ভাঙাচোরা চন্দ্রমুখী

ফারুক সুমন

শুনেছি বাঙালি মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হতো সিক্স-সেভেনে থাকতেই। কারো ভাগ্য আবার এতোই ভালো যে, মায়ের গর্ভে থাকতে কিংবা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটি নির্ধারণ হয়ে যেতো। বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে কন্যার বিয়ে। কিংবা বাবার বন্ধুর কন্যার সাথে ছেলের বিয়ে। অঞ্চলভেদে এই রেওয়াজ এখনো প্রচলিত আছে। কিন্তু আমি তো ছেলে। আমার ভাগ্য তবে এতো ভালো কেন? মায়ের মুখে শুনেছি। আমার জন্মের পরেও বাবা তার বন্ধুর সঙ্গে ‘বেয়াই বেয়াই’ ভাব বজায় রেখেছিলেন দীর্ঘদিন।

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি। সেই উচ্চমাধ্যমিক পর্ব থেকেই আমি পাত্রী দেখা শুরু করি। যদিও এর আগে পরোক্ষভাবে নানান জায়গায় বিয়েথা নিয়ে কম পানি ঘোলা হয়নি। ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। আমাদের ক্লাসের পাশেই মেয়েদের ক্লাস। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের কিচিরমিচির শব্দের কথা আপনাদের জানা আছে নিশ্চয়। পঞ্চম শ্রেণির এ-শাখায় আমি। আর বি-শাখায় বিলকিস। নামটা সুন্দর, তাই না? হ্যাঁ, এই বিলকিস জীবনে প্রথম বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল অভিনব কায়দায়।

মনেপড়ে, এ-শাখা এবং বি-শাখার মাঝখানে ছিল বাঁশের বেড়া। দুষ্টু ছেলেমেয়েরা ইকোনো কলম দিয়ে বাঁশের বেড়া গুঁতো দিয়ে ফুটো করে দিতো। ক্রমশ সেই ফুটো আরো বড় হতো। একদিন সেই ফুটো দিয়ে বি-শাখা থেকে ভাঁজ করা একটি রঙিন কাগজ উঁকি দিলো। কৌতূহল নিয়ে সেই রঙিন কাগজ হাতে নিলাম। খুলে দেখি সেখানে নীল কালিতে লেখা-

‘আমাকে বিয়ে করবে? আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই’। নিচে লেখা ‘ইতি বিলকিস’।

ওরে বাবা, বিয়ে! লজ্জায় খুন হয়ে যাচ্ছিলাম তখন।

হ্যাঁ, বিলকিস মেয়েটিকে চিনি আমি। ছুটির পর হাইস্কুলের গুণ্ডা টাইপের ছেলেরা বিলকিসের পিছে পিছে যায়। সবাই তারে এই বলে খেপায়-

“বিলকিস কিসকিস

আলু কুটে ভাতে দিস

জামাই আসলে পাতে দিস

বিলকিস কিসকিস।”

বিলকিস দেখতে কিউট। তার পেছনে আমাদের ক্লাসেরও দুয়েকজন ঘুরে। ক্লাসে আমি নিরীহদের একজন। চুপচাপ থাকি। বিলকিস আমারে এই কাগজটি দিলো কেন? ভাবনায় পড়ে যাই।

আমার সমবয়সী। সম্পর্কে আমার চাচা হয়। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। নাম তার মিলন (যে এখন অনেক বড় ব্যবসায়ী)। লেইজার প্রিয়ডে রঙিন ভাঁজকরা কাগজটি মিলনকে দেখালাম। মিলন খুলে দেখে বললো- “এটা তোরে দেয় নাই। তোর নাম নাই এখানে।” হুম, তাইতো। আমার নাম নাই এখানে। বিলকিস অন্য কাউকে এটা দিতে চেয়েছে হয়তো। ভুল করে আমার বেঞ্চে এসেছে। অস্বীকার করবো না। জীবনের প্রথম এই বিয়ের প্রস্তাবের কথা এখনো ভুলিনি। “কোথাও যেন মায়া রহিয়া গেলো।”

তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে ক্লাস করি। তাও এই প্যান্ট আমার নয়। খালাতো ভাই গিয়াস উদ্দিনের প্যান্ট ধার করে নিয়েছি। কিছুদিন পরে ফেরত দিবো এই শর্তে। গিয়াস উদ্দিন সাইজে আমার চেয়ে মোটা। ফলে সেই ঢোলা প্যান্ট বেল্ট দিয়ে বেঁধে কোমরে পরতে হয়েছে। তো সেইসময় এরকম আবোলতাবোল দিনে আমার প্রথম বিয়ের প্রস্তাব আসে।

আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমিন বাজার এসে টিউশনি করি আমার এক দূরসম্পর্কের আন্টির বাসায়। আন্টির দুই মেয়ে। সোহানা ও সুমনা। একজন ওয়ানে পড়ে আরেকজন থ্রি। আমি এদের পড়াই। মেঘলার মা বিশেষ কোনো কাজে আন্টিদের বাসায় এসেছেন। আমাকে দেখেশুনে তার নাকি পছন্দ হয়েছে। তিনি তার কন্যাকে আমার কাছে পাত্রস্থ করতে চান।

হঠাৎ একদিন আন্টি আমাকে ডেকে বললেন- ‘বাবা, একটা ভালো পাত্রী আছে আমার হাতে। তুমি চাইলে দেখতে পারো।’ কথাটি শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি তাৎক্ষণিক বিয়ের ব্যাপারে আমার অনাগ্রহের কথা সাফ জানিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। যাত্রাবাড়ী গিয়ে অভিভাবক তুল্য মামীকে ধরলেন। আমার মা তখনো গ্রামে থাকেন। ফলে ঢাকায় এই মামা এবং মামী আমার একমাত্র অভিভাবক। মামী আমাকে ডেকে বললেন, ‘ওরা আমাকে খুব জোর করছে। ভালো হবে। একমাত্র মেয়ে। মেয়েদের নিজস্ব বাড়ি আছে আমিন বাজার এলাকায়। এছাড়া মালিবাগ মোড়ের এই দিকেও জায়গা আছে।’

মামীর কথায় মনে মনে আহত হই। শেষে মামী নিজেই বললেন, ‘মেয়েটিকে দেখ। বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তারা আমারে খুব করে ধরেছে। আমি মানা করতে পারছি না।’

আমি সম্মতি দিলাম। পাত্রী দেখতে যাবো। শর্ত হচ্ছে, পছন্দ না হলে বিয়ের ব্যাপারে জোর করা যাবে না।

আমার মামাতো ভাই জুয়েল। যে এখন ইতালিতে থাকে। বয়সে আমার ছোট হলেও বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তাকে সাথে নিয়ে জীবনে প্রথম প্রত্যক্ষভাবে পাত্রী দেখতে চললাম। তাও নৌকাযোগে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পাত্রী দেখার এই প্রক্রিয়া অন্যরকম ভয় ও শিহরণ তৈরি করে মনে। আন্টির বাড়ি থেকে বের হয়ে নৌকা ভেসেছে তুরাগ নদীতে। বিকেলের সূর্যের তেজ ক্রমশ কমে আসছে। বর্ষাকাল বিধায় নদীতে টইটুম্বুর পানি। ছোট ডিঙি পূর্ব দিকে মিনিট দশেক চলার পর ভিড়েছে গিয়ে এক পাড়ভাঙা খেয়াঘাটে।

আমি চিন্তিত। জুয়েল আমাকে অভয় দিচ্ছে- ‘ভাই, এতো টেনশন নিয়েন না। আমরা ফিরে এসে বলবো পছন্দ হয়নি। বিয়ে হবে না।’ আমি কিছু বলি না। ঘর্মাক্ত হয়ে জুয়েলের মুখের দিকে বোবার মতো চেয়ে থাকি। ঘাটে মেয়ের মা আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। যাওয়ার পর তিনি আমাদের হাসিমুখে ডেকে নিলেন। সে কী আদর! শুরুতেই ‘বাবা’ বলে ডাকলেন। আমি লজ্জিত। কারণ পাত্রী দেখার জন্য খালি হাতে যাচ্ছি। মিষ্টি, পান-সুপারি, বিস্কুট-চানাচুর কিছুই নিইনি। গাবতলি এবং আমিন বাজারের মাঝামাঝি জায়গায় বাড়িটি। পুরান ঢাকার মতো এখানেও রাস্তাগুলো বেশ সরু। কয়েকটি চিপাগলি ঘুরে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উঠি। সামনের রুমে আমাদের বসতে দিয়ে পাত্রীর মা ভেতরের রুমে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে শরবত, বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি নিয়ে সামনে এলো মেয়েটি। কিছু পরিস্থিতি বোঝানোর ভাষা থাকে না। আমিও তেমন একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়ে যাই। কোনো রকমে চোখ তুলে তাকালেও গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। মনে হলো কেউ যেন আমার কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে। ঘরে বোধহয় মা এবং মেয়ে ছাড়া এখন কেউ নেই। মেয়েকে একটি চেয়ারে বসিয়ে তিনি নিজেও পাশে বসলেন।

