অনলাইন পাঠের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার রোধে ১৭ মার্চ থেকে প্রাথমিকসহ সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ। পিছিয়েছে চলতি সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। একটানা দীর্ঘ বন্ধে লেখাপড়ার অপূরণীয় ক্ষতি লাঘব ও শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শুরু থেকে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং ১২ আগস্ট থেকে রেডিওর মাধ্যমে পাঠ সম্প্রচারিত হচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে চলছে পিটিআইসমূহে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেড় বছর মেয়াদী ডিপিএড প্রশিক্ষণ এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। এর বাইরে অনেক শিক্ষক ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায়ও অনলাইনে পাঠদান করছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছেন।

অনলাইন পাঠের উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা রয়েছে। যদিও এই ধারার পাঠ কোনো অবস্থাতেই নিয়মিত শ্রেণী পাঠদানের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু চলমান অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ে অন্যান্য সব খাতের মতো শিক্ষা খাতও দারুণ বিপর্যস্ত। অনলাইন পাঠ অনেকটাই নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালোর মতো। তবে শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর উপযোগিতা মূল্যায়নের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে দুর্যোগকালীন সম্পূর্ণ ডিজিটাল নির্ভর পাঠদান। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছে এটা অপ্রত্যাশিত ক্রান্তিকালীন ছুটি। যে কোনো অবস্থাতেই তাই পড়ালেখার গুরুত্ব কতোটা সেই বার্তাটাও এর মাধ্যমে দেওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া, যোগাযোগ ও বিনোদনের মাধ্যম ছাড়াও মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ইত্যাদি যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক এই নতুন ধারণাটাও তারা পেয়েছে। দীর্ঘ ছুটিতে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার প্রতি অবহেলার চিরন্তন অভ্যাসটা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পরিবর্তন করা গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ঘরে বসে শেখার এমন সময়োপযোগী কার্যক্রম সব বয়সের শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদ অনেকটা দূর করছে।

পক্ষান্তরে, অনলাইন ক্লাসের রয়েছে বেশ কিছু অসুবিধা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সিংহভাগ শিক্ষার্থী নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। চলমান ক্রান্তিকালে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। যুদ্ধ করছেন অন্তত বেঁচে থাকার। তাই ক্যাবল সংযোগসমৃদ্ধ টিভি, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের মাধ্যমে পড়ালেখা তাদের কাছে গরীবের ঘোড়া রোগের সমতুল্য। ফলে পাঠ থেকে বঞ্চিত বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী। তাদের মনে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। এক বাবা তার হালের গরু বিক্রি করে সন্তানকে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছেন। আবার মোবাইল ফোন না পাওয়ায় কয়েকজনের আত্মহত্যার অপ্রত্যাশিত খবরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। অন্যদিকে, দেশের প্রান্তিক জেলাগুলোর অনেক জায়গায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা দুর্বল। সঙ্গে একই পরিমাণ ডাটার মূল্য ও মেয়াদ কোম্পানিভেদে আলাদা এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের পর অব্যবহৃত ডাটা ব্যবহার করার সুযোগ না থাকা পাঠদান কার্যক্রমের গতিশীলতা নষ্ট করছে। কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়িয়ে বা খণ্ডকালীন কোনো কাজের আয়ে তাদের পড়ালেখার ব্যয় নির্বাহ করে। কিন্তু করোনাকালে তারা সম্পূর্ণই পরিবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ায় অনলাইন পাঠে তাদের ইচ্ছে মূল্য পাচ্ছে না। টিভি ও রেডিওর পাঠের ব্যাপ্তি প্রত্যাশিত সুফল প্রাপ্তির অন্যতম একটি সমস্যা। শিক্ষার্থীর প্রশ্নের মাধ্যমে শেখার গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ অনলাইন ক্লাসে খুব একটা নেই। এছাড়া নিচের স্তরের শিক্ষায় উপকরণের ব্যবহার ছাড়া পাঠের নির্ধানিত শিখনফল অর্জন করা কঠিন। সর্বোপরি, ‘প্রযুক্তি ধারালো অস্ত্র’ কথাটা অনস্বীকার্য। বিশ^বিদ্যালয় ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের শিক্ষার্থীদের অনলাইন পাঠের পাশাপাশি বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট, নোট ও গবেষণা কর্ম চালাতে হয় বলে তাদের অনেকটা সময় ব্যয় হচ্ছে যন্ত্রের পেছনে। একটানা দীর্ঘক্ষণ মোবাইল বা ল্যাপটপের পর্দায় চোখ এবং কানে ইয়ার ফোন বা হেড ফোন রাখায় সংশ্লিষ্টদের চোখ, কান ও মস্তিষ্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।

সবকিছু ছাপিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান অনলাইন পাঠ নিঃসন্দেহে একটি অভূতপূর্ব এবং যুগোপযোগী ধারণার পরীক্ষামূলক সূচনা বলা যায়। ক্রান্তিকালেও স্বল্প পরিসরে শিক্ষা কার্যক্রম নির্বাসনে যায় নি, এটাই অন্যতম প্রাপ্তি। তবে মোটাদাগে এর সুফল পেতে হলে অনলাইন প্ল্যাটফরমের পরিসর বাড়াতে হবে। বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠগুলোর ব্যাপ্তি কিছুটা বাড়িয়ে বিটিভিতে সম্প্রচার করা গেলে আরও অনেক শিক্ষার্থী সুবিধার আওতায় আসতো। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সরকার ও শিক্ষকদের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোকেও। স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করে শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিত হলে মানসম্মত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন ত্বরান্বিত হবে।

আবু ফারুক

সহকারী শিক্ষক

ভাগ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

সদর, বান্দরবান।

আরও খবর

মঙ্গলবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১১ মহররম ১৪৪২, ১৫ ভাদ্র ১৪২৭

