‘কাল বাঁচতে হলে আজ সরব হও’

দেবাহুতি চক্রবর্তী

(গতকালের পর)

সে সংক্রান্ত মামলায় তিনজন বিচারপতি রায় দেন, যেটুকু ছাপা হয়ে গেছে তার লভ্যাংশ ফেরত দিতে। তাতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে তারা তাদের পত্রিকায় তিনজন বিচারপতির মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে কার্টুন এঁকে পরদিন ছাপিয়ে ক্যাপশন দেয় ‘তিন বৃদ্ধ নেকড়ে ’...। ১৯৮৭তে এই ঘটনা আদালত অবমাননার আমলে না নিয়ে বিচারপতিরা বলেন, আমরা তিনজনই বৃদ্ধ। আর ওদের কাছে আমরা বোকা। তাতে কিছু যায় আসে না। এতটা এসব দেশের মানুষের কাছে দুরাশা বা স্পর্ধাও বটে। কিন্তু, ভারতীয় বিচার বিভাগ প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের মান্যতা দিতে যেয়ে এতদিন যা সাধারণের কিছুটা আড়ালে ছিল এখন তা সম্পূর্ণ উন্মোচিত করে ফেললেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেননি। কোন বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। শুধু আগামী ইতিহাসের জন্য গত ছয় বছরের বিদায়ী কয়েকজন প্রধান বিচারপতির কার্যক্রমকে নিরীক্ষার কথা টুইট করেন। অভিযুক্তর পক্ষে এটর্নি জেনারেল কে কে ভেনুগোপাল বিদায়ী ৯ জন বিচারপতির কথা উল্লেখ করে বলেন, বিচার বিভাগ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য অবমাননামূলক কীনা? বিচারপতি অরুণ মিশ্রর বেঞ্চ তাকে থামিয়ে দেন। বলেন,তাদের প্রত্যাশা ছিল অন্যরকম। তাদের মনে হয়েছে, ...What is wrong in using the word apology? Apology is a magical ward ....। ম্যাজিকটা এইক্ষেত্রে উলটে গেছে। উল্লেখ করতে না দেয়া ৯ বিচারপতির বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়া ফলাও করে প্রকাশ করছে।

