শিশু-কিশোররা ভাসুক আনন্দময় জ্ঞানের সাগরে

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় ক্রমোন্নতিতে আমরা এখন আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যেমন এখন আগের চেয়ে বেশি ব্যস্ত তেমনি শিক্ষার্থীদের উপর বেড়েছে পরীক্ষায় তথাকথিত ভালো ফলাফলের চাপ। তাই বিদ্যালয়ের নিয়মমাফিক পড়ালেখার বাইরে তাদের পাঠানো হচ্ছে বিশেষ কোচিং বা প্রাইভেটে। বিদ্যালয় ছুটির পর বৈকালিক অবসরে খেলার মাঠে দল বেঁধে খেলাধুলার চিত্র এখন সহজলভ্য নয়। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পান্নয়ের প্রভাবে খেলার মাঠ যেমন কমছে তেমনি গৎবাঁধা পড়ালেখার বাড়তি চাপে বিশেষ করে শহরাঞ্চলের শিশু-কিশোররা এখন অনেকটাই ঘরবন্দি যান্ত্রিক এক জীবনের যন্ত্রস্বরূপ। সবুজ মাঠে গড়াগড়ি কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে হৈ হুল্লোড় ভুলে এখন তারা টিভির কার্টুন ছবি অথবা মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের রঙিন পর্দায় কৃত্রিম খেলায় বিনোদন খুঁজে। অভিভাবকদের অবস্থাও অনেকটা কর্মস্থল আর ঘরকেন্দ্রীক।

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের শক্ত ভিত রচনা করতে তারা সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত। অথচ একটা সময়ে সব বয়সের মানুষের অবসর বিনোদনের প্রিয় সাথী ছিল বই। প্রতিদিনের পড়ালেখা ও কাজকর্মের ব্যস্ততার ফাঁকে বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে মেতে থাকতো শিক্ষার্থী ও অন্যান্যরা। পাঠ্যবইয়ের ভেতরে লুকিয়েও চলতো পছন্দের সব বইপড়া। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, কবিতা কিংবা রহস্যোপন্যাসের বইয়ের আদানপ্রদান চলতো। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে উপহারের তালিকায় শীর্ষে ছিল বই। কিন্তু এখন? তার জায়গা দখল করেছে সাময়িক আনন্দদানের বিনিময়ে শরীর ও মস্তিষ্কের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিসাধনকারী নানা আধুনিক যন্ত্র।

বই মানুষের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে যেমন জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণকারী তেমনি মনের ক্লান্তি, অবসাদ ও বিমর্ষতা দূর করার পরীক্ষিত টোটকা। একটি ভালো বই যে কোনো বয়সের পাঠকের জানার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিকে করে উন্নত ও প্রসারিত। সমাজ, সভ্যতা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও দেশকে জানতে বই পড়ার চেয়ে উত্তম আর কিছুই হতে পারে না। তাই বিশ^কবি বইকে অতীত ও বর্তমানের সাঁকো হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আবার, পল্লী কবি জসীমউদ্দিন বইকে জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বর্তমানে বইপড়ার আগ্রহ ও অভ্যাস ক্রমেই কমছে। বড়োদের অনাগ্রহ ও অনভ্যাসের প্রভাবে পরিবারের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও বই পড়ার আগ্রহ গড়ে উঠছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তাদের দৃষ্টি শিশুতোষ বইয়ের বদলে গেইমস, কার্টুন আর গানে। এতে যেমন শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও। স্বাধীন চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশে শিশু-কিশোরদের বইপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির পাশাপাশি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হওয়া দরকার। নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ের বই তাদের একাগ্রতা ও সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটাতে সহায়ক। ধৈর্য, পরমতসহিষ্ণুতা, সেবা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মানবিকতা ও দেশপ্রেমের মতো মানবিক সব মূল্যবোধ গঠনে বইপড়ার বিকল্প নেই।

নিয়মিত বইপড়ার অভ্যাস শিশু-কিশোরদের মেধা ও মননের যথাযথ উন্নয়নের পাশাপাশি প্রচলিত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের মানসিকভাবে দৃঢ় করে। বিখ্যাতদের শৈশব, স্বপ্ন এবং জীবনযাপন তাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস হতে পারে। তাদের স্বপ্ন দেখার সাহস ও তা পূরণের পথ আবিষ্কারের চালিকাশক্তি হতে পারে বই। এছাড়া, দেশের জাতীয় সংস্কৃতি, উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী, ব্যক্তিত্ব এবং দেশপ্রেমের মাহাত্ম্য মুখের বক্তৃতায় যতোটা না তাদের হৃদয়ে গ্রথিত হবে তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি শক্তিশালী হবে বইপড়ার মাধ্যমে যখন তারা এসব ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গে কথা বলবে। আজকের শিশু-কিশোর আগামীর কর্ণধার। তাদের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হিসেবে গড়তে হলে বইপড়ার আগ্রহ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বইপড়ার মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণী-গোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের আনন্দময় জ্ঞানের অতল সাগরে ভাসাতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

আবু ফারুক

সহকারী শিক্ষক, ভাগ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদর, বান্দরবান।

