‘করমজলের নাইয়া’

একটি মাটিগন্ধা কাব্য

কুশল ভৌমিক

সাহিত্য সুচিত্রক, সাহিত্য তিলোত্তমা সাহিত্যের সুবৃহৎ নন্দনকাননে একটি বাসন্তি ফুলের নাম কবিতা। আমরা জানি গ্রিক শব্দ পোয়েইন থেকে পোয়েট্রি শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ সৃষ্টি করা। অর্থাৎ একজন কবিকে সংবেদনশীল মনের অধিকারী হয়ে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞানকে creative faculty বা সৃষ্টিশীল অনুষদের সাথে সার্থক বিক্রিয়া ঘটিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাব্যপথ সৃষ্টি করতে হয়। কিন্তু সবাই এই পথ সৃষ্টি করতে পারেন না; কেউ কেউ পারেন। আর পারেন না বলেই জীবনানন্দ দাশ বলে গিয়েছেন “সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি”। এই কাব্য ভাষা ও কাব্য পথ তৈরি করার জন্য একজন কবিকে সাধনা করতে হয়, নিরন্তর অনুশীলন করতে হয়। কবি মাহফুজ রিপনের “করমজলের নাইয়া” পাঠ করতে গিয়ে এ কথাগুলোই বার বার মনের কোণে উঁকি দিয়েছে।

মাহফুজ রিপন মাটিগন্ধা কবি। শস্য-শ্যামল পল্লীবাংলার অবারিত মাঠ-ঘাট, রুপালি নদী, নিঃসীম বিস্তারে মিশে থাকা পল্লীবাংলার অপরূপ প্রকৃতি আর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সহজ সরল জীবনের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, মিলন, বিচ্ছেদ তার কবিতার মুখ্য উপাদান। তার কবিতা তাই শেকড় সন্ধানী। লোকায়ত উপাদান তার কাব্যিক বুননে হয়ে চিরায়ত বা শাশ^ত। কবি হিসাবে মাহফুজ রিপনের এখানেই সার্থকতা।

‘করমজলের নাইয়া’ কাব্যগ্রন্থটিতে মোট চল্লিশটি কবিতা রয়েছে এবং চারটি পর্বে বিভক্ত। সাঁই পর্ব, প্রেম পর্ব , জল পর্ব, দ্রোহ পর্ব। প্রতিটি পর্বেই স্বাদ ও বুননের ভিন্নতা রয়েছে। সাঁই পর্বের কবিতাগুলো সুফিবাদী চেতনা সমৃদ্ধ যেখানে বাউল মনে প্রকৃতি ও সারল্যের কীর্তনে বিভোর। সাঁই এর চরণে আত্মসমর্পণ করে কবি লাভ করেন পরমানন্দ।

‘ফিলিপ নগর থেকে ছুটে আসা বাঘাইড় ধরা পরে পাথর ঘাটায়

সাঁই তুমি না থাকলে সুগন্ধী টোপেও মাছেরা আসে না বড়শিতলায়।

(তেরশত নদীর দোহাই, সাঁই পর্ব, পৃষ্ঠা-৯)

একই কবিতায় রয়েছে-

‘গুরুবার পাতালপুরে মাছেদের জলসা- তারা তেরশত নদীর নামকীর্তন করে;’

আধ্যাত্মিক চেতনার নিগূঢ স্পন্দন কবি অনুভব করেন কবিতার পরতে পরতে। তাই তো তিনি আবিষ্কার করেন জগদীশ্বর পরান সাঁই অন্তর্গত রক্তের ভেতর।

‘এক দৌড়ে চলে যাই পাহাড় থেকে পাহাড়ে

কাছে গেলে কেউ নাই সব যেন হাওয়াই মিঠাই

শুধু একলা আসনে বসে আছেন পরান সাঁই।’

(মনীষার মন্দিরা, সাঁই পর্ব, পৃষ্ঠা-১০)

কেবল আধ্যাত্মিক চেতনামণ্ডিত বিন্যাস নয় কবির মনোজগত প্রেমের মঞ্জিল। রোমান্টিক দ্যোতনা তাই কবির সৃষ্টির মহুয়া-

‘শিরশির বইছে মধ্যরাতের পুবালি বাতাস

প্রেম দাও ভুলে যাই মৃত্যপুরের দাগ খতিয়ান।’

(মধু মরণ, প্রেম পর্ব, পৃষ্ঠা-২৩)

এ যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে W.H. Auden এর অমর পঙক্তি “We must love each other or die” মাহফুজ রিপনের কবিতায় অন্তমূলে পাওয়া যায় মাটির গন্ধ, জীবনের গন্ধ আর প্রবাহমান নদীর গন্ধ-

