ে বলতে গেলে পেছনে যেতে হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, একমাত্র সুদান ছাড়া আরব রাষ্ট্রগুলো এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই আনোয়ার সাদাত ইজরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। পরে তিনি প্যালেস্টাইনের বিষয়ে আরবরাষ্ট্র এবং পিএলওর সঙ্গে সমঝোতা করার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। সেই প্রত্যাখানের জের হিসেবে আরব লীগ থেকে মিশরকে দশ বছরর জন্য (১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল) বহিষ্কার করা হয়। যদিও সেই চুক্তি অনুসারে মিশর সিনাই উপত্যকা ফেরত পেয়েছিল, যা সাধারণ জনগণের কাছে ছিল মন্দের ভালো, কিন্তু ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দল দ্বিপাক্ষিক শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে আরো বেশি সোচ্চার হয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল যে, সেই শান্তি চুক্তির জন্য আনোয়ার সাদাত প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভাগাড়ে ঠেলে দিয়েছে।
মেহেরুন এবং সিস্টার মাই সাদাত মিউজিয়ামে ঢোকার মুখে টেলিভিশনের স্ক্রিনে আনোয়ার সাদাতের জীবন কাহিনী (ডক্যুমেন্টারি) দেখছিল। সেই সময় আমি মনের অজান্তেই দুপাশের প্রদর্শিত আইটেম দেখতে দেখতে এগোতে থাকি। সাদাত মিউজিয়ামে প্রয়াত প্রেসিডেন্টের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কড়িডোরের একপাশে তার প্রেসিডেন্সিয়াল অফিস। সেখানে রয়েছে চেয়ার, কাঠের বিশাল টেবিল এবং চেয়ারের ডান দিকে মেঝেতে হাত-ব্যাগ। আমি কিছুক্ষণ বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
একসময় আমি আরেকটু এগিয়ে যাই। সেখানে রয়েছে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো আনোয়ার সাদাতের কোট এবং টেবিলের ওপর এক পাশে তামাকের পাইপ, কলম, নোটবুক, রেডিও এবং এক কপি কোরান শরীফ, যা তিনি নিয়মিত পাঠ করতেন। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি কাঁচের ফ্রেমে বাঁধা তাঁর বিভিন্ন ধরনের মিলিটারি পোশাক।
তারপরেই কাঁচের ঘেরা আনোয়ার সাদাতের প্রিয় জলপাই রঙের পোশাকের দিকে এগিয়ে যাই। পাশেই আরবি, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় বিবরণ লেখা আছে। আমি পড়ার পরে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মুখে কোন রা নেই। আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার সময় তার পরনে ছিল সেই পোশাক। পোশাকের রোব বা স্যাশ-এ (নিচোল বা উত্তরীয়) এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। যাহোক, মিউজিয়ামের অভ্যন্তরে তার ব্যবহৃত প্রায় সব জিনিসই আছে, শুধু সশরীরে তিনি নেই। তবে তিনি বেঁচে আছেন মিশরীয়দের মন ও মননে, হৃদয়ের গভীরে।
একসময় তাকিয়ে দেখি মেহেরুন এবং সিস্টার মাই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই চুপচাপ। চোখেমুখে মন খারাপের ধূসর মেঘের ছায়া। নিস্তব্ধতার মধ্যে কিছুটা সময় কেটে যায়। যাহোক, সাদাত মিউজিয়াম দেখার পরে আমরা লাইব্রেরি ভবন থেকে বেরিয়ে এসে পেছন দিকে হাঁটতে থাকি। তখন সন্ধ্যার তরল অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে খোলা জায়গায় মানুষের ভিড়। অনেকেই সেখানে গিয়েছেন পড়ন্ত বিকেলের শেষ সময়টুকু নিংড়ে নিতে, কেউবা গিয়েছেন খানিকটা সময় সাগরের বিশালতাকে অনুভব করতে। কথায় বলে, সাগর এবং পাহাড়ের কাছে গেলে মানুষের মন বিশাল হয়। কিন্তু আমরা সেদিকে পা মাড়াইনি। কেননা সিস্টার মাই প্রস্তাব করে, ‘চলো, একটা স্পেশাল দোকানে কফি পান করি।’ আমি চট করে প্রস্তাবটা লুফে নিয়ে বললাম, ‘লেটস্ গো।’