-‘তোমরা কথা বল। লজ্জার কিছু নাই বাবা। নিজের মেয়ে বলে বলছি না। আমার মেয়ে শান্তশিষ্ট।’

এটুকু বলে তিনি ভেতরের রুমে গেলেন। জুয়েল বলল, ‘ভাই কিছু জিজ্ঞেস করেন।’

মেয়েটি ওড়না মাথায় নিচু হয়ে আছে।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?

-‘চন্দ্রমুখী’।

কোন ক্লাসে পড়?

‘অষ্টম শ্রেণিতে’।

মেয়ের মা আবার এলেন।

-‘বুঝলে বাবা। কথা গোপন রাখবো না। ওর বাবা দুই বিয়া করেছেন। পৃথক বাড়িতে থাকে। তবে আমাদের খাওনখরচ কিছুর কমতি নাই। সব পাঠায়ে দেন। মেঘলার বাবা নিজেই মেঘলার নামে এই বাড়িটা লিখে দিছেন। মালিবাগে আমাদের জায়গা আছে। গাবতলিতে আমাদের নিজস্ব জায়গায় মার্কেট আছে। আমার সতীনের ছেলেরা তেমন সুবিধার নয়। আমার ইচ্ছা চন্দ্রমুখীরে তোমার মতোন এরকম শিক্ষিত একটা ছেলের হাতে তুইলা দিই। তাছাড়া এইসব জায়গাজমি বুইজ্জা নেওন যাইবো না।’

আমি পাথরের মতো শুনি। কিন্তু মুখে কোনো কথা সরে না। আচ্ছা আন্টি আমরা তাহলে এখন উঠি। ‘বসো, তোমগো লাগি সেমাই রান্না করছি। খায়া যাও।’ তিনি সেমাই আনতে গেলেন। তার যাওয়ার পরেই ‘আমি আসি এখন’ বলেই জড়সড় হয়ে চন্দ্রমুখী বেরিয়ে যায়। তাকে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল।

সেমাই খেতে খেতে তিনি এবার জিজ্ঞেস করলেন।

-‘তোমার পছন্দ হয়েছে বাবা?’

আমি আগের মতোই চুপ থাকি। সেমাই খাওয়া শেষে বললাম, আমরা এখন আসি। যা বলার আন্টিকে বলবো। আপনি ওনার কাছে জেনে নিবেন।

আমি এবং জুয়েল বাসা থেকে বের হই। আমাদের এগিয়ে দিতে খেয়াঘাট পর্যন্ত তিনিও আসেন। তুরাগ নদীর দূষিত কালো পানিতে নৌকা ভেসেছে কেবল। ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখি অসহায় একজন নারীর চোখ। যেখানে কন্যা সম্প্রদানের আকুল আকুতি। যার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা থাকেন। একমাত্র মেয়েটিকে নিয়ে যিনি অনিশ্চিত জীবনের আশঙ্কায় দিন কাটান। যিনি আমার মতো শিক্ষিত পাত্রের হাতে কন্যাকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত জীবনের স্বপ্ন দেখেন। ধীরে ধীরে আমাদের নৌকাটি সন্ধ্যার অন্ধকারে আড়াল হয়ে যায়। চোখে ভাসে ভাঙাচোরা চন্দ্রমুখীর অবয়ব। আমরা বোধহয় এভাবেই ফিরে যাই নিজ নিজ গন্তব্যে।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