১৯৮৯ সনে ছয় মাসের জন্য ১৯তম প্রধান বিচারপতি ভেংকটরামিয়া অবসর নিয়েই প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে বলেন, ...The judiciary in India has deteriorated in its standards because such Judges are appointed as are willing to be influenced by lavish parties and whisKz bottles...তিনি অন্যত্র আরও বলেন যে, প্রত্যেক হাইকোর্টে ৪/৫ জন বিচারক আছেন, যারা প্রত্যেক সন্ধ্যায় কোন আইনজীবী বা বিদেশি এমবেসি বা সরকারি লোকজনের বাসায় যান, খান। ভারতের ২২টি হাইকোর্টের অন্তত ৯০ জন বিচারপতি এ দলভুক্ত। তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আসে। প্রশ্ন আসে সেসব বিচারপতির নাম সুনির্দিষ্ট না হলে সবাই সন্দেহের তালিকায় থাকবেন। বম্বে হাইকোর্ট এই প্রশ্নে অস্বীকৃতি জানিয়ে চাইনিজ একটি প্রবাদ উল্লেখে মামলা খারিজ করেন, As long as you are up-right,do not care if your shadow is crooked. জাস্টিস বিচারপতি এসপি ভারুচা, বিচারপতি মাইকেল সালদাহনা, বিচারপতি মারকাণ্ডে কাটজু প্রত্যেকেই কতিপয় বিচারক দুর্নীতিবাজ বলে উল্লেখ করেন। চারজন বিচারপতি প্রেস কনফারেন্স করে আদালত অঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রসঙ্গে বলেন If this institution is discredited,democracy is not safe.উল্লেখ্য এই চার বিচারপতির একজন সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। যিনি নিজে অবসরে যাওয়ার মুহূর্তে রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য কলঙ্কজনক অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরি মসজিদ নিয়ে রায় দেন। তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন একজন নারী কর্মচারী তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। সেই অভিযোগের বিচার হয় না। উপরন্তু এই অভিযোগকারিনীর ও তার পুলিশ স্বামী চাকরি হারায়। অবাক হবার কথা গগৈ বিদায়ের পরে আবার দুজনেই স্বপদে নিয়োজিত হন। আর গগৈ তার সরকারি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। বিচারপতি এমএন ভেংকটচালিয়া, বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ নায়ার বিচারপতি একে গাঙ্গুলি নানাভাবে বিচারপতিদের সমালোচনা করেন। ৯৭-৯৮ সনের প্রধান বিচারপতি জেএস ভার্মা কষ্ট নিয়ে বলেন, When I joined the bar 40 years back, no one talked about corruption even in the district judges . Now when people talk about corruption in the apex court, I feel like it is a slap on my face.এরচেয়ে কঠিন কথা আর কি হতে পারে? রঞ্জন গগৈ এর মতো গত ছয় বছরে চারজন প্রধান বিচারপতি ভারতের গণতন্ত্রের হুমকি, তা যে কেউ বলার অধিকার রাখে, যা আরও তীব্রভাবে উঠে আসে গত ২৫ আগস্ট প্রশান্ত ভূষণের পক্ষে দাঁড়ানো আর এক আইনজীবী দুষ্যন্ত দাভের বক্তব্যে ...। তিনি প্রশ্ন তোলেন গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক সংবেদনশীল মামলাগুলো একাধিকক্রমে কেন নির্দিষ্ট কয়টি বেঞ্চে যায়? কেন তা নরিম্যানের মতো বিচারপতিদের কোর্টে যায় না? গগৈ এর বিরুদ্ধে আনীত যৌন হয়রানির অভিযোগ শুনানির জন্য কেন তার নিজ বেঞ্চের অন্তর্ভুক্ত হয়? কেন অভিযোগের বিচার না হয়ে চাকরি পুনর্বহাল হয়? কেন অবসর শেষেই তিনি প্রধান বিচারপতির বহু নিচের পদ রাজ্যসভার সদস্য হন? কেন কোভিড আক্রান্ত সময়ে তবলিগি জামাতের বিরুদ্ধে করোনা ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানো বন্ধে, কেন ভারতের লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের হয়রানির বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিতভাবে কোর্ট এগিয়ে আসে না? যোগ্যদের বাদ রেখে সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী লিপ্সু ব্যক্তিরা যদি বিচারপতি হতে থাকেন এবং অবসর শেষে আর এক পদে বসার প্রতিযোগিতায় থাকেন, তাদের হাতে দেশের সংবিধান কীভাবে সুরক্ষিত হবে? কিন্তু, নাগরিকের মৌলিক কথা বলার অধিকার শাসকদল যখন রুদ্ধ করে রাখে, আদালত ছাড়া তাদের আশ্রয় কোথায়?

ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে এবং বেঞ্চ অফিসার হিসেবে একজন আইনজীবী এই প্রশ্নে আঙুল তুলতেই পারেন। আদালত বিষয়টি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে জল ঘোলা করে তুলেছেন। নিজেদের সম্মান রাখতে প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে পুরোনো আর নতুন মামলা এক করে রায়ের সময় পেছানো হয়। ভারতের আইনজীবীদের মাঝ থেকে কথা এসেছে যারা এই অভিযোগ এনেছেন, তাদের বেঞ্চে কেন বিচার হবে? বিচারপতিদের সংখ্যার এক দশমাংশের নিচে এই সংবেদনশীল অভিযোগ কেন নিষ্পত্তি হবে? বৃহত্তর বেঞ্চ শুনানির জন্য দরকার। এই প্রশ্ন ও উঠছে যে, সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারেন, তার রিভিউ এর সুযোগ থাকা দরকার। প্রশান্ত ভূষণ টুইট তুলে নেননি। সেই টুইট সমর্থিত হচ্ছে হাজার হাজার। রিটুইট হচ্ছে। ব্যক্তি প্রশান্ত ভূষণের ভালো-মন্দ কোন আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে না। তার কারণ, সাধারণ মানুষ তাদের না বলতে পারা কথার প্রকাশ দেখছে এই টুইট ও সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উঠে আসা বক্তব্যে। এটাও উঠে আসছে প্রধান অভিযোগকারী বিচারপতি অরুন মিশ্র কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রশংসা করে তাকে ‘জিনিয়াস’ বলেন। আদৌ একজন বিচারপতি এটা পারেন কীনা? এই ক্রমে উঠে আসা প্রশ্নগুলো সব অব্যক্তকে ব্যক্ত করতে শুরু করেছে। এযেন সেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অন্যতম প্রেরণা জোগানো গানের মতো, ... বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা। ‘... তবে, জনতার শক্তি ভুল করে কম। তারা স্পষ্ট বলছে, সরকারের প্রতিভূ হিসেবে বিচারপতির দরকার নেই। ভারতের হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আগেও যেমন বহু নির্ভিক, নির্লোভী, ন্যায়পরায়ণ, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানচেতনা সমৃদ্ধ, প্রজ্ঞাবান, আইন ও সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ত বিচারপতি ছিলেন এবং এখনও আছেন দেশের মানুষ তাদেরকেই আস্থা করতে চায়। তাদের প্রতি আস্থা নিয়েই এই দলকানা, দুর্নীতিবাজ, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিচারপতিদের সুনির্দিষ্ট করতে চায়। আইনের ঊর্ধ্বে কেউই বা কোন প্রতিষ্ঠানই নয়। কথায় কথায় আদালত অবমাননার অভিযোগ আর নিষ্পত্তি কোন প্রকৃত সুরক্ষা নয়। আদালতের প্রাজ্ঞ জনোচিত রায়ই তাদের পরিচয়। তাই বলা হয়, ... Contempt of court is not the weapon . The Supreme court should wield to preserve its honour..প্রশান্ত ভূষণ আদালত প্রদত্ত বিধি মোতাবেক শাস্তি মাথা পেতে নেবেন মর্মে অনড় আছেন। এ যেন সেই স্বদেশী আমলের হাসি মুখে শাস্তির জন্য অপেক্ষা করা। এক প্রশান্ত ভূষণকে শাস্তি দিয়ে আদালতের সম্মান রক্ষা হবে কি? সরকার নিজেও প্রচ্ছন্ন বিব্রত অবস্থায় আছেন ধারণা। বিচারপতিদের নিয়ে যেসব কথা উঠছে, তার সঙ্গে সরকারের অনেক ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সরকারের প্রভাব যত বাড়ে, বিচারপতিরা ততই শাসকের দিক হেলতে থাকেন। কারণ তারাও এই নগদ নারায়ণ সেবা থেকেই অনেকে উঠে আসেন। আবার বিচারপতিরা ন্যায়নিষ্ঠ নয় যেখানে, সেখানেই সরকারের চাপ বাড়ে। সবাই এখনও এক কাতারে নেমে আসেননি বিধায় কিছু কিছু প্রতিকার মানুষ অবশ্যই পায়। রায় দিলেই হবে না, প্রকৃত বিচার হয়েছে মানুষকে এটা বুঝতে হবে। তবেই তো বিচারের সার্থকতা। সাংবিধানিক বিধি এব স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলা বোধ বিচারপতিদের বর্ম। ভারতের বিচাপতিরা এ দায়বোধ থেকে যত বিচ্যুত হচ্ছেন, ভারতের গণতন্ত্র তত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতীয় নাগরিকদের বিপন্নতা ততই বাড়ছে। সরকার ও শাসকদলের বিরুদ্ধে কথা বললেই কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে নানাভাবে। হিন্দুত্ববাদের দিকে স্পষ্টত ঝুঁকে পড়া ভারতে বিভিন্ন হাইকোর্টে ধর্মীয় অনুসঙ্গ সম্বলিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবসম্পন্ন বিচারপতিদের মানসিকতা বিচারের রায়ে প্রভাব ফেলছে। বিবাহিত হিন্দু নারীর শাঁখা-সিঁদুর আবশ্যকীয় বা কোভিড আক্রান্ত সময়ে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার বিষয় নিয়ে রায়গুলি নিতান্তই হাস্যপদ। এবং যে কোন মানুষ সেই রায় নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত কাশ্মীর প্রশ্নে বা শত শত বিচারাধীন হেবিয়াস কর্পাস রিটে আশ্চর্যজনক নীরবতাও প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। অযোধ্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় রীতিমতো লেজে আগুন লাগিয়ে সংবিধানের বুকে লঙ্কা কাণ্ড ঘটানোর মতো। যুক্তি নয়, বিশ্বাস-অন্ধবিশ্বাস যেখানে রায়ের মূল প্রতিপাদ্যতে পৌঁছেছে। অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করের মতো লাখো কণ্ঠ প্রতিনিয়ত যে রায়ের নিন্দা করছে, আগামী ইতিহাসে অবশ্যই সেই রায়দাতা কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন, এতে সন্দেহ কী? পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে ঔরংগবাদ হাইকোর্টের তবলিগ জামাত সংক্রান্ত রায়, বা পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নড়েচড়ে বসা বা আধার কার্ড নিয়ে রায় ইতিবাচক স্বীকৃতি পেয়েছে। অন্যায় জোরে মানুষের চোখ, মুখ বাঁধা যায়, মন বা বিবেক বাঁধা যায় না, সেই বিবেকের অবমাননা করতে রাজি নন প্রশান্ত ভূষণ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি শ্রদ্ধাই তার এই সিদ্ধান্তে অনড় অটল থাকার শক্তি। সে সঙ্গে আজ প্রেরণা ভারতের লাখো মানুষের সাহসী বিবেক।