কফি শপটি লাইব্রেরি চত্বরে ঢোকার বাম দিকে এবং মূল রাস্তার পাশে। আয়তনে খুবই ছোট। চার-পাঁচটা ছোট টেবিল, সঙ্গে চেয়ার। তাই রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় চেয়ার-টেবিল বিছানো আছে। কফি শপের ভেতরে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন টেবিল জুড়ে রীতিমতো গাদগাদি করে বসে আছে। আমাদের তিনজনকে ঢুকতে দেখে চারজনের টেবিলে বসা দু’জন উঠে আমাদের বসার জন্য অনুরোধ করে। বসার জায়গা পেয়ে আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একে তো সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে ছিল সারাদিনের ক্লান্তি, তার উপর আসার পথে সিস্টার মাই কফি শপের গুণকীর্তণ করার সময় সতর্ক করে ভিড়ের কথা বলেছিল। যাহোক, সিস্টার মাই শর্ট ব্ল্যাক, আমি চিনি ছাড়া কাপুচিনো এবং মেহেরুন হট চকলেট অর্ডার করি। কেননা চা বা কফির প্রতি মেহেরুনের কোনো আসক্তি নেই, তবে মাঝেমধ্যে সঙ্গ দেওয়ার জন্য হট চকোলেটে আপত্তি নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি শপের ভেতরে দু’জন লোক প্রবেশ করে এবং এক কোণে বসে। বসার কয়েক মিনিটের তাদের জন্য কফি পরিবেশন করা হয়। ইতোমধ্যে তারা বাক্স খুলে বাদ্যযন্ত্র বের করে। আমি ট্যাঁরা চোখে তাকিয়ে থাকি। জিজ্ঞাসা করার আগেই সিস্টার মাই বললো যে, ওরা সঙ্গীত শিল্পী এবং গান গেয়ে খদ্দেরদের চিত্তবিনোদন করবে। উল্লেখ্য, আলেকজান্দ্রিয়াকে ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ অর্থাৎ ‘সঙ্গীতের শহর’ বলা হয়। যাহোক, বাদ্যযন্ত্রে টুং টাং শব্দ করে অবশেষে ওরা গান শুরু করে। গানের ফাঁকে মাঝে মাঝে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল। কমন পড়ার জন্য সিস্টার মাই গানের সঙ্গে সুর মেলায়। এক ফাঁকে সিস্টার মাইয়ের মাধ্যমে শিল্পীদের অনুমতি নিয়ে মেহেরুন ভিডিও করে। একসময় সঙ্গীত শিল্পী এবং যন্ত্রবাদককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা কফি শপ থেকে বেরিয়ে আসি।
আলেকজান্দ্রিয়ার বুকে এক টুকরো রোমান সভ্যতার চিহ্ন অ্যাম্ফিথিয়েটার (বা নাট্যশালা)। শুধু আলেকজান্দ্রিয়ায় নয়, পুরো মিশরের একমাত্র অ্যাম্ফিথিয়েটার, যার অবস্থান আধুনিক আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘কম এল-দিক্কা’ (Kom el-Dikka) এলাকায়। ‘কম এল-দিক্কা’ আরবি শব্দ, যার অর্থ ধ্বংসস্তূপের পাহাড? বা ঢিঁবি। তৎকালীন সময়ে অ্যাম্ফিথিয়েটার বিভিন্ন মিউজিক্যাল শো এবং যুদ্ধের সময়ে সামরিক সম্মেলনের জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে অনেকের ধারণা যে, তখন হয়তো অ্যাম্ফিথিয়েটার কোনো ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়াম ছিল।
যাহোক, আলেকজান্দ্রিয়ায় আমাদের পরিকল্পিত ভ্রমণ তালিকায় অ্যাম্ফিথিয়েটারও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেননা আলেকজান্দ্রিয়া শহর এবং আশেপাশে যেসব জায়গায় প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শন আছে, তার মধ্যে রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার অন্যতম।
