নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলা বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন

গতকাল ছিল দিনাজপুর ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনে তৎকালীন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন শহরে কতিপয় বিপথগামী পুলিশ কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। এ ঘটনায় প্রতিবাদী জনতার মিছিলের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে সাতটি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। প্রতিবাদী যুবক সামু, গ্রামের নিরীহ কৃষক কাদের ও রিকশাচালক সিরাজের লাশ পাওয়া গেলেও বাকি ৪টি লাশ পুলিশ গুম করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই থেকে তাদের স্মরণে ২৭ আগস্ট দিনাজপুর ট্র্যাজেডি দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি স্মরণে প্রতিবছরের মতো গতকাল দুপুর ১২টায় দশমাইল পূর্ব সাদিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শহীদ ‘সামু-কাদের-সিরাজ’ একাডেমিক ভবনে স্মরণে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী নেতা ও দিনাজপুর-১ সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল।

প্রধান অতিথি এমপি গোপাল বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। কিন্তু আজও কি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে? এর কারণ হলো মামলার দীর্ঘসূত্রতা। দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তাই নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলাগুলো বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দিনাজপুরের সহজ-সরল ও বাহে মানুষগুলো ৯৫’র ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ করে দেখিয়েছেন তাদের বাহুকার জোর কত। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে আমরা যে বিচার পেয়েছি তা বিশে^র ইতিহাসে বিরল। পুলিশ কিশোরী ইয়াসমিনকে পতিতা বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন যদি দিনাজপুরের মানুষ জেগে না উঠত তাহলে হয়তো অপরাধী পুলিশের বদলে আমার ফাঁসি হতো। তিনি আরও বলেন, বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার প্রতিনিধি সে সময় দিনাজপুরে এসে সাধারণ মানুষের আট দফা দাবি মেনে নিলেও তারা তা বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মামলা প্রত্যাহারসহ নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

শহীদ সামু-কাদের-সিরাজ স্মরণ কমিটির আহ্বায়ক মো. মজিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বরূপ বকসী বাচ্চু, সুন্দরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শরিফউদ্দিন, সুন্দরপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হামিদুল ইসলাম, কাহারোল উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. বজলুর করিম বাবুল।

উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কিশোরী ইয়াসমিন ৩ পুলিশ সদস্যের দ্বারা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়ায় দোষী পুলিশদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ২৭ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিতে শহরের রামনগর মাঠ হতে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল বের করে। মিছিলটি যখন শহরের তৎকালীন লিলি সিনেমা মোড় হয়ে পূর্বদিকে সদর হাসপাতাল হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিল, তখন মুন্সিপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি ও রাস্তায় থাকা বিপুল সংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ একযোগে প্রতিবাদী জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ ও অসংখ্য টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশের গুলিতে সামু, কাদের ও সিরাজসহ নাম না জানা ৭ জন নিহত হয়। আহত হয় ৩ শতাধিক। তৎকালীন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি প্রবীণ জননেতা অ্যাডভোকেট এম. আবদুর রহিমের নেতৃত্বে আইনজীবীদের একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে অবস্থিত ৪টি পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশের ৪টি পিকআপ ভ্যান জ্বালিয়ে দেয়। বিক্ষোভের এই সুযোগ নিয়ে কতিপয় সাদা পোশাকধারী সরকারি লোক জনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে দিনাজপুর প্রেসক্লাবসহ স্থানীয় ৫টি পত্রিকা অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সন্ধ্যায় শহরে জারি করা হয় কারফিউ। পুলিশ প্রত্যাহার করে শহরে নামানো হয় তৎকালীন বিডিআর বাহিনীর সদস্যদের।

জনতার উত্তাল আন্দোলনের চাপে তৎকালীন সরকার সে সময়কার জেলা প্রশাসক মো. জব্বার ফারুক ও পুলিশ সুপার আবদুল মোতালেবকে ২৯ আগস্ট প্রত্যাহার করে নেয়। জেলার সব পুলিশ বাহিনীর সদস্য পরিবর্তন করা হয়। আন্দেলনের তীব্রতা অনুমান করে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে পুলিশের এএসআই মঈনুল ইসলাম, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও পিকআপ চালক অমৃত লাল বর্মনকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় তৎকালীন প্রশাসন।

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০ , ৮ মহররম ১৪৪২, ২৮ আগস্ট ২০২০

ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি : স্মরণসভা

নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলা বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন

চিত্ত ঘোষ, দিনাজপুর

গতকাল ছিল দিনাজপুর ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনে তৎকালীন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন শহরে কতিপয় বিপথগামী পুলিশ কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। এ ঘটনায় প্রতিবাদী জনতার মিছিলের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে সাতটি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। প্রতিবাদী যুবক সামু, গ্রামের নিরীহ কৃষক কাদের ও রিকশাচালক সিরাজের লাশ পাওয়া গেলেও বাকি ৪টি লাশ পুলিশ গুম করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই থেকে তাদের স্মরণে ২৭ আগস্ট দিনাজপুর ট্র্যাজেডি দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি স্মরণে প্রতিবছরের মতো গতকাল দুপুর ১২টায় দশমাইল পূর্ব সাদিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শহীদ ‘সামু-কাদের-সিরাজ’ একাডেমিক ভবনে স্মরণে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী নেতা ও দিনাজপুর-১ সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল।

প্রধান অতিথি এমপি গোপাল বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। কিন্তু আজও কি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে? এর কারণ হলো মামলার দীর্ঘসূত্রতা। দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তাই নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলাগুলো বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দিনাজপুরের সহজ-সরল ও বাহে মানুষগুলো ৯৫’র ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ করে দেখিয়েছেন তাদের বাহুকার জোর কত। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে আমরা যে বিচার পেয়েছি তা বিশে^র ইতিহাসে বিরল। পুলিশ কিশোরী ইয়াসমিনকে পতিতা বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন যদি দিনাজপুরের মানুষ জেগে না উঠত তাহলে হয়তো অপরাধী পুলিশের বদলে আমার ফাঁসি হতো। তিনি আরও বলেন, বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার প্রতিনিধি সে সময় দিনাজপুরে এসে সাধারণ মানুষের আট দফা দাবি মেনে নিলেও তারা তা বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মামলা প্রত্যাহারসহ নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

শহীদ সামু-কাদের-সিরাজ স্মরণ কমিটির আহ্বায়ক মো. মজিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বরূপ বকসী বাচ্চু, সুন্দরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শরিফউদ্দিন, সুন্দরপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হামিদুল ইসলাম, কাহারোল উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. বজলুর করিম বাবুল।

উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কিশোরী ইয়াসমিন ৩ পুলিশ সদস্যের দ্বারা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়ায় দোষী পুলিশদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ২৭ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিতে শহরের রামনগর মাঠ হতে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল বের করে। মিছিলটি যখন শহরের তৎকালীন লিলি সিনেমা মোড় হয়ে পূর্বদিকে সদর হাসপাতাল হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিল, তখন মুন্সিপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি ও রাস্তায় থাকা বিপুল সংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ একযোগে প্রতিবাদী জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ ও অসংখ্য টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশের গুলিতে সামু, কাদের ও সিরাজসহ নাম না জানা ৭ জন নিহত হয়। আহত হয় ৩ শতাধিক। তৎকালীন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি প্রবীণ জননেতা অ্যাডভোকেট এম. আবদুর রহিমের নেতৃত্বে আইনজীবীদের একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে অবস্থিত ৪টি পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশের ৪টি পিকআপ ভ্যান জ্বালিয়ে দেয়। বিক্ষোভের এই সুযোগ নিয়ে কতিপয় সাদা পোশাকধারী সরকারি লোক জনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে দিনাজপুর প্রেসক্লাবসহ স্থানীয় ৫টি পত্রিকা অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সন্ধ্যায় শহরে জারি করা হয় কারফিউ। পুলিশ প্রত্যাহার করে শহরে নামানো হয় তৎকালীন বিডিআর বাহিনীর সদস্যদের।

জনতার উত্তাল আন্দোলনের চাপে তৎকালীন সরকার সে সময়কার জেলা প্রশাসক মো. জব্বার ফারুক ও পুলিশ সুপার আবদুল মোতালেবকে ২৯ আগস্ট প্রত্যাহার করে নেয়। জেলার সব পুলিশ বাহিনীর সদস্য পরিবর্তন করা হয়। আন্দেলনের তীব্রতা অনুমান করে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে পুলিশের এএসআই মঈনুল ইসলাম, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও পিকআপ চালক অমৃত লাল বর্মনকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় তৎকালীন প্রশাসন।