আমরা অবশ্যই অপেক্ষায় থাকব এই রায়ের জন্য।

রায় যাই হোক, ভারতের এই চিত্র আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অচেনা তো নয়ই, বরং যথেষ্ট মিল রয়েছে। স্বাধীনতা খর্ব ও সংকুচিত হওয়ার পরেও ভারতীয় মিডিয়ায় ভারতের জনগণের একটা বড় অংশ যেভাবে, যে ভাষায় বিচারব্যবস্থা, বিচারপতি, জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে কথা বলছেন, আমাদের কণ্ঠস্বর সেখানে অপেক্ষাকৃত আরও কুণ্ঠিত। অথচ সংবিধানের মর্যাদা অক্ষুণœ থাকা বা না-থাকার ঝুঁকি আমাদের দেশেও বিপজ্জনকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট। দুর্নীতি আর অর্থ ও ক্ষমতার মোহ সব প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা বোধকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। গত ২২-৮-২০ তারিখ বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একটি ভবন উদ্বোধনের সময় বর্তমান মৎস ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, ... ‘আমাদের কিছু কিছু বিচারক আছেন, যারা নিজেরাই আজ্ঞাবহ হয়ে যান। কেউ মনে করেন, খালেদা জিয়ার মামলাটি আসছে, যদি এখানে ভূমিকা না রাখি তাহলে কীসের বিএনপি করতাম। কেউ মনে করেন যে, আমি তো আওয়ামী লীগ করতাম, বিএনপির একজনের মামলা আসছে, যদি ঠেকিয়ে দিতে না পারি কীসের আওয়ামী লিগার আমি? ... এটা নির্ভর করে নিজের মানসিকতার ওপর। মাইন্ড সেট আপ যদি কেউ চেঞ্জ না করেন, তাহলে হয় না। আমরা সবসময় বিচারককে সম্মান করতে পারি না।’ ... সংবিধান, মৌলিক অধিকার, বিচার এসব নিয়ে যে কথাগুলো ভারতের প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এলে আমরা কোনভাবেই তার বাইরের নই।

প্রশান্ত ভূষণের কথাগুলো আমরা আমাদের মতো করে আমাদের দেশের বাস্তবতায় ভাবতেই পারি।

‘আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের সামনে দাঁড়িয়ে। সংবিধানের প্রতিটা অধ্যায়ের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতার স্পর্ধার সামনে দাঁড়িয়েই আমাদের কথা বলতে হবে। তার জন্য যা পরিণাম, ভুগতে হয়, হবে। তা না হলে কাল আর বাঁচানোর জন্য কিছু থাকবে না। কাল বাঁচতে হলে আজ সরব হও।’ ...