সেদিন খুব সকালেই নাস্তা সেরে সিস্টার মাইয়ের জন্য হোটেলের লবিতে এসে অপেক্ষায় করি। কথা মতো ঠিক ন’টায় এসে সিস্টার মাই উপস্থিতি। সালাম জানিয়েই বললো, ‘তোমার কি তৈরি?’ মেহেরুন কণ্ঠস্বরে রসিকতর সামান্য রস ঢেলে বললো, ‘তৈরি কিনা, দেখতেই তো পাচ্ছো।’ ‘তাহলে চলো। উবার অপেক্ষায় করছে’, বলেই সিস্টার মাই গটগট করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে ফুটপাতে। আমরা উবারে উঠি। আলেকজান্দ্রিয়ার ব্যস্ত এবং নামকরা সড়ক ‘কর্নিশ’ মোটামুটি ব্যস্ত ছিল। তাই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে খানিকটা বেশি সময় লেগেছে।
মূলত ‘অ্যাম্ফিথিয়েটার’ শব্দের অর্থ দু’টি থিয়েটার এবং কাঠামোগত দিক থেকে দেখতে অত্যন্ত চমৎকার এবং চিত্তাকর্ষক। সাধারণত ডাবল-সার্কুলার আকৃতিতে নির্মিত হয়। অ্যাম্ফিথিয়েটারের উপরে কোনো ছাদ নেই, এমনকি স্টেজে কোনো পর্দা নেই। তবে কাঠামোর মাঝখানে অর্কেষ্ট্রার অংশ যেখানে সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। এই অংশটি মার্বেলের তৈরি দু’টি বিশাল স্তম্ভের উপর ভর করে আছে এবং মেঝেতে রোমান মোজাইকের সূক্ষ্ম কারুকাজ। দর্শকদের অংশের উপরের দিকে পাঁচটি কম্পার্টমেন্ট ছিল, যা গুণিজন এবং বিত্তশালীদের জন্য নির্ধারিত। দুঃখজনক যে, ষষ্ঠ শতাব্দিতে পুরো আলেকজান্দ্রিয়া শহর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অ্যাম্ফিথিয়েটারের বিভিন্ন অংশও ধ্বংস হয়।
আমাদের এবং নিজের জন্য সিস্টার মাই টিকেট ক্রয় করে। এখানেও স্বদেশী এবং বিদেশীদের জন্য টিকেটের মূল্য আলাদা। গেটে বসা দারোয়ানকে টিকেট দেখিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। ঢুকেই দেখি ডানে-বায়ে, আশেপাশে এবং উপরে নিচে রাজকীয় হালে দশ-বারোটা বিড়ালের আনাগোনা। কেউ কিছু বলে না, এমনকি কর্তৃপক্ষও না।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার আগে আমি মনের অজান্তেই অ্যাম্ফিথিয়েটারের উল্টো দিকের উঁচু জায়গার গ্যালারির দিকে হাঁটতে থাকি। গ্যালারি উপর থেকে ছবি তুলি। কয়েক মিনিট পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সেই সময় আমি যেন টাইম মেশিনে চেপে দু’হাজার আগের দিনে ফিরে যাই। আমার কল্পনায় ভেসে উঠে সেই সব দিনগুলোয় অ্যাম্ফিথিয়েটারে অনুষ্ঠিত সঙ্গীতানুষ্ঠানের দৃশ্য এবং সুরের মনোমুগ্ধকর মূর্ছনা।
কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ভাবছিলাম, জানি না। হয়তো দু’মিনিট, এমনকি দশ মিনিটও হতে পারে। যাহোক, একসময় সম্বিৎ ফিরে এলে তাকিয়ে দেখি মেহেরুন এবং মাই তরতর করে ডানপাশের সিঁড়ি ভেঙে নেমে যাচ্ছে নিচে। ত্রস্তব্যস্ত হয়ে আমিও তাদের অনুসরণ করে নিচে নেমে যাই। সিঁড়িগুলো বেশ খাড়া। নামার সময় আমাকে খানিকটা সাবধানী হতে হয়েছে। তখন দুপুর ছিল, তাই হয়তো দর্শকদের তেমন ভিড় ছিল না। তবে দশ-বারো জন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে ছিল।
বিশাল এলাকা জুড়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার এবং আশেপাশের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল দ্বিতীয় শতাব্দীতে। এসব স্থাপনা গ্রীক-রোমান স্থাপত্যের অতি পরিচিত স্থাপত্য শৈলী। অ্যাম্ফিথিয়েটারের ব্যস প্রায় বিয়াল্লিশ মিটার এবং সেখানে আনুমানিক ছয় শ’ দর্শকদের বসার ব্যবস্থা ছিল। তাদের বসার জন্য রয়েছে তেরটি অর্ধ-বৃত্তাকার সাদা এবং ধূসর বর্ণের মার্বেল পাথরের সারি, যা এখনো স্পষ্ট দেখা যায়। থিয়েটারের সবচেয়ে নিচের স্তরটি গোলাপী রঙের গ্রানাইট পাথরের তৈরি।
