রাহাত খানের গল্প

আত্মজিজ্ঞাসা এবং সমকালের এক অসাধারণ চিত্রশালা

ম্যারিনা নাসরীন

চোখের সামনে যা কিছু দেখা যায় তার সাথে মেধা আর অন্তর্দৃষ্টি-র সংযোগ সাধন ঘটাতে পারলেই চোখের বাইরের অনেককিছু দেখা সম্ভব। সবাই সেটি পারেন না, কেউ কেউ পারেন। তবে শুধু সংযোগ ঘটাতে পারলেই হবে না, সেটিকে প্রকাশ করার ক্ষমতাও থাকতে হবে। যাঁদের প্রকাশ করার এই ক্ষমতাটি রয়েছে, তাঁরা অসাধারণ সৃজনশীলতার অধিকারী। যাকে বলে জাতশিল্পী। রাহাত খান ছিলেন সেরকম একজন জাতশিল্পী যাকে আধুনিক কথাসাহিত্যের পুরোধাদের একজন বললেও কম বলা হয়। ছোটগল্পে তাঁর স্বর অন্যদের থেকে একদম আলাদা, একেবারেই ব্যতিক্রম।

অনেকের মতে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো লেখক সময়কে নিখুঁতভাবে আঁকতে পারেন না। সে বিচারে রাহাত খানের রচনা পড়তে গেলে পাঠক ধন্ধে পড়ে যাবেন। কারণ তিনি প্রায় প্রতিটি গল্প উপন্যাসে মানব চরিত্রের অন্তরদ্বন্দ্বকে যে পারঙ্গমতায় ব্যবচ্ছদে করেছেন, খণ্ড বিখণ্ড করেছেন- তাতে করে পাঠকের মনে হবে লেখক তাঁর নিজের জীবনকেই লিখছেন। অথচ একই সংগে এত এত চরিত্রে জীবন যাপন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

একইভাবে রাহাত খানের রচনায় আমরা দেখতে পাই তিনি অসংখ্য চিত্রের মাধ্যমে সমকালকে নিখুঁতভাবে এঁকে গিয়েছেন। তাঁর গল্প মানে সময়ের চলচ্চিত্র। এতে করে বোঝা যায় তিনি তাঁর চারপাশে ঘূর্ণায়মান প্রতিটি চরিত্র, সমাজ, রাষ্ট্রকে তীব্র আকাক্সক্ষার সাথে পাঠ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় বললে, ‘সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখতে’। তিনি তাঁর সময়কে সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখেছেন এবং অত্যন্ত মেধার সাথে তাঁর নির্মাণ করেছেন।

রাহাত খানের গল্পের প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত যে, পাঠক তাঁর সঙ্গে যাত্রা শুরু করে শেষ পর্যন্ত নিমগ্ন হয়ে তাঁর সঙ্গেই অবস্থান করতে বাধ্য হন। গল্পের শেষেও পাঠক চরিত্র থেকে সহসা বেরুতে পারেন না। তাঁর মনে নতুন নতুন অনেকগুলো গল্পের জন্ম হয়। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন তিনি।

যেমন ‘অন্তহীন যাত্রা’য় মাতাল কামরুদ্দিন আহমদ ‘জেড’ আদ্যক্ষরের এক দীর্ঘদিনের শয্যাসঙ্গিনীর বাসা আরামবাগ থেকে হেঁটে ভূতের গলিতে নিজের বাসায় ফিরছে। একা নিঃসঙ্গ পুরোপুরি হতাশ একজন মানুষ। স্ত্রীর মৃত্যুচিন্তা তাঁকে বিচলিত করে না। হাঁটতে হাঁটতে সে নির্দ্বিধায়, অকপটে আত্মবিশ্লেষণ করে। আমরা সেখানে দেখতে পাই, সেই বিশে্লষণ থেকে বেরিয়ে আসছে সময়ের সব মহাসত্য। রাষ্ট্র সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুণে খাওয়া ছিদ্রগুলো পাঠকের চোখে বিশাল ফোকর হয়ে ধরা পড়ে এই গল্পে। শ্রেণি বৈষম্যের দিকে আঙ্গুল তুলতে গিয়ে তাই কামরুদ্দিনের কণ্ঠে আমরা শুনি, ‘কুকুর হতে সাবধান’ সংস্কৃতির দখল দিন দিন বাড়ছে যেমন বাড়ছে মাতালের সংখ্যা’।

তাঁর আত্মজিজ্ঞাসায় জানতে পারি সেই সময়ের আক্রা আর হতাশার কথা, ‘তেলের দাম পঁচিশ টাকা সের, মরিচ পঁয়ষট্টি টাকা সের, চাল আট টাকা ছাড়িয়ে গেছে, বলেন, মানুষ বাঁচবে?’