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

‘কাল বাঁচতে হলে আজ সরব হও’

দেবাহুতি চক্রবর্তী

(গতকালের পর)

সে সংক্রান্ত মামলায় তিনজন বিচারপতি রায় দেন, যেটুকু ছাপা হয়ে গেছে তার লভ্যাংশ ফেরত দিতে। তাতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে তারা তাদের পত্রিকায় তিনজন বিচারপতির মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে কার্টুন এঁকে পরদিন ছাপিয়ে ক্যাপশন দেয় ‘তিন বৃদ্ধ নেকড়ে ’...। ১৯৮৭তে এই ঘটনা আদালত অবমাননার আমলে না নিয়ে বিচারপতিরা বলেন, আমরা তিনজনই বৃদ্ধ। আর ওদের কাছে আমরা বোকা। তাতে কিছু যায় আসে না। এতটা এসব দেশের মানুষের কাছে দুরাশা বা স্পর্ধাও বটে। কিন্তু, ভারতীয় বিচার বিভাগ প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের মান্যতা দিতে যেয়ে এতদিন যা সাধারণের কিছুটা আড়ালে ছিল এখন তা সম্পূর্ণ উন্মোচিত করে ফেললেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেননি। কোন বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। শুধু আগামী ইতিহাসের জন্য গত ছয় বছরের বিদায়ী কয়েকজন প্রধান বিচারপতির কার্যক্রমকে নিরীক্ষার কথা টুইট করেন। অভিযুক্তর পক্ষে এটর্নি জেনারেল কে কে ভেনুগোপাল বিদায়ী ৯ জন বিচারপতির কথা উল্লেখ করে বলেন, বিচার বিভাগ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য অবমাননামূলক কীনা? বিচারপতি অরুণ মিশ্রর বেঞ্চ তাকে থামিয়ে দেন। বলেন,তাদের প্রত্যাশা ছিল অন্যরকম। তাদের মনে হয়েছে, ...What is wrong in using the word apology? Apology is a magical ward ....। ম্যাজিকটা এইক্ষেত্রে উলটে গেছে। উল্লেখ করতে না দেয়া ৯ বিচারপতির বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়া ফলাও করে প্রকাশ করছে।