আলেকজান্দ্রিয়ার রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার ১৯৬০ সালে নিছক কাকতালীয়ভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফাঁকা জায়গার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং একসময় গভর্নরকে জিজ্ঞেস করেন খালি জায়গায় কী করা হবে। তখন গভর্নর সেখানে মিউনিসিপ্যাল অফিসের দালান নির্মাণ করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুমতি চাইলেন। অনুমতি পাওয়ার পর গভর্নর খনন কাজ শুরু করেন। তখনই শ্রমিকরা জমি পরিষ্কার করার সময় ধুলো ও বালি সরিয়ে কয়েকটি শক্ত লৌহ নির্মিত থামের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। সবাই ধারণা করে যে, হয়তো মাটির নিচে কিছু চাপা পড়ে আছে। পরবর্তীতে নির্মাণ কাজ স্থগিত রেখে খনন কাজ চালানো হয় এবং আবিষ্কৃত হয় গ্রেকো-রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার, যা বিংশ শতকে মিশরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তারপর ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয় আশেপাশের বিভিন্ন স্থাপনা। এ পর্যন্ত খনন করে ছ’টি আলাদা অংশ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো হলো: অ্যাম্ফিথিয়েটার, অডিটোরিয়া, স্নানাগার, আবাসিক ঘরবাড়ি, বাসস্থান এবং উন্মুক্ত জাদুঘর। যাহোক, এসব স্থাপনার সংক্ষিপ্ত বিবরণী পথের পাশে বিভিন্ন জায়গায় নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো আছে। আমি সেগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেই এবং নিজের জ্ঞানের সীমানা বাড়াই।
বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০
ফজল হাসান
ভ্রমণ : চার
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির নিচের তলায় চারটি মিউজিয়াম রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাদাত মিউজিয়াম অন্যতম। বাকি তিনটি মিউজিয়াম হলো অ্যান্টিক্যুইটিজ্ মিউজিয়াম, পাণ্ডুলিপি মিউজিয়াম এবং হিস্ট্রি অব সায়েন্স মিউজিয়াম। অ্যান্টিক্যুইটিজ্ মিউজিয়ামে ইসলাম প্রসারের আগ পর্যন্ত মিশরের ইতিহাস, বিশেষ করে ফ্যারাও থেকে শুরু করে রোমান সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন রাখা হয়েছে। এসব নিদর্শনের মধ্যে আছে ভূমধ্যসাগরের তলদেশ থেকে উদ্ধারকৃত নানান ধরনের পুরাকীর্তি। পাণ্ডুলিপি মিউজিয়ামে রয়েছে ছয় হাজারের বেশি দূর্লভ গ্রন্থ, মূল্যবান দলিল এবং দুষ্প্রাপ্য মানচিত্র। অন্যদিকে প্রদর্শনীর হিস্ট্রি অব সায়েন্স মিউজিয়ামে আছে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থাবলী। আমাদের দুর্ভাগ্যই যে, সময়ের স্বল্পতার জন্য সবগুলো মিউজিয়াম ঘুরে দেখতে পারিনি। তবে কৌতূহলী হয়ে সাদাত মিউজিয়ামে ঢুকেছিলাম। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত পরের পর্বে আছে।
পরিশেষে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি সম্পর্কে একটা কথাই বলার আছে এবং তাহলো প্রাচীন সময়ে লাইব্রেরির প্রবেশ পথে দালানের গায়ে খোদাই করে লেখা ছিল অ ঝধহরঃড়ৎরঁস ভড়ৎ ঃযব গরহফ, অর্থাৎ মনের জন্য স্বাস্থ্যকর স্থান। আসলেই তাই। এতে কোনো খাদ নেই। কেননা জ্ঞানপিপাসু এবং শিক্ষার্থীরা সেই লাইব্রেরিতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে মনের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি দেখা শেষ করে আমরা সিঁড়ি বেয়ে ভবনের নিচের তলায় নামি। সেখানে মিশরের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের স্মৃতি রক্ষার্থে প্ল্যানেটোরিয়ামের পাশেই রয়েছে সাদাত মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে ঢোকার মুখে ডান পাশে রয়েছে তার স্ট্যাচু। আমি দাঁড়িয়ে স্ট্যাচুর পাশে লেখা পড়ছিলাম। একসময় স্ট্যাচুর পাশে দাঁড়িতে সেলফি তোলার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু উল্টোদিকে বসা একজন হিজাব পরা নারী নিরাপত্তাকর্মী কেমন করে আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল, তার উত্তর আমার জানা নেই। যাহোক, ভদ্রমহিলা কাছে এসে চোস্ত ইংরেজিতে জানতে চাইলো আমি কি ছবি তুলতে চাই কিনা। আমি হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ি। তিনি কাছে এসে মোবাইল নিয়ে পেছনে সরে গিয়ে আমার ছবি তোলেন। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে করিডোর পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি।
সাদাত মিউজিয়ামটি মিসেস জেহান আল-সাদাত [আনোয়ার সাদাতের স্ত্রী] এবং মিসেস সুজান মোবারক [মিশরের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারকের স্ত্রী] ২০০৯ সালে মিউজিয়ামটি উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে আনোয়ার সাদাত (জন্ম ১৯১৮ এবং মৃত্যু ১৯৮১) ছিলেন মিশরের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তার আগে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর একজন চৌকষ কর্নেল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দেল নাসেরের মৃত্যুর পর ১৯৭০ সালে তিনি মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনোয়ার সাদাত ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুর যুদ্ধে মিশরকে নেতৃত্বে দিয়ে ইজরায়েলের দখল থেকে সিনাই উপত্যকা উদ্ধার করেন, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইজরায়েল দখল করেছিল। সেই ইয়ম কিপুর যুদ্ধের পরে তিনি মিশর এবং স্বল্প সময়ের জন্য আরব বিশ্বে সময় নায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে ইজরায়েলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক শান্তি চুক্তি করার জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে ইজরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগিনের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। বলা হয়, ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ পার্টির বিদ্রোহী আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সেই শান্তি চুক্তি। এ বিষয়ে বলতে গেলে পেছনে যেতে হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, একমাত্র সুদান ছাড়া আরব রাষ্ট্রগুলো এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই আনোয়ার সাদাত ইজরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। পরে তিনি প্যালেস্টাইনের বিষয়ে আরবরাষ্ট্র এবং পিএলওর সঙ্গে সমঝোতা করার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। সেই প্রত্যাখানের জের হিসেবে আরব লীগ থেকে মিশরকে দশ বছরর জন্য (১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল) বহিষ্কার করা হয়। যদিও সেই চুক্তি অনুসারে মিশর সিনাই উপত্যকা ফেরত পেয়েছিল, যা সাধারণ জনগণের কাছে ছিল মন্দের ভালো, কিন্তু ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দল দ্বিপাক্ষিক শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে আরো বেশি সোচ্চার হয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল যে, সেই শান্তি চুক্তির জন্য আনোয়ার সাদাত প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভাগাড়ে ঠেলে দিয়েছে।