কামরুদ্দিন নিজে একজন ধান্ধাবাজ নিষ্ঠুর চরিত্রের মানুষ। এই চরিত্রের মানুষ আমাদের সমাজে বিরল নয়। রাহাত খান ‘অন্তহীন যাত্রা’ গল্পে কামরুদ্দিনের মাধ্যমে সেসব চরিত্রকে পাকা জহুরীর মতো উপস্থাপন করেছেন। তাদের অন্তরাত্মার অন্তর্দন্দ্বের পোস্টমর্টেম করে দেখিয়েছেন। কামরুদ্দিন পিতার মতো দেখতে ভিক্ষুককে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারে, দরিদ্র বন্ধু দিব্যেন্দু অভুক্ত স্ত্রী সন্তানের খাবারের জন্য একশটি টাকা চাইলে টাকার পরিবর্তে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে পারে, অথচ নারীদের ক্ষেত্রে সে এতটা খারাপ ভাবতে পারে না। তার মতে, ‘আমি দেখেছি খারাপ মহিলা পাওয়া খুব দুষ্কর। বাইরে থেকে যারা খারাপের তীব্র সম্ভাবনা দেখায়, কাছে যাওয়া মাত্র তারা লুকানো কোষ থেকে বের করে আনে মাতৃত্ববোধ, নারীত্ব, মানবিকতাÑ এমনকি সতীত্ববোধ নামক টাইম বোমাটি।’

টাকার বিনিময়ে নারী কারো শয্যাসঙ্গিনী হলে আমাদের সমাজ তাকে বেশ্যা নাম দেয়। কিন্তু শুধু তারাই কি বেশ্যা? আমাদের সমাজে আরো নানা পেশার বেশ্যা রয়েছে রাহাত খান অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সেসমস্ত বেশ্যার সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন। এই গল্পে আমরা সেই সাহসী স্বর শুনতে পাই সচারচর লেখকগণ যেগুলো এড়িয়ে চলেন। কামরুদ্দিনের সংলাপে আমরা এক লেখক বেশ্যাকে চিনি, টাকার বিনিময়ে যাকে যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায়। সাংবাদিক বেশ্যা, আমলা বেশ্যা, এমনকি কামরুদ্দিন নিজেও একজন বেশ্যা যে রাজনীতিতে তিন বছর বেশ্যাগিরি করেছে এখন যেখানে আছে সেটাও এমন একটি বিছানা যেখানে টাকা দিলেই তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়।

খুব সরল সাধারণ বর্ণনায় সমাজের এসব অন্ধকার দিকে লেখক রাহাত খান একদম ঠিকঠাক আলো ফেলেছেন। আবার একজন খারাপ মানুষের মধ্যে যে খারাপ হবার জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, অনুতাপ, বিষাদ থাকতে পারে সেটাও অসাধারণভাবে উন্মোচন করেছেন। তাই তো কামরুদ্দিন আক্ষেপ করে বলে, ‘তুই খবরের কাগজে কেন বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশের মানুষকে জানাসনি যে তুই একটা মস্তবড় বেশ্যা?’

‘অন্ত্যহীন যাত্রা’ গল্পের শেষে দেখা যায় কামরুদ্দিন শবযাত্রীদের সঙ্গী হয়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেছে। যার শেষ কোথায় তার জানা নেই। পাঠক এখানে এসে একজন খারাপ মানুষ কামরুদ্দিনের জন্য অদ্ভুত ধরনের বেদনাবোধে আক্রান্ত হবেন। তাকে ঘিরে নতুন নতুন সম্ভাবনার কথা ভাববেন। পাঠককে গল্পে আটকে রাখার মতো এমনই যাদুকরী ক্ষমতার লেখক রাহাত খান।

‘অন্তহীন যাত্রা’র মতোই ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ রাহাত খানের একটি কালজয়ী গল্প। অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষ নিজেকে কখনো অতিক্রম করতে পারে না। মানুষ যখন নিজেই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায় তখন সে সম্পর্ক, মায়ামমতা, মানবিকতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেকেই স্থান দেয়। তাই এই গল্পে আমরা অমানবিকতার চূড়ান্ত রূপ দেখি। আবার বলা যায় এটাই চরম বাস্তবিকতা, পরম সত্য। এই অতিমারি করোনাকালীন সময়ে আমরা এমন কিছু সত্যের মুখোমুখি হয়েছি। দেখেছি অসুস্থ মাকে করোনা আক্রান্ত ভেবে সন্তানেরা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছে, মৃতপ্রায় অসুস্থ পিতাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, ছটফট করে মৃত্যুবরণ করেছেন অথচ এক গ্লাস পানি পর্যন্ত এক পিতাকে/স্বামীকে খেতে দেওয়া হয়নি। এই ঘটনাগুলো যখন কোনো লেখক গল্পে প্রকাশ করবেন তখন হয়ত অতিরঞ্জিত মনে হবে। এমন এক নিষ্ঠুর সত্যের কাহিনী ‘ইমান আলীর মৃত্যু’। এই গল্পে আমরা একদিকে শাসক শ্রেণিকে বন্যাপীড়িত দরিদ্রের খাবার লুটেপুটে খেতে দেখি, অন্যদিকে সুযোগসন্ধানী শ্রেণির সুযোগের নগ্ন ব্যবহার দেখতে পাই। গাছের ডালে, পানির ওপর মাচায় থাকা উপোসী মানুষের শেষ আশ্রয়ের ভিটেটুকুও পানির দরে কিনে আরো ধনী হয়ে যায় এই শ্রেণি। সম্পর্কের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার প্রতিক ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ গল্পটি। তাই ভাই ফকীরচানের সন্তানেরা যখন নিপাট উপোস, জ্বর জারিতে একের পর মরতে থাকে তখন রহিমচান আর তার স্ত্রী একছালা চাল-আলুর বস্তার ওপর এমনভাবে শুয়ে থাকে যেনো সোনা-রুপার মতো দামী কোনো জিনিস আগলে রেখেছে। সরকারি রিলিফ অনিয়মিতভাবে কিছুদিন এসে বন্ধ হয়ে যায়। বন্যাপীড়িত ইমান আলীর পরিবারের দুঃখ দুর্দশা আমাদেরকে অসহায় করে তোলে এদেশের সিস্টেমের কাছে, দুর্নিতীবাজ কিছু মানুষের কাছে। তাইতো ফকীরচানের মৃত মেয়ে জৈতুনের লাশ যখন ভাসতে ভাসতে আবারো স্রোতের টানে চঙর নিচে ফিরে আসে ওর সদ্য ছিদ্রকরা নাকের লাল সুতো আমাদের দিকে ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, আমার পরিণতির জন্য দায়ী কে? এর জবাব লেখক রাহাত খান বা আমাদের মতো পাঠকের কাছে থাকে না। পিতা ফকীরচান বুকে জড়িয়ে মেয়ের লাশকে আবার বিলে ভাসিয়ে দিয়ে আসে। কবর দেবার ডাংগাও যে গরিবের ভাগ্যে নেই!

