ঢাকা চেম্বারের ওয়েবিনার

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা গ্রহণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ, অবকাঠামো ও মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, শিল্প-শিক্ষার সমন্বয়সহ দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারী বক্তারা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারে ডাক, টেলিযোগোযোগ এবং তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জাব্বার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও সম্মানীত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পরাগ।

স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, চতুর্থ শিল্প বৈশি^ক ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়নসহ সর্বোপরি অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং আমাদের শিল্পখাতে এ বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ এখাতের উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদান খুবই জরুরি। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বাংলাদেশে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি খুব স্বল্পসময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে, তবে এখাতের প্রয়োজনীয় অগ্রগতির জন্য আমাদের প্রস্তুতি এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রায় নয়। এ লক্ষ্যে তিনি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রস্তাবিত শিল্পনীতিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকা খুবই আবশ্যক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নতুন নতুন ব্যবসায়িক কার্যক্রম সূচনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে, তবে এ সুবিধা গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ এবং তার যাথাযথ বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।

মোস্তফা জাব্বার বলেন, স্বাধীনতার পর আমাদের অর্থনীতি কৃষির উপর অধিক হারে নির্ভর থাকলেও আজকে আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখছি। বিশে^র শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রথম চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রথম চিন্তা-ভাবনা আসলেও, যেটি বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে হলে, জনগণের কাছে তথ্য-প্রযুক্তির সেবা দ্রুত পৌঁছাতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের তথ্য-প্রযুক্তি গ্রহণের সক্ষমতা অত্যন্ত বেশি, যেটি কোভিড-১৯ মহামারীর সময় সেটি প্রমাণিত হয়েছে এবং বর্তমানে মহামারীর সময়ে দেশের টেলিকম খাত মানুষকে সর্বাত্মক সেবার চেষ্টা করেছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ৮ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে, যেখনে ৮ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করা হতো, তবে বর্তমানে দেশে ২১০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছে এবং এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে কুয়াকাটা সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা বাড়াতো হতে পারে। বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কিভাবে কাজ করবে এবং কিভাবে দেশের মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তার উপর নির্ভর করে এ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে ৫জি সুবিধা প্রদান করা যাবে এবং দেশের উদ্যোক্তাদের সহায়তার লক্ষ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে ৫জি সুবিধা প্রদান করা হবে। এছাড়াও তিনি দেশের শিক্ষাকার্যক্রমে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন।

অনুষ্ঠানের সম্মানীত অতিথির বক্তব্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পরাগ বলেন, আমাদের এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন পণ্য উৎপাদনের যেমন সুযোগ তৈরি করবে, সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে এবং সে সুযোগ গ্রহণে আমাদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বস্তাবায়ন করতে হবে। প্রস্তাবিত শিল্পনীতি ২০২০-২১-এ বিদ্যমান শিল্পখাতসমূহের সব দিককে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে একটি সমন্বিত শিল্পনীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের টিকে থাকতে হলে উদ্যোক্তাদের অবশ্যই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গ্রহণ করার মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনির্ভাসিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সহযোগী অধ্যাপক সাজিদ আমিত। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ছে এবং শিল্পখাতে বিশেষ করে পণ্য উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও গর্ভানেন্স’র ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধন করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান বিষয়গুলো হলো- আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি, রোবোটিকস, বিগ ডাট অ্যান্ড এনালাটিক্স এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রভৃতি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ মানব সম্পদের কোন বিকল্প নেই তা উল্লেখ করে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংষ্কার, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন একান্ত আবশ্যক মত প্রকাশ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)-এর তথ্য অনুসারে এ বিপ্লবের ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন লোক বেকার হবে এবং বাংলাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ৫.৭ মিলিয়ন, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও রয়েছে। তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক খাতেও আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসাবে এবং আমাদের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। তিনি দেশের এসএমই উদ্যোক্তাদের নিজেদের পণ্য প্রসারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর আহ্বান জানান। ওয়েবিনারে নির্ধারিত আলোচনায় পাঠাও-এর সভাপতি এবং চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ফাহিম আহমেদ, এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল হায়দার, বিজিএমইএ-এর পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন স্ট্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রাশেদুর রহমান, বুয়েট’র তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ আনোয়ারুল ফাতাহ এবং ইউনিডো-এর বাংলাদেশস্থ আবাসিক প্রতিনিধি জাকি উজ্জ জামান প্রমুখ যোগদান করেন।