ভাঙাচোরা চন্দ্রমুখী

ফারুক সুমন

image

শুনেছি বাঙালি মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হতো সিক্স-সেভেনে থাকতেই। কারো ভাগ্য আবার এতোই ভালো যে, মায়ের গর্ভে থাকতে কিংবা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটি নির্ধারণ হয়ে যেতো। বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে কন্যার বিয়ে। কিংবা বাবার বন্ধুর কন্যার সাথে ছেলের বিয়ে। অঞ্চলভেদে এই রেওয়াজ এখনো প্রচলিত আছে। কিন্তু আমি তো ছেলে। আমার ভাগ্য তবে এতো ভালো কেন? মায়ের মুখে শুনেছি। আমার জন্মের পরেও বাবা তার বন্ধুর সঙ্গে ‘বেয়াই বেয়াই’ ভাব বজায় রেখেছিলেন দীর্ঘদিন।

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি। সেই উচ্চমাধ্যমিক পর্ব থেকেই আমি পাত্রী দেখা শুরু করি। যদিও এর আগে পরোক্ষভাবে নানান জায়গায় বিয়েথা নিয়ে কম পানি ঘোলা হয়নি। ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। আমাদের ক্লাসের পাশেই মেয়েদের ক্লাস। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের কিচিরমিচির শব্দের কথা আপনাদের জানা আছে নিশ্চয়। পঞ্চম শ্রেণির এ-শাখায় আমি। আর বি-শাখায় বিলকিস। নামটা সুন্দর, তাই না? হ্যাঁ, এই বিলকিস জীবনে প্রথম বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল অভিনব কায়দায়।

মনেপড়ে, এ-শাখা এবং বি-শাখার মাঝখানে ছিল বাঁশের বেড়া। দুষ্টু ছেলেমেয়েরা ইকোনো কলম দিয়ে বাঁশের বেড়া গুঁতো দিয়ে ফুটো করে দিতো। ক্রমশ সেই ফুটো আরো বড় হতো। একদিন সেই ফুটো দিয়ে বি-শাখা থেকে ভাঁজ করা একটি রঙিন কাগজ উঁকি দিলো। কৌতূহল নিয়ে সেই রঙিন কাগজ হাতে নিলাম। খুলে দেখি সেখানে নীল কালিতে লেখা-

‘আমাকে বিয়ে করবে? আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই’। নিচে লেখা ‘ইতি বিলকিস’।

ওরে বাবা, বিয়ে! লজ্জায় খুন হয়ে যাচ্ছিলাম তখন।

হ্যাঁ, বিলকিস মেয়েটিকে চিনি আমি। ছুটির পর হাইস্কুলের গুণ্ডা টাইপের ছেলেরা বিলকিসের পিছে পিছে যায়। সবাই তারে এই বলে খেপায়-

“বিলকিস কিসকিস

আলু কুটে ভাতে দিস

জামাই আসলে পাতে দিস

বিলকিস কিসকিস।”

বিলকিস দেখতে কিউট। তার পেছনে আমাদের ক্লাসেরও দুয়েকজন ঘুরে। ক্লাসে আমি নিরীহদের একজন। চুপচাপ থাকি। বিলকিস আমারে এই কাগজটি দিলো কেন? ভাবনায় পড়ে যাই।

আমার সমবয়সী। সম্পর্কে আমার চাচা হয়। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। নাম তার মিলন (যে এখন অনেক বড় ব্যবসায়ী)। লেইজার প্রিয়ডে রঙিন ভাঁজকরা কাগজটি মিলনকে দেখালাম। মিলন খুলে দেখে বললো- “এটা তোরে দেয় নাই। তোর নাম নাই এখানে।” হুম, তাইতো। আমার নাম নাই এখানে। বিলকিস অন্য কাউকে এটা দিতে চেয়েছে হয়তো। ভুল করে আমার বেঞ্চে এসেছে। অস্বীকার করবো না। জীবনের প্রথম এই বিয়ের প্রস্তাবের কথা এখনো ভুলিনি। “কোথাও যেন মায়া রহিয়া গেলো।”

তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে ক্লাস করি। তাও এই প্যান্ট আমার নয়। খালাতো ভাই গিয়াস উদ্দিনের প্যান্ট ধার করে নিয়েছি। কিছুদিন পরে ফেরত দিবো এই শর্তে। গিয়াস উদ্দিন সাইজে আমার চেয়ে মোটা। ফলে সেই ঢোলা প্যান্ট বেল্ট দিয়ে বেঁধে কোমরে পরতে হয়েছে। তো সেইসময় এরকম আবোলতাবোল দিনে আমার প্রথম বিয়ের প্রস্তাব আসে।

আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমিন বাজার এসে টিউশনি করি আমার এক দূরসম্পর্কের আন্টির বাসায়। আন্টির দুই মেয়ে। সোহানা ও সুমনা। একজন ওয়ানে পড়ে আরেকজন থ্রি। আমি এদের পড়াই। মেঘলার মা বিশেষ কোনো কাজে আন্টিদের বাসায় এসেছেন। আমাকে দেখেশুনে তার নাকি পছন্দ হয়েছে। তিনি তার কন্যাকে আমার কাছে পাত্রস্থ করতে চান।

হঠাৎ একদিন আন্টি আমাকে ডেকে বললেন- ‘বাবা, একটা ভালো পাত্রী আছে আমার হাতে। তুমি চাইলে দেখতে পারো।’ কথাটি শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি তাৎক্ষণিক বিয়ের ব্যাপারে আমার অনাগ্রহের কথা সাফ জানিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। যাত্রাবাড়ী গিয়ে অভিভাবক তুল্য মামীকে ধরলেন। আমার মা তখনো গ্রামে থাকেন। ফলে ঢাকায় এই মামা এবং মামী আমার একমাত্র অভিভাবক। মামী আমাকে ডেকে বললেন, ‘ওরা আমাকে খুব জোর করছে। ভালো হবে। একমাত্র মেয়ে। মেয়েদের নিজস্ব বাড়ি আছে আমিন বাজার এলাকায়। এছাড়া মালিবাগ মোড়ের এই দিকেও জায়গা আছে।’

মামীর কথায় মনে মনে আহত হই। শেষে মামী নিজেই বললেন, ‘মেয়েটিকে দেখ। বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তারা আমারে খুব করে ধরেছে। আমি মানা করতে পারছি না।’

আমি সম্মতি দিলাম। পাত্রী দেখতে যাবো। শর্ত হচ্ছে, পছন্দ না হলে বিয়ের ব্যাপারে জোর করা যাবে না।

আমার মামাতো ভাই জুয়েল। যে এখন ইতালিতে থাকে। বয়সে আমার ছোট হলেও বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তাকে সাথে নিয়ে জীবনে প্রথম প্রত্যক্ষভাবে পাত্রী দেখতে চললাম। তাও নৌকাযোগে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পাত্রী দেখার এই প্রক্রিয়া অন্যরকম ভয় ও শিহরণ তৈরি করে মনে। আন্টির বাড়ি থেকে বের হয়ে নৌকা ভেসেছে তুরাগ নদীতে। বিকেলের সূর্যের তেজ ক্রমশ কমে আসছে। বর্ষাকাল বিধায় নদীতে টইটুম্বুর পানি। ছোট ডিঙি পূর্ব দিকে মিনিট দশেক চলার পর ভিড়েছে গিয়ে এক পাড়ভাঙা খেয়াঘাটে।

আমি চিন্তিত। জুয়েল আমাকে অভয় দিচ্ছে- ‘ভাই, এতো টেনশন নিয়েন না। আমরা ফিরে এসে বলবো পছন্দ হয়নি। বিয়ে হবে না।’ আমি কিছু বলি না। ঘর্মাক্ত হয়ে জুয়েলের মুখের দিকে বোবার মতো চেয়ে থাকি। ঘাটে মেয়ের মা আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। যাওয়ার পর তিনি আমাদের হাসিমুখে ডেকে নিলেন। সে কী আদর! শুরুতেই ‘বাবা’ বলে ডাকলেন। আমি লজ্জিত। কারণ পাত্রী দেখার জন্য খালি হাতে যাচ্ছি। মিষ্টি, পান-সুপারি, বিস্কুট-চানাচুর কিছুই নিইনি। গাবতলি এবং আমিন বাজারের মাঝামাঝি জায়গায় বাড়িটি। পুরান ঢাকার মতো এখানেও রাস্তাগুলো বেশ সরু। কয়েকটি চিপাগলি ঘুরে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উঠি। সামনের রুমে আমাদের বসতে দিয়ে পাত্রীর মা ভেতরের রুমে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে শরবত, বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি নিয়ে সামনে এলো মেয়েটি। কিছু পরিস্থিতি বোঝানোর ভাষা থাকে না। আমিও তেমন একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়ে যাই। কোনো রকমে চোখ তুলে তাকালেও গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। মনে হলো কেউ যেন আমার কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে। ঘরে বোধহয় মা এবং মেয়ে ছাড়া এখন কেউ নেই। মেয়েকে একটি চেয়ারে বসিয়ে তিনি নিজেও পাশে বসলেন।