এই গল্পে আমরা লেখকের কুশলতায় সম্পর্কের মায়া বা নিষ্ঠুরতা দু’পিঠই অবলোকন করতে পারি। যে পিতা অসুস্থ হলে সন্তানেরা আকাশবাতাস তোলপাড় করে কাঁদতে পারে, যত্ন করে প্রিয় খাবার খাওয়ায়, অভাবের তাড়নায়, পেটের ক্ষুধায়, সেই সন্তানেরাই আবার পিতাকে রাস্তায় মুমূর্ষ অবস্থায় ফেলে খাবারেরে সন্ধানে ছুটে যায়। পিতাকে কাঁধে নিয়ে পনের কিলোমিটার হাঁটার মতো শক্তি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর তিনভাই রহিমচান, ফকীরচান, আবুচান কারো ছিল না। এতদসত্ত্বেও মুমূর্ষু পিতা ইমান আলী যখন ছোট ছেলে আবুচানের পিরান চেপে ধরে আর আবুচান ‘ভায়ু গো, ভায়ু গো মল্লাম মল্লাম’ চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যায় তখন সেই দৃশ্যের মুখোমুখি হতে আমরা ভয় পাই, নির্মম সত্যে আঁতকে উঠি।

রাহাত খানের ‘মধ্যরাতে’ গল্পটি ছোটগল্পের সাধারণ কাঠামোর বাইরে একেবারে ভিন্ন ধাঁচের একটি গল্প। আর দশটি গল্পের সাথে ঠিক মেলানো যাবে না। তাই বলে ছোটগল্পের মান এতে ক্ষুণœ হয়নি বরং বহুগুণে বেড়েছে। গল্পটি মূলত ফোনের ক্রসকানেকশনে পাওয়া দুই মধ্যবয়সী নারীপুরুষের কথপোকথন। দুজনের সংলাপের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন সম্পর্কে মোটামুটি জানা হয়ে যায়। পুরো সময় কথক এখানে অনুপস্থিত তবে গল্পের শেষে তাঁর উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই একরকম উপসংহারের আদলে। গল্পটিতে আমরা একদিকে যেমন উচ্চবিত্ত শ্রেণি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্র সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাই তেমনি নারীর স্বাধীনতা, ভালোলাগা-মন্দলাগা নিয়ে পুরুষের চিন্তাভাবনার গণ্ডি সম্পর্কেও জানতে পারি। মানুষ আদতেই একা- সেই সূত্রটির উদাহরণও হতে পারে ‘মধ্যরাতে’ গল্পটি। মানুষের মধ্যে নিজেকে গোপন রাখার প্রবণতাও কম নয়। কিন্তু দুজন অচেনা মানুষকে আমরা মধ্যরাতে একে অপরের কাছে আগল খুলে দিতে দেখি। যেটি হয়ত পরিচিত মানুষের কাছে সম্ভব নয়। তাদের আলাপের একটি পর্যায়ে পাঠকের মনে হয়েছিল নিঃসঙ্গ দুজন মানুষ হয়তবা পরস্পরের কাছে আসার একটি সুযোগ পেয়েছে, তাদের মনে দুজনের ভবিষ্যত বন্ধুত্বের সম্ভাবনাও উঁকি দেয়। কিন্তু শেষে ফোনের লাইন কেটে গিয়ে সকল সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। পাঠক হয়ত এখানে এসে কিছুটা হতাশ হয়ে ভাবতে পারেন, এ কেমন পরিণতি! কিন্তু সেই মুহূর্তে লেখক অঙ্গুলী হেলিয়ে বলে দেন, মানুষের গল্প এমনই। জীবনভর বহু রং নম্বর। লেখকের এই ভয়ানক সত্যিকে মানতে অস্বীকার করবে কে?

