করোনা, কৃষি ও প্রাইভেট সেক্টর

ড. আবুল কালাম আযাদ

কৃষিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টরের ভূমিকা অগ্রগণ্য। কৃষি আমাদের আদি পেশা হলেও সেটি ছিল খোরপোষের কৃষি। সরকারি প্রশংসনীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অগ্রণী ভূমিকার জন্যই কৃষি আজ আধা-বাণিজ্যিক (Semi-commercial) রূপ লাভ করেছে। এই করোনাকালীন সময়ে ও করোনা-উত্তর কৃষি হবে অধিক চ্যালেঞ্জিং। এটা সবারই জানা কৃষিতে বিনিয়োগ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত প্রাইভেট সেক্টর সেখানেই বিনিয়োগ করে থাকে যেখান থেকে তারা আয় করতে পারবে। করোনাকালীন ও করোনা-উত্তর কৃষির ফসলভিত্তিক উন্নয়নে প্রাইভেট সেক্টরে ভূমিকা নিয়ে এই প্রবন্ধ।

বীজ কৃষির প্রধানতম ইনপুট, যা ছাড়া কৃষি উৎপাদন সম্ভব নয়। বর্তমানে মানসম্মত বীজের ব্যবহার ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি সেক্টরের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরও বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি করছে। তবে তাদের এই উদ্যোগ সীমিত কিছু ফসলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেসব প্রাইভেট সেক্টরের আরঅ্যান্ডডি (R&D) রয়েছে তারা বীজ উৎপাদনে অনেকটাই এগিয়েছে। এক সময় সবজি বীজ প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে এখন R&D থাকায় তারা উন্নত জাতের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করছে। দুই বছর আগে আমি এদেশের একটি নামকরা প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানির এজিএমে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করি। সেখানে উপস্থাপিত বীজবিষয়ক একটি প্রতিবেদন থেকে জানতে পারলাম তারা এসব সবজি বীজ দেশে ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোতে রপ্তানিও করছে।

বীজ উৎপাদন একটি সুনির্দিষ্ট কারিগরি বিষয়। সঠিক জলবায়ু ও কারিগরি জ্ঞানের সমন্বয়ে বীজ উৎপাদন করতে হয়। মানসম্পন্ন বীজ মানেই ভালো ফসল। আর বীজের মান বলতে উন্নত জাতের ভালো মানের বীজ বোঝায়। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনা ছাড়াও প্রাইভেট সেক্টর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধানের বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ করছে। ফলে ধানের উৎপাদন ও ফলন দুটোই কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অন্যান্য ফসলের বীজ উৎপাদন প্রাইভেট সেক্টরে সীমিত। ভুট্টা বীজ প্রায় পুরোটাই আমদানি-নির্ভর এবং আমদানির কাজটি করছে প্রাইভেট সেক্টর। তাই স্থানীয়ভাবে ভুট্টা বীজ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর সবজি বীজের ক্ষেত্রে দেশের শীতপ্রধান উত্তরাঞ্চলকে টার্গেট করা যেতে পারে বীজ উৎপাদনের জন্য। পিয়াজ বীজসহ যেসব বীজ পর-পরাগায়িত সেসব বীজ উৎপাদনে আইসোলেশন দূরত্ব মেইনটেইন করতে হয়। তাই এসব বীজ উৎপাদনের জন্য Crop Zoning অনুসরণ করা আবশ্যক হবে। ডাল ফসল, তেল ফসল ও মসলা ফসলে এখনও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। তাই প্রাইভেট সেক্টর এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া এ পেশা বাঁচিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। সময়ের প্রয়োজনে এদেশে অনেকাংশে যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। আর তা হয়েছে প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোগের ফলে। সরকার অবশ্য জোড় চেষ্টা করছে প্রাইভেট সেক্টরকে সম্পৃক্ত করে এই যান্ত্রিকীকরণের কাজটি দ্রুততার সঙ্গে করতে। এ জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ৫০-৭০% প্রণোদনা দিয়ে কৃষক তথা প্রাইভেট সেক্টরকে উৎসাহিত করা হচ্ছে যাতে যান্ত্রিকীকরণের কাজ দ্রুততম সময়ে করা যায়। এদেশে যারা নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমে যান্ত্রিকীকরণ করছে তাদের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশের ওপর সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে। তাদের চাওয়া আরও অনেক বেশি। সরকার অবশ্যই ন্যায়সংগত বিষয়গুলো ভেবে দেখবে।

