ইতিহাসের অভিষেকে বঙ্গবন্ধু

জামিরুল ইসলাম শরীফ

ইতিহাসই নেতৃত্বের স্রষ্টা। কোনো ব্যক্তজীবনকে নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার ব্যাপারে রয়েছে ইতিহাসের নিজস্ব নিয়ম, তার চিরঅক্ষয় শিক্ষা। এই নিয়ম ও শিক্ষা অনুসারে ইতিহাসের বিচিত্র-বন্ধুর পথে যিনি সার্থক অভিযাত্রী, তিনিই নন্দিত হন নেতা রূপে। ইতিহাসের অভিষেকও তারই জন্য। তাই নেতা যিনি হবেন তাকে নিত্য-নিয়তই অর্জন করতে হয় ইতিহাসের এই নিয়ম ও শিক্ষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। এই উপলব্ধি ও জ্ঞান শুধু পুঁথি-আহৃত হলেই চলে না- বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ হতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনগণের অবিসংবাদি নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠার মূলে ইতিহাসের স্বীকৃতি ও তার সত্য সন্ধানে নেমে জানতে হবে তাঁর জীবন ও কর্মধারা সম্পর্কে প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেণের। যে বিশ্লেষণ হতে হবে বিশ্ব রাজনীত, বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরাগত মুক্ত বিচারবুদ্ধির আলোকে।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সেই কিশোর তরুণের জীবনকে আবিষ্কার করতে হয় অতীতের গর্ভ থেকে। অর্থ-সম্পদের দিক দিয়ে প্রাচুর্য ছিল না। তিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পারিবারিক ঐতিহ্য অবশ্য বনেদি। সুতরাং মধ্যবিত্ত শ্রেণি-চরিত্র এবং বনেদি পরিবারের প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল সংগত ও স্বাভাবিক। কিন্তু শ্রেণি-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও বনেদিয়ানার প্রভাব থেকে মুক্তির সম্ভাবনা বয়ে আনল যুগের হাওয়া। প্রথম মহাযুদ্ধের অভিঘাতের ফলে এদেশের মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তাবোধে চির ধরতে শুরু করেছিল। তাঁর পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার উপরও এই অভিঘাতের প্রভাব পড়ে। ক্ষয়িষ্ণু-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানের পক্ষে তাই সেদিন পারিবারিক বনেদিয়ানার অবরোধ ভেঙে বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সহপাঠী, সমবয়সী বন্ধুদের সাথে দ্বিধাহীন চিত্তে মেলামেশা করা যেমন সহজ হয়েছিল, তেমনি সম্ভব হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ার কাদা-মাটির পথে বঙ্গবন্ধুর পদচারণা। বিত্তহীন ও নিম্নবিত্তদের সাথে একাত্মতার শুভ সূচনা তাঁর এই কৈশোর-তারুণ্যের প্রতিধ্বনিমুখর শিশিরসিক্ত তেপান্তরের মাঠে। যার গণ্ডি পেরিয়ে শৈশব সুখস্মৃতির সঙ্গে বৈপরীত্য, নানা অসঙ্গতিও বঞ্চনাবোধের গ্লানি তাঁর চিত্তবৃত্তিকে সচেতন করে তোলে। পরাধীনতার বেড়াজালে বাঙালির অসম্মান, অমর্যাদাকর বন্দিত্বের মধ্যেই তিনি বাঙালির অধিকার ও মুক্তির অভ্যুদয় দেখতে পান। অসহায় মানুষের কাছে নির্ভরতার উৎস ও প্রতীক হয়ে ওঠেন। একের অনুভূতি দশের কাছে, দশের অনুভূতি দেশের কাছে পৌঁছে যায়। সমগ্র ব্রিটিশ-ভারতবর্ষ জুড়ে তখন গুঞ্জরিত হচ্ছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে মুক্তির সঞ্জীবনী মন্ত্র। স্কুলে কোনো এক সরকারি অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নির্দেশের প্রতি স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানানোর মধ্যদিয়েই শুরু হলো পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর এক সংগ্রামী জীবনের এবং বাঙালির আপন সত্তাকে স্থায়ী করবার দুরাশা লালনের মধ্য দিয়ে। তাঁর বাঙ্ময় প্রতিবাদ-লৌকিক ভাষা অসামান্যের সার্বজনীন সঙ্গমে পৌঁছে যায় এমন এক স্তরে- যা পরবর্তীকালে ধরা পড়েছিল আর একজন নায়কের চোখে, তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল জীবনের পর কলকাতায় ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে প্রৌঢ়ত্বের সূচনা পর্যন্ত ছাত্রনেতা, যুবনেতা এবং রাজনৈতিক নেতা রূপে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী রেখেছিলেন এক অক্ষয় প্রভাব। সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর এই সম্পর্ক সৃষ্টির মূলে ছিল রাজনৈতিক চেতনা ও কর্মধারায় নিয়মতান্ত্রিক বিদ্রোহের প্রতি সংহতি গুণ। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারের সন্তান সোহরাওয়ার্দীর দেশে-বিদেশে অভিজাত পরিমণ্ডলে ছিল অবাধ যোগাযোগ ও যাতায়াত। কিন্তু আভিজাত্যের উত্তরাধিকার ও প্রভাব সত্ত্বেও আপামর গণমানুষের সাথে একাত্মতার আকর্ষণ অনুভব করতেন এবং এই আকর্ষণের কারণেই আভিজাত্যের আগল ভেঙে তিনিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষের কাতারে, একাত্মতার অনন্য চেতনায় হতে পেরেছিলেন তাদের সব সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার সাথি। ব্যক্তি জীবনে এই বিদ্রোহী সত্তার কারণেই সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল তরুণ মুজিবের ভিতরে এক মহৎ তেজস্বী বিদ্রোহী ও সংগ্রামী সত্তাকে আবিষ্কার করা, চেতনা ও বিশ্বাসের দিক দিয়েও এই দুই নেতার জীবন ও কর্মধারা ছিল অভিন্ন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে স্বাধীনতার দাবিতে রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল প্রধানত দুটি ধারার। নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের ‘অখণ্ড ভারত’ এবং মুসলিম লীগের ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্য দিয়েই এই দুই ধারার পরিচয় মূর্ত হয়েছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব উভয়ই মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন সত্য, তাঁরা উভয়ই বিশ্বাস করতেন নিঃসংশয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী আর একটি সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতেন- এ স্বপ্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার এবং এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যাকে সর্বোত্তম বিশ্বাসী সাথি হিসেবে পেয়েছিলে, তিনিই শেখ মুজিব। আমাদের বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন- সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। তাঁর সব সংগ্রামী কর্মধারাই ছিল আপামর গণমানুষকে সাথে নিয়ে সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনা, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক

চিরআপোসহীন সৈনিক। ব্রিটিশ শাসনামলে কৈশোরে একদিন স্কুলে সরকারি অনুষ্ঠান পালনে অস্বীকৃতির মাধ্যমে যে বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটেছিল, সেই বিদ্রোহী চেতনাই পরবর্তী সময়ে তাঁকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে নিত্য-সংগ্রামী রূপে গড়েছিল। ব্রিটিশ শাসন অবসানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ল তখন সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব। এক ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ক্ষণ-মুক্তির পর আরেক নতুন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য তখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে বাঙালিরা। জননেতা মওলানা ভাসানী তখন এদেশে শুরু করেছিলেন অধিকার আদায়ের এক দুর্বার গণসংগ্রাম। সে সময় তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিব ছিলেন মওলানা ভাসানীর পাশে বিশ্বস্ততম সংগ্রামী সাথী রূপে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিছুদিন পর ভারত থেকে এসে অংশগ্রহণ করলেন এই গণসংগ্রামে। সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-মুজিবের এই সমাবেশের শক্তি প্রচ থেকে প্রচ তর হলো আরেক মহানায়কের অংশগ্রহণে- তিনি শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক। মহান নেতৃবৃন্দের ঐক্যের যোগফলে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম লাভ করল এক অনিরুদ্ধ জঙ্গমতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক চক্রের স্বার্থরক্ষাকারী মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটিয়ে বাঙালিরা স্বাধীকারের স্বপক্ষে তাদের রায় ঘোষণা করল। ’৫৪ সালের নির্বাচনে এই বিজয়ের পর থেকে অবশ্য বাংলার মাটিতে ঘটেছে অনেক ঘটনা। পর্দার অন্তরালে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং গণতন্ত্র বিরোধী শক্তির পুনরায় ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে অনেক আপোষধর্মী পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। রাজনীতি ও গণমানুষের সাথে অবিচ্ছেদ্য নাড়ির সম্পর্ক-বন্ধনে ও একাত্মতা তাঁকে পথ দেখিয়েছিল সংগ্রাম ও মুক্তির পথে সঠিক ও নির্ভীক অভিযাত্রায়। সংগ্রামের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে করেছিল ইতিহাস সচেতন। এই সচেতনতাই তাঁর মানসে দিকনির্দেশকের মতো কাজ করেছে কখন কীভাবে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে, কোনটি সঠিক ও কার্যকরী। ইতিহাসের নিয়ম ও শিক্ষা মেনে পর্যায়ক্রমে তিনি অগ্রসর হয়েছেন দুর্গম পথে। এ পথযাত্রায় ভাবপ্রবণতা অথবা হটকারিতা কখনও তাঁকে যেমন বিভ্রান্ত করতে পারেনি, তেমনি পারেনি কোনো সুবিধাবাদ তাঁকে বিন্দুমাত্র প্রলুব্ধ করতে। ইতিহাসের সঠিক মুহূর্ত বিচার করেই তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর বাঙালির স্বাধীকারের সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই ৬ দফা ঘোষণায় হয়েছিল ক্ষীপ্ত। ‘অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার’ করার হুমকি থেকে শুরু করে শেখ মুজিবকে কারাগারের অন্ধ অলিন্দে তারা নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন অকুতোভয়। জেল জীবন আর অত্যাচার-নির্যাতনের বহু দুঃসহ অভিজ্ঞতাই ছিল তাঁর জীবনে। জেলের ভিতরে থেকেই তিনি পরিচালনা করতে লাগলেন বাঙালির স্বাধীকারের এই সংগ্রাম। আগরতলা মামলায় তাঁকে প্রধান আসামী করা হলো। কিন্তু তিনি দমলেন না, বরং আস্থা রাখলেন দেশবাসীর ওপর, তদের সংহতির ওপর। তাঁর এই আস্থা অমূলক ছিল না। পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচারী কার্যক্রম ও শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হলো ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থানের প্রচণ্ড অভিঘাতে শাসকচক্রের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবার উপক্রম হলো। কারাগারের আগল খুলে গেল, বেরিয়ে এলেন শেখ মুজিব জনগণের অবিসংবাদী মহানায়ক রূপে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক এবং বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য তার স্বরূপকে অন্তরে উপলব্ধি ও ধারণ করে বাঙালির জীবনসৌধের আনাচে-কানাচে তার পরাধীনতার অন্ধকার মহলে তিনি স্থায়ী প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলেন। সমগ্র জাতি তাঁকে অভিষিক্ত করল ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা যত দ্রুততায় সাড়া দিয়েছি, তাঁর আদেশ-নির্দেশেও সে পরিমাণে ক্ষিপ্রতা দেখিয়েছি। তাই শুধু নাম নয়, সম্বোধন নয়, শেখ মুজিব কীভাবে পরিণত হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’তে সেটিই ইতিহাস। এদিকে পাকিস্তানি শাসকচক্রও উপায়ন্তর না দেখে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ লাভ করল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয়। এবং এই বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রমাণ করে দিলেন স্বাধীকার ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ রায়। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের এই রায়কে মেনে নিতে অস্বীকার করল। তারা স্পষ্টতই জানত ৬ দফাকে মেনে নেওয়ার তখন অর্থই হচ্ছে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। আমাদের জাতীয় জীবনে তখন আরেক ক্রান্তিলগ্ন। স্বাধীনতা আর মুক্তির আকক্সক্ষায় ব্যগ্র ও উন্মুখ তখন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। ৬ দফার স্বপক্ষে গণরায় মেনে নিতে শাসকচক্রের কূটবুদ্ধির ধূর্ততা আর অনীহা লক্ষ্য করে তখন অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে একতরফা ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ শুনবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস সচেতন বঙ্গবন্ধু সেদিন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তো বঙ্গবন্ধুরই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। তাঁর সব সংগ্রামের লক্ষ্যও ছিল এই স্বাধীনতা। সে কেবল ঘোষণার দ্বারা আসে না, ত্যাগ ও মহিমার দ্বারাই তাকে অর্জন করতে হয়। ছিনিয়ে আনতে হয় কখনও তা সাংঘাতিক সংঘাতের পরিক্রমার মধ্য দিয়ে। সেজন্য প্রয়োজন সংগ্রামের উপযুক্ত সাংগঠনিক শক্তির, লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতির। সেইসঙ্গে বিশ্ববাসীর সামনে স্বাধীনতা, যৌক্তিকতা প্রমাণেরও প্রয়োজন রয়েছে। এসব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু তাই তাৎক্ষণিক স্বাধীনতা ঘোষণার মতো হঠকারিতার পথে না গিয়ে ’৭১-এর ৩ মার্চ পাকিস্তানি শাসকচক্রের সাথে অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করলেন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসভায় গোটা দেশবাসীর কাছে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম সূচনার ঘোষণা দিয়ে ‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বান জানালেন এবং ২৫ মার্চের পর নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের সাংঘাতিক সংঘাত, মৃত্যু আর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকার ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাসে ঘটেনি। আর যিনি সুদীর্ঘকাল সংগ্রাম, জেল-জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন সয়ে জাতির দুঃখের তপস্যার মধ্য দিয়ে সমস্ত দেশকে যথার্থভাবে, গভীরভাবে আপন করে নিয়েছেন, তিনি যেন আমাদের সকলের হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুব্রত গ্রহণ করলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর কারাপ্রকোষ্ঠের অনতিদূরে কবর খোড়া হলো তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু কার্যকর করে কবরস্থ করার জন্য। কিন্তু জ্যোতিষ্কের মতো তেজ, অপ্রতিদ্বন্দ্বি রাজনৈতিক আর নিপাট মনুষ্যত্বে তাঁর সমকক্ষ পৃথিবীর আর কোথাও জন্মায়নি- এই বিশিষ্টতার সংহতিগুণের জন্যেই তাঁকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই বাঙালি জাতির জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে কেটেছে বঙ্গবন্ধুর।

তাই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এবং বাঙালির চির ইতিহাসের আদ্যন্তে ফুটে আছে একটি নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামগ্রিক জীবন নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। সে ইতিহাস আপামর গণমানুষকে নিয়ে। গণমানুষের সংহতি ও অকৃত্রিম ভালোবাসাই ছিল তাঁর সংগ্রামী অভিযাত্রার একমাত্র শক্তি এবং এ অভিযাত্রায় তিনি সবসময়ই ইতিহাসের শিক্ষাকে পথ প্রদর্শিকা রূপে গ্রহণ করেছেন। পথ চলায় বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতির দুর্ভাগ্য তাই ঘটেনি তাঁর জীবনে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাড়ে ৭ কোটি গণ-মানুষের অবিসংবাদী নেতারূপে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠা তো ইতিহাসেরই স্বীকৃতি। স্বয়ং ইতিহাসই তাঁকে এই মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেছে। যদিও ’৭৫-এর বীভৎসের তাণ্ডব, নিকৃষ্ট নৃশংসের সদর্প সংকলনে চির বেদনায় ধূসর করেছে আমাদের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি। ’৭১-এর পরাজিত দুর্বৃত্তের হাতের প্রসারিত থাবা রক্তাক্ত করেছে স্বাধীন ফলবান বৃক্ষের পুষ্পশোভিত শাখা। কিন্তু বিধির বিধানে সত্য চিরকাল স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। সেই সত্যের প্রতিভূ বঙ্গবন্ধুরই যোগ্য উত্তরাধিকারী জনচিত্তজয়ী দেবদূত কন্যা শেখ হাসিনা।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