অনলাইন পাঠের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার রোধে ১৭ মার্চ থেকে প্রাথমিকসহ সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ। পিছিয়েছে চলতি সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। একটানা দীর্ঘ বন্ধে লেখাপড়ার অপূরণীয় ক্ষতি লাঘব ও শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শুরু থেকে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং ১২ আগস্ট থেকে রেডিওর মাধ্যমে পাঠ সম্প্রচারিত হচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে চলছে পিটিআইসমূহে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেড় বছর মেয়াদী ডিপিএড প্রশিক্ষণ এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। এর বাইরে অনেক শিক্ষক ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায়ও অনলাইনে পাঠদান করছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছেন।

অনলাইন পাঠের উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা রয়েছে। যদিও এই ধারার পাঠ কোনো অবস্থাতেই নিয়মিত শ্রেণী পাঠদানের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু চলমান অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ে অন্যান্য সব খাতের মতো শিক্ষা খাতও দারুণ বিপর্যস্ত। অনলাইন পাঠ অনেকটাই নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালোর মতো। তবে শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর উপযোগিতা মূল্যায়নের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে দুর্যোগকালীন সম্পূর্ণ ডিজিটাল নির্ভর পাঠদান। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছে এটা অপ্রত্যাশিত ক্রান্তিকালীন ছুটি। যে কোনো অবস্থাতেই তাই পড়ালেখার গুরুত্ব কতোটা সেই বার্তাটাও এর মাধ্যমে দেওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া, যোগাযোগ ও বিনোদনের মাধ্যম ছাড়াও মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ইত্যাদি যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক এই নতুন ধারণাটাও তারা পেয়েছে। দীর্ঘ ছুটিতে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার প্রতি অবহেলার চিরন্তন অভ্যাসটা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পরিবর্তন করা গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ঘরে বসে শেখার এমন সময়োপযোগী কার্যক্রম সব বয়সের শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদ অনেকটা দূর করছে।

পক্ষান্তরে, অনলাইন ক্লাসের রয়েছে বেশ কিছু অসুবিধা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সিংহভাগ শিক্ষার্থী নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। চলমান ক্রান্তিকালে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। যুদ্ধ করছেন অন্তত বেঁচে থাকার। তাই ক্যাবল সংযোগসমৃদ্ধ টিভি, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের মাধ্যমে পড়ালেখা তাদের কাছে গরীবের ঘোড়া রোগের সমতুল্য। ফলে পাঠ থেকে বঞ্চিত বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী। তাদের মনে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। এক বাবা তার হালের গরু বিক্রি করে সন্তানকে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছেন। আবার মোবাইল ফোন না পাওয়ায় কয়েকজনের আত্মহত্যার অপ্রত্যাশিত খবরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। অন্যদিকে, দেশের প্রান্তিক জেলাগুলোর অনেক জায়গায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা দুর্বল। সঙ্গে একই পরিমাণ ডাটার মূল্য ও মেয়াদ কোম্পানিভেদে আলাদা এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের পর অব্যবহৃত ডাটা ব্যবহার করার সুযোগ না থাকা পাঠদান কার্যক্রমের গতিশীলতা নষ্ট করছে। কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়িয়ে বা খণ্ডকালীন কোনো কাজের আয়ে তাদের পড়ালেখার ব্যয় নির্বাহ করে। কিন্তু করোনাকালে তারা সম্পূর্ণই পরিবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ায় অনলাইন পাঠে তাদের ইচ্ছে মূল্য পাচ্ছে না। টিভি ও রেডিওর পাঠের ব্যাপ্তি প্রত্যাশিত সুফল প্রাপ্তির অন্যতম একটি সমস্যা। শিক্ষার্থীর প্রশ্নের মাধ্যমে শেখার গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ অনলাইন ক্লাসে খুব একটা নেই। এছাড়া নিচের স্তরের শিক্ষায় উপকরণের ব্যবহার ছাড়া পাঠের নির্ধানিত শিখনফল অর্জন করা কঠিন। সর্বোপরি, ‘প্রযুক্তি ধারালো অস্ত্র’ কথাটা অনস্বীকার্য। বিশ^বিদ্যালয় ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের শিক্ষার্থীদের অনলাইন পাঠের পাশাপাশি বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট, নোট ও গবেষণা কর্ম চালাতে হয় বলে তাদের অনেকটা সময় ব্যয় হচ্ছে যন্ত্রের পেছনে। একটানা দীর্ঘক্ষণ মোবাইল বা ল্যাপটপের পর্দায় চোখ এবং কানে ইয়ার ফোন বা হেড ফোন রাখায় সংশ্লিষ্টদের চোখ, কান ও মস্তিষ্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।

সবকিছু ছাপিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান অনলাইন পাঠ নিঃসন্দেহে একটি অভূতপূর্ব এবং যুগোপযোগী ধারণার পরীক্ষামূলক সূচনা বলা যায়। ক্রান্তিকালেও স্বল্প পরিসরে শিক্ষা কার্যক্রম নির্বাসনে যায় নি, এটাই অন্যতম প্রাপ্তি। তবে মোটাদাগে এর সুফল পেতে হলে অনলাইন প্ল্যাটফরমের পরিসর বাড়াতে হবে। বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠগুলোর ব্যাপ্তি কিছুটা বাড়িয়ে বিটিভিতে সম্প্রচার করা গেলে আরও অনেক শিক্ষার্থী সুবিধার আওতায় আসতো। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সরকার ও শিক্ষকদের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোকেও। স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করে শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিত হলে মানসম্মত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন ত্বরান্বিত হবে।

আবু ফারুক

সহকারী শিক্ষক

ভাগ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

সদর, বান্দরবান।