১৯৮৯ সনে ছয় মাসের জন্য ১৯তম প্রধান বিচারপতি ভেংকটরামিয়া অবসর নিয়েই প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে বলেন, ...The judiciary in India has deteriorated in its standards because such Judges are appointed as are willing to be influenced by lavish parties and whisKz bottles...তিনি অন্যত্র আরও বলেন যে, প্রত্যেক হাইকোর্টে ৪/৫ জন বিচারক আছেন, যারা প্রত্যেক সন্ধ্যায় কোন আইনজীবী বা বিদেশি এমবেসি বা সরকারি লোকজনের বাসায় যান, খান। ভারতের ২২টি হাইকোর্টের অন্তত ৯০ জন বিচারপতি এ দলভুক্ত। তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আসে। প্রশ্ন আসে সেসব বিচারপতির নাম সুনির্দিষ্ট না হলে সবাই সন্দেহের তালিকায় থাকবেন। বম্বে হাইকোর্ট এই প্রশ্নে অস্বীকৃতি জানিয়ে চাইনিজ একটি প্রবাদ উল্লেখে মামলা খারিজ করেন, As long as you are up-right,do not care if your shadow is crooked. জাস্টিস বিচারপতি এসপি ভারুচা, বিচারপতি মাইকেল সালদাহনা, বিচারপতি মারকাণ্ডে কাটজু প্রত্যেকেই কতিপয় বিচারক দুর্নীতিবাজ বলে উল্লেখ করেন। চারজন বিচারপতি প্রেস কনফারেন্স করে আদালত অঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রসঙ্গে বলেন If this institution is discredited,democracy is not safe.উল্লেখ্য এই চার বিচারপতির একজন সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। যিনি নিজে অবসরে যাওয়ার মুহূর্তে রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য কলঙ্কজনক অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরি মসজিদ নিয়ে রায় দেন। তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন একজন নারী কর্মচারী তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। সেই অভিযোগের বিচার হয় না। উপরন্তু এই অভিযোগকারিনীর ও তার পুলিশ স্বামী চাকরি হারায়। অবাক হবার কথা গগৈ বিদায়ের পরে আবার দুজনেই স্বপদে নিয়োজিত হন। আর গগৈ তার সরকারি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। বিচারপতি এমএন ভেংকটচালিয়া, বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ নায়ার বিচারপতি একে গাঙ্গুলি নানাভাবে বিচারপতিদের সমালোচনা করেন। ৯৭-৯৮ সনের প্রধান বিচারপতি জেএস ভার্মা কষ্ট নিয়ে বলেন, When I joined the bar 40 years back, no one talked about corruption even in the district judges . Now when people talk about corruption in the apex court, I feel like it is a slap on my face.এরচেয়ে কঠিন কথা আর কি হতে পারে? রঞ্জন গগৈ এর মতো গত ছয় বছরে চারজন প্রধান বিচারপতি ভারতের গণতন্ত্রের হুমকি, তা যে কেউ বলার অধিকার রাখে, যা আরও তীব্রভাবে উঠে আসে গত ২৫ আগস্ট প্রশান্ত ভূষণের পক্ষে দাঁড়ানো আর এক আইনজীবী দুষ্যন্ত দাভের বক্তব্যে ...। তিনি প্রশ্ন তোলেন গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক সংবেদনশীল মামলাগুলো একাধিকক্রমে কেন নির্দিষ্ট কয়টি বেঞ্চে যায়? কেন তা নরিম্যানের মতো বিচারপতিদের কোর্টে যায় না? গগৈ এর বিরুদ্ধে আনীত যৌন হয়রানির অভিযোগ শুনানির জন্য কেন তার নিজ বেঞ্চের অন্তর্ভুক্ত হয়? কেন অভিযোগের বিচার না হয়ে চাকরি পুনর্বহাল হয়? কেন অবসর শেষেই তিনি প্রধান বিচারপতির বহু নিচের পদ রাজ্যসভার সদস্য হন? কেন কোভিড আক্রান্ত সময়ে তবলিগি জামাতের বিরুদ্ধে করোনা ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানো বন্ধে, কেন ভারতের লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের হয়রানির বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিতভাবে কোর্ট এগিয়ে আসে না? যোগ্যদের বাদ রেখে সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী লিপ্সু ব্যক্তিরা যদি বিচারপতি হতে থাকেন এবং অবসর শেষে আর এক পদে বসার প্রতিযোগিতায় থাকেন, তাদের হাতে দেশের সংবিধান কীভাবে সুরক্ষিত হবে? কিন্তু, নাগরিকের মৌলিক কথা বলার অধিকার শাসকদল যখন রুদ্ধ করে রাখে, আদালত ছাড়া তাদের আশ্রয় কোথায়?

ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে এবং বেঞ্চ অফিসার হিসেবে একজন আইনজীবী এই প্রশ্নে আঙুল তুলতেই পারেন। আদালত বিষয়টি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে জল ঘোলা করে তুলেছেন। নিজেদের সম্মান রাখতে প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে পুরোনো আর নতুন মামলা এক করে রায়ের সময় পেছানো হয়। ভারতের আইনজীবীদের মাঝ থেকে কথা এসেছে যারা এই অভিযোগ এনেছেন, তাদের বেঞ্চে কেন বিচার হবে? বিচারপতিদের সংখ্যার এক দশমাংশের নিচে এই সংবেদনশীল অভিযোগ কেন নিষ্পত্তি হবে? বৃহত্তর বেঞ্চ শুনানির জন্য দরকার। এই প্রশ্ন ও উঠছে যে, সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারেন, তার রিভিউ এর সুযোগ থাকা দরকার। প্রশান্ত ভূষণ টুইট তুলে নেননি। সেই টুইট সমর্থিত হচ্ছে হাজার হাজার। রিটুইট হচ্ছে। ব্যক্তি প্রশান্ত ভূষণের ভালো-মন্দ কোন আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে না। তার কারণ, সাধারণ মানুষ তাদের না বলতে পারা কথার প্রকাশ দেখছে এই টুইট ও সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উঠে আসা বক্তব্যে। এটাও উঠে আসছে প্রধান অভিযোগকারী বিচারপতি অরুন মিশ্র কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রশংসা করে তাকে ‘জিনিয়াস’ বলেন। আদৌ একজন বিচারপতি এটা পারেন কীনা? এই ক্রমে উঠে আসা প্রশ্নগুলো সব অব্যক্তকে ব্যক্ত করতে শুরু করেছে। এযেন সেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অন্যতম প্রেরণা জোগানো গানের মতো, ... বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা। ‘... তবে, জনতার শক্তি ভুল করে কম। তারা স্পষ্ট বলছে, সরকারের প্রতিভূ হিসেবে বিচারপতির দরকার নেই। ভারতের হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আগেও যেমন বহু নির্ভিক, নির্লোভী, ন্যায়পরায়ণ, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানচেতনা সমৃদ্ধ, প্রজ্ঞাবান, আইন ও সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ত বিচারপতি ছিলেন এবং এখনও আছেন দেশের মানুষ তাদেরকেই আস্থা করতে চায়। তাদের প্রতি আস্থা নিয়েই এই দলকানা, দুর্নীতিবাজ, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিচারপতিদের সুনির্দিষ্ট করতে চায়। আইনের ঊর্ধ্বে কেউই বা কোন প্রতিষ্ঠানই নয়। কথায় কথায় আদালত অবমাননার অভিযোগ আর নিষ্পত্তি কোন প্রকৃত সুরক্ষা নয়। আদালতের প্রাজ্ঞ জনোচিত রায়ই তাদের পরিচয়। তাই বলা হয়, ... Contempt of court is not the weapon . The Supreme court should wield to preserve its honour..প্রশান্ত ভূষণ আদালত প্রদত্ত বিধি মোতাবেক শাস্তি মাথা পেতে নেবেন মর্মে অনড় আছেন। এ যেন সেই স্বদেশী আমলের হাসি মুখে শাস্তির জন্য অপেক্ষা করা। এক প্রশান্ত ভূষণকে শাস্তি দিয়ে আদালতের সম্মান রক্ষা হবে কি? সরকার নিজেও প্রচ্ছন্ন বিব্রত অবস্থায় আছেন ধারণা। বিচারপতিদের নিয়ে যেসব কথা উঠছে, তার সঙ্গে সরকারের অনেক ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সরকারের প্রভাব যত বাড়ে, বিচারপতিরা ততই শাসকের দিক হেলতে থাকেন। কারণ তারাও এই নগদ নারায়ণ সেবা থেকেই অনেকে উঠে আসেন। আবার বিচারপতিরা ন্যায়নিষ্ঠ নয় যেখানে, সেখানেই সরকারের চাপ বাড়ে। সবাই এখনও এক কাতারে নেমে আসেননি বিধায় কিছু কিছু প্রতিকার মানুষ অবশ্যই পায়। রায় দিলেই হবে না, প্রকৃত বিচার হয়েছে মানুষকে এটা বুঝতে হবে। তবেই তো বিচারের সার্থকতা। সাংবিধানিক বিধি এব স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলা বোধ বিচারপতিদের বর্ম। ভারতের বিচাপতিরা এ দায়বোধ থেকে যত বিচ্যুত হচ্ছেন, ভারতের গণতন্ত্র তত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতীয় নাগরিকদের বিপন্নতা ততই বাড়ছে। সরকার ও শাসকদলের বিরুদ্ধে কথা বললেই কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে নানাভাবে। হিন্দুত্ববাদের দিকে স্পষ্টত ঝুঁকে পড়া ভারতে বিভিন্ন হাইকোর্টে ধর্মীয় অনুসঙ্গ সম্বলিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবসম্পন্ন বিচারপতিদের মানসিকতা বিচারের রায়ে প্রভাব ফেলছে। বিবাহিত হিন্দু নারীর শাঁখা-সিঁদুর আবশ্যকীয় বা কোভিড আক্রান্ত সময়ে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার বিষয় নিয়ে রায়গুলি নিতান্তই হাস্যপদ। এবং যে কোন মানুষ সেই রায় নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত কাশ্মীর প্রশ্নে বা শত শত বিচারাধীন হেবিয়াস কর্পাস রিটে আশ্চর্যজনক নীরবতাও প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। অযোধ্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় রীতিমতো লেজে আগুন লাগিয়ে সংবিধানের বুকে লঙ্কা কাণ্ড ঘটানোর মতো। যুক্তি নয়, বিশ্বাস-অন্ধবিশ্বাস যেখানে রায়ের মূল প্রতিপাদ্যতে পৌঁছেছে। অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করের মতো লাখো কণ্ঠ প্রতিনিয়ত যে রায়ের নিন্দা করছে, আগামী ইতিহাসে অবশ্যই সেই রায়দাতা কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন, এতে সন্দেহ কী? পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে ঔরংগবাদ হাইকোর্টের তবলিগ জামাত সংক্রান্ত রায়, বা পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নড়েচড়ে বসা বা আধার কার্ড নিয়ে রায় ইতিবাচক স্বীকৃতি পেয়েছে। অন্যায় জোরে মানুষের চোখ, মুখ বাঁধা যায়, মন বা বিবেক বাঁধা যায় না, সেই বিবেকের অবমাননা করতে রাজি নন প্রশান্ত ভূষণ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি শ্রদ্ধাই তার এই সিদ্ধান্তে অনড় অটল থাকার শক্তি। সে সঙ্গে আজ প্রেরণা ভারতের লাখো মানুষের সাহসী বিবেক।