ইতিহাসের অভিষেকে বঙ্গবন্ধু

জামিরুল ইসলাম শরীফ

image

ইতিহাসই নেতৃত্বের স্রষ্টা। কোনো ব্যক্তজীবনকে নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার ব্যাপারে রয়েছে ইতিহাসের নিজস্ব নিয়ম, তার চিরঅক্ষয় শিক্ষা। এই নিয়ম ও শিক্ষা অনুসারে ইতিহাসের বিচিত্র-বন্ধুর পথে যিনি সার্থক অভিযাত্রী, তিনিই নন্দিত হন নেতা রূপে। ইতিহাসের অভিষেকও তারই জন্য। তাই নেতা যিনি হবেন তাকে নিত্য-নিয়তই অর্জন করতে হয় ইতিহাসের এই নিয়ম ও শিক্ষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। এই উপলব্ধি ও জ্ঞান শুধু পুঁথি-আহৃত হলেই চলে না- বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ হতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনগণের অবিসংবাদি নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠার মূলে ইতিহাসের স্বীকৃতি ও তার সত্য সন্ধানে নেমে জানতে হবে তাঁর জীবন ও কর্মধারা সম্পর্কে প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেণের। যে বিশ্লেষণ হতে হবে বিশ্ব রাজনীত, বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরাগত মুক্ত বিচারবুদ্ধির আলোকে।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সেই কিশোর তরুণের জীবনকে আবিষ্কার করতে হয় অতীতের গর্ভ থেকে। অর্থ-সম্পদের দিক দিয়ে প্রাচুর্য ছিল না। তিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পারিবারিক ঐতিহ্য অবশ্য বনেদি। সুতরাং মধ্যবিত্ত শ্রেণি-চরিত্র এবং বনেদি পরিবারের প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল সংগত ও স্বাভাবিক। কিন্তু শ্রেণি-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও বনেদিয়ানার প্রভাব থেকে মুক্তির সম্ভাবনা বয়ে আনল যুগের হাওয়া। প্রথম মহাযুদ্ধের অভিঘাতের ফলে এদেশের মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তাবোধে চির ধরতে শুরু করেছিল। তাঁর পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার উপরও এই অভিঘাতের প্রভাব পড়ে। ক্ষয়িষ্ণু-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানের পক্ষে তাই সেদিন পারিবারিক বনেদিয়ানার অবরোধ ভেঙে বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সহপাঠী, সমবয়সী বন্ধুদের সাথে দ্বিধাহীন চিত্তে মেলামেশা করা যেমন সহজ হয়েছিল, তেমনি সম্ভব হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ার কাদা-মাটির পথে বঙ্গবন্ধুর পদচারণা। বিত্তহীন ও নিম্নবিত্তদের সাথে একাত্মতার শুভ সূচনা তাঁর এই কৈশোর-তারুণ্যের প্রতিধ্বনিমুখর শিশিরসিক্ত তেপান্তরের মাঠে। যার গণ্ডি পেরিয়ে শৈশব সুখস্মৃতির সঙ্গে বৈপরীত্য, নানা অসঙ্গতিও বঞ্চনাবোধের গ্লানি তাঁর চিত্তবৃত্তিকে সচেতন করে তোলে। পরাধীনতার বেড়াজালে বাঙালির অসম্মান, অমর্যাদাকর বন্দিত্বের মধ্যেই তিনি বাঙালির অধিকার ও মুক্তির অভ্যুদয় দেখতে পান। অসহায় মানুষের কাছে নির্ভরতার উৎস ও প্রতীক হয়ে ওঠেন। একের অনুভূতি দশের কাছে, দশের অনুভূতি দেশের কাছে পৌঁছে যায়। সমগ্র ব্রিটিশ-ভারতবর্ষ জুড়ে তখন গুঞ্জরিত হচ্ছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে মুক্তির সঞ্জীবনী মন্ত্র। স্কুলে কোনো এক সরকারি অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নির্দেশের প্রতি স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানানোর মধ্যদিয়েই শুরু হলো পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর এক সংগ্রামী জীবনের এবং বাঙালির আপন সত্তাকে স্থায়ী করবার দুরাশা লালনের মধ্য দিয়ে। তাঁর বাঙ্ময় প্রতিবাদ-লৌকিক ভাষা অসামান্যের সার্বজনীন সঙ্গমে পৌঁছে যায় এমন এক স্তরে- যা পরবর্তীকালে ধরা পড়েছিল আর একজন নায়কের চোখে, তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল জীবনের পর কলকাতায় ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে প্রৌঢ়ত্বের সূচনা পর্যন্ত ছাত্রনেতা, যুবনেতা এবং রাজনৈতিক নেতা রূপে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী রেখেছিলেন এক অক্ষয় প্রভাব। সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর এই সম্পর্ক সৃষ্টির মূলে ছিল রাজনৈতিক চেতনা ও কর্মধারায় নিয়মতান্ত্রিক বিদ্রোহের প্রতি সংহতি গুণ। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারের সন্তান সোহরাওয়ার্দীর দেশে-বিদেশে অভিজাত পরিমণ্ডলে ছিল অবাধ যোগাযোগ ও যাতায়াত। কিন্তু আভিজাত্যের উত্তরাধিকার ও প্রভাব সত্ত্বেও আপামর গণমানুষের সাথে একাত্মতার আকর্ষণ অনুভব করতেন এবং এই আকর্ষণের কারণেই আভিজাত্যের আগল ভেঙে তিনিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষের কাতারে, একাত্মতার অনন্য চেতনায় হতে পেরেছিলেন তাদের সব সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার সাথি। ব্যক্তি জীবনে এই বিদ্রোহী সত্তার কারণেই সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল তরুণ মুজিবের ভিতরে এক মহৎ তেজস্বী বিদ্রোহী ও সংগ্রামী সত্তাকে আবিষ্কার করা, চেতনা ও বিশ্বাসের দিক দিয়েও এই দুই নেতার জীবন ও কর্মধারা ছিল অভিন্ন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে স্বাধীনতার দাবিতে রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল প্রধানত দুটি ধারার। নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের ‘অখণ্ড ভারত’ এবং মুসলিম লীগের ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্য দিয়েই এই দুই ধারার পরিচয় মূর্ত হয়েছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব উভয়ই মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন সত্য, তাঁরা উভয়ই বিশ্বাস করতেন নিঃসংশয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী আর একটি সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতেন- এ স্বপ্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার এবং এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যাকে সর্বোত্তম বিশ্বাসী সাথি হিসেবে পেয়েছিলে, তিনিই শেখ মুজিব। আমাদের বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন- সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। তাঁর সব সংগ্রামী কর্মধারাই ছিল আপামর গণমানুষকে সাথে নিয়ে সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনা, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক

চিরআপোসহীন সৈনিক। ব্রিটিশ শাসনামলে কৈশোরে একদিন স্কুলে সরকারি অনুষ্ঠান পালনে অস্বীকৃতির মাধ্যমে যে বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটেছিল, সেই বিদ্রোহী চেতনাই পরবর্তী সময়ে তাঁকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে নিত্য-সংগ্রামী রূপে গড়েছিল। ব্রিটিশ শাসন অবসানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ল তখন সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব। এক ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ক্ষণ-মুক্তির পর আরেক নতুন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য তখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে বাঙালিরা। জননেতা মওলানা ভাসানী তখন এদেশে শুরু করেছিলেন অধিকার আদায়ের এক দুর্বার গণসংগ্রাম। সে সময় তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিব ছিলেন মওলানা ভাসানীর পাশে বিশ্বস্ততম সংগ্রামী সাথী রূপে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিছুদিন পর ভারত থেকে এসে অংশগ্রহণ করলেন এই গণসংগ্রামে। সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-মুজিবের এই সমাবেশের শক্তি প্রচ থেকে প্রচ তর হলো আরেক মহানায়কের অংশগ্রহণে- তিনি শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক। মহান নেতৃবৃন্দের ঐক্যের যোগফলে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম লাভ করল এক অনিরুদ্ধ জঙ্গমতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক চক্রের