পাঠাও-এর সভাপতি এবং চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ফাহিম আহমেদ বলেন, ৬০ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে পাঠাও অ্যাপের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করছে এবং ঢাকা শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। গত ৫ বছরে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ এসেছে এবং এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর জন্য মানব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করতে হবে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল হায়দার বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়নের অংশ হিসেবে উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের লক্ষ্যে ‘অনলাইন মার্কেট প্লেস’ তৈরির কাজ করছে এসএমই ফাউন্ডেশন।

বিজিএমইএ-এর পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত সুবিধা গ্রহণ করে, আমাদের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে পণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে বৈশি^ক পরিম-লে নিজস্ব ব্রান্ড তৈরি করতে হবে। নতুন পণ্যের ডিজাইন তৈরিতে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তিনি এ বিপ্লবের ফলে আমাদের দেশে স্বল্প দক্ষ মানব সম্পদের কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়টিকে মোকাবিলা করার জন্য স্বল্প দক্ষ জনবলকে তাদের নিজস্ব খাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনঃদক্ষ করে গড়ে তোলতে হবে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন স্ট্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রাশেদুর রহমান বলেন, চতুর্থ শিল্পকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটা নিয়ে ভয়ের কোন সুযোগ নেই। এ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। শিল্পখাতের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রমের আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগীকরণের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। বুয়েট’র তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ আনোয়ারুল ফাতাহ বলেন, শিল্পখাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কিভাবে কাজ করবে। সেটা উদ্যোক্তাদের জানতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা নিয়ে সাধারণ জনগণ এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য একটি ‘সেন্টার (হাব)’ স্থাপন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তিনি বিশ^বিদ্যালয়সমূহকে শিক্ষাকার্যক্রমের আধুনিকায়ন এবং বিশ^বিদ্যালয়, মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও শিল্পখাতগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ আরও বৃদ্ধির উপর জোরারোপ করেন।

শুক্রবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৪ মহররম ১৪৪২, ১৮ ভাদ্র ১৪২৭

ঢাকা চেম্বারের ওয়েবিনার

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা গ্রহণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক |

image

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ, অবকাঠামো ও মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, শিল্প-শিক্ষার সমন্বয়সহ দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারী বক্তারা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারে ডাক, টেলিযোগোযোগ এবং তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জাব্বার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও সম্মানীত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পরাগ।

স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, চতুর্থ শিল্প বৈশি^ক ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়নসহ সর্বোপরি অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং আমাদের শিল্পখাতে এ বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ এখাতের উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদান খুবই জরুরি। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বাংলাদেশে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি খুব স্বল্পসময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে, তবে এখাতের প্রয়োজনীয় অগ্রগতির জন্য আমাদের প্রস্তুতি এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রায় নয়। এ লক্ষ্যে তিনি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রস্তাবিত শিল্পনীতিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকা খুবই আবশ্যক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নতুন নতুন ব্যবসায়িক কার্যক্রম সূচনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে, তবে এ সুবিধা গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ এবং তার যাথাযথ বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।

মোস্তফা জাব্বার বলেন, স্বাধীনতার পর আমাদের অর্থনীতি কৃষির উপর অধিক হারে নির্ভর থাকলেও আজকে আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখছি। বিশে^র শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রথম চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রথম চিন্তা-ভাবনা আসলেও, যেটি বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে হলে, জনগণের কাছে তথ্য-প্রযুক্তির সেবা দ্রুত পৌঁছাতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের তথ্য-প্রযুক্তি গ্রহণের সক্ষমতা অত্যন্ত বেশি, যেটি কোভিড-১৯ মহামারীর সময় সেটি প্রমাণিত হয়েছে এবং বর্তমানে মহামারীর সময়ে দেশের টেলিকম খাত মানুষকে সর্বাত্মক সেবার চেষ্টা করেছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ৮ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে, যেখনে ৮ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করা হতো, তবে বর্তমানে দেশে ২১০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছে এবং এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে কুয়াকাটা সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা বাড়াতো হতে পারে। বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কিভাবে কাজ করবে এবং কিভাবে দেশের মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তার উপর নির্ভর করে এ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে ৫জি সুবিধা প্রদান করা যাবে এবং দেশের উদ্যোক্তাদের সহায়তার লক্ষ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে ৫জি সুবিধা প্রদান করা হবে। এছাড়াও তিনি দেশের শিক্ষাকার্যক্রমে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন।