‘মধ্যিখানে চর’ গল্পটি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিপথগামী এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার আত্মদহনের ইতিহাস। যে সোনার দেশ গড়বার স্বপ্ন নিয়ে, সমাজকে বদলে দেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেছিল স্বাধীন বাংলায় একে একে তার বিনাশ ঘটতে থাকে। লাগামহীন দুর্নীতি, বেকার সমস্যা আর একসময়ের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘাতকেরাই যখন অর্থবিত্ত মালিক হয়ে ক্ষমতার মঞ্চে সমাসীন হয়, আতিক, মিজান, হাজারীর মতো ব্যর্থতা আর

হতাশায় নিমজ্জিত মুক্তিযোদ্ধারা তখন টাকার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। গল্পের সবুজ নিজের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়। সে ফ্রিডম ফাইটার সবুজ, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রবেশের সময়ে এক মা ছুটে গিয়ে যার কপালে চুমু খেয়ে হুহু করে কেঁদে উঠেছিলেন। তাঁর পুত্র হয়ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরতে পারেনি। সেদিন সবুজ বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু সুন্দর প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পারেনি। একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে যে হাতে পাক সেনাদেরকে মেরেছিল শুধুমাত্র দেশের জন্য, সেই সবুজেরাই চার বছর বয়সী এক কন্যা শিশুর সামনে পিতাকে মারতে দ্বিধা করেনি। ঘটনা একই, প্রেক্ষাপট শুধু ভিন্ন। আমরা দেশকে বাঁচাতে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠা যে যুবককে টুপি খোলা অভিবাদন জানাই, কিন্তু নিজের স্বার্থে একজন মানুষকে হত্যা করতে দেখলে সেই যুবকের প্রতি ঘৃণায় থুঃ থুঃ ছিটাই। কিন্তু লেখক রাহাত খানা অত্যন্ত চাতুর্যতার সাথে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন স্বপ্নহীন যুবকের পথভ্রষ্ঠ হবার জন্য সে একাই দায়ী নয়। তার জন্য দেশ, সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতিও দায়ী। তিনি সবুজের মনোলোকে ভেসে ওঠা হতাশা, গ্লানি আর না পারার ক্লান্তিকে একজন মেধাবী চিত্রকরের মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘কোনদিকে যাবেÑ মায়ের দিকে, শিউলির দিকে, ভক্সওয়াগনের দিকে, এইসব কিছুই সে জানে না। বুঝতেও পারে না।’ এই আর্তি আমাদেরকে বহুবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন করে।

এই স্বল্প পরিসরে রাহাত খানের গল্পের সামগ্রিক উপস্থাপনা আমার মতো নবিশির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তবুও আরো কিছু গল্পের কথা না বললেই নয়। তাঁর রচিত ‘চুপি চুপি বাঁশী বাজে’ গল্পে প্রাক্তন স্ত্রী সোহানার প্রতি আয়াজের ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রেমের সন্ধান পাই আমরা, অন্যদিকে ‘আমাদের বিষবৃক্ষ’ গল্পে রায়টের কারণে ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতের নীলমণিপুর থেকে উন্মূল হয়ে আসা আতাউরের পরিবারের নিদারুণ মনঃকষ্টকে অনুধাবন করি। যেমনটি পরবর্তীতে রায়টের কারণেই এদেশ থেকে উন্মূল হয়েছিল মাখনলালের পরিবার। রাহাত খান ভিন্ন সময়ে, ভিন্নভিন্ন জায়গায় বুকের ক্ষরণকে একই ক্যানভাসে দারুণভাবে এঁকেছেন এই গল্পে। তাঁর ‘উদ্বেল পিপাসা’ গল্পে একজন পীড়িত স্বামীর অসাহায়ত্ব আমাদেরকে দোলা দেয়, অথচ স্বামীকে ফেলে অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া স্ত্রীকেও ভ্রষ্ঠা বলতে কুণ্ঠাবোধ করি। কারণ এটাই সত্যের মতো স্বাভাবিক। রাহাত খানের ‘চুড়ি’ গল্পটি সমাজ এবং নারীর প্রেমের অন্য আরেকটি দিক উন্মোচিত করে। স্বল্প বেতনভুক পিওন বৈদরের সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য জৈগুনকে কিছু নারীলোভী পুরুষের মনোরঞ্জন করতে হয়। এই গল্পে রাহাত খান দেখিয়েছেন, জৈগুনের মতো স্ত্রীদের স্বামীর সাথে মিলনের সময় চুড়ির মিঠা আওয়াজ ওঠে কিন্তু যখন সে সংসারের প্রয়োজনে পরপুরুষের শয্যার সঙ্গী হয় তখন চুড়ির আওয়াজ থমকে যায়। কারণ সেখানে মহব্বত থাকে না, থাকে প্রয়োজন।

রাহাত খান চিন্তা-চেতনা এবং লেখনীতে সময়ের অগ্রবর্তী একজন নিভৃতচারী লেখক। তিনি সময়কে যে সাহসিকতার সাথে, নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন, তেমনটি খুব কমই দেখা যায়। অথচ এরজন্য কোনো বাগাড়ম্বর নেই, নেই কোনো আয়োজন। তাঁর সাহিত্য গতিময়তার এক অতুলনীয় প্রতীক। সহজ ভাষায় সরল গতিতে নিস্পৃহভাবে তিনি কল্পনাশক্তির বিস্ময়কর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, চরিত্রকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন, জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোণের ব্যাখা দিয়েছেন।

আজ রাহাত খান আমাদের মাঝে নেই কিন্তু এমন কিছু অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম তিনি রেখে গিয়েছেনÑ যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রাখবে নিশ্চিত। একজন রাহাত খান নিজেই নিজের তুলনা।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