আমরা অবশ্যই অপেক্ষায় থাকব এই রায়ের জন্য।

রায় যাই হোক, ভারতের এই চিত্র আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অচেনা তো নয়ই, বরং যথেষ্ট মিল রয়েছে। স্বাধীনতা খর্ব ও সংকুচিত হওয়ার পরেও ভারতীয় মিডিয়ায় ভারতের জনগণের একটা বড় অংশ যেভাবে, যে ভাষায় বিচারব্যবস্থা, বিচারপতি, জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে কথা বলছেন, আমাদের কণ্ঠস্বর সেখানে অপেক্ষাকৃত আরও কুণ্ঠিত। অথচ সংবিধানের মর্যাদা অক্ষুণœ থাকা বা না-থাকার ঝুঁকি আমাদের দেশেও বিপজ্জনকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট। দুর্নীতি আর অর্থ ও ক্ষমতার মোহ সব প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা বোধকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। গত ২২-৮-২০ তারিখ বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একটি ভবন উদ্বোধনের সময় বর্তমান মৎস ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, ... ‘আমাদের কিছু কিছু বিচারক আছেন, যারা নিজেরাই আজ্ঞাবহ হয়ে যান। কেউ মনে করেন, খালেদা জিয়ার মামলাটি আসছে, যদি এখানে ভূমিকা না রাখি তাহলে কীসের বিএনপি করতাম। কেউ মনে করেন যে, আমি তো আওয়ামী লীগ করতাম, বিএনপির একজনের মামলা আসছে, যদি ঠেকিয়ে দিতে না পারি কীসের আওয়ামী লিগার আমি? ... এটা নির্ভর করে নিজের মানসিকতার ওপর। মাইন্ড সেট আপ যদি কেউ চেঞ্জ না করেন, তাহলে হয় না। আমরা সবসময় বিচারককে সম্মান করতে পারি না।’ ... সংবিধান, মৌলিক অধিকার, বিচার এসব নিয়ে যে কথাগুলো ভারতের প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এলে আমরা কোনভাবেই তার বাইরের নই।

প্রশান্ত ভূষণের কথাগুলো আমরা আমাদের মতো করে আমাদের দেশের বাস্তবতায় ভাবতেই পারি।

‘আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের সামনে দাঁড়িয়ে। সংবিধানের প্রতিটা অধ্যায়ের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতার স্পর্ধার সামনে দাঁড়িয়েই আমাদের কথা বলতে হবে। তার জন্য যা পরিণাম, ভুগতে হয়, হবে। তা না হলে কাল আর বাঁচানোর জন্য কিছু থাকবে না। কাল বাঁচতে হলে আজ সরব হও।’ ...