-‘তোমরা কথা বল। লজ্জার কিছু নাই বাবা। নিজের মেয়ে বলে বলছি না। আমার মেয়ে শান্তশিষ্ট।’

এটুকু বলে তিনি ভেতরের রুমে গেলেন। জুয়েল বলল, ‘ভাই কিছু জিজ্ঞেস করেন।’

মেয়েটি ওড়না মাথায় নিচু হয়ে আছে।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?

-‘চন্দ্রমুখী’।

কোন ক্লাসে পড়?

‘অষ্টম শ্রেণিতে’।

মেয়ের মা আবার এলেন।

-‘বুঝলে বাবা। কথা গোপন রাখবো না। ওর বাবা দুই বিয়া করেছেন। পৃথক বাড়িতে থাকে। তবে আমাদের খাওনখরচ কিছুর কমতি নাই। সব পাঠায়ে দেন। মেঘলার বাবা নিজেই মেঘলার নামে এই বাড়িটা লিখে দিছেন। মালিবাগে আমাদের জায়গা আছে। গাবতলিতে আমাদের নিজস্ব জায়গায় মার্কেট আছে। আমার সতীনের ছেলেরা তেমন সুবিধার নয়। আমার ইচ্ছা চন্দ্রমুখীরে তোমার মতোন এরকম শিক্ষিত একটা ছেলের হাতে তুইলা দিই। তাছাড়া এইসব জায়গাজমি বুইজ্জা নেওন যাইবো না।’

আমি পাথরের মতো শুনি। কিন্তু মুখে কোনো কথা সরে না। আচ্ছা আন্টি আমরা তাহলে এখন উঠি। ‘বসো, তোমগো লাগি সেমাই রান্না করছি। খায়া যাও।’ তিনি সেমাই আনতে গেলেন। তার যাওয়ার পরেই ‘আমি আসি এখন’ বলেই জড়সড় হয়ে চন্দ্রমুখী বেরিয়ে যায়। তাকে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল।

সেমাই খেতে খেতে তিনি এবার জিজ্ঞেস করলেন।

-‘তোমার পছন্দ হয়েছে বাবা?’

আমি আগের মতোই চুপ থাকি। সেমাই খাওয়া শেষে বললাম, আমরা এখন আসি। যা বলার আন্টিকে বলবো। আপনি ওনার কাছে জেনে নিবেন।

আমি এবং জুয়েল বাসা থেকে বের হই। আমাদের এগিয়ে দিতে খেয়াঘাট পর্যন্ত তিনিও আসেন। তুরাগ নদীর দূষিত কালো পানিতে নৌকা ভেসেছে কেবল। ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখি অসহায় একজন নারীর চোখ। যেখানে কন্যা সম্প্রদানের আকুল আকুতি। যার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা থাকেন। একমাত্র মেয়েটিকে নিয়ে যিনি অনিশ্চিত জীবনের আশঙ্কায় দিন কাটান। যিনি আমার মতো শিক্ষিত পাত্রের হাতে কন্যাকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত জীবনের স্বপ্ন দেখেন। ধীরে ধীরে আমাদের নৌকাটি সন্ধ্যার অন্ধকারে আড়াল হয়ে যায়। চোখে ভাসে ভাঙাচোরা চন্দ্রমুখীর অবয়ব। আমরা বোধহয় এভাবেই ফিরে যাই নিজ নিজ গন্তব্যে।