রাহাত খানের গল্প

আত্মজিজ্ঞাসা এবং সমকালের এক অসাধারণ চিত্রশালা

ম্যারিনা নাসরীন

image

চোখের সামনে যা কিছু দেখা যায় তার সাথে মেধা আর অন্তর্দৃষ্টি-র সংযোগ সাধন ঘটাতে পারলেই চোখের বাইরের অনেককিছু দেখা সম্ভব। সবাই সেটি পারেন না, কেউ কেউ পারেন। তবে শুধু সংযোগ ঘটাতে পারলেই হবে না, সেটিকে প্রকাশ করার ক্ষমতাও থাকতে হবে। যাঁদের প্রকাশ করার এই ক্ষমতাটি রয়েছে, তাঁরা অসাধারণ সৃজনশীলতার অধিকারী। যাকে বলে জাতশিল্পী। রাহাত খান ছিলেন সেরকম একজন জাতশিল্পী যাকে আধুনিক কথাসাহিত্যের পুরোধাদের একজন বললেও কম বলা হয়। ছোটগল্পে তাঁর স্বর অন্যদের থেকে একদম আলাদা, একেবারেই ব্যতিক্রম।

অনেকের মতে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো লেখক সময়কে নিখুঁতভাবে আঁকতে পারেন না। সে বিচারে রাহাত খানের রচনা পড়তে গেলে পাঠক ধন্ধে পড়ে যাবেন। কারণ তিনি প্রায় প্রতিটি গল্প উপন্যাসে মানব চরিত্রের অন্তরদ্বন্দ্বকে যে পারঙ্গমতায় ব্যবচ্ছদে করেছেন, খণ্ড বিখণ্ড করেছেন- তাতে করে পাঠকের মনে হবে লেখক তাঁর নিজের জীবনকেই লিখছেন। অথচ একই সংগে এত এত চরিত্রে জীবন যাপন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

একইভাবে রাহাত খানের রচনায় আমরা দেখতে পাই তিনি অসংখ্য চিত্রের মাধ্যমে সমকালকে নিখুঁতভাবে এঁকে গিয়েছেন। তাঁর গল্প মানে সময়ের চলচ্চিত্র। এতে করে বোঝা যায় তিনি তাঁর চারপাশে ঘূর্ণায়মান প্রতিটি চরিত্র, সমাজ, রাষ্ট্রকে তীব্র আকাক্সক্ষার সাথে পাঠ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় বললে, ‘সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখতে’। তিনি তাঁর সময়কে সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখেছেন এবং অত্যন্ত মেধার সাথে তাঁর নির্মাণ করেছেন।

রাহাত খানের গল্পের প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত যে, পাঠক তাঁর সঙ্গে যাত্রা শুরু করে শেষ পর্যন্ত নিমগ্ন হয়ে তাঁর সঙ্গেই অবস্থান করতে বাধ্য হন। গল্পের শেষেও পাঠক চরিত্র থেকে সহসা বেরুতে পারেন না। তাঁর মনে নতুন নতুন অনেকগুলো গল্পের জন্ম হয়। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন তিনি।

যেমন ‘অন্তহীন যাত্রা’য় মাতাল কামরুদ্দিন আহমদ ‘জেড’ আদ্যক্ষরের এক দীর্ঘদিনের শয্যাসঙ্গিনীর বাসা আরামবাগ থেকে হেঁটে ভূতের গলিতে নিজের বাসায় ফিরছে। একা নিঃসঙ্গ পুরোপুরি হতাশ একজন মানুষ। স্ত্রীর মৃত্যুচিন্তা তাঁকে বিচলিত করে না। হাঁটতে হাঁটতে সে নির্দ্বিধায়, অকপটে আত্মবিশ্লেষণ করে। আমরা সেখানে দেখতে পাই, সেই বিশে্লষণ থেকে বেরিয়ে আসছে সময়ের সব মহাসত্য। রাষ্ট্র সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুণে খাওয়া ছিদ্রগুলো পাঠকের চোখে বিশাল ফোকর হয়ে ধরা পড়ে এই গল্পে। শ্রেণি বৈষম্যের দিকে আঙ্গুল তুলতে গিয়ে তাই কামরুদ্দিনের কণ্ঠে আমরা শুনি, ‘কুকুর হতে সাবধান’ সংস্কৃতির দখল দিন দিন বাড়ছে যেমন বাড়ছে মাতালের সংখ্যা’।

তাঁর আত্মজিজ্ঞাসায় জানতে পারি সেই সময়ের আক্রা আর হতাশার কথা, ‘তেলের দাম পঁচিশ টাকা সের, মরিচ পঁয়ষট্টি টাকা সের, চাল আট টাকা ছাড়িয়ে গেছে, বলেন, মানুষ বাঁচবে?’