ছোট আকারের খণ্ড খণ্ড জমি, একই কৃষি অঞ্চলে নানাবিধ ফসলের সমন্বয়, একেক ফসলে একেক ধরনের যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সব মিলিয়ে যান্ত্রিকীকরণের বাকি কাজটা করা বেশ কষ্টসাধ্যই হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্যদেশের কিছু অভিজ্ঞতা নেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখা যায়। ৭/৮ বছর আগে আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারি সফরে গিয়েছিলাম। সেখানকার জমিও আমাদের মতোই ছোট ছোট। তবে তাদের ফসলের ডাইভারসিটি আমাদের চেয়ে অনেক কম। সেখানে দেখলাম, একটি বড় জায়গাজুড়ে (ওয়ার্কশপ) নানা রকম কৃষি যন্ত্রপাতি মজুত রাখা আছে ভাড়া দেয়ার জন্য। কৃষকরা প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষি যন্ত্রপাতি ভাড়ায় নিয়ে যাচ্ছে এবং কাজ শেষে আবার ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। তবে সেখানে ধানের প্রাধান্য এবং ফসলের ডাইভারসিটি কম থাকায় কাজটি সহজতর হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ পিপিপির মাধ্যমে উক্ত মডেলটি আমাদের দেশেও গ্রহণ করা যায় কিনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা ভেবে দেখতে পারেন।

কৃষি যন্ত্রের সঠিক মান বজায় রাখতে প্রাইভেট সেক্টর বিদেশ থেকে যেসব যন্ত্রপাতি এদেশে এনে বিক্রি করছে তাদের সার্ভিস ওয়ারেন্টির মেয়াদ ৫-১০ বছর করা যায় কিনা তাও তারা ভেবে দেখতে পারেন। কারণ বিদেশ থেকে আমদানি করা সব যন্ত্রই এদেশের উপযোগী এবং আন্তর্জাতিক মানের নয়। তাই বেশি সময়ের ওয়ারেন্টি থাকলে ভালো মানের যন্ত্র আমদানি হবে বলে আশা করা যায়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে অন্যতম মূল সমস্যা আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রের এবং খুচরা যন্ত্রাংশের সঠিক মান। একসময় মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কারিগরি কমিটি ছিল যা বেশ আগে থেকেই বিলুপ্ত। তাই কৃষি যন্ত্রের মান নিয়ন্ত্রণে এমন ধরনের কারিগরি কমিটি থাকা উত্তম। ৫-১০ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি থাকলে ভালো মানের কৃষি যন্ত্র এদেশে আনা হবে এবং কৃষক ভাইয়েরা তা কিনতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজটিও স্থায়ী রূপ লাভ করবে।

আমাদের দেশের ফসলের ডাইভারসিটি এত বেশি যে এখানে সারা বছর প্রায় দুই শতাধিক ফসল উৎপন্ন হয়। এসব ফসল উৎপাদনে জমি তৈরি প্রায় একই ধরনের হলেও এসব ফসল বীজ/চারা বপন/রোপণ, আন্তঃপরিচর্যা, ফসল উত্তোলন এবং সংগ্রহোত্তর অপারেশনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। তাই কৃষিতে পরিপূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেমন মুগডাল ৩/৪ বারে উত্তোলন করতে অনেক শ্রমিক প্রয়োজন হয়। মুগডাল হারভেস্ট করার জন্য কোন যন্ত্র এদেশে এখনও পাওয়া যায় না। এর অন্যতম কারণ কাঁচা অবস্থায় যন্ত্রের মাধ্যমে এগুলোর পড (Pod) থেকে বীজ আলাদা করা যায় না। এজন্য প্রয়োজনে বিদেশি অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা ডাল সংগ্রহের আগে কেমিক্যাল স্প্রে করে মাঠেই গাছসহ শুকিয়ে নেয় যাতে গাছের পড ও বীজ সহজেই আলাদা করা যায়। সুতরাং ফসলের ধরন, অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং আলোচিত চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখেই পরবর্তী যান্ত্রিকীকরণের কাজগুলো করতে হবে। সেই সঙ্গে এদেশে যারা ছোট ছোট যন্ত্র উৎপাদন করছে এবং খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে তাদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য বলে তাদের পেট্রোনাইজ করা প্রয়োজন। সরকার সিনক্রোনাইজ ফার্মিং এর মাধ্যমে ধান রোপণ ও কর্তনে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে চাইছে। প্রাইভেট সেক্টরের উচিত একাজে সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করা।