‘ইঁচা আর তিতপুঁটির ঝাঁক ঘন হয় হাঁটু জলে

কলকাদার ভেতর থেকে নিরালে যায় ফলি

মাছেদের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে বহুকাল ধরে

তারা নদী ও নদের মিলন চায় জলতৃষ্ণায়’

(নদী ও নদের গল্প, জলপর্ব, পৃষ্ঠা- ২৯)

মাহফুজ রিপন beast fable technicque ব্যবহার করেছেন বেশ সাবলীলভাবে। মাছেদের সঙ্গোপন আলাপচারিতা আর জলের ধর্মে তাই ফুটে ওঠে আমাদের যাপিত জীবন-

‘ধরা পড়লেই সব সাধু চোর হয়ে যায়;

সারাদিন ঘের মালিক টাকি মাছের গীবত করে।

কালা পানিতে মাছেরা লাফায় তারা গীবতের অর্থ বোঝে না।’

(করমজল, জল পর্ব, পৃষ্ঠা-৩৩)

করমজলের নাইয়া গ্রন্থের শেষ পর্বটি দ্রোহের। এখানে কবির মধ্যে মার্কসবাদের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি সাম্য এবং মৈত্রীর এক পৃথিবী বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন, মানসে লালন করেন শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন।

‘নির্বাচন ঘনায় ভোটের মাঠে জিন্দাবাদ আর মূর্দাবাদ চলছে

আমার টাকশাল নেই, প্রতিভা নেই; তাই কোনো মার্কাও নেই’

(আমার কোনো প্রতিভা নেই, দ্রোহ পর্ব, পৃষ্ঠা-৪৭)

কবি কোন গণ্ডিবদ্ধ হতে পারেন না, তিনি মূলত পক্ষ ও বিপক্ষের প্রতিপক্ষ। কবির কোনো মার্কা নেই মানুষের ভালোবাসা ছাড়া।

এই মাটিগন্ধা কবির কাব্য পাঠে তৃপ্ত হয়েছি। কবির জন্য ভালোবাসা রইলো।

করমজলের নাইয়া ॥ মাহফুজ রিপন ॥ প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত ॥ মূল্য: ১৫০ টাকা ॥ বেহুলাবাংলা প্রকাশনী ॥ প্রকাশকাল: ২০২০।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

‘করমজলের নাইয়া’

একটি মাটিগন্ধা কাব্য

কুশল ভৌমিক

image

সাহিত্য সুচিত্রক, সাহিত্য তিলোত্তমা সাহিত্যের সুবৃহৎ নন্দনকাননে একটি বাসন্তি ফুলের নাম কবিতা। আমরা জানি গ্রিক শব্দ পোয়েইন থেকে পোয়েট্রি শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ সৃষ্টি করা। অর্থাৎ একজন কবিকে সংবেদনশীল মনের অধিকারী হয়ে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞানকে creative faculty বা সৃষ্টিশীল অনুষদের সাথে সার্থক বিক্রিয়া ঘটিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাব্যপথ সৃষ্টি করতে হয়। কিন্তু সবাই এই পথ সৃষ্টি করতে পারেন না; কেউ কেউ পারেন। আর পারেন না বলেই জীবনানন্দ দাশ বলে গিয়েছেন “সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি”। এই কাব্য ভাষা ও কাব্য পথ তৈরি করার জন্য একজন কবিকে সাধনা করতে হয়, নিরন্তর অনুশীলন করতে হয়। কবি মাহফুজ রিপনের “করমজলের নাইয়া” পাঠ করতে গিয়ে এ কথাগুলোই বার বার মনের কোণে উঁকি দিয়েছে।

মাহফুজ রিপন মাটিগন্ধা কবি। শস্য-শ্যামল পল্লীবাংলার অবারিত মাঠ-ঘাট, রুপালি নদী, নিঃসীম বিস্তারে মিশে থাকা পল্লীবাংলার অপরূপ প্রকৃতি আর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সহজ সরল জীবনের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, মিলন, বিচ্ছেদ তার কবিতার মুখ্য উপাদান। তার কবিতা তাই শেকড় সন্ধানী। লোকায়ত উপাদান তার কাব্যিক বুননে হয়ে চিরায়ত বা শাশ^ত। কবি হিসাবে মাহফুজ রিপনের এখানেই সার্থকতা।