কামরুদ্দিন নিজে একজন ধান্ধাবাজ নিষ্ঠুর চরিত্রের মানুষ। এই চরিত্রের মানুষ আমাদের সমাজে বিরল নয়। রাহাত খান ‘অন্তহীন যাত্রা’ গল্পে কামরুদ্দিনের মাধ্যমে সেসব চরিত্রকে পাকা জহুরীর মতো উপস্থাপন করেছেন। তাদের অন্তরাত্মার অন্তর্দন্দ্বের পোস্টমর্টেম করে দেখিয়েছেন। কামরুদ্দিন পিতার মতো দেখতে ভিক্ষুককে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারে, দরিদ্র বন্ধু দিব্যেন্দু অভুক্ত স্ত্রী সন্তানের খাবারের জন্য একশটি টাকা চাইলে টাকার পরিবর্তে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে পারে, অথচ নারীদের ক্ষেত্রে সে এতটা খারাপ ভাবতে পারে না। তার মতে, ‘আমি দেখেছি খারাপ মহিলা পাওয়া খুব দুষ্কর। বাইরে থেকে যারা খারাপের তীব্র সম্ভাবনা দেখায়, কাছে যাওয়া মাত্র তারা লুকানো কোষ থেকে বের করে আনে মাতৃত্ববোধ, নারীত্ব, মানবিকতাÑ এমনকি সতীত্ববোধ নামক টাইম বোমাটি।’

টাকার বিনিময়ে নারী কারো শয্যাসঙ্গিনী হলে আমাদের সমাজ তাকে বেশ্যা নাম দেয়। কিন্তু শুধু তারাই কি বেশ্যা? আমাদের সমাজে আরো নানা পেশার বেশ্যা রয়েছে রাহাত খান অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সেসমস্ত বেশ্যার সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন। এই গল্পে আমরা সেই সাহসী স্বর শুনতে পাই সচারচর লেখকগণ যেগুলো এড়িয়ে চলেন। কামরুদ্দিনের সংলাপে আমরা এক লেখক বেশ্যাকে চিনি, টাকার বিনিময়ে যাকে যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায়। সাংবাদিক বেশ্যা, আমলা বেশ্যা, এমনকি কামরুদ্দিন নিজেও একজন বেশ্যা যে রাজনীতিতে তিন বছর বেশ্যাগিরি করেছে এখন যেখানে আছে সেটাও এমন একটি বিছানা যেখানে টাকা দিলেই তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়।

খুব সরল সাধারণ বর্ণনায় সমাজের এসব অন্ধকার দিকে লেখক রাহাত খান একদম ঠিকঠাক আলো ফেলেছেন। আবার একজন খারাপ মানুষের মধ্যে যে খারাপ হবার জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, অনুতাপ, বিষাদ থাকতে পারে সেটাও অসাধারণভাবে উন্মোচন করেছেন। তাই তো কামরুদ্দিন আক্ষেপ করে বলে, ‘তুই খবরের কাগজে কেন বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশের মানুষকে জানাসনি যে তুই একটা মস্তবড় বেশ্যা?’

‘অন্ত্যহীন যাত্রা’ গল্পের শেষে দেখা যায় কামরুদ্দিন শবযাত্রীদের সঙ্গী হয়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেছে। যার শেষ কোথায় তার জানা নেই। পাঠক এখানে এসে একজন খারাপ মানুষ কামরুদ্দিনের জন্য অদ্ভুত ধরনের বেদনাবোধে আক্রান্ত হবেন। তাকে ঘিরে নতুন নতুন সম্ভাবনার কথা ভাববেন। পাঠককে গল্পে আটকে রাখার মতো এমনই যাদুকরী ক্ষমতার লেখক রাহাত খান।

‘অন্তহীন যাত্রা’র মতোই ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ রাহাত খানের একটি কালজয়ী গল্প। অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষ নিজেকে কখনো অতিক্রম করতে পারে না। মানুষ যখন নিজেই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায় তখন সে সম্পর্ক, মায়ামমতা, মানবিকতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেকেই স্থান দেয়। তাই এই গল্পে আমরা অমানবিকতার চূড়ান্ত রূপ দেখি। আবার বলা যায় এটাই চরম বাস্তবিকতা, পরম সত্য। এই অতিমারি করোনাকালীন সময়ে আমরা এমন কিছু সত্যের মুখোমুখি হয়েছি। দেখেছি অসুস্থ মাকে করোনা আক্রান্ত ভেবে সন্তানেরা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছে, মৃতপ্রায় অসুস্থ পিতাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, ছটফট করে মৃত্যুবরণ করেছেন অথচ এক গ্লাস পানি পর্যন্ত এক পিতাকে/স্বামীকে খেতে দেওয়া হয়নি। এই ঘটনাগুলো যখন কোনো লেখক গল্পে প্রকাশ করবেন তখন হয়ত অতিরঞ্জিত মনে হবে। এমন এক নিষ্ঠুর সত্যের কাহিনী ‘ইমান আলীর মৃত্যু’। এই গল্পে আমরা একদিকে শাসক শ্রেণিকে বন্যাপীড়িত দরিদ্রের খাবার লুটেপুটে খেতে দেখি, অন্যদিকে সুযোগসন্ধানী শ্রেণির সুযোগের নগ্ন ব্যবহার দেখতে পাই। গাছের ডালে, পানির ওপর মাচায় থাকা উপোসী মানুষের শেষ আশ্রয়ের ভিটেটুকুও পানির দরে কিনে আরো ধনী হয়ে যায় এই শ্রেণি। সম্পর্কের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার প্রতিক ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ গল্পটি। তাই ভাই ফকীরচানের সন্তানেরা যখন নিপাট উপোস, জ্বর জারিতে একের পর মরতে থাকে তখন রহিমচান আর তার স্ত্রী একছালা চাল-আলুর বস্তার ওপর এমনভাবে শুয়ে থাকে যেনো সোনা-রুপার মতো দামী কোনো জিনিস আগলে রেখেছে। সরকারি রিলিফ অনিয়মিতভাবে কিছুদিন এসে বন্ধ হয়ে যায়। বন্যাপীড়িত ইমান আলীর পরিবারের দুঃখ দুর্দশা আমাদেরকে অসহায় করে তোলে এদেশের সিস্টেমের কাছে, দুর্নিতীবাজ কিছু মানুষের কাছে। তাইতো ফকীরচানের মৃত মেয়ে জৈতুনের লাশ যখন ভাসতে ভাসতে আবারো স্রোতের টানে চঙর নিচে ফিরে আসে ওর সদ্য ছিদ্রকরা নাকের লাল সুতো আমাদের দিকে ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, আমার পরিণতির জন্য দায়ী কে? এর জবাব লেখক রাহাত খান বা আমাদের মতো পাঠকের কাছে থাকে না। পিতা ফকীরচান বুকে জড়িয়ে মেয়ের লাশকে আবার বিলে ভাসিয়ে দিয়ে আসে। কবর দেবার ডাংগাও যে গরিবের ভাগ্যে নেই!