নন ইউরিয়া সার আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি প্রাধান্য থাকলেও সার বিতরণ সম্পূর্ণ ডিলারনির্ভর। জমি এবং সার ব্যবস্থাপনায় কিছু কম্পোস্ট বা ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন ও বিতরণ ছাড়া প্রাইভেট সেক্টরের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা নেই। বছর বছর ফসল চাষ করতে করতে জমি অম্লীয় অবস্থা (Acidic) ধারণ করে যা চুন দিয়ে লাইমিং করতে হয়। অধিক হারে জৈব ও জীবাণু সার উৎপাদনের মাধ্যমে জমির গুণাগুণ ঠিক রাখার ক্ষেত্রেও তারা ভূমিকা রাখতে পারেন। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের সেচযন্ত্র আমদানি ও সরবরাহ যেমন বারিড পাইপ, স্প্রিংলার ইরিগেশন, ড্রিপ ইরিগেশনসহ পানি সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে তারা কৃষি উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষি উৎপাদনে নানা ধরনের কীটনাশক ও বালাইনাশক প্রয়োজন হয়। যার কোন কোনটি সিস্টেমিক এবং কোন কোনটি কন্টাক্ট। প্রাইভেট সেক্টর অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে কীটনাশক বিদেশ থেকে এনে রিপ্যাকের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। এছাড়া নিরাপদ খাদ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য আজকাল জৈব বালাইনাশক বা সেক্স ফেরোমন ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি অনুমোদন গ্রহণপূর্বক প্রাইভেট সেক্টর পরিপূর্ণভাবে এসবের জোগান দিচ্ছে। এসব কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করতে যে সব যন্ত্র/স্প্রেয়ার প্রয়োজন হয় তার উল্লেখযোগ্য এদেশেই প্রস্তুত করা হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগে এবং কিছু অংশ আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে। এসব উদ্যোগ চলমান রেখে ভবিষ্যতে এর পরিধি আরও বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে।

কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য প্রাইভেট সেক্টরই কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি করে কৃষিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। বর্তমানে এসব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের এথনিক মার্কেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। এখন প্রয়োজন এসব দেশের মেইনস্ট্রিম মার্কেটে প্রবেশ করা। কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে দেশে মানসম্পন্ন পণ্য সারা বছর উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক সময় এদেশ থেকে পাট, চা, চামড়া রপ্তানি হলেও এখন নানা ধরনের সবজি ফল-মূল, আলু, হাফ প্রসেসড ও ফুল প্রসেসড ফুডসহ নানাবিধ কৃষিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। অপরদিকে ডাল, তেল, মসলাসহ ঘাটতি পণ্য এদেশে আমদানি করে আমাদের চাহিদা পূরণ করছে প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানিই। তবে আমরা চাই প্রাইভেট সেক্টরের সক্রিয় সহায়তায় এসব পণ্য এদেশেই উৎপন্ন হোক। কৃষিপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষি পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই প্রাইভেট সেক্টরনির্ভর। ফসল ঘরে তোলা, পরিবহন ব্যবস্থাপনা, বাজার ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-হারভেস্ট প্রসেসিং করে পণ্য বাজারে সরবরাহ ইত্যাদি কার্যক্রমগুলো প্রাইভেট সেক্টর করে আসছে। তবে এসব পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষকরা যাতে তাদের পণ্যের ন্যায্য দাম পায় এ বিষয়ে আরও আন্তরিক হতে হবে। ভরা মৌসুমে উৎপাদিত ফল-মূল ও শাকসবজি প্রসেসিং ও হাফ প্রসেসিং বাজারজাত করার কাজে প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।

পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নে প্রাইভেট সেক্টরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে ভবিষ্যতে মান বৃদ্ধি ও আকর্ষণীয় করার জন্য সংশ্লিষ্টরা আরও বেশি যতœবান হবেন এটিই প্রত্যাশা। কৃষক ভাইয়েরা এসব অনুষ্ঠান কখন শুনতে/দেখতে চান? এ বিষয়ে একটি মতামত জরিপ করা যেতে পারে। আর যেসব প্রিন্ট মিডিয়ায় কৃষিবিষয়ক পাতা নেই তারা তা সংযোজন করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, করোনাকালীন ও করোনা-উত্তর জাতীয় উন্নয়নে আরও কীভাবে ভূমিকা রাখা যায় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই আরও যতœবান হবেন বলে প্রত্যাশা করি।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি

গবেষণা কাউন্সিল]

drakazad61@gmail.com

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০ , ৮ মহররম ১৪৪২, ২৮ আগস্ট ২০২০