মেহেরুন এবং সিস্টার মাই সাদাত মিউজিয়ামে ঢোকার মুখে টেলিভিশনের স্ক্রিনে আনোয়ার সাদাতের জীবন কাহিনী (ডক্যুমেন্টারি) দেখছিল। সেই সময় আমি মনের অজান্তেই দুপাশের প্রদর্শিত আইটেম দেখতে দেখতে এগোতে থাকি। সাদাত মিউজিয়ামে প্রয়াত প্রেসিডেন্টের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কড়িডোরের একপাশে তার প্রেসিডেন্সিয়াল অফিস। সেখানে রয়েছে চেয়ার, কাঠের বিশাল টেবিল এবং চেয়ারের ডান দিকে মেঝেতে হাত-ব্যাগ। আমি কিছুক্ষণ বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
একসময় আমি আরেকটু এগিয়ে যাই। সেখানে রয়েছে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো আনোয়ার সাদাতের কোট এবং টেবিলের ওপর এক পাশে তামাকের পাইপ, কলম, নোটবুক, রেডিও এবং এক কপি কোরান শরীফ, যা তিনি নিয়মিত পাঠ করতেন। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি কাঁচের ফ্রেমে বাঁধা তাঁর বিভিন্ন ধরনের মিলিটারি পোশাক।
তারপরেই কাঁচের ঘেরা আনোয়ার সাদাতের প্রিয় জলপাই রঙের পোশাকের দিকে এগিয়ে যাই। পাশেই আরবি, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় বিবরণ লেখা আছে। আমি পড়ার পরে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মুখে কোন রা নেই। আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার সময় তার পরনে ছিল সেই পোশাক। পোশাকের রোব বা স্যাশ-এ (নিচোল বা উত্তরীয়) এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। যাহোক, মিউজিয়ামের অভ্যন্তরে তার ব্যবহৃত প্রায় সব জিনিসই আছে, শুধু সশরীরে তিনি নেই। তবে তিনি বেঁচে আছেন মিশরীয়দের মন ও মননে, হৃদয়ের গভীরে।
একসময় তাকিয়ে দেখি মেহেরুন এবং সিস্টার মাই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই চুপচাপ। চোখেমুখে মন খারাপের ধূসর মেঘের ছায়া। নিস্তব্ধতার মধ্যে কিছুটা সময় কেটে যায়। যাহোক, সাদাত মিউজিয়াম দেখার পরে আমরা লাইব্রেরি ভবন থেকে বেরিয়ে এসে পেছন দিকে হাঁটতে থাকি। তখন সন্ধ্যার তরল অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে খোলা জায়গায় মানুষের ভিড়। অনেকেই সেখানে গিয়েছেন পড়ন্ত বিকেলের শেষ সময়টুকু নিংড়ে নিতে, কেউবা গিয়েছেন খানিকটা সময় সাগরের বিশালতাকে অনুভব করতে। কথায় বলে, সাগর এবং পাহাড়ের কাছে গেলে মানুষের মন বিশাল হয়। কিন্তু আমরা সেদিকে পা মাড়াইনি। কেননা সিস্টার মাই প্রস্তাব করে, ‘চলো, একটা স্পেশাল দোকানে কফি পান করি।’ আমি চট করে প্রস্তাবটা লুফে নিয়ে বললাম, ‘লেটস্ গো।’
কফি শপটি লাইব্রেরি চত্বরে ঢোকার বাম দিকে এবং মূল রাস্তার পাশে। আয়তনে খুবই ছোট। চার-পাঁচটা ছোট টেবিল, সঙ্গে চেয়ার। তাই রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় চেয়ার-টেবিল বিছানো আছে। কফি শপের ভেতরে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন টেবিল জুড়ে রীতিমতো গাদগাদি করে বসে আছে। আমাদের তিনজনকে ঢুকতে দেখে চারজনের টেবিলে বসা দু’জন উঠে আমাদের বসার জন্য অনুরোধ করে। বসার জায়গা পেয়ে আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একে তো সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে ছিল সারাদিনের ক্লান্তি, তার উপর আসার পথে সিস্টার মাই কফি শপের গুণকীর্তণ করার সময় সতর্ক করে ভিড়ের কথা বলেছিল। যাহোক, সিস্টার মাই শর্ট ব্ল্যাক, আমি চিনি ছাড়া কাপুচিনো এবং মেহেরুন হট চকলেট অর্ডার করি। কেননা চা বা কফির প্রতি মেহেরুনের কোনো আসক্তি নেই, তবে মাঝেমধ্যে সঙ্গ দেওয়ার জন্য হট চকোলেটে আপত্তি নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি শপের ভেতরে দু’জন লোক প্রবেশ করে এবং এক কোণে বসে। বসার কয়েক মিনিটের তাদের জন্য কফি