এই গল্পে আমরা লেখকের কুশলতায় সম্পর্কের মায়া বা নিষ্ঠুরতা দু’পিঠই অবলোকন করতে পারি। যে পিতা অসুস্থ হলে সন্তানেরা আকাশবাতাস তোলপাড় করে কাঁদতে পারে, যত্ন করে প্রিয় খাবার খাওয়ায়, অভাবের তাড়নায়, পেটের ক্ষুধায়, সেই সন্তানেরাই আবার পিতাকে রাস্তায় মুমূর্ষ অবস্থায় ফেলে খাবারেরে সন্ধানে ছুটে যায়। পিতাকে কাঁধে নিয়ে পনের কিলোমিটার হাঁটার মতো শক্তি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর তিনভাই রহিমচান, ফকীরচান, আবুচান কারো ছিল না। এতদসত্ত্বেও মুমূর্ষু পিতা ইমান আলী যখন ছোট ছেলে আবুচানের পিরান চেপে ধরে আর আবুচান ‘ভায়ু গো, ভায়ু গো মল্লাম মল্লাম’ চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যায় তখন সেই দৃশ্যের মুখোমুখি হতে আমরা ভয় পাই, নির্মম সত্যে আঁতকে উঠি।

রাহাত খানের ‘মধ্যরাতে’ গল্পটি ছোটগল্পের সাধারণ কাঠামোর বাইরে একেবারে ভিন্ন ধাঁচের একটি গল্প। আর দশটি গল্পের সাথে ঠিক মেলানো যাবে না। তাই বলে ছোটগল্পের মান এতে ক্ষুণœ হয়নি বরং বহুগুণে বেড়েছে। গল্পটি মূলত ফোনের ক্রসকানেকশনে পাওয়া দুই মধ্যবয়সী নারীপুরুষের কথপোকথন। দুজনের সংলাপের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন সম্পর্কে মোটামুটি জানা হয়ে যায়। পুরো সময় কথক এখানে অনুপস্থিত তবে গল্পের শেষে তাঁর উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই একরকম উপসংহারের আদলে। গল্পটিতে আমরা একদিকে যেমন উচ্চবিত্ত শ্রেণি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্র সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাই তেমনি নারীর স্বাধীনতা, ভালোলাগা-মন্দলাগা নিয়ে পুরুষের চিন্তাভাবনার গণ্ডি সম্পর্কেও জানতে পারি। মানুষ আদতেই একা- সেই সূত্রটির উদাহরণও হতে পারে ‘মধ্যরাতে’ গল্পটি। মানুষের মধ্যে নিজেকে গোপন রাখার প্রবণতাও কম নয়। কিন্তু দুজন অচেনা মানুষকে আমরা মধ্যরাতে একে অপরের কাছে আগল খুলে দিতে দেখি। যেটি হয়ত পরিচিত মানুষের কাছে সম্ভব নয়। তাদের আলাপের একটি পর্যায়ে পাঠকের মনে হয়েছিল নিঃসঙ্গ দুজন মানুষ হয়তবা পরস্পরের কাছে আসার একটি সুযোগ পেয়েছে, তাদের মনে দুজনের ভবিষ্যত বন্ধুত্বের সম্ভাবনাও উঁকি দেয়। কিন্তু শেষে ফোনের লাইন কেটে গিয়ে সকল সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। পাঠক হয়ত এখানে এসে কিছুটা হতাশ হয়ে ভাবতে পারেন, এ কেমন পরিণতি! কিন্তু সেই মুহূর্তে লেখক অঙ্গুলী হেলিয়ে বলে দেন, মানুষের গল্প এমনই। জীবনভর বহু রং নম্বর। লেখকের এই ভয়ানক সত্যিকে মানতে অস্বীকার করবে কে?

