বকশিশই কি তাদের মূল লক্ষ্য?

বর্তমান সময়ে করোনার এই মহামারীতে সম্পূর্ণ প্রতিষেধকহীন অবস্থাতে একজন রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে শুধু মাত্র পর্যাপ্ত পরিমান সেবা ও মানুষিক সবলতার জন্য। শুধু মাত্র ওষুধ দিয়েই রোগ সেরে ওঠে না। ওষুধের পাশাপাশি প্রয়োজন সেবা ও মানুষিক প্রণোদনা। যা আমরা নার্সদের থেকে পেয়ে থাকি। বিশ্বজুড়ে করোনার এই মহামারীতে ডাক্তারদের পাশাপাশি নার্সদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু কিছু কিছু সুবিধাবাদী ডাক্তার ও নার্স আছে যারা ডাক্তার ও নার্সিং সেবার মতো এই মহৎ পেশাকে কলুষিত করে তুলছে দিনদিন। সেবাকে পরিনত করছে বানিজ্যে। যার প্রভাব পড়ছে ভুক্তভোগী রোগী ছাড়াও দেশ ও জনজীবনের ওপর। নিষ্ঠুরতা ও অবহেলার কারনে প্রানও দিতে হচ্ছে অনেকের। সম্প্রতি এরূপ একটি নির্মমতার শিকার হয়ে হাসপাতালে এক শিশুর নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

বখশিশের টাকা দিতে বিলম্ব হওয়ায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আবদুর রহমান নামে ৩০ দিন বয়সী এক শিশুর অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কর্তব্যরত নার্স রিমা আকতারের বিরুদ্ধে। অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলার কয়েক মিনিট পরেই শিশুটি মারা গেছে। গত (৮ আগস্ট) বিকেলে গাইবান্ধা জেলা হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে। শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গ নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশু আবদুর রহমানকে। ভর্তি করার পর পরই অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেন কর্তব্যরত নার্স রিমা আকতার। কিছুক্ষণ পর রিমা আকতার শিশুটির স্বজনদের কাছে অক্সিজেন বাবদ বখশিশ দাবি করেন। বখশিশের টাকা আনতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি অক্সিজেন মাস্কটি খুলে ফেলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায় শিশুটি। যা ডাক্তার-নার্স সহ গোটা দেশ ও জাতির জন্য লজ্জাজনক ঘটনা।

নার্সিং একটি মহৎ পেশা এবং সেবামূলক কাজ। পৃথিবীতে যত মহৎ পেশা আছে নার্সিং তার মধ্যে অন্যতম। কেননা সকল শাস্ত্র জ্ঞানে বলা আছে “সেবাই ধর্ম, সেবাই কর্ম, সেবাই ভক্তি, সেবাই মুক্তি”। বিগত কয়েক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিপুল সম্প্রসারণের সঙ্গে নার্সিং পেশাটির সম্প্রসারন ঘটেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে একজন ডাক্তারের সঙ্গে সহকারী হিসেবে চারজন নার্সকে সার্বক্ষণিক থাকা প্রয়োজন প্রত্যেকটা রোগীকে ভালোমতো সেবা প্রদান করার জন্য। কিন্তু আমরা, দেখি তার বিপরীত। আবার যারা দায়িত্বরত অবস্থায় থাকেন তাদের মাঝে লোভ, লালসা, দুর্নীতি, ধোকাবাজিতে ভরপুর।

নার্সিং নামক এই শব্দের পিছে আছে বিশাল এক মানবতার গল্প। নার্সদের এই মহৎ পেশাকে সম্মানিত করে তুলতে আধুনিক নার্সিং এর প্রবর্তক মহীয়সী সেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের সেবা কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে তার জন্মদিনে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস হিসাবে পালন করা হয়। নাইটিংগেলের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অসুস্থ সৈন্যদের পাশে দাঁড়ানো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের এই যুদ্ধে সৈন্যদের অবস্থা বিপন্ন। সে সময় প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি সিডনি হার্বাট (নাইটিংগেলের সারা জীবনের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু) নাইটিংগেলকে লিখলেন- ‘যুদ্ধের এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় আহত সৈন্যদের তত্ত্বাবধান করার মতো একজনও উপযুক্ত ব্যক্তি নেই। যদি আপনি এ কাজের ভার গ্রহণ করেন, দেশ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’ দেশের এই ডাক নাইটিংগেল উপেক্ষা করতে পারেননি। নিজ উদ্যোগে নার্সিংয়ের জন্য ৩৮ জনের স্বেচ্ছাসেবী দল নিয়ে তিনি ছুটে যান। যা আজো নার্সিং সেবার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে।