করোনা, কৃষি ও প্রাইভেট সেক্টর

ড. আবুল কালাম আযাদ

কৃষিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টরের ভূমিকা অগ্রগণ্য। কৃষি আমাদের আদি পেশা হলেও সেটি ছিল খোরপোষের কৃষি। সরকারি প্রশংসনীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অগ্রণী ভূমিকার জন্যই কৃষি আজ আধা-বাণিজ্যিক (Semi-commercial) রূপ লাভ করেছে। এই করোনাকালীন সময়ে ও করোনা-উত্তর কৃষি হবে অধিক চ্যালেঞ্জিং। এটা সবারই জানা কৃষিতে বিনিয়োগ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত প্রাইভেট সেক্টর সেখানেই বিনিয়োগ করে থাকে যেখান থেকে তারা আয় করতে পারবে। করোনাকালীন ও করোনা-উত্তর কৃষির ফসলভিত্তিক উন্নয়নে প্রাইভেট সেক্টরে ভূমিকা নিয়ে এই প্রবন্ধ।

বীজ কৃষির প্রধানতম ইনপুট, যা ছাড়া কৃষি উৎপাদন সম্ভব নয়। বর্তমানে মানসম্মত বীজের ব্যবহার ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি সেক্টরের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরও বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি করছে। তবে তাদের এই উদ্যোগ সীমিত কিছু ফসলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেসব প্রাইভেট সেক্টরের আরঅ্যান্ডডি (R&D) রয়েছে তারা বীজ উৎপাদনে অনেকটাই এগিয়েছে। এক সময় সবজি বীজ প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে এখন R&D থাকায় তারা উন্নত জাতের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করছে। দুই বছর আগে আমি এদেশের একটি নামকরা প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানির এজিএমে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করি। সেখানে উপস্থাপিত বীজবিষয়ক একটি প্রতিবেদন থেকে জানতে পারলাম তারা এসব সবজি বীজ দেশে ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোতে রপ্তানিও করছে।

বীজ উৎপাদন একটি সুনির্দিষ্ট কারিগরি বিষয়। সঠিক জলবায়ু ও কারিগরি জ্ঞানের সমন্বয়ে বীজ উৎপাদন করতে হয়। মানসম্পন্ন বীজ মানেই ভালো ফসল। আর বীজের মান বলতে উন্নত জাতের ভালো মানের বীজ বোঝায়। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনা ছাড়াও প্রাইভেট সেক্টর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধানের বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ করছে। ফলে ধানের উৎপাদন ও ফলন দুটোই কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অন্যান্য ফসলের বীজ উৎপাদন প্রাইভেট সেক্টরে সীমিত। ভুট্টা বীজ প্রায় পুরোটাই আমদানি-নির্ভর এবং আমদানির কাজটি করছে প্রাইভেট সেক্টর। তাই স্থানীয়ভাবে ভুট্টা বীজ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর সবজি বীজের ক্ষেত্রে দেশের শীতপ্রধান উত্তরাঞ্চলকে টার্গেট করা যেতে পারে বীজ উৎপাদনের জন্য। পিয়াজ বীজসহ যেসব বীজ পর-পরাগায়িত সেসব বীজ উৎপাদনে আইসোলেশন দূরত্ব মেইনটেইন করতে হয়। তাই এসব বীজ উৎপাদনের জন্য Crop Zoning অনুসরণ করা আবশ্যক হবে। ডাল ফসল, তেল ফসল ও মসলা ফসলে এখনও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। তাই প্রাইভেট সেক্টর এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া এ পেশা বাঁচিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। সময়ের প্রয়োজনে এদেশে অনেকাংশে যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। আর তা হয়েছে প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোগের ফলে। সরকার অবশ্য জোড় চেষ্টা করছে প্রাইভেট সেক্টরকে সম্পৃক্ত করে এই যান্ত্রিকীকরণের কাজটি দ্রুততার সঙ্গে করতে। এ জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ৫০-৭০% প্রণোদনা দিয়ে কৃষক তথা প্রাইভেট সেক্টরকে উৎসাহিত করা হচ্ছে যাতে যান্ত্রিকীকরণের কাজ দ্রুততম সময়ে করা যায়। এদেশে যারা নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমে যান্ত্রিকীকরণ করছে তাদের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশের ওপর সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে। তাদের চাওয়া আরও অনেক বেশি। সরকার অবশ্যই ন্যায়সংগত বিষয়গুলো ভেবে দেখবে।