স্বার্থরক্ষাকারী মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটিয়ে বাঙালিরা স্বাধীকারের স্বপক্ষে তাদের রায় ঘোষণা করল। ’৫৪ সালের নির্বাচনে এই বিজয়ের পর থেকে অবশ্য বাংলার মাটিতে ঘটেছে অনেক ঘটনা। পর্দার অন্তরালে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং গণতন্ত্র বিরোধী শক্তির পুনরায় ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে অনেক আপোষধর্মী পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। রাজনীতি ও গণমানুষের সাথে অবিচ্ছেদ্য নাড়ির সম্পর্ক-বন্ধনে ও একাত্মতা তাঁকে পথ দেখিয়েছিল সংগ্রাম ও মুক্তির পথে সঠিক ও নির্ভীক অভিযাত্রায়। সংগ্রামের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে করেছিল ইতিহাস সচেতন। এই সচেতনতাই তাঁর মানসে দিকনির্দেশকের মতো কাজ করেছে কখন কীভাবে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে, কোনটি সঠিক ও কার্যকরী। ইতিহাসের নিয়ম ও শিক্ষা মেনে পর্যায়ক্রমে তিনি অগ্রসর হয়েছেন দুর্গম পথে। এ পথযাত্রায় ভাবপ্রবণতা অথবা হটকারিতা কখনও তাঁকে যেমন বিভ্রান্ত করতে পারেনি, তেমনি পারেনি কোনো সুবিধাবাদ তাঁকে বিন্দুমাত্র প্রলুব্ধ করতে। ইতিহাসের সঠিক মুহূর্ত বিচার করেই তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর বাঙালির স্বাধীকারের সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই ৬ দফা ঘোষণায় হয়েছিল ক্ষীপ্ত। ‘অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার’ করার হুমকি থেকে শুরু করে শেখ মুজিবকে কারাগারের অন্ধ অলিন্দে তারা নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন অকুতোভয়। জেল জীবন আর অত্যাচার-নির্যাতনের বহু দুঃসহ অভিজ্ঞতাই ছিল তাঁর জীবনে। জেলের ভিতরে থেকেই তিনি পরিচালনা করতে লাগলেন বাঙালির স্বাধীকারের এই সংগ্রাম। আগরতলা মামলায় তাঁকে প্রধান আসামী করা হলো। কিন্তু তিনি দমলেন না, বরং আস্থা রাখলেন দেশবাসীর ওপর, তদের সংহতির ওপর। তাঁর এই আস্থা অমূলক ছিল না। পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচারী কার্যক্রম ও শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হলো ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থানের প্রচণ্ড অভিঘাতে শাসকচক্রের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবার উপক্রম হলো। কারাগারের আগল খুলে গেল, বেরিয়ে এলেন শেখ মুজিব জনগণের অবিসংবাদী মহানায়ক রূপে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক এবং বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য তার স্বরূপকে অন্তরে উপলব্ধি ও ধারণ করে বাঙালির জীবনসৌধের আনাচে-কানাচে তার পরাধীনতার অন্ধকার মহলে তিনি স্থায়ী প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলেন। সমগ্র জাতি তাঁকে অভিষিক্ত করল ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা যত দ্রুততায় সাড়া দিয়েছি, তাঁর আদেশ-নির্দেশেও সে পরিমাণে ক্ষিপ্রতা দেখিয়েছি। তাই শুধু নাম নয়, সম্বোধন নয়, শেখ মুজিব কীভাবে পরিণত হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’তে সেটিই ইতিহাস। এদিকে পাকিস্তানি শাসকচক্রও উপায়ন্তর না দেখে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ লাভ করল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয়। এবং এই বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রমাণ করে দিলেন স্বাধীকার ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ রায়। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের এই রায়কে মেনে নিতে অস্বীকার করল। তারা স্পষ্টতই জানত ৬ দফাকে মেনে নেওয়ার তখন অর্থই হচ্ছে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। আমাদের জাতীয় জীবনে তখন আরেক ক্রান্তিলগ্ন। স্বাধীনতা আর মুক্তির আকক্সক্ষায় ব্যগ্র ও উন্মুখ তখন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। ৬ দফার স্বপক্ষে গণরায় মেনে নিতে শাসকচক্রের কূটবুদ্ধির ধূর্ততা আর অনীহা লক্ষ্য করে তখন অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে একতরফা ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ শুনবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস সচেতন বঙ্গবন্ধু সেদিন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তো বঙ্গবন্ধুরই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। তাঁর সব সংগ্রামের লক্ষ্যও ছিল এই স্বাধীনতা। সে কেবল ঘোষণার দ্বারা আসে না, ত্যাগ ও মহিমার দ্বারাই তাকে অর্জন করতে হয়। ছিনিয়ে আনতে হয় কখনও তা সাংঘাতিক সংঘাতের পরিক্রমার মধ্য দিয়ে। সেজন্য প্রয়োজন সংগ্রামের উপযুক্ত সাংগঠনিক শক্তির, লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতির। সেইসঙ্গে বিশ্ববাসীর সামনে স্বাধীনতা, যৌক্তিকতা প্রমাণেরও প্রয়োজন রয়েছে। এসব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু তাই তাৎক্ষণিক স্বাধীনতা ঘোষণার মতো হঠকারিতার পথে না গিয়ে ’৭১-এর ৩ মার্চ পাকিস্তানি শাসকচক্রের সাথে অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করলেন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসভায় গোটা দেশবাসীর কাছে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম সূচনার ঘোষণা দিয়ে ‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বান জানালেন এবং ২৫ মার্চের পর নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের সাংঘাতিক সংঘাত, মৃত্যু আর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকার ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাসে ঘটেনি। আর যিনি সুদীর্ঘকাল সংগ্রাম, জেল-জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন সয়ে জাতির দুঃখের তপস্যার মধ্য দিয়ে সমস্ত দেশকে যথার্থভাবে, গভীরভাবে আপন করে নিয়েছেন, তিনি যেন আমাদের সকলের হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুব্রত গ্রহণ করলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর কারাপ্রকোষ্ঠের অনতিদূরে কবর খোড়া হলো তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু কার্যকর করে কবরস্থ করার জন্য। কিন্তু জ্যোতিষ্কের মতো তেজ, অপ্রতিদ্বন্দ্বি রাজনৈতিক আর নিপাট মনুষ্যত্বে তাঁর সমকক্ষ পৃথিবীর আর কোথাও জন্মায়নি- এই বিশিষ্টতার সংহতিগুণের জন্যেই তাঁকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই বাঙালি জাতির জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে কেটেছে বঙ্গবন্ধুর।

তাই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এবং বাঙালির চির ইতিহাসের আদ্যন্তে ফুটে আছে একটি নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামগ্রিক জীবন নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। সে ইতিহাস আপামর গণমানুষকে নিয়ে। গণমানুষের সংহতি ও অকৃত্রিম ভালোবাসাই ছিল তাঁর সংগ্রামী অভিযাত্রার একমাত্র শক্তি এবং এ অভিযাত্রায় তিনি সবসময়ই ইতিহাসের শিক্ষাকে পথ প্রদর্শিকা রূপে গ্রহণ করেছেন। পথ চলায় বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতির দুর্ভাগ্য তাই ঘটেনি তাঁর জীবনে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাড়ে ৭ কোটি গণ-মানুষের অবিসংবাদী নেতারূপে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠা তো ইতিহাসেরই স্বীকৃতি। স্বয়ং ইতিহাসই তাঁকে এই মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেছে। যদিও ’৭৫-এর বীভৎসের তাণ্ডব, নিকৃষ্ট নৃশংসের সদর্প সংকলনে চির বেদনায় ধূসর করেছে আমাদের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি। ’৭১-এর পরাজিত দুর্বৃত্তের হাতের প্রসারিত থাবা রক্তাক্ত করেছে স্বাধীন ফলবান বৃক্ষের পুষ্পশোভিত শাখা। কিন্তু বিধির বিধানে সত্য চিরকাল স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। সেই সত্যের প্রতিভূ বঙ্গবন্ধুরই যোগ্য উত্তরাধিকারী জনচিত্তজয়ী দেবদূত কন্যা শেখ হাসিনা।