অনুষ্ঠানের সম্মানীত অতিথির বক্তব্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পরাগ বলেন, আমাদের এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন পণ্য উৎপাদনের যেমন সুযোগ তৈরি করবে, সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে এবং সে সুযোগ গ্রহণে আমাদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বস্তাবায়ন করতে হবে। প্রস্তাবিত শিল্পনীতি ২০২০-২১-এ বিদ্যমান শিল্পখাতসমূহের সব দিককে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে একটি সমন্বিত শিল্পনীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের টিকে থাকতে হলে উদ্যোক্তাদের অবশ্যই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গ্রহণ করার মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনির্ভাসিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সহযোগী অধ্যাপক সাজিদ আমিত। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ছে এবং শিল্পখাতে বিশেষ করে পণ্য উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও গর্ভানেন্স’র ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধন করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান বিষয়গুলো হলো- আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি, রোবোটিকস, বিগ ডাট অ্যান্ড এনালাটিক্স এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রভৃতি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ মানব সম্পদের কোন বিকল্প নেই তা উল্লেখ করে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংষ্কার, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন একান্ত আবশ্যক মত প্রকাশ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)-এর তথ্য অনুসারে এ বিপ্লবের ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন লোক বেকার হবে এবং বাংলাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ৫.৭ মিলিয়ন, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও রয়েছে। তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক খাতেও আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসাবে এবং আমাদের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। তিনি দেশের এসএমই উদ্যোক্তাদের নিজেদের পণ্য প্রসারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর আহ্বান জানান। ওয়েবিনারে নির্ধারিত আলোচনায় পাঠাও-এর সভাপতি এবং চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ফাহিম আহমেদ, এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল হায়দার, বিজিএমইএ-এর পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন স্ট্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রাশেদুর রহমান, বুয়েট’র তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ আনোয়ারুল ফাতাহ এবং ইউনিডো-এর বাংলাদেশস্থ আবাসিক প্রতিনিধি জাকি উজ্জ জামান প্রমুখ যোগদান করেন।

পাঠাও-এর সভাপতি এবং চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ফাহিম আহমেদ বলেন, ৬০ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে পাঠাও অ্যাপের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করছে এবং ঢাকা শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। গত ৫ বছরে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ এসেছে এবং এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর জন্য মানব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করতে হবে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল হায়দার বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়নের অংশ হিসেবে উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের লক্ষ্যে ‘অনলাইন মার্কেট প্লেস’ তৈরির কাজ করছে এসএমই ফাউন্ডেশন।

বিজিএমইএ-এর পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত সুবিধা গ্রহণ করে, আমাদের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে পণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে বৈশি^ক পরিম-লে নিজস্ব ব্রান্ড তৈরি করতে হবে। নতুন পণ্যের ডিজাইন তৈরিতে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তিনি এ বিপ্লবের ফলে আমাদের দেশে স্বল্প দক্ষ মানব সম্পদের কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়টিকে মোকাবিলা করার জন্য স্বল্প দক্ষ জনবলকে তাদের নিজস্ব খাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনঃদক্ষ করে গড়ে তোলতে হবে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন স্ট্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রাশেদুর রহমান বলেন, চতুর্থ শিল্পকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটা নিয়ে ভয়ের কোন সুযোগ নেই। এ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। শিল্পখাতের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রমের আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগীকরণের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। বুয়েট’র তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ আনোয়ারুল ফাতাহ বলেন, শিল্পখাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কিভাবে কাজ করবে। সেটা উদ্যোক্তাদের জানতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা নিয়ে সাধারণ জনগণ এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য একটি ‘সেন্টার (হাব)’ স্থাপন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তিনি বিশ^বিদ্যালয়সমূহকে শিক্ষাকার্যক্রমের আধুনিকায়ন এবং বিশ^বিদ্যালয়, মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও শিল্পখাতগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ আরও বৃদ্ধির উপর জোরারোপ করেন।