পরিবেশন করা হয়। ইতোমধ্যে তারা বাক্স খুলে বাদ্যযন্ত্র বের করে। আমি ট্যাঁরা চোখে তাকিয়ে থাকি। জিজ্ঞাসা করার আগেই সিস্টার মাই বললো যে, ওরা সঙ্গীত শিল্পী এবং গান গেয়ে খদ্দেরদের চিত্তবিনোদন করবে। উল্লেখ্য, আলেকজান্দ্রিয়াকে ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ অর্থাৎ ‘সঙ্গীতের শহর’ বলা হয়। যাহোক, বাদ্যযন্ত্রে টুং টাং শব্দ করে অবশেষে ওরা গান শুরু করে। গানের ফাঁকে মাঝে মাঝে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল। কমন পড়ার জন্য সিস্টার মাই গানের সঙ্গে সুর মেলায়। এক ফাঁকে সিস্টার মাইয়ের মাধ্যমে শিল্পীদের অনুমতি নিয়ে মেহেরুন ভিডিও করে। একসময় সঙ্গীত শিল্পী এবং যন্ত্রবাদককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা কফি শপ থেকে বেরিয়ে আসি।
আলেকজান্দ্রিয়ার বুকে এক টুকরো রোমান সভ্যতার চিহ্ন অ্যাম্ফিথিয়েটার (বা নাট্যশালা)। শুধু আলেকজান্দ্রিয়ায় নয়, পুরো মিশরের একমাত্র অ্যাম্ফিথিয়েটার, যার অবস্থান আধুনিক আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘কম এল-দিক্কা’ (Kom el-Dikka) এলাকায়। ‘কম এল-দিক্কা’ আরবি শব্দ, যার অর্থ ধ্বংসস্তূপের পাহাড? বা ঢিঁবি। তৎকালীন সময়ে অ্যাম্ফিথিয়েটার বিভিন্ন মিউজিক্যাল শো এবং যুদ্ধের সময়ে সামরিক সম্মেলনের জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে অনেকের ধারণা যে, তখন হয়তো অ্যাম্ফিথিয়েটার কোনো ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়াম ছিল।
যাহোক, আলেকজান্দ্রিয়ায় আমাদের পরিকল্পিত ভ্রমণ তালিকায় অ্যাম্ফিথিয়েটারও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেননা আলেকজান্দ্রিয়া শহর এবং আশেপাশে যেসব জায়গায় প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শন আছে, তার মধ্যে রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার অন্যতম।
সেদিন খুব সকালেই নাস্তা সেরে সিস্টার মাইয়ের জন্য হোটেলের লবিতে এসে অপেক্ষায় করি। কথা মতো ঠিক ন’টায় এসে সিস্টার মাই উপস্থিতি। সালাম জানিয়েই বললো, ‘তোমার কি তৈরি?’ মেহেরুন কণ্ঠস্বরে রসিকতর সামান্য রস ঢেলে বললো, ‘তৈরি কিনা, দেখতেই তো পাচ্ছো।’ ‘তাহলে চলো। উবার অপেক্ষায় করছে’, বলেই সিস্টার মাই গটগট করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে ফুটপাতে। আমরা উবারে উঠি। আলেকজান্দ্রিয়ার ব্যস্ত এবং নামকরা সড়ক ‘কর্নিশ’ মোটামুটি ব্যস্ত ছিল। তাই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে খানিকটা বেশি সময় লেগেছে।
মূলত ‘অ্যাম্ফিথিয়েটার’ শব্দের অর্থ দু’টি থিয়েটার এবং কাঠামোগত দিক থেকে দেখতে অত্যন্ত চমৎকার এবং চিত্তাকর্ষক। সাধারণত ডাবল-সার্কুলার আকৃতিতে নির্মিত হয়। অ্যাম্ফিথিয়েটারের উপরে কোনো ছাদ নেই, এমনকি স্টেজে কোনো পর্দা নেই। তবে কাঠামোর মাঝখানে অর্কেষ্ট্রার অংশ যেখানে সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। এই অংশটি মার্বেলের তৈরি দু’টি বিশাল স্তম্ভের উপর ভর করে আছে এবং মেঝেতে রোমান মোজাইকের সূক্ষ্ম কারুকাজ। দর্শকদের অংশের উপরের দিকে পাঁচটি কম্পার্টমেন্ট ছিল, যা গুণিজন এবং বিত্তশালীদের জন্য নির্ধারিত। দুঃখজনক যে, ষষ্ঠ শতাব্দিতে পুরো আলেকজান্দ্রিয়া শহর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অ্যাম্ফিথিয়েটারের বিভিন্ন অংশও ধ্বংস হয়।