‘মধ্যিখানে চর’ গল্পটি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিপথগামী এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার আত্মদহনের ইতিহাস। যে সোনার দেশ গড়বার স্বপ্ন নিয়ে, সমাজকে বদলে দেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেছিল স্বাধীন বাংলায় একে একে তার বিনাশ ঘটতে থাকে। লাগামহীন দুর্নীতি, বেকার সমস্যা আর একসময়ের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘাতকেরাই যখন অর্থবিত্ত মালিক হয়ে ক্ষমতার মঞ্চে সমাসীন হয়, আতিক, মিজান, হাজারীর মতো ব্যর্থতা আর

হতাশায় নিমজ্জিত মুক্তিযোদ্ধারা তখন টাকার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। গল্পের সবুজ নিজের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়। সে ফ্রিডম ফাইটার সবুজ, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রবেশের সময়ে এক মা ছুটে গিয়ে যার কপালে চুমু খেয়ে হুহু করে কেঁদে উঠেছিলেন। তাঁর পুত্র হয়ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরতে পারেনি। সেদিন সবুজ বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু সুন্দর প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পারেনি। একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে যে হাতে পাক সেনাদেরকে মেরেছিল শুধুমাত্র দেশের জন্য, সেই সবুজেরাই চার বছর বয়সী এক কন্যা শিশুর সামনে পিতাকে মারতে দ্বিধা করেনি। ঘটনা একই, প্রেক্ষাপট শুধু ভিন্ন। আমরা দেশকে বাঁচাতে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠা যে যুবককে টুপি খোলা অভিবাদন জানাই, কিন্তু নিজের স্বার্থে একজন মানুষকে হত্যা করতে দেখলে সেই যুবকের প্রতি ঘৃণায় থুঃ থুঃ ছিটাই। কিন্তু লেখক রাহাত খানা অত্যন্ত চাতুর্যতার সাথে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন স্বপ্নহীন যুবকের পথভ্রষ্ঠ হবার জন্য সে একাই দায়ী নয়। তার জন্য দেশ, সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতিও দায়ী। তিনি সবুজের মনোলোকে ভেসে ওঠা হতাশা, গ্লানি আর না পারার ক্লান্তিকে একজন মেধাবী চিত্রকরের মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘কোনদিকে যাবেÑ মায়ের দিকে, শিউলির দিকে, ভক্সওয়াগনের দিকে, এইসব কিছুই সে জানে না। বুঝতেও পারে না।’ এই আর্তি আমাদেরকে বহুবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন করে।

এই স্বল্প পরিসরে রাহাত খানের গল্পের সামগ্রিক উপস্থাপনা আমার মতো নবিশির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তবুও আরো কিছু গল্পের কথা না বললেই নয়। তাঁর রচিত ‘চুপি চুপি বাঁশী বাজে’ গল্পে প্রাক্তন স্ত্রী সোহানার প্রতি আয়াজের ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রেমের সন্ধান পাই আমরা, অন্যদিকে ‘আমাদের বিষবৃক্ষ’ গল্পে রায়টের কারণে ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতের নীলমণিপুর থেকে উন্মূল হয়ে আসা আতাউরের পরিবারের নিদারুণ মনঃকষ্টকে অনুধাবন করি। যেমনটি পরবর্তীতে রায়টের কারণেই এদেশ থেকে উন্মূল হয়েছিল মাখনলালের পরিবার। রাহাত খান ভিন্ন সময়ে, ভিন্নভিন্ন জায়গায় বুকের ক্ষরণকে একই ক্যানভাসে দারুণভাবে এঁকেছেন এই গল্পে। তাঁর ‘উদ্বেল পিপাসা’ গল্পে একজন পীড়িত স্বামীর অসাহায়ত্ব আমাদেরকে দোলা দেয়, অথচ স্বামীকে ফেলে অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া স্ত্রীকেও ভ্রষ্ঠা বলতে কুণ্ঠাবোধ করি। কারণ এটাই সত্যের মতো স্বাভাবিক। রাহাত খানের ‘চুড়ি’ গল্পটি সমাজ এবং নারীর প্রেমের অন্য আরেকটি দিক উন্মোচিত করে। স্বল্প বেতনভুক পিওন বৈদরের সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য জৈগুনকে কিছু নারীলোভী পুরুষের মনোরঞ্জন করতে হয়। এই গল্পে রাহাত খান দেখিয়েছেন, জৈগুনের মতো স্ত্রীদের স্বামীর সাথে মিলনের সময় চুড়ির মিঠা আওয়াজ ওঠে কিন্তু যখন সে সংসারের প্রয়োজনে পরপুরুষের শয্যার সঙ্গী হয় তখন চুড়ির আওয়াজ থমকে যায়। কারণ সেখানে মহব্বত থাকে না, থাকে প্রয়োজন।

রাহাত খান চিন্তা-চেতনা এবং লেখনীতে সময়ের অগ্রবর্তী একজন নিভৃতচারী লেখক। তিনি সময়কে যে সাহসিকতার সাথে, নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন, তেমনটি খুব কমই দেখা যায়। অথচ এরজন্য কোনো বাগাড়ম্বর নেই, নেই কোনো আয়োজন। তাঁর সাহিত্য গতিময়তার এক অতুলনীয় প্রতীক। সহজ ভাষায় সরল গতিতে নিস্পৃহভাবে তিনি কল্পনাশক্তির বিস্ময়কর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, চরিত্রকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন, জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোণের ব্যাখা দিয়েছেন।

আজ রাহাত খান আমাদের মাঝে নেই কিন্তু এমন কিছু অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম তিনি রেখে গিয়েছেনÑ যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রাখবে নিশ্চিত। একজন রাহাত খান নিজেই নিজের তুলনা।