সাদা যে শান্তির প্রতিক, সাদা যে শান্তি বহন করে তা নার্সদের দেখলেই বোঝা যায়। “নার্স মানেই মনে সাদা, নার্স মানে পোষাকে সাদা। নার্স মানে আচরন ও কর্মেও সাদা”। শান্তির প্রতীক এই সাদাকে তারা মনে ধারণ করে জীবন যৌবনকে উৎসর্গ করেন সাদার ভুবনে। উৎসর্গ করেন মানবতার সেবাই। তাদের গায়ের সঙ্গে সব সময় আবৃত্ত থাকে মানবতার চাদর। ঠিক এমনটাই হওয়া উচিৎ। মনে সব সময় সেবাকে লালন করা উচিৎ কিন্তু পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের দেশের নার্সদের রোগীদের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার চিত্র দেখতে পায়। যা একটা দেশ ও জাতীর জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার।

তবে সবাইকে এক দাড়ি পাল্লায় মাপা হলে আবার অবিচার করা হবে। কেমনা দেশে এখনও অনেক ডাক্তার বা নার্স আছে যারা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে অকাতরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যেনো সেবাই তাদের মূল ধর্ম, সেবাই তাদের ব্রত। রাত নেই, দিন নেই সংসার, পরিবার, সন্তানের মায়াকান্না তাদের সেবাধর্মী মনের কাছে অবহেলিত ও তুচ্ছ। সন্তানের প্রাপ্য ভালোবাসা টুকু দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন মানবতার চাদরে মোড়ানো এই সাদা পোষাকের এই নার্সরা। তাদের এই উৎসর্গ, আতœত্যাগ মানব জাতির জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাসের যে তান্ডব চলছে তার সম্মুখে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে অকাতরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই নার্সরা। নিজেদের পরিবার, পরিজন, সন্তান তাদের কাছে এখন সবই সামান্য এবং তাদের একমাত্র ব্রত মানবসেবা রোগীকে সুস্থ করে তোলা। অথচ সেবা করতে যেয়ে তারা শিকার হচ্ছে করোনার ভয়াবহ ছোবলে। এ জানা সত্তেও তারা থেমে নেই সব সময় বিরাজমান মানবতার সেবাই। তাদের এই ত্যাগ, পরিশ্রম ও জীবন উৎসর্গের মহান দৃষ্টান্তের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা। এবং যেসব অসাধু, লোভী, কালো চাদরে মোড়ানো নার্স নামে সেবার পরিবর্তে বাণিজ্য করে চলেছে তাদেরকে জানাই ধিক্কার।

ইমরান হুসাইন।

শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও খবর

শনিবার, ২৯ আগস্ট ২০২০ , ৯ মহররম ১৪৪২, ২৯ আগস্ট ২০২০

বকশিশই কি তাদের মূল লক্ষ্য?

বর্তমান সময়ে করোনার এই মহামারীতে সম্পূর্ণ প্রতিষেধকহীন অবস্থাতে একজন রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে শুধু মাত্র পর্যাপ্ত পরিমান সেবা ও মানুষিক সবলতার জন্য। শুধু মাত্র ওষুধ দিয়েই রোগ সেরে ওঠে না। ওষুধের পাশাপাশি প্রয়োজন সেবা ও মানুষিক প্রণোদনা। যা আমরা নার্সদের থেকে পেয়ে থাকি। বিশ্বজুড়ে করোনার এই মহামারীতে ডাক্তারদের পাশাপাশি নার্সদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু কিছু কিছু সুবিধাবাদী ডাক্তার ও নার্স আছে যারা ডাক্তার ও নার্সিং সেবার মতো এই মহৎ পেশাকে কলুষিত করে তুলছে দিনদিন। সেবাকে পরিনত করছে বানিজ্যে। যার প্রভাব পড়ছে ভুক্তভোগী রোগী ছাড়াও দেশ ও জনজীবনের ওপর। নিষ্ঠুরতা ও অবহেলার কারনে প্রানও দিতে হচ্ছে অনেকের। সম্প্রতি এরূপ একটি নির্মমতার শিকার হয়ে হাসপাতালে এক শিশুর নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

বখশিশের টাকা দিতে বিলম্ব হওয়ায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আবদুর রহমান নামে ৩০ দিন বয়সী এক শিশুর অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কর্তব্যরত নার্স রিমা আকতারের বিরুদ্ধে। অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলার কয়েক মিনিট পরেই শিশুটি মারা গেছে। গত (৮ আগস্ট) বিকেলে গাইবান্ধা জেলা হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে। শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গ নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশু আবদুর রহমানকে। ভর্তি করার পর পরই অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেন কর্তব্যরত নার্স রিমা আকতার। কিছুক্ষণ পর রিমা আকতার শিশুটির স্বজনদের কাছে অক্সিজেন বাবদ বখশিশ দাবি করেন। বখশিশের টাকা আনতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি অক্সিজেন মাস্কটি খুলে ফেলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায় শিশুটি। যা ডাক্তার-নার্স সহ গোটা দেশ ও জাতির জন্য লজ্জাজনক ঘটনা।