আরও খবর

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০ , ৮ মহররম ১৪৪২, ২৮ আগস্ট ২০২০

শিশু-কিশোররা ভাসুক আনন্দময় জ্ঞানের সাগরে

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় ক্রমোন্নতিতে আমরা এখন আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যেমন এখন আগের চেয়ে বেশি ব্যস্ত তেমনি শিক্ষার্থীদের উপর বেড়েছে পরীক্ষায় তথাকথিত ভালো ফলাফলের চাপ। তাই বিদ্যালয়ের নিয়মমাফিক পড়ালেখার বাইরে তাদের পাঠানো হচ্ছে বিশেষ কোচিং বা প্রাইভেটে। বিদ্যালয় ছুটির পর বৈকালিক অবসরে খেলার মাঠে দল বেঁধে খেলাধুলার চিত্র এখন সহজলভ্য নয়। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পান্নয়ের প্রভাবে খেলার মাঠ যেমন কমছে তেমনি গৎবাঁধা পড়ালেখার বাড়তি চাপে বিশেষ করে শহরাঞ্চলের শিশু-কিশোররা এখন অনেকটাই ঘরবন্দি যান্ত্রিক এক জীবনের যন্ত্রস্বরূপ। সবুজ মাঠে গড়াগড়ি কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে হৈ হুল্লোড় ভুলে এখন তারা টিভির কার্টুন ছবি অথবা মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের রঙিন পর্দায় কৃত্রিম খেলায় বিনোদন খুঁজে। অভিভাবকদের অবস্থাও অনেকটা কর্মস্থল আর ঘরকেন্দ্রীক।

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের শক্ত ভিত রচনা করতে তারা সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত। অথচ একটা সময়ে সব বয়সের মানুষের অবসর বিনোদনের প্রিয় সাথী ছিল বই। প্রতিদিনের পড়ালেখা ও কাজকর্মের ব্যস্ততার ফাঁকে বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে মেতে থাকতো শিক্ষার্থী ও অন্যান্যরা। পাঠ্যবইয়ের ভেতরে লুকিয়েও চলতো পছন্দের সব বইপড়া। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, কবিতা কিংবা রহস্যোপন্যাসের বইয়ের আদানপ্রদান চলতো। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে উপহারের তালিকায় শীর্ষে ছিল বই। কিন্তু এখন? তার জায়গা দখল করেছে সাময়িক আনন্দদানের বিনিময়ে শরীর ও মস্তিষ্কের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিসাধনকারী নানা আধুনিক যন্ত্র।

বই মানুষের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে যেমন জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণকারী তেমনি মনের ক্লান্তি, অবসাদ ও বিমর্ষতা দূর করার পরীক্ষিত টোটকা। একটি ভালো বই যে কোনো বয়সের পাঠকের জানার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিকে করে উন্নত ও প্রসারিত। সমাজ, সভ্যতা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও দেশকে জানতে বই পড়ার চেয়ে উত্তম আর কিছুই হতে পারে না। তাই বিশ^কবি বইকে অতীত ও বর্তমানের সাঁকো হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আবার, পল্লী কবি জসীমউদ্দিন বইকে জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বর্তমানে বইপড়ার আগ্রহ ও অভ্যাস ক্রমেই কমছে। বড়োদের অনাগ্রহ ও অনভ্যাসের প্রভাবে পরিবারের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও বই পড়ার আগ্রহ গড়ে উঠছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তাদের দৃষ্টি শিশুতোষ বইয়ের বদলে গেইমস, কার্টুন আর গানে। এতে যেমন শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও। স্বাধীন চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশে শিশু-কিশোরদের বইপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির পাশাপাশি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হওয়া দরকার। নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ের বই তাদের একাগ্রতা ও সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটাতে সহায়ক। ধৈর্য, পরমতসহিষ্ণুতা, সেবা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মানবিকতা ও দেশপ্রেমের মতো মানবিক সব মূল্যবোধ গঠনে বইপড়ার বিকল্প নেই।

নিয়মিত বইপড়ার অভ্যাস শিশু-কিশোরদের মেধা ও মননের যথাযথ উন্নয়নের পাশাপাশি প্রচলিত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের মানসিকভাবে দৃঢ় করে। বিখ্যাতদের শৈশব, স্বপ্ন এবং জীবনযাপন তাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস হতে পারে। তাদের স্বপ্ন দেখার সাহস ও তা পূরণের পথ আবিষ্কারের চালিকাশক্তি হতে পারে বই। এছাড়া, দেশের জাতীয় সংস্কৃতি, উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী, ব্যক্তিত্ব এবং দেশপ্রেমের মাহাত্ম্য মুখের বক্তৃতায় যতোটা না তাদের হৃদয়ে গ্রথিত হবে তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি শক্তিশালী হবে বইপড়ার মাধ্যমে যখন তারা এসব ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গে কথা বলবে। আজকের শিশু-কিশোর আগামীর কর্ণধার। তাদের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হিসেবে গড়তে হলে বইপড়ার আগ্রহ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বইপড়ার মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণী-গোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের আনন্দময় জ্ঞানের অতল সাগরে ভাসাতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

আবু ফারুক

সহকারী শিক্ষক, ভাগ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদর, বান্দরবান।