‘করমজলের নাইয়া’ কাব্যগ্রন্থটিতে মোট চল্লিশটি কবিতা রয়েছে এবং চারটি পর্বে বিভক্ত। সাঁই পর্ব, প্রেম পর্ব , জল পর্ব, দ্রোহ পর্ব। প্রতিটি পর্বেই স্বাদ ও বুননের ভিন্নতা রয়েছে। সাঁই পর্বের কবিতাগুলো সুফিবাদী চেতনা সমৃদ্ধ যেখানে বাউল মনে প্রকৃতি ও সারল্যের কীর্তনে বিভোর। সাঁই এর চরণে আত্মসমর্পণ করে কবি লাভ করেন পরমানন্দ।

‘ফিলিপ নগর থেকে ছুটে আসা বাঘাইড় ধরা পরে পাথর ঘাটায়

সাঁই তুমি না থাকলে সুগন্ধী টোপেও মাছেরা আসে না বড়শিতলায়।

(তেরশত নদীর দোহাই, সাঁই পর্ব, পৃষ্ঠা-৯)

একই কবিতায় রয়েছে-

‘গুরুবার পাতালপুরে মাছেদের জলসা- তারা তেরশত নদীর নামকীর্তন করে;’

আধ্যাত্মিক চেতনার নিগূঢ স্পন্দন কবি অনুভব করেন কবিতার পরতে পরতে। তাই তো তিনি আবিষ্কার করেন জগদীশ্বর পরান সাঁই অন্তর্গত রক্তের ভেতর।

‘এক দৌড়ে চলে যাই পাহাড় থেকে পাহাড়ে

কাছে গেলে কেউ নাই সব যেন হাওয়াই মিঠাই

শুধু একলা আসনে বসে আছেন পরান সাঁই।’

(মনীষার মন্দিরা, সাঁই পর্ব, পৃষ্ঠা-১০)

কেবল আধ্যাত্মিক চেতনামণ্ডিত বিন্যাস নয় কবির মনোজগত প্রেমের মঞ্জিল। রোমান্টিক দ্যোতনা তাই কবির সৃষ্টির মহুয়া-

‘শিরশির বইছে মধ্যরাতের পুবালি বাতাস

প্রেম দাও ভুলে যাই মৃত্যপুরের দাগ খতিয়ান।’

(মধু মরণ, প্রেম পর্ব, পৃষ্ঠা-২৩)

এ যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে W.H. Auden এর অমর পঙক্তি “We must love each other or die” মাহফুজ রিপনের কবিতায় অন্তমূলে পাওয়া যায় মাটির গন্ধ, জীবনের গন্ধ আর প্রবাহমান নদীর গন্ধ-

‘ইঁচা আর তিতপুঁটির ঝাঁক ঘন হয় হাঁটু জলে

কলকাদার ভেতর থেকে নিরালে যায় ফলি

মাছেদের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে বহুকাল ধরে

তারা নদী ও নদের মিলন চায় জলতৃষ্ণায়’

(নদী ও নদের গল্প, জলপর্ব, পৃষ্ঠা- ২৯)

মাহফুজ রিপন beast fable technicque ব্যবহার করেছেন বেশ সাবলীলভাবে। মাছেদের সঙ্গোপন আলাপচারিতা আর জলের ধর্মে তাই ফুটে ওঠে আমাদের যাপিত জীবন-

‘ধরা পড়লেই সব সাধু চোর হয়ে যায়;

সারাদিন ঘের মালিক টাকি মাছের গীবত করে।

কালা পানিতে মাছেরা লাফায় তারা গীবতের অর্থ বোঝে না।’

(করমজল, জল পর্ব, পৃষ্ঠা-৩৩)

করমজলের নাইয়া গ্রন্থের শেষ পর্বটি দ্রোহের। এখানে কবির মধ্যে মার্কসবাদের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি সাম্য এবং মৈত্রীর এক পৃথিবী বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন, মানসে লালন করেন শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন।

‘নির্বাচন ঘনায় ভোটের মাঠে জিন্দাবাদ আর মূর্দাবাদ চলছে

আমার টাকশাল নেই, প্রতিভা নেই; তাই কোনো মার্কাও নেই’

(আমার কোনো প্রতিভা নেই, দ্রোহ পর্ব, পৃষ্ঠা-৪৭)

কবি কোন গণ্ডিবদ্ধ হতে পারেন না, তিনি মূলত পক্ষ ও বিপক্ষের প্রতিপক্ষ। কবির কোনো মার্কা নেই মানুষের ভালোবাসা ছাড়া।

এই মাটিগন্ধা কবির কাব্য পাঠে তৃপ্ত হয়েছি। কবির জন্য ভালোবাসা রইলো।

করমজলের নাইয়া ॥ মাহফুজ রিপন ॥ প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত ॥ মূল্য: ১৫০ টাকা ॥ বেহুলাবাংলা প্রকাশনী ॥ প্রকাশকাল: ২০২০।