নার্সিং একটি মহৎ পেশা এবং সেবামূলক কাজ। পৃথিবীতে যত মহৎ পেশা আছে নার্সিং তার মধ্যে অন্যতম। কেননা সকল শাস্ত্র জ্ঞানে বলা আছে “সেবাই ধর্ম, সেবাই কর্ম, সেবাই ভক্তি, সেবাই মুক্তি”। বিগত কয়েক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিপুল সম্প্রসারণের সঙ্গে নার্সিং পেশাটির সম্প্রসারন ঘটেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে একজন ডাক্তারের সঙ্গে সহকারী হিসেবে চারজন নার্সকে সার্বক্ষণিক থাকা প্রয়োজন প্রত্যেকটা রোগীকে ভালোমতো সেবা প্রদান করার জন্য। কিন্তু আমরা, দেখি তার বিপরীত। আবার যারা দায়িত্বরত অবস্থায় থাকেন তাদের মাঝে লোভ, লালসা, দুর্নীতি, ধোকাবাজিতে ভরপুর।

নার্সিং নামক এই শব্দের পিছে আছে বিশাল এক মানবতার গল্প। নার্সদের এই মহৎ পেশাকে সম্মানিত করে তুলতে আধুনিক নার্সিং এর প্রবর্তক মহীয়সী সেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের সেবা কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে তার জন্মদিনে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস হিসাবে পালন করা হয়। নাইটিংগেলের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অসুস্থ সৈন্যদের পাশে দাঁড়ানো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের এই যুদ্ধে সৈন্যদের অবস্থা বিপন্ন। সে সময় প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি সিডনি হার্বাট (নাইটিংগেলের সারা জীবনের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু) নাইটিংগেলকে লিখলেন- ‘যুদ্ধের এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় আহত সৈন্যদের তত্ত্বাবধান করার মতো একজনও উপযুক্ত ব্যক্তি নেই। যদি আপনি এ কাজের ভার গ্রহণ করেন, দেশ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’ দেশের এই ডাক নাইটিংগেল উপেক্ষা করতে পারেননি। নিজ উদ্যোগে নার্সিংয়ের জন্য ৩৮ জনের স্বেচ্ছাসেবী দল নিয়ে তিনি ছুটে যান। যা আজো নার্সিং সেবার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে।

সাদা যে শান্তির প্রতিক, সাদা যে শান্তি বহন করে তা নার্সদের দেখলেই বোঝা যায়। “নার্স মানেই মনে সাদা, নার্স মানে পোষাকে সাদা। নার্স মানে আচরন ও কর্মেও সাদা”। শান্তির প্রতীক এই সাদাকে তারা মনে ধারণ করে জীবন যৌবনকে উৎসর্গ করেন সাদার ভুবনে। উৎসর্গ করেন মানবতার সেবাই। তাদের গায়ের সঙ্গে সব সময় আবৃত্ত থাকে মানবতার চাদর। ঠিক এমনটাই হওয়া উচিৎ। মনে সব সময় সেবাকে লালন করা উচিৎ কিন্তু পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের দেশের নার্সদের রোগীদের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার চিত্র দেখতে পায়। যা একটা দেশ ও জাতীর জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার।

তবে সবাইকে এক দাড়ি পাল্লায় মাপা হলে আবার অবিচার করা হবে। কেমনা দেশে এখনও অনেক ডাক্তার বা নার্স আছে যারা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে অকাতরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যেনো সেবাই তাদের মূল ধর্ম, সেবাই তাদের ব্রত। রাত নেই, দিন নেই সংসার, পরিবার, সন্তানের মায়াকান্না তাদের সেবাধর্মী মনের কাছে অবহেলিত ও তুচ্ছ। সন্তানের প্রাপ্য ভালোবাসা টুকু দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন মানবতার চাদরে মোড়ানো এই সাদা পোষাকের এই নার্সরা। তাদের এই উৎসর্গ, আতœত্যাগ মানব জাতির জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাসের যে তান্ডব চলছে তার সম্মুখে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে অকাতরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই নার্সরা। নিজেদের পরিবার, পরিজন, সন্তান তাদের কাছে এখন সবই সামান্য এবং তাদের একমাত্র ব্রত মানবসেবা রোগীকে সুস্থ করে তোলা। অথচ সেবা করতে যেয়ে তারা শিকার হচ্ছে করোনার ভয়াবহ ছোবলে। এ জানা সত্তেও তারা থেমে নেই সব সময় বিরাজমান মানবতার সেবাই। তাদের এই ত্যাগ, পরিশ্রম ও জীবন উৎসর্গের মহান দৃষ্টান্তের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা। এবং যেসব অসাধু, লোভী, কালো চাদরে মোড়ানো নার্স নামে সেবার পরিবর্তে বাণিজ্য করে চলেছে তাদেরকে জানাই ধিক্কার।

ইমরান হুসাইন।

শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।