ছোট আকারের খণ্ড খণ্ড জমি, একই কৃষি অঞ্চলে নানাবিধ ফসলের সমন্বয়, একেক ফসলে একেক ধরনের যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সব মিলিয়ে যান্ত্রিকীকরণের বাকি কাজটা করা বেশ কষ্টসাধ্যই হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্যদেশের কিছু অভিজ্ঞতা নেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখা যায়। ৭/৮ বছর আগে আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারি সফরে গিয়েছিলাম। সেখানকার জমিও আমাদের মতোই ছোট ছোট। তবে তাদের ফসলের ডাইভারসিটি আমাদের চেয়ে অনেক কম। সেখানে দেখলাম, একটি বড় জায়গাজুড়ে (ওয়ার্কশপ) নানা রকম কৃষি যন্ত্রপাতি মজুত রাখা আছে ভাড়া দেয়ার জন্য। কৃষকরা প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষি যন্ত্রপাতি ভাড়ায় নিয়ে যাচ্ছে এবং কাজ শেষে আবার ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। তবে সেখানে ধানের প্রাধান্য এবং ফসলের ডাইভারসিটি কম থাকায় কাজটি সহজতর হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ পিপিপির মাধ্যমে উক্ত মডেলটি আমাদের দেশেও গ্রহণ করা যায় কিনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা ভেবে দেখতে পারেন।

কৃষি যন্ত্রের সঠিক মান বজায় রাখতে প্রাইভেট সেক্টর বিদেশ থেকে যেসব যন্ত্রপাতি এদেশে এনে বিক্রি করছে তাদের সার্ভিস ওয়ারেন্টির মেয়াদ ৫-১০ বছর করা যায় কিনা তাও তারা ভেবে দেখতে পারেন। কারণ বিদেশ থেকে আমদানি করা সব যন্ত্রই এদেশের উপযোগী এবং আন্তর্জাতিক মানের নয়। তাই বেশি সময়ের ওয়ারেন্টি থাকলে ভালো মানের যন্ত্র আমদানি হবে বলে আশা করা যায়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে অন্যতম মূল সমস্যা আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রের এবং খুচরা যন্ত্রাংশের সঠিক মান। একসময় মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কারিগরি কমিটি ছিল যা বেশ আগে থেকেই বিলুপ্ত। তাই কৃষি যন্ত্রের মান নিয়ন্ত্রণে এমন ধরনের কারিগরি কমিটি থাকা উত্তম। ৫-১০ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি থাকলে ভালো মানের কৃষি যন্ত্র এদেশে আনা হবে এবং কৃষক ভাইয়েরা তা কিনতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজটিও স্থায়ী রূপ লাভ করবে।

আমাদের দেশের ফসলের ডাইভারসিটি এত বেশি যে এখানে সারা বছর প্রায় দুই শতাধিক ফসল উৎপন্ন হয়। এসব ফসল উৎপাদনে জমি তৈরি প্রায় একই ধরনের হলেও এসব ফসল বীজ/চারা বপন/রোপণ, আন্তঃপরিচর্যা, ফসল উত্তোলন এবং সংগ্রহোত্তর অপারেশনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। তাই কৃষিতে পরিপূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেমন মুগডাল ৩/৪ বারে উত্তোলন করতে অনেক শ্রমিক প্রয়োজন হয়। মুগডাল হারভেস্ট করার জন্য কোন যন্ত্র এদেশে এখনও পাওয়া যায় না। এর অন্যতম কারণ কাঁচা অবস্থায় যন্ত্রের মাধ্যমে এগুলোর পড (Pod) থেকে বীজ আলাদা করা যায় না। এজন্য প্রয়োজনে বিদেশি অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা ডাল সংগ্রহের আগে কেমিক্যাল স্প্রে করে মাঠেই গাছসহ শুকিয়ে নেয় যাতে গাছের পড ও বীজ সহজেই আলাদা করা যায়। সুতরাং ফসলের ধরন, অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং আলোচিত চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখেই পরবর্তী যান্ত্রিকীকরণের কাজগুলো করতে হবে। সেই সঙ্গে এদেশে যারা ছোট ছোট যন্ত্র উৎপাদন করছে এবং খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে তাদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য বলে তাদের পেট্রোনাইজ করা প্রয়োজন। সরকার সিনক্রোনাইজ ফার্মিং এর মাধ্যমে ধান রোপণ ও কর্তনে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে চাইছে। প্রাইভেট সেক্টরের উচিত একাজে সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করা।