আমাদের এবং নিজের জন্য সিস্টার মাই টিকেট ক্রয় করে। এখানেও স্বদেশী এবং বিদেশীদের জন্য টিকেটের মূল্য আলাদা। গেটে বসা দারোয়ানকে টিকেট দেখিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। ঢুকেই দেখি ডানে-বায়ে, আশেপাশে এবং উপরে নিচে রাজকীয় হালে দশ-বারোটা বিড়ালের আনাগোনা। কেউ কিছু বলে না, এমনকি কর্তৃপক্ষও না।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার আগে আমি মনের অজান্তেই অ্যাম্ফিথিয়েটারের উল্টো দিকের উঁচু জায়গার গ্যালারির দিকে হাঁটতে থাকি। গ্যালারি উপর থেকে ছবি তুলি। কয়েক মিনিট পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সেই সময় আমি যেন টাইম মেশিনে চেপে দু’হাজার আগের দিনে ফিরে যাই। আমার কল্পনায় ভেসে উঠে সেই সব দিনগুলোয় অ্যাম্ফিথিয়েটারে অনুষ্ঠিত সঙ্গীতানুষ্ঠানের দৃশ্য এবং সুরের মনোমুগ্ধকর মূর্ছনা।
কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ভাবছিলাম, জানি না। হয়তো দু’মিনিট, এমনকি দশ মিনিটও হতে পারে। যাহোক, একসময় সম্বিৎ ফিরে এলে তাকিয়ে দেখি মেহেরুন এবং মাই তরতর করে ডানপাশের সিঁড়ি ভেঙে নেমে যাচ্ছে নিচে। ত্রস্তব্যস্ত হয়ে আমিও তাদের অনুসরণ করে নিচে নেমে যাই। সিঁড়িগুলো বেশ খাড়া। নামার সময় আমাকে খানিকটা সাবধানী হতে হয়েছে। তখন দুপুর ছিল, তাই হয়তো দর্শকদের তেমন ভিড় ছিল না। তবে দশ-বারো জন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে ছিল।
বিশাল এলাকা জুড়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার এবং আশেপাশের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল দ্বিতীয় শতাব্দীতে। এসব স্থাপনা গ্রীক-রোমান স্থাপত্যের অতি পরিচিত স্থাপত্য শৈলী। অ্যাম্ফিথিয়েটারের ব্যস প্রায় বিয়াল্লিশ মিটার এবং সেখানে আনুমানিক ছয় শ’ দর্শকদের বসার ব্যবস্থা ছিল। তাদের বসার জন্য রয়েছে তেরটি অর্ধ-বৃত্তাকার সাদা এবং ধূসর বর্ণের মার্বেল পাথরের সারি, যা এখনো স্পষ্ট দেখা যায়। থিয়েটারের সবচেয়ে নিচের স্তরটি গোলাপী রঙের গ্রানাইট পাথরের তৈরি।
আলেকজান্দ্রিয়ার রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার ১৯৬০ সালে নিছক কাকতালীয়ভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফাঁকা জায়গার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং একসময় গভর্নরকে জিজ্ঞেস করেন খালি জায়গায় কী করা হবে। তখন গভর্নর সেখানে মিউনিসিপ্যাল অফিসের দালান নির্মাণ করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুমতি চাইলেন। অনুমতি পাওয়ার পর গভর্নর খনন কাজ শুরু করেন। তখনই শ্রমিকরা জমি পরিষ্কার করার সময় ধুলো ও বালি সরিয়ে কয়েকটি শক্ত লৌহ নির্মিত থামের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। সবাই ধারণা করে যে, হয়তো মাটির নিচে কিছু চাপা পড়ে আছে। পরবর্তীতে নির্মাণ কাজ স্থগিত রেখে খনন কাজ চালানো হয় এবং আবিষ্কৃত হয় গ্রেকো-রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার, যা বিংশ শতকে মিশরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তারপর ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয় আশেপাশের বিভিন্ন স্থাপনা। এ পর্যন্ত খনন করে ছ’টি আলাদা অংশ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো হলো: অ্যাম্ফিথিয়েটার, অডিটোরিয়া, স্নানাগার, আবাসিক ঘরবাড়ি, বাসস্থান এবং উন্মুক্ত জাদুঘর। যাহোক, এসব স্থাপনার সংক্ষিপ্ত বিবরণী পথের পাশে বিভিন্ন জায়গায় নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো আছে। আমি সেগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেই এবং নিজের জ্ঞানের সীমানা বাড়াই।