নন ইউরিয়া সার আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি প্রাধান্য থাকলেও সার বিতরণ সম্পূর্ণ ডিলারনির্ভর। জমি এবং সার ব্যবস্থাপনায় কিছু কম্পোস্ট বা ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন ও বিতরণ ছাড়া প্রাইভেট সেক্টরের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা নেই। বছর বছর ফসল চাষ করতে করতে জমি অম্লীয় অবস্থা (Acidic) ধারণ করে যা চুন দিয়ে লাইমিং করতে হয়। অধিক হারে জৈব ও জীবাণু সার উৎপাদনের মাধ্যমে জমির গুণাগুণ ঠিক রাখার ক্ষেত্রেও তারা ভূমিকা রাখতে পারেন। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের সেচযন্ত্র আমদানি ও সরবরাহ যেমন বারিড পাইপ, স্প্রিংলার ইরিগেশন, ড্রিপ ইরিগেশনসহ পানি সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে তারা কৃষি উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষি উৎপাদনে নানা ধরনের কীটনাশক ও বালাইনাশক প্রয়োজন হয়। যার কোন কোনটি সিস্টেমিক এবং কোন কোনটি কন্টাক্ট। প্রাইভেট সেক্টর অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে কীটনাশক বিদেশ থেকে এনে রিপ্যাকের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। এছাড়া নিরাপদ খাদ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য আজকাল জৈব বালাইনাশক বা সেক্স ফেরোমন ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি অনুমোদন গ্রহণপূর্বক প্রাইভেট সেক্টর পরিপূর্ণভাবে এসবের জোগান দিচ্ছে। এসব কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করতে যে সব যন্ত্র/স্প্রেয়ার প্রয়োজন হয় তার উল্লেখযোগ্য এদেশেই প্রস্তুত করা হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগে এবং কিছু অংশ আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে। এসব উদ্যোগ চলমান রেখে ভবিষ্যতে এর পরিধি আরও বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে।

কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য প্রাইভেট সেক্টরই কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি করে কৃষিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। বর্তমানে এসব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের এথনিক মার্কেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। এখন প্রয়োজন এসব দেশের মেইনস্ট্রিম মার্কেটে প্রবেশ করা। কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে দেশে মানসম্পন্ন পণ্য সারা বছর উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক সময় এদেশ থেকে পাট, চা, চামড়া রপ্তানি হলেও এখন নানা ধরনের সবজি ফল-মূল, আলু, হাফ প্রসেসড ও ফুল প্রসেসড ফুডসহ নানাবিধ কৃষিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। অপরদিকে ডাল, তেল, মসলাসহ ঘাটতি পণ্য এদেশে আমদানি করে আমাদের চাহিদা পূরণ করছে প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানিই। তবে আমরা চাই প্রাইভেট সেক্টরের সক্রিয় সহায়তায় এসব পণ্য এদেশেই উৎপন্ন হোক। কৃষিপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষি পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই প্রাইভেট সেক্টরনির্ভর। ফসল ঘরে তোলা, পরিবহন ব্যবস্থাপনা, বাজার ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-হারভেস্ট প্রসেসিং করে পণ্য বাজারে সরবরাহ ইত্যাদি কার্যক্রমগুলো প্রাইভেট সেক্টর করে আসছে। তবে এসব পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষকরা যাতে তাদের পণ্যের ন্যায্য দাম পায় এ বিষয়ে আরও আন্তরিক হতে হবে। ভরা মৌসুমে উৎপাদিত ফল-মূল ও শাকসবজি প্রসেসিং ও হাফ প্রসেসিং বাজারজাত করার কাজে প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।

পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নে প্রাইভেট সেক্টরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে ভবিষ্যতে মান বৃদ্ধি ও আকর্ষণীয় করার জন্য সংশ্লিষ্টরা আরও বেশি যতœবান হবেন এটিই প্রত্যাশা। কৃষক ভাইয়েরা এসব অনুষ্ঠান কখন শুনতে/দেখতে চান? এ বিষয়ে একটি মতামত জরিপ করা যেতে পারে। আর যেসব প্রিন্ট মিডিয়ায় কৃষিবিষয়ক পাতা নেই তারা তা সংযোজন করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, করোনাকালীন ও করোনা-উত্তর জাতীয় উন্নয়নে আরও কীভাবে ভূমিকা রাখা যায় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই আরও যতœবান হবেন বলে প্রত্যাশা করি।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি

গবেষণা কাউন্সিল